হযরত ফাতেমা যাহরা (সালামুল্লাহ আলাইহা)

wikishia থেকে

ফাতেমা বলতে যে মহীয়সীদেরকে বোঝানো হয়েছে তাদের পরিচয় জানতে দেখুন

হযরত ফাতেমা (আ.) , ফাতেমা যাহরা (আরবি: فاطمة الزهراء) বলে প্রসিদ্ধ (জীবনকাল নবুওয়াতের পঞ্চম বর্ষ - ১১হিজরী), হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও হযরত খাদীজার (আ.) কন্যা এবং ইমাম আলীর (আ.) স্ত্রী। তিনি ঐ পাঁচ ব্যক্তির (আলে আবা বা আস্হাবে কিসা) অন্তর্ভুক্ত রাসূল (সা.) যাদের স্বীয় আবার (কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত লম্বা বহিরাবরণ) ভেতরে নিয়ে দোয়া করলে মহান আল্লাহ সকল প্রকার আত্মিক পঙ্কিলতা থেকে তাঁদের পবিত্র বলে ঘোষণা করে সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতের শেষাংশ অবতীর্ণ করেন, যার ভিত্তিতে বার ইমামী শিয়ারা তাঁদের নিষ্পাপ (মাসুম) বলে মনে করে। শিয়াদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ইমাম (ইমাম হাসান ও হোসাইন) এবং হযরত যায়নাবউম্মে কুলসুম তাঁর সন্তান। তাঁর প্রসিদ্ধ উপাধি হল বাতুলসাইয়্যেদাতু নিসাইল আলামীন এবং তাঁর প্রসিদ্ধ ডাক নাম হল উম্মু আবিহা (পিতার মাতা)। তিনি নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথে মুবাহিলায় (সূরা আলে ইমরান: ৬১ আয়াতে বর্ণিত সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী প্রমাণের ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জে) মহানবীর (সা.) সঙ্গে অংশগ্রহণকারী একমাত্র নারী।

তাঁর শানে সূরা কাউসার অবতীর্ণ হয়েছে এবং তিনি আয়াতে তাত্বহীর (আহযাব:৩৩), মাওয়াদ্দাতের আয়াত (শূরা:২৩) এবং দরিদ্র ও বন্দীদের খাদ্যদানের আয়াত (সূরা দাহর: ৭-১০) যাদের শানে অবতীর্ণ হয়েছে তাঁদের অন্যতম। মহানবী (সা.) তাঁকে নিজের অস্তিত্বের অংশ বলে বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য হাদীসে তিনি (সা.) তাঁকে বিশ্ববাসী নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নারী এবং তাঁর সন্তুষ্টি ও ক্রোধের মধ্যে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ক্রোধ বলে ঘোষণা করেছেন।

হযরত ফাতেমার (আ.) শিশুকাল ও কিশোর জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তাঁর জীবনের এ সময়কাল সম্পর্কে শুধু এটুকু জানা যায় যে, তিনি বিভিন্ন সময় রাসূলের (সা.) প্রতি মুশরিকদের সহিংস আচরণে তাঁকে সান্ত্বনা দিতেন, মহানবীর (সা.) বনি হাশেমকে বয়কটের বছরগুলিতে তিনি আবু তালিবের উপত্যকায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন এবং তিনি মহানবীর (সা.) হিজরতের অব্যবহিত পরেই হযরত আলীর (আ.) সাথে মদীনায় হিজরত করেন।

ফাতেমা (আ.) সাকিফার পরামর্শসভার অবৈধ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আবু বকরের খেলাফতকে জোরপূর্বক দখলকৃত বলে ঘোষণা করেন এবং তাঁর বাইয়াতকে অস্বীকার করেন। তিনি আবুবকর কর্তৃক তাঁর অধিকারভুক্ত ফাদাক ভূমি জব্দ করার প্রতিবাদে ও হযরত আলীর (আ.) খেলাফতের সপক্ষে মসজিদে নববীতে একটি বক্তব্য রাখেন যা ফাদাকের খুতবা বা খুতবায়ে ফাদাকিয়া নামে প্রসিদ্ধ। তিনি মহানবীর (সা.) ইন্তিকালের কিছুদিন পর তাঁর গৃহে আবুবকর এর এজেন্টদের দ্বারা পরিচালিত এক হামলায় গুরুতর আহত হন এবং শয্যাশায়ি হন। এর কয়েকদিন পরেই তিনি ১১ হিজরীর জামাদিউস সানী মাসের ৩ তারিখে মদীনায় শাহাদাতবরণ করেন। মহানবির (সা.) মহান এ কন্যার পবিত্র দেহ মোবারক তাঁরই নির্দেশক্রমে রাতে গোপনে দাফন করা হয়। তাঁর পবিত্র কবর কোথায় তা অজ্ঞাত রয়েছে।

তাঁর জ্ঞানগত ও আধ্যত্মিক উত্তরাধিকারের মধ্যে হযরত ফাতেমার (আ.) তাসবিহাত (নামাজের পর যে চৌত্রিশ বার আল্লাহু আকবার, তেত্রিশ বার সুবহানাল্লাহ ও তেত্রিশবার আলহামদুলিল্লাহ পড়া হয়), মুছহাফে ফাতেমা (জীবরাঈল (আ.) কর্তৃক ইলহামকৃত ভবিষ্যদ্বাণীসমূহের সমষ্টি যা হযরত আলী (আ.) তাঁর থেকে শুনে সঙ্কলন করেন) ও ফাদাকের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন রেওয়ায়াত অনুযায়ী এ সহিফাটি (গ্রন্থ) একের পর এক ইমামদের হাতে হস্তান্তরিত হয়ে এখন ইমাম মাহদীর (আ.) হাতে রয়েছে। শিয়ারা হযরত ফাতেমাকে (আ.) তাদের আদর্শ মনে করে এবং তাঁর শাহাদাতের দিনে (শাহাদাত বার্ষিকীতে) শোকপ্রকাশ (আযাদারী) করে থাকে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে তাঁর জন্মদিনটি (২০ জামাদ্সি সানী) নারী ও মাতৃদিবস ঘোষিত হয়েছে এবং এ দেশে মেয়েদের নামকরণের ক্ষেত্রে ফাতেমা ও যাহরা নাম দুটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।

হযরত ফাতেমা (আ.) সম্পর্কিত বিভিন্ন রচনা ও সঙ্কলনকে তিনভাগে ভাগ করা যায়, যথা: মুসনাদসমূহ (তাঁর সম্পর্কে বা তাঁর থেকে বর্ণিত বিষয়সমূহের সঙ্কলন), মানকাবাত (তাঁর ফজিলত ও মর্যাদার বর্ণনা সঙ্কলন) ও জীবনীগ্রন্থ।

নাম ও বংশ পরিচয়

হযরত ফাতিমা (আ.) মহানবী হযরত মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সা.) ও হযরত খাদীজার (আ.) কন্যা। হযরত ফাতেমার (আ.) অনেক (ত্রিশের মত) উপাধি রয়েছে। তাঁর প্রসিদ্ধ উপাধির মধ্যে যাহরা, ছিদ্দীক্বাহ, মুহাদ্দাসাহ, বাতুল, সাইয়্যেদাতু নিসায়িল আলামিন, মানছুরা, তাহিরাহ, মুতাহহরাহ, যাকিয়াহ, মুবারাকাহ, রাযিয়াহ ও মারযিয়াহ উল্লেখযোগ্য।

হযরত ফাতেমার (আ.) প্রসিদ্ধ ডাকনাম গুলো হল: উম্মু আবিহা, উম্মুল আয়েম্মাহ, উম্মুল হাসান, উম্মুল হোসাইন।

জীবনী

ফাতেমা (আ.) মহানবী (সা.) ও হযরত খাদীজার (আ.) শেষ সন্তান। কোন কোন ঐতিহাসিক ও গবেষকের মতে তিনি মহানবি (সা.) ও হযরত খাদীজার একমাত্র কন্যা সন্তান। (তাদের মতে যায়নাব, রোকাইয়া ও উম্মে কুলসূম হযরত খাদীজার নিজের কন্যা নন, বরং পালিত কন্যা।) ঐতিহাসিকরা একমত যে, তিনি মক্কায় (মাসআ’ এলাকার আত্তারীন ও আলহিজর নামক দুইগলির মাঝে অবস্থিত) হযরত খাদীজার গৃহে জন্মগ্রহণ করেন।

জন্ম ও শৈশব

শিয়াদের প্রসিদ্ধ মতে হযরত ফাতেমা (আ.) নবুওয়াতের পঞ্চম বর্ষে যা আহক্বাফিয়া বর্ষ নামে পরিচিত (সূরা আহক্বাফ অবতীর্ণের বছর) জন্মগ্রহণ করেন। শেইখ মুফিদকাফআ’মী তাঁর জন্ম ২য় হিজরীতে হয়েছে বলেছেন। আহলে সুন্নাতের প্রচলিত মতে তিনি নবুওয়াতের পাঁচ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। শিয়া গ্রন্থসমূহে তাঁর জন্ম ২০ জামাদিউস সানী উল্লেখিত হয়েছে।

হযরত ফাতেমার শৈশব ও কৈশোর জীবন সম্পর্কে ইতিহাস গ্রন্থসমূহে খুবই কম বিবরণ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক বর্ণনামতে মহানবি (সা.) প্রকাশ্যে ইসলামের প্রতি দাওয়াতের কাজ শুরুর পর ফাতেমা (আ.) বিভিন্ন সময় স্বীয় পিতার ওপর মুশরিকদের নির্যাতন ও নিপীড়িনের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য ছিলেন। এছাড়া তিনি শৈশবে তাঁর পিতা ও বনি হাশেমের ওপর তিন বছর ব্যাপী আরোপিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের সময় তাঁদের সাথে আবু তালিবের উপত্যকায় ছিলেন। তিনি শৈশবেই স্বীয় মাতা খাদীজা (আ.) ও পিতার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ও চাচা আবু তালিবের বিয়োগব্যথা সহ্য করেন। এরপরই কুরাইশরা রাসূলকে (সা.) হত্যার পরিকল্পনা করে ও তিনি রাতের অন্ধকারে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। এর কিছুদিন পরই তিনি হযরত আলী (আ.) ও কয়েকজন নারীর সাথে মদীনায় হিজরত করেন। এগুলো তাঁর কৈশোরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা।

বিবাহের প্রস্তাব ও বিবাহ (হযরত আলী ও ফাতেমার বিবাহ)

আরোও দেখুন: ইমাম আলী ও ফাতিমার (আ.) বিবাহ

অনেকেই হযরত ফাতেমাকে (আ.) বিবাহ করার প্রস্তাব নিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি কেবল হযরত আলীর (আ.) প্রস্তাবেই সম্মত হন। একদল গবেষকর মতে মহানবী (সা.) মদীনায় হিজরতের পর যখন মদীনার নেতৃত্বের ভার গ্রহণ (ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা) করেন তখন হযরত ফাতেমা (আ.) মহানবির (সা.) সন্তান হিসাবে মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার স্থান লাভ করেন।

এছাড়াও হযরত ফাতেমার (আ.) প্রতি মহানবির (সা.) বিশেষ স্নেহ ও ভালবাসা এবং হযরত ফাতেমার (আ.) বিশেষত্ব ও অন্যান্য নারিদের ওপর তাঁর গুণগত শ্রেষ্ঠত্বের কারণে অনেক মুসলমানই তাঁর পাণিপ্রার্থী ছিলেন। প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণকারী কুরাইশ গোত্রের মোটামোটি সম্পদশালী ব্যক্তিদের অনেকেই তাঁকে বিবাহ করার প্রস্তাব নিয়ে আসেন। আবু বকর, উমরআবদুর রহমান ইবনে আওফ তাদের অন্যতম। তাদের সকলের প্রস্তাবকে রাসূল (সা.) প্রত্যাখ্যান করেন। মহানবী (সা.) তাদের প্রস্তাবের জবাবে বলেন, ‘ফাতেমার বিয়ে ঐশী একটি বিষয় এবং আমি এক্ষেত্রে আল্লাহর সিদ্ধান্তের মুখাপেক্ষী।’ কখনও কখনও তিনি প্রস্তাব দানকারিদের হযরত ফাতেমার (আ.) অসম্মতির কথা জানিয়ে দিতেন।

হযরত আলী (আ.) মহানবির (সা.) সাথে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক এবং হযরত ফাতেমার (আ.) ধর্মীয় ও নৈতিক গুণাবলির কারণে তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার তীব্র আকাঙ্খা রাখতেন। কিন্তু তিনি লজ্জাবশত প্রস্তাব দেয়া থেকে বিরত ছিলেন। সা’দ ইবনে মাআয হযরত আলীর (আ.) মনোবাসনার বিষয়টি রাসূলকে (সা.) অবহিত করলে তিনি সম্মত হন। তিনি (সা.) আলীর (আ.) মর্যাদা ও গুণগত বৈশিষ্ট্যগুলো হযরত ফাতেমার কাছে বর্ণনা করলে তিনিও এ বিয়েতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।

রাসূল (সা.) আল্লাহর নির্দেশে হযরত ফাতেমাকে (আ.) হযরত আলীর (আ.) সাথে বিবাহ দেন। হযরত আলী (আ.) হিজরতের প্রাথমিক দিনগুলোতে অন্যান্য মুহাজিরদের মত অর্থনৈতিক কষ্টে ছিলেন। একারণে তিনি মহানবির (আ.) পরামর্শক্রমে স্বীয় বর্মটি বিক্রয় অথবা বন্ধক রেখে হযরত ফাতেমার দেনমোহর শোধ করেন। হযরত ফাতেমা (আ.) ও হযরত আলীর (আ.) বিবাহের আকদ মুসলমানদের উপস্থিতিতে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। তাঁদের বিবাহের আকদের বছর সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ গ্রন্থে তাঁদের আকদের সাল দ্বিতীয় হিজরি বলা হয়েছে। তাঁদের বিবাহের অনুষ্ঠান বদর যুদ্ধের পর দ্বিতীয় হিজরির শাওয়াল অথবা যিলহজ মাসে অনুষ্ঠিত হয়।

হযরত ফাতেমার (আ.) দাম্পত্য জীবন

হাদীসগ্রন্থ ও ঐতিহাসিক বর্ণনানুযায়ী হযরত আলীর (আ.) প্রতি হযরত ফাতেমার (আ.) ভালোবাসা এতটা অনন্য ছিল যে, মহানবির (আ.) সামনেও তা প্রকাশিত হত। তাঁর সামনে হযরত ফাতেমা (আ.) হযরত আলীকে সর্বোত্তম স্বামী বলে উল্লেখ করতেন। হযরত আলীর (আ.) প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি ফাতেমার (আ.) অন্যতম গুণ বলে উল্লেখিত হয়েছে। ঘরে তিনি হযরত আলীকে (আ.) ভালবাসাপূর্ণ সম্বোধনে ডাকতেন এবং অন্য লোকের উপস্থিতিতে সম্মানসূচক ‘আবুল হাসান’ বলে সম্ভাষণ করতেন। হাদীস ও ঐতিহাসিক বিবরণে এসেছে হযরত ফাতেমা (আ.) গৃহে সাজসজ্জা করে থাকতেন এবং সবসময় আতর ও সুগন্ধী ব্যবহার করতেন।

হযরত আলী (আ.) ও ফাতেমার (আ.) দাম্পত্য জীবনের শুরুটা অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে অতিবাহিত হয়। এমনকি কখনও কখনও তাঁরা দু’সন্তানসহ অভুক্ত থাকতেন। কিন্তু ফাতেমা (আ.) কখনই এজন্য অভিযোগ করতেন না, বরং স্বামীকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করার জন্য ভেড়ার পশম দিয়ে দড়ি, বস্ত্র ও পাটি ইত্যাদি তৈরী করতেন।

হযরত ফাতেমা (আ.) মহানবির (আ.) পরামর্শ অনুযায়ী ঘরের ভেতরের কাজগুলো নিজেই করতে আগ্রহী ছিলেন এবং ঘরের বাইরের কাজগুলো হযরত আলীর (আ.) ওপর ছেড়ে দিতেন। এমনকি যখন রাসূল (সা.) তাঁর গৃহের কাজে সাহায্য করার জন্য ফিযযা নামের এক দাসীকে প্রেরণ করেন তখনও তিনি ঐ দাসীর সাথে তাঁর কাজকে সমানভাগে ভাগ করে নেন। কোন কোন বর্ণনামতে একদিন ঘরের কাজ হযরত ফাতেমা (আ.) করতেন, পরের দিন ফিযযা এ কাজ করতেন।

সন্তানগণ

শিয়া-সুন্নী উভয়সূত্রে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হযরত আলী ও ফাতেমার (আ.) হাসান, হোসাইন, যায়নাবউম্মে কুলসূম নামে চার সন্তান ছিল। শিয়া সূত্রসমূহের অধিকাংশে এবং কিছু সংখ্যক সুন্নীসূত্রে তাঁদের মুহসেন নামের এক পুত্র সন্তানের উল্লেখ পাওয়া যায়, যিনি রাসূলের (সা.) ইন্তেকালের পরবর্তী সময়ে ঘটিত এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় (গর্ভপাতের কারণে) মৃত্যুবরণ করে।

জীবনের শেষ সময়ের কিছু ঘটনা

ফাতেমার (আ.) জীবনের শেষভাগে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। একারণে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে কেউ তাঁকে হাসতে দেখেনি। মহানবির (সা.) মৃত্যু, সাকিফার ঘটনা, খেলাফত জবরদখল, আবুবকর কর্তৃক ফাদাক ভূমি জব্দকরণ এবং মসজিদে নববিতে সাহাবাদের উপস্থিতিতে ফাদাক সম্পর্কিত খুতবা দান এ দিনগুলোতে সংঘটিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আলীর (আ.) পাশাপাশি ফাতেমা (আ.)ও আবুবকরের খেলাফত ও সাকিফার পরামর্শ সভার প্রধান ও মূল বিরোধী ছিলেন। একারণেই তাঁরা খলিফার সহযোগিদের হুমকির সম্মুখীন হন যার নমূনা ও প্রমাণ তাঁদের গৃহে অগ্নিসংযোগের হুমকির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।

আবু বকরের বিরোধিতা ও তাঁর হাতে আলী (আ.) বাইয়াত না করা এবং তাঁর পক্ষাবলম্বী সাহাবাদের ফাতেমার (আ.) গৃহে অবস্থান গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে খলিফার লোকেরা সেখানে হামলা চালায়। এ হামলায় ফাতেমা (আ.) আলীকে (আ.) জোরপূর্বক বাইয়াতের জন্য আবুবকরের কাছে নিয়ে যেতে বাঁধা দান করেন এবং আক্রমণকারীদের আঘাতে গুরুতর আহত হন। ফলে তাঁর গর্ভের সন্তান মারা যায়। এরপর ফাতেমা (আ.) শয্যাশায়ি হয়ে পড়েন এবং কিছুদিন পরে শাহাদাতবরণ করেন। তখন মদীনার আনসার নারীদের একদল তাঁর সাথে দেখা করতে আসলে তিনি তাদের উদ্দেশে এক বক্তব্য রাখেন যাতে তিনি রাসূলের (সা.) মৃত্যুর পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লোকদের নির্লিপ্ততার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তাঁর এরূপ অবস্থান ও অসন্তুষ্টির বিষয়টি তাঁর জীবনের অন্যতম ঘটনা হিসাবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে উল্লেখিত হয়েছে।

ফাতেমা (আ.) হযরত আলীর প্রতি ওয়াসিয়াত করে যান যে, তাঁর বিরোধিরা যেন তাঁর জানাযার নামাজে ও দাফনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করে এবং তাঁকে যেন রাতের অন্ধকারে দাফন করা হয়। প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে তিনি ১১ হিজরির ৩ জামাদিউস সানী মদীনায় শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর আয়ুষ্কাল ১৮ বছর ছিল বলে বলা হয়ে থাকে। তবে ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতে তাঁর বয়স ২৩ বলা হয়েছে।

সামাজিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক অবস্থানগত ভূমিকা

হযরত ফাতেমা (আ.) বিভিন্নরূপ সামাজিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছেন। মহানবির (সা.) জীবদ্দশায় তাঁর উল্লেখযোগ্য সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে মদীনায় হিজরত, উহুদের যুদ্ধে মহানবির (সা.) শুশ্রুষা, খন্দকের যুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে খাদ্য সরবরাহ এবং মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলের (সা.) সহযোগী হওয়া। কিন্তু তাঁর এ সংক্ষিপ্ত জীবনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোর অধিকাংশই মহানবির (সা.) ইন্তেকালের পর পরিচালিত হয়েছে।

তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানগত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার মধ্যে রয়েছে: সাকিফার ঘটনা ও মহানবির (সা.) স্থলাভিষিক্ত হিসাবে আবু বকরকে নির্বাচনের বিরাধিতা, খেলাফতের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসাবে হযরত আলীর (আ.) যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বের সপক্ষে স্বীকৃতি লাভের জন্য মুহাজির ও আনসারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের ঘরে ঘরে যাওয়া, ফাদাকের মালিকানা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রচেষ্টা চালানো, মুহাজিরআনসারের উপস্থিতিতে ফাদাকের প্রসিদ্ধ খুতবা দান, তাঁর গৃহে আক্রমণের সময় হযরত আলীর (আ.) প্রতিরক্ষায় ভূমিকা পালন। কিছু সংখ্যক গবেষকের মতে হযরত ফাতেমা পরিচালিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দেয়া বক্তব্যগুলোর অনেকগুলোই মূলত মহানবির (সা.) মৃত্যুর পর উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় অর্থাৎ আবুবকর ও তার সমর্থকদের দ্বারা খেলাফত জবরদখলের প্রতিবাদে হয়েছে।

সাকিফার পরামর্শসভার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা

আরোও দেখুন: সকিফায়ে বনি সায়েদার ঘটনা

সাকিফার পরামর্শসভা অনুষ্ঠিত হওয়া ও খলিফা হিসাবে আবুবকরের হাতে একদল লোকের বাইয়াতের বিরুদ্ধে যখন হযরত আলী, তালহা ও যুবায়েরসহ কিছু সংখ্যক সাহাবা প্রতিবাদ জানান, তখন হযরত ফাতেমা তাঁদের সাথে ছিলেন। কারণ মহানবি (সা.) বিদায় হজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে গাদীরে খুমে হযরত আলীকে (আ.) নিজের স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেছিলেন। ঐতিহাসিক বর্ণনামতে ফাতেমা (আ.) হযরত আলীকে (আ.) সাথে নিয়ে সাহাবাদের নিকট যেতেন ও আলীকে (আ.) খলিফা করার জন্য তাঁদের কাছে সাহায্য চাইতেন। সাহাবারা ফাতেমার (আ.) আবেদনের জবাবে বলতেন যদি তারা আবু বকরেরর হাতে বাইয়াত করার পূর্বে তাদের কাছে আসতেন তবে তারা তাঁর সাথে সহযোগিতা করতেন।

ফাদাকের ঘটনা ও ঐতিহাসিক বক্তব্য

আরোও দেখুন: ফাদাকের ঘটনাফাদাকের খুতবা

আবুবকর ফাদাকের জমিটি হযরত ফাতেমার (আ.) থেকে কেড়ে নিয়ে খেলাফতের অধীনে নিয়ে নিলে ফাতেমা (আ.) তার এ পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানান। তিনি ফাদাক ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আবুবকরের সাথে সংলাপ করেন এবং স্বীয় সাক্ষ্য ও প্রমাণ উপস্থাপন করেন। আবুবকর ফাতেমার অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে একটি পত্রে ফাদাককে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু উমর ইবনে খাত্তাব ঐ পত্রটি ফাতেমার (আ.) হাত থেকে অপমানের সাথে ছিনিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে।

কোন কোন সূত্রে বলা হয়েছে উমর হযরত ফাতেমাকে প্রহার করার ফলে তিনি গুরুতর আহত হন এবং তাঁর গর্ভপাত ঘটে। ফাতেমা ফাদাক ফিরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর মসজিদে নববীতে যান এবং সাহাবাদের উপস্থিতিতে ফাদাকের খুতবা নামক প্রসিদ্ধ বক্তব্যটি দেন। এ বক্তব্যে তিনি ফাদাক জব্দ ও খেলাফত কুক্ষিগত করার কারণে আবুবকরের সমালোচনা ও নিন্দা করেন এবং আবুবকর ও তার সমর্থকদের পদক্ষেপগুলোর পরিণাম জাহান্নাম বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন।

ফাতেমার (আ.) গৃহে আবু বকরের বিরোধিদের অবস্থান গ্রহণ

আরোও দেখুন: হযরত ফাতেমার (আ.) গৃহে হামলার ঘটনা

যখন সাহাবাদের একদল গাদীরের ভাষণে আলীর (আ.) খেলাফতকে মেনে নেয়ার মহানবির (সা.) নির্দেশকে উপেক্ষা করে আবু বকরের হাতে বাইয়াত করলেন তখন হযরত আলী (আ.), ফাতেমা (আ.), বনি হাশেমের সকল সদস্যসহ সাহাবাদের একাংশ এ কাজের প্রতিবাদে হযরত ফাতেমার (আ.) গৃহে সমবেত হলেন। তাঁর গৃহে অবস্থানকারীদের মধ্যে আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেব, সালমান ফারসি, আবু যার গিফারী, মিকদাদ, উবাই ইবনে কা’ব ও বনি হাশেমের পুরুষরা উল্লেখযোগ্য।

হযরত ফাতেমার (আ.) গৃহে হামলার ঘটনা

আবু বকরের খেলাফতের সমর্থকরা জোরপূর্বক হযরত আলীকে (আ.) বাইয়াতের জন্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ফাতেমা (আ.) আক্রমণকারিদের বাঁধা দেন। তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরী শতাব্দির সুন্নী আলেম ইবনে আবদু রাব্বি বর্ণনা করেছেন যে, আবু বকর যখন শুনতে পেলেন খেলাফতের বিরোধিরা হযরত ফাতেমার গৃহে অবস্থান করছেন তখন তিনি এ সমাবেশ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য সেখানে হামলার এবং যদি তারা ছত্রভঙ্গ না হয় তবে তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার নির্দেশ দেন।

উমর ইবনে খাত্তাব একদল লোককে সাথে নিয়ে ফাতেমার (আ.) গৃহের দরজায় গিয়ে গৃহে অবস্থানকারিদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয় এবং যদি তারা বেরিয়ে না আসে তবে গৃহে আগুন দেয়ার হুমকি দেয়। উমর ও তার সঙ্গীরা গৃহে প্রবেশ করতে সহিংসতার আশ্রয় নেয়। তখন ফাতেমা (আ.) আক্রমণকারিদের আল্লাহর কাছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভয় দেখান। তখন তারা আলী (আ.) ও বনি হাশেমের সদস্যরা ব্যতীত অন্যান্যদের আবু বকরের বাইয়াতের জন্য মসজিদে ধরে নিয়ে যায়।

আক্রমণকারিরা উক্ত ব্যক্তিদের থেকে জোরপূর্বক বাইয়াত নেয়ার পর আলী ও বনি হাশেমের পুরুষদের থেকে বাইয়াত নেয়ার জন্য আবার ফাতেমার (আ.) গৃহে হামলা চালায় ও তাঁর গৃহের দরজায় আগুন দেয়। ফাতেমা (আ.) দরজার পেছনে দাাঁড়িয়ে ছিলেন। উমর, মুগিরা, কুনফুয ও অন্যান্যরা অগ্নিদগ্ধ দরজায় উপর্যুপরি লাথি মারতে থাকে। ফলে দরজা তাঁর ওপর পড়ে যায় এবং তিনি আহত ও তাঁর গর্ভের শিশুর (মুহসেন) মৃত্যু হয়। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে কুনফুয হযরত ফাতেমাকে (আ.) দরজা দিয়ে দেয়ালে চেপে ধরে এবং তাঁকে দরজা দিয়ে আঘাত করে। ফলে তাঁর পাঁজর ভেঙ্গে যায়। তিনি এ ঘটনার পরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।

আবু বকর ও উমরের প্রতি ফাতেমার (আ.) ক্রোধ

হযরত ফাতেমা (আ.) ফাদাক জবরদখল ও জোরপূর্বক বাইয়াত গ্রহণের ঘটনায় আবুবকর ও উমরের রূঢ় আচরণের কারণে মুত্যু পর্যন্ত আবুবকর ও উমরের প্রতি ক্রোধান্বিত ছিলেন। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে ফাতেমার (আ.) গৃহে উমর ও তার সহযোগিদের হামলার পর আবু বকর ও উমর তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য আসেন; কিন্তু ফাতেমা (আ.) অনুমতি দানে সম্মত হননি। অবশেষে তারা হযরত আলীর শরণাপন্ন হলে তিনি অনুমতি দেন।

তারা হযরত ফাতেমার (আ.) সাক্ষাতে আসলে তিনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এমনকি তাদের সালামের জবাবও দেননি। ফাতেমা (আ.) তাদের রাসূলের (সা.) ঐ হাদীসকে স্মরণ করিয়ে দেন যাতে তিনি (সা.) বলেছেন ফাতেমার ক্রোধে তিনি ক্রোধান্বিত হন। অতঃপর বলেন যে, তিনি তাদের আচরণের কারণে তাদের দু’জনের ওপরই ক্রোধান্বিত হয়েছেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে ফাতেমা (আ.) শপথ করেন প্রত্যেক নামাজের পর তাদের দু’জনের ওপর অভিসম্পাত করবেন।

হযরত ফাতেমার (আ.) শাহাদাত, শবযাত্রা ও দাফন

আরোও দেখুন: হযরত ফাতিমার (আ.) শাহাদাতহযরত ফাতিমার (আ.) দাফন ও কাফন

মহানবির (সা.) মৃত্যুর পরবর্তী ঘটনায় ফাতেমা (আ.) দৈহিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কিছুদিন পর তিনি শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর শাহাদাতের দিন নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বর্ণনা ভেদে তিনি মহানবির (সা.) মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ, পঁচাত্তর অথবা পঁচানব্বই দিন পর মৃত্যুবরণ করেন। শিয়াসূত্রের প্রসিদ্ধতম বর্ণনামতে তাঁর শাহাদাত ৩ জামাদিউস সানীতে ঘটেছে। এ প্রসিদ্ধ তারিখটি (পঁচানব্বই দিন পর তাঁর শাহাদাতের বিষয়টি) ইমাম সাদিকের (আ.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসের ভিত্তিতে বলা হয়ে থাকে। ৭৫ দিনের হিসেবে তার মৃত্যু শাহাদাতের দিন ১৩ জামাদিউস সানী। কিছু বর্ণনানুযায়ী তিনি ৮ রবিউস সানী ও অন্য বর্ণনামতে ১৩ রবিউসসানী অথবা ৩ রমজানে মৃত্যুবরণ করেন। ইমাম কাযিম (আ.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে হযরত ফাতেমা (আ.) শাহাদাতবরণ করেছেন। অন্য রেওয়ায়েতে ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ফাতেমা (আ.) মুগিরা বিন শোবার দাস কুনফুযের তরবারির কোষের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু ঘটে এবং তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এর ফলেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কোন কোন গবেষকের মতে হযরত ফাতেমা (আ.) তাঁর পবিত্র দেহ মোবারক গোপনে দাফনের যে নির্দেশটি দিয়েছেন তা আবুবকরের খেলাফতের বিরোধিতায় তাঁর শেষ রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিল।

হযরত ফাতেমার (আ.) দাফনের স্থান

আরোও দেখুন: হযরত ফাতিমাকে (আ.) কোথায় দাফন করা হয়েছে?

ফাতেমা (আ.) শাহাদাতের পূর্বে ওসিয়ত করেছিলেন যে, তাঁর প্রতি যারা অবিচার করেছে ও তাঁকে অসন্তুষ্ট করেছে তারা যেন তাঁর জানাযার নামাজে ও তাঁর দাফনের সময় না আসে। এজন্যই তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তাঁকে মানুষের অগোচরে দাফন করা হয় এবং তাঁর কবর যেন সবার থেকে গোপন রাখা হয়। ঐতিহাসিক বর্ণনা মতে হযরত আলী (আ.) তাঁর স্ত্রী ফাতেমাকে (আ.) আসমা বিনতে উমাইসের সহায়তায় গোসল দেন এবং নিজেই তাঁর জানাযার নামাজ পড়ান। অন্যদের মধ্যে যারা তাঁর জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ করেন তাদের সংখ্যা ও নাম নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন ইতিহাস গ্রন্থে নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা তাঁর জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ করেছেন: ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইন, আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব, মিকদাদ, সালমান, আবুজর, আম্মার, আকিল, যুবাইর, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও ফায্ল বিন আব্বাস। ইমাম আলী (আ.) তাঁকে কবরস্থ করার পর তাঁর কবরের স্থানটি এমনভাবে ঢেকে দেন যেন কেউ তা একটি কবর বলে বুঝতে না পারে। তাঁর কবরের স্থানই শুধু অজ্ঞাত নয় এমনকি সার্বিকভাবে তাঁর কবর কোন স্থানে তা নিয়েও বিভিন্নরূপ বর্ণনা রয়েছে:

  • কোন কোন ঐতিহাসিক হযরত ফাতেমার কবর মহানবির (আ.) রওজা মোবারকে বলে মনে করেন।
  • কোন কোন সূত্রে তিনি তাঁর নিজের শয়নকক্ষেই কবরস্থ হয়েছেন বলা হয়েছে। তাঁর বাসস্থানটি বনি উমাইয়ার শাসনামেলে মসজিদে নববির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
  • কোন কোন বর্ণনায় তিনি জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে দাফন হয়েছেন বলা হয়েছে।
  • কিছু গ্রন্থে তাঁর কবরের স্থান আকিল ইবনে আবি তালিবের গৃহ বলে উল্লিখিত হয়েছে। আকিলের গৃহটি যা জান্নাতুল বাকী কবরস্থানের পাশে অবস্থিত একটি বড় ও প্রশস্ত গৃহ ছিল। এ গৃহটিতে হযরত আলীর (আ.) মাতা ফাতেমা বিনতে আসাদ, তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব এবং পরবর্তীতে ইমাম হাসানসহ কয়েকজন ইমাম দাফন হওয়ার পর যিয়ারতের স্থানে পরিণত হয়েছে।

হযরত ফাতেমার (আ.) ফজিলত ও মর্যাদার বৈশিষ্ট্যসমূহ

আরোও দেখুন: হযরত ফাতেমার (আ.) ফজিলত ও মর্যাদাসমূহ

শিয়াসুন্নী তাফসির, হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে হযরত ফাতেমার (আ.) অসংখ্য ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। এ ফজিলতগুলোর অনেকগুলোই পবিত্র কোরআনে এসেছে এবং হযরত ফাতেমা (আ.) সেগুলোর অন্তর্ভুক্ত, যেমন: আহলে বাইতের শানে নাযিল হওয়া তাতহীরের আয়াত, মুবাহিলার আয়াত ও মাওয়াদ্দাতের আয়াত। আবার কোন কোন ফজিলত বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যেমন: বাদআর হাদীস (যাতে মহানবী বলেছেন: ফাতেমা আমার অস্তিত্বের অংশ) ও মুহাদ্দাসা হওয়ার হাদীস।

হযরত ফাতেমার (আ.) মাসুম (নির্ভুল ও নিষ্পাপ) হওয়া

আরোও দেখুন: হযরত ফাতেমার (আ.) নিষ্পাপত্ব

আল্লামাহ মাজলিসির মতে শিয়ারা হযরত ফাতেমার (আ.) মাসুম হওয়ার বিষয়ে ঐকমত্য। তাতহীরের আয়াত, হাদীসে বাদ্বআহ্ ও আহলে বাইতের নিষ্পাপতা নির্দেশক অন্যান্য হাদীসসমূহ তাঁর নিষ্পাপতার পক্ষে দলীল। তাতহীরের আয়াত অনুযায়ী মহান আল্লাহ আহলে বাইতকে সবধরনের পাপ ও পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করেছেন এবং শিয়া ও সুন্নী সূত্রে বর্ণিত অনেক হাদীসেই ফাতেমাকে (আ.) আহলে বাইতের অন্যতম প্রধান সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত ফাতেমার (আ.) মাসুম হওয়ার আবশ্যক অর্থ হল নবিগণ ও ইমামদের কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন তাঁদের বাণী, কর্ম ও নিরব সম্মতির বিষয়গুলো শরীয়তের দলীল হওয়া, দ্বীনের বিভিন্ন বিষয় ও কোরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দাতা ও তাঁদের মত প্রামাণ্য হওয়া এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের কর্মপন্থা ও গৃহীত পদক্ষেপ সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী হওয়া এবং মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁরা পূর্ণ আদর্শ হওয়ার এ সবগুলোই হযরত ফাতেমার (আ.) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আহলে সুন্নাতের হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে বর্ণিত অনেক রেওয়ায়েতেও বলা হয়েছে মহানবি (সা.) তাতহীরের আয়াতের দ্বারা আহলে বাইতের সদস্যদের অর্থাৎ আলী (আ.), ফাতেমা (আ.), হাসান (আ.) ও হোসাইন (আ.) কে সকল প্রকার গুনাহ থেকে পবিত্র থাকার সপক্ষে প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন।

ইবাদত

আরোও দেখুন: হযরত ফাতেমার (আ.) নামাজ

হযরত ফাতেমা (আ.) রাসূলের (সা.) মতই ইবাদতের প্রতি আসক্ত ছিলেন। তিনি দিবা-রাত্রির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সময় নামাজ ও মুনাজাত করে কাটাতেন। কোন কোন গ্রন্থের বিবরণে হযরত ফাতেমার (আ.) প্রতি ঐশী অদৃশ্য সাহায্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন, সালমান ফারসি হযরত ফাতেমার (আ.) সাক্ষাতে গেলে দেখতে পান যে, তিনি কোরআন তেলাওয়াত করছেন আর তাঁর সামনের যাতাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘুরছে ও আটা তৈরি হচ্ছে। এতে তিনি আশ্চর্য হয়ে মহানবিকে (সা.) এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন: মহান আল্লাহ জীবরাঈলকে (আ.) যাতাটি ঘুরানোর জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ইবাদতের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে নামাজ পড়া, রাত জেগে ইবাদত করা, অন্যদের জন্য বিশেষত প্রতিবেশিদের জন্য দোয়া করা, প্রায়ই রোজা রাখা এবং শহীদদের কবর জিয়ারত। আহলে বাইতের পবিত্র ইমামগণ এবং বিভিন্ন সাহাবী ও তাবেয়ীর বর্ণনায় তাঁর এ বৈশিষ্ট্যগুলোর বিবরণ এসেছে। বিভিন্ন দোয়া ও মুনাজাতের গ্রন্থে তাঁর থেকে বেশ কিছু নামাজ (বিশেষ সময়ে ও ক্ষেত্রে পঠনীয়), দোয়া ও তসবিহ (যিকির) বর্ণিত হয়েছে।

মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট ফাতেমার (আ.) মর্যাদা

শিয়া ও সুন্নী আলেম ও মনীষীরা সূরা শূরার ২৩ নং আয়াত (মুওয়াদ্দাতের আয়াত বলে প্রসিদ্ধ) অনুযায়ী হযরত ফাতেমার প্রতি ভালবাসাকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ বলে গণ্য করেছেন। এ আয়াতে মহানবির (আ.) নিকটাত্মীয়দের (বংশধরদের) প্রতি ভালবাসাকে তাঁর রেসালাতের দায়িত্বের প্রতিদান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মুফাসসিররা মহানবির (আ.) নিকটাত্মীয় বলতে তাঁর আহলে বাইতকে বুঝানো হয়েছে বলেছেন। হাদীসসমূহের বর্ণনানুযায়ী আহলে বাইত হলেন ফাতেমা (আ.), আলী (আ.), হাসান ও হোসাইন (আ.)। মাওয়াদ্দাতের আয়াত ছাড়াও মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: মহান আল্লাহ ফাতেমার ক্রোধে ক্রোধান্বিত ও তাঁর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হয়।

সাইয়েদ মুহাম্মাদ হাসান মীর জাহানী তার ‘জুন্নাতুল আছেসাহ’ গ্রন্থে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে ফাতেমাকে (আ.) বিশ্বজগত সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য বলা হয়েছে। মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত এ হাদীসটি ‘হাদীসে লাওলাক’ নামে প্রসিদ্ধ। এতে বিশ্বজগতের সৃষ্টি মহানবির (সা.) সৃষ্টির শর্তাধীন এবং মহানবির সৃষ্টিকে হযরত আলীর (আ.) সৃষ্টির শর্তাধীন এবং তাঁদের উভয়ের সৃষ্টিকে হযরত ফাতেমার সৃষ্টির শর্তাধীন বলা হয়েছে। কোন কোন গবেষক বলেছেন: যদিও হাদীসটির সূত্র ত্রুটিযুক্ত; কিন্তু এর বিষয়বস্তু সাংঘর্ঘিক ও ত্রুটিপূর্ণ নয়।

মহানবী (সা.) হযরত ফাতেমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং সকলের চেয়ে বেশি তাঁর প্রতি ভালবাসা ও সম্মান দেখাতেন। ‘হাদীসে বাদ্বআহ্’ নামে প্রসিদ্ধ হাদীসে মহানবী (সা.) হযরত ফাতেমাকে (আ.) নিজের অস্তিত্বের অংশ বলে পরিচিয় করিয়েছেন এবং বলেছেন: যে কেউ ফাতেমাকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল। এ হাদীসটি প্রথম যুগের হাদীস সঙ্কলকদের (মুহাদ্দিস) অনেকেই বর্ণনা করেছেন। মহান শিয়া মনীষী শেইখ মুফিদ ও বিশিষ্ট সুন্নী মুহাদ্দিস আহমাদ বিন হাম্বাল তাঁদের গ্রন্থে এ হাদীসটি বিভিন্নভাবে (সূত্রে) বর্ণনা করেছেন।

নারিদের নেত্রী

শিয়া ও সুন্নি সূত্রের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাদীসে হযরত ফাতেমাকে দুই জাহান, উম্মতেরবেহেশতের নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

মুবাহিলার জন্য মনোনীত একমাত্র নারী

মহানবির (সা.) সাথে নাজরানের খ্রিস্টানদের মুবাহিলায় মুসলমানদের মধ্যে একমাত্র মনোনীত নারী ছিলেন ফাতেমা (আ.)। এ ঘটনাটি মুবাহিলার আয়াতে (সূরা আলে ইমরান ৬১নং আয়াত) বর্ণিত হয়েছে। তাফসির, হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহের বর্ণনার ভিত্তিতে নিশ্চিত বলা যায় এ আয়াতটি মহানবির (আ.) আহলে বাইতের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছে। ‍এ ঘটনায় হযরত আলী (আ.), হযরত ফাতেমা, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (আ.) মহানবির (সা.) সাথে ছিলেন।

রাসূলের (সা.) বংশ ধারা তাঁর কন্যা ফাতেমার মাধ্যমে অব্যাহত থাকা

ফাতেমার (আ.) মাধ্যমেই রাসূলের (সা.) বংশ ধারা অব্যাহত থাকা এবং ফাতেমার (আ.) সন্তানদের মধ্য থেকে ইমামদের মনোনীত হওয়া এ মহীয়সী নারির অন্যতম মর্যাদার বৈশিষ্ট্য। কোন কোন মুফাসসির ফাতেমার (আ.) মাধ্যমেই রাসূলের (সা.) বংশধর অব্যাহত থাকাকে সূরা কাউসারেরকাউসার’ (অফুরন্ত কল্যাণ) শব্দের দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছেন।

দানশীলতা

হযরত ফাতেমার (আ.) অন্যতম আচরণগত বৈশিষ্ট্য হল দানশীলতা। ফাতেমা (আ.) তাঁর দাম্পত্য জীবনে যখন হযরত আলীর (আ.) অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল ছিল তখনও তিনি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন এবং সবসময় দান করতেন। বিবাহের রাতে তিনি নিজের বিয়ের পোশাক এক দরিদ্র ব্যক্তিকে দান করেন। এক অভাবী লোকের অভাব পূরণের জন্য নিজের গলার মূল্যবান হারটিও দিয়ে দেন। তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা অভাবগ্রস্ত, অনাথ (ইয়াতিম) ও বন্দিকে তাঁদের সবার খাবার দিয়ে দেন। তাফসির ও ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহে এসেছে একদিন রোজা রাখার পর হযরত আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন (আলাইহিমুস সালাম) ইফতার করতে বসলে একে একে উপরোক্ত তিনজন তাঁদের গৃহের দরজায় এসে খাদ্য চাইলে তাঁরা সবাই নিজের অংশটি দিয়ে অভুক্ত থাকেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সূরা দাহরের ৫ থেকে ৯ নং আয়াত অবতীর্ণ হয়। এ আয়াতগুলোকে ‘আয়াতে ইতয়াম’ বলা হয়।

মুহাদ্দাছ হওয়া (ফেরেশতাদের সাথে কথোপকথনকারী)

হযরত ফাতেমার (আ.) অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ফেরেশতাদের সাথে কথোপকথন, এজন্য তাঁকে ‘মুহাদ্দাছা’ বলা হয়। ফেরেশতারা রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবদ্দশায় যেমন হযরত ফাতেমার সাথে কথা বলেছেন, তাঁর (সা.) মৃত্যুর পরও ফাতেমাকে সান্ত্বনা দান ও তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যত সম্পর্কে খবর দিয়েছেন। আল্লাহর ফেরেশতা ফাতেমার নিকট এসে ভবিষ্যতে রাসূলের (সা.) উম্মতের মধ্যে যা কিছু ঘটবে সে সম্পর্কে খবর দিতেন এবং তিনি হযরত আলীর (আ.) কাছে তা বর্ণনা করতেন এবং তিনি ফাতেমার থেকে শুনে লিখতেন যা ‘মুছহাফে ফাতেমা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

যিয়ারতনামা

বেশ কিছু শিয়া গ্রন্থে ইমাম সাদিক (আ.) থেকে হযরত ফাতেমার (আ.) একটি যিয়ারতনামা বর্ণিত হয়েছে। এ যিয়ারতনামায় বলা হয়েছে হযরত ফাতেমা (আ.) সৃষ্টি হওয়ার (পৃথিবীতে আগমনের) পূর্বে (ঊর্ধ্বজগতে) আল্লাহর পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তাতে তিনি ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। এ যিয়ারতনামায় হযরত ফাতেমার বেলায়েতকে মেনে নেয়াকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং সকল নবির বেলায়েতের স্বীকৃতি দানের অনুরূপ গণ্য করা হয়েছে। তেমনি এ যিয়ারতনামায় বলা হয়েছে, যে কেউ তাঁর আনুগত্য করবে ও তাঁর বেলায়েতের ওপর অটল থাকবে তার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়ে তাকে পবিত্র করা হবে।

আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার

হযরত ফাতেমা (আ.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে (স্বীয় ইবাদতকে ত্রুটিহীনভাবে আল্লাহর কাছে প্রেরণ করবে) মহান আল্লাহ তাঁর সর্বোত্তম কল্যাণকে তার জন্য নির্ধারণ করেন। (ইবনে ফাহাদ হিল্লী, ইদ্দাতুদ দায়ী, ১৪০৭হি., দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত, পৃ. ২৩৩)

হযরত ফাতেমার (আ.) বাণী, কর্ম এবং আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনী এক মূল্যবান নৈতিক, জ্ঞানগত ও শিক্ষাগত সম্পদ যা মুসলমানদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ও বিভিন্ন গ্রন্থসূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে। হযরত ফাতেমার রেখে যাওয়া জ্ঞানগত ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের মধ্যে রয়েছে মুছহাফে ফাতেমা, ফাদাকের বক্তব্য (খুতবায়ে ফাদাকিয়া), যিকির (তাসবিহ, তাহলীল ও তাকবির) এবং বিশেষ নামাজসমূহ।

  • হযরত ফাতেমা সূত্রে বর্ণিত হাদীস ও তাঁর বাণীসমূহ ফাতেমার (আ.) উত্তরাধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁর সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ বৈচিত্রপূর্ণ ও বিভিন্ন বিষয়কে শামিল করে: মৌলিক বিশ্বাস ও অন্যান্য বিশ্বাসগত বিষয় (আকীদা সম্পর্কিত), ফিকাহ ও বিধানগত বিষয়, নৈতিকতা, আধ্যাত্মিক, সামাজিক প্রভৃতি বিষয়। তাঁর বর্ণিত হাদীসসমূহ শিয়া ও সুন্নী গ্রন্থসমূহে সঙ্কলিত হয়েছে। এ হাদীসগুলির বেশ কিছু ‘মুসনাদে ফাতেমা’ ও ‘আখবারে ফাতেমা’ শিরোনামের গ্রন্থে সংগৃহীত ও লিপিবদ্ধ রয়েছে। দুঃখজনকভাবে এ সকল গ্রন্থের অনেকগুলোই সময়ের পরিক্রমায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে বিদ্যমান বিভিন্ন রেজাল, তারাজেম (জীবনী গ্রন্থে) ও গ্রন্থপরিচিতি সঙ্কলনসমূহে যেখানে বিভিন্ন লেখক, রাবী ও হাদীস বর্ণনাকারীর পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে সেখানে শুধু সেগুলোর নাম পাওয়া যায়।
  • মুছহাফে ফাতেমা একটি ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্কলন যা তিনি ঐশী ফেরেশতার থেকে শুনে হযরত আলীকে বলেছেন এবং হযরত আলী তা লিখে রেখেছেন। শিয়া সূত্র অনুযায়ী এ গ্রন্থটি ইমামদের হাতে বিদ্যমান ছিল এবং প্রত্যেক ইমাম মৃত্যুর পূর্বে তাঁর পরবর্তী ইমামের কাছে তা হস্তান্তর করেছেন। ইমামরা ছাড়া কেউই এ গ্রন্থটি দেখার সুযোগ পায়নি। বর্তমানে এটি ইমাম মাহদীর (আ.) হাতে রয়েছে।
  • ফাদাকের বক্তব্য: হযরত ফাতেমার বাণীসমূহের মধ্যে প্রসিদ্ধ একটি বাণী হল ফাদাক সম্পর্কিত খুতবা। এ খুতবায় তিনি আবুবকরের খেলাফতকে অবৈধ ও ফাদাক জমির ওপর ম্বীয় মালিকানার বৈধতাকে প্রমাণ করেছেন। তাঁর এ বক্তব্যের অনেকগুলো শারহ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখা হয়েছে। সেগুলোর অধিকাংশের নাম হয় ‘শারহে খুতবায়ে যাহরা (আ.)’ অথবা ‘শারহে খুতবায়ে লোম্মাহ’।
  • হযরত ফাতেমা যাহরার (আ.) তাসবিহ এমন একটি যিকির যা তিনি আল্লাহর রাসূলের (সা.) কাছে শিখেছিলেন। তিনি এটা শিখতে পেরে খুবই খুশি হয়েছিলেন। হযরত ফাতেমা কর্তৃক এ তাসবিহটি শিখার ঘটনার বিবরণ শিয়া ও সুন্নি সূত্রের বিভিন্ন গ্রন্থে এসেছে। এ তাসবিহ সম্পর্কে জানার পর হযরত আলী (আ.) কোন অবস্থাতেই তা পাঠ ত্যাগ করেননি।
  • হযরত যাহরার (আ.) নামাজ নামে প্রসিদ্ধ কয়েকটি নামাজের সমষ্টি যা ফাতেমা (আ.) মহানবী (সা.) অথবা জীবরাঈল (আ.) থেকে শিখেছেন। কোন কোন হাদীস ও দোয়ার গ্রন্থে এ নামাজগুলি উল্লেখিত হয়েছে।
  • হযরত যাহরার (আ.) নামে প্রচলিত বিভিন্ন কবিতা যা বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। মহানবির (সা.) মৃত্যুর পূর্বের ও পরের ফাতেমার (আ.) কবিতাসমগ্র শিরোনামে বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়েছে।

শিয়া সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ফাতেমা (আ.)

শিয়ারা হযরত ফাতেমাকে নিজেদের আদর্শ বলে মনে করে। শিয়াদের জীবন ও শিয়া সংস্কৃতিতে তাঁর জীবনচরিতের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এর কিছু উদাহরণ নিচে দেয়া হল:

  • দেনমোহরের সুন্নাত: একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম জাওয়াদ (আ.) তাঁর স্ত্রীর দেনমোহর হযরত ফাতেমার (আ.) দেনমোহরের পরিমাণে নির্ধারণ করেন। এ পরিমাণটি হল পাঁচশ দিরহাম। এ পরিমাণ দেহমোহরকে ‘মাহরুস সুন্নাহ’ বলা হয়; কারণ মহানবি (সা.) তাঁর স্ত্রী ও কন্যা ফাতেমার (আ.) জন্য এ পরিমাণ অর্থকে দেনমোহর নির্ধারণ করেছিলেন।
  • আইয়ামে ফাতেমিয়াহ: শিয়ারা হযরত ফাতেমার (আ.) শাহাদাতের দিনগুলোতে শোকানুষ্ঠান (আযাদারী) পালন করে থাকে। ইরানে হযরত ফাতেমার শাহাদাতের দিনটি (৩ জামিাদিউস সানী) সরকারী ছুটি থাকে। মার্জায়ে তাকলিদগণ এ দিনে পায়ে হেঁটে শোক মিছিলে অংশগ্রহণ করেন।
  • নারী দিবস: ইরানে হযরত ফাতেমার (আ.) জন্মবার্ষিকী (২০ জামাদিউস সানী) নারী দিবস ঘোষিত হয়েছে। ইরানের জনগণ এই দিন উৎসব পালন করে এবং তাদের মাতাদের উপহার দিয়ে থাকে।
  • বিবাহ দিবস: ইরানের বর্ষপঞ্জীতে ১ যিলহজকে বিয়ের দিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ এদিনে হযরত আলী (আ.) ও যহরত ফাতেমার (আ.) বিবাহ হয়েছিল।
  • বনি হাশেমের পল্লীর প্রতীকি বিনির্মাণ: হযরত ফাতেমার (আ.) শাহাদাতের দিনগুলোতে বিভিন্ন স্থানে বনি হাশেমের মহল্লা ও পল্লীর প্রতীকি বিনির্মাণ করা হয়। এ পল্লীর মধ্যে হযরত ফাতেমার গৃহ, মসজিদুন নবী, জান্নাতুল বাকি কবরস্থানসহ তৎকালীন প্রাচীন মদীনার ধাচে বনি হাশেমের মহল্লার অনুরূপ তৈরী করা হয়। প্রচুর মানুষ তা দেখার জন্য আসে।
  • থিয়েটার ও তাযিয়া (অভিনয়ের মাধ্যমে হযরত ফাতেমার জীবনের বিভিন্ন ঘটনার প্রদর্শনী): বিগত বছরগুলিতে ইরানের বিভিন্ন স্থানে তাঁর জীবনী ভিত্তিক থিয়েটার, পথ থিয়েটার ও তাযিয়া অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। হযরত ফাতেমার শাহাদাতের দিনগুলোতে অনুষ্ঠিত ‘পানি ও আয়নার নারী’ ও ‘স্বদেশে নির্বাসিত এক মহিয়সী নারী’ এরূপ দু’টি থিয়েটার।
  • মেয়েদের নামকরণ: ২০১৩সালের মে মাসে প্রকাশিত ইরানের সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী ফাতেমা ও যাহরা এ দুটি নাম ইরানে প্রচলিত মেয়েদের নামের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় দশটি নামের অন্তর্ভুক্ত।
  • হযরত ফাতেমার (আ.) সন্তানদের সাথে সম্পৃক্ততা: শিয়াদের মধ্যে যাইদী ফিরকা এ মতে বিশ্বাসী যে, ইমাম ও নেতাকে অবশ্যই হযরত ফাতেমার বংশধর থেকে হতে হবে এবং কেবল তাঁরাই মুসলমানদের নেতৃত্বের অধিকার রাখে। একারণে এ ফিরকার অনুসারিরা কেবল তাদেরই নেতৃত্ব ও শাসনকে মানে যারা হযরত ফাতেমার বংশধর। মিশরের ফাতেমী শাসকরাও যাইদিদের মত তাদের শাসকদের হযরত ফাতেমার সাথে সম্পৃক্ত করে থাকে এবং দাবি করে থাকে তারাও হযরত ফাতেমার বংশধর হিসাবে শাসক হয়েছে।

হযরত ফাতেমা সম্পর্কিত সাহিত্য ও কবিতা

অনেক ফার্সি সাহিত্যিক ও কবি হযরত ফাতেমা সম্পর্কে গল্প ও কবিতা রচনা করেছেন। কারো কারো মতে হযরত ফাতেমা সম্পর্কিত সবচেয়ে পুরাতন ফার্সি কবিতা পঞ্চম হিজরি সালে রচিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে হযরত ফাতেমার শানে কবিতা রচনার প্রচলন অনেক বেড়েছে। এরূপ কবিতার আধিক্যের বিষয়টি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুষ্ঠিত হযরত ফাতেমা সম্পর্কে যে সকল কবি কবিতা রচনা করেছেন তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সেমিনার ও সম্মেলন থেকে বোঝা যায়। অনেক সাহিত্য গবেষক কবিতার শ্রেণী ও ধরনগত বিভাজনের ক্ষেত্রে যে সকল কবিতায় হযরত ফাতেমার মর্যাদা ও জীবনী সম্পর্কে আলোচিত হয়ে থাকে সেগুলোকে শে’রে আ’ঈনীর (ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কবিতার) অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

সাম্প্রতিক কালের গ্রন্থগুলোর (গদ্য রচনা) মধ্যে ‘কেশতি পাহলু গেরেফতেহ’ (নৌকা তীরে ভিড়েছে) ও ‘ফাতেমা ফাতেমা আস্ত্’ (ফাতেমা হল ফাতেমা) –এর নাম উল্লেখ করা যায়। আর হযরত ফাতেমার ফযিলত ও মর্যাদা বর্ণনায় রচিত কবিতাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মরহুম আয়াতুল্লাহ শেখ মোহাম্মাদ হোসাইন গারাভীর (যিনি কোম্পানী নামে প্রসিদ্ধ) বিখ্যাত একটি কবিতা যা এভাবে শুরু হয়েছে: দোখতারে ফেকরে বেকরে মান গোনচেয়ে লাব চু ওয়াকুনাদ/ আয নামাকিনে কালামে খুদ হাক্বে নামাক আদা কুনাদ।

গ্রন্থপরিচিতি

হযরত ফাতেমা (আ.) সম্পর্কিত গ্রন্থপরিচিতি

প্রথম দিকের হিজরী শতাব্দীগুলো থেকেই মুসলমানরা বিশেষত শিয়ারা হযরত ফাতেমা (আ.) সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা শুরু হয়েছিল। হযরত ফাতেমা সম্পর্কিত সঙ্কলন ও গ্রন্থগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা যায়: মুসনাদসমূহ (তাঁর বাণীসমূহ ও তাঁর সূত্রে বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহ সম্বলিত গ্রন্থ), মানকাবাত গ্রন্থ (তাঁর শান ও মর্যাদায় বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহের সঙ্কলন) ও জীবনীগ্রন্থ।

হযরত ফাতেমা সম্পর্কে শিয়াদের সঙ্কলিত মুসনাদ ও হাদীসসমগ্রের মধ্যে তাবারী রচিত ‘দালায়েলুল ইমামাহ’ গ্রন্থটি তাঁর মুসনাদ সম্বলিত সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ। শিয়াদের সঙ্কলিত অন্যান্য মুসনাদগুলোর মধ্যে কয়েকটির নাম নিচে উল্লেখ করা হল:

  • আযিযুল্লাহ আতারুদী রচিত ‘মুসনাদে ফাতেমাতুয যাহরা
  • সাইয়েদ হোসাইন শাইখুল ইসলামী সঙ্কলিত ‘মুসনাদে ফাতেমা যাহরা’
  • মোহাম্মাদ দাশতি সঙ্কলিত ‘নাহজুল হায়াত’ (ফাতেমার বাণীসমগ্রের অভিধান)
  • মাহদী জাফারি রচিত ‘মুসনাদে ফাতেমা’

হযরত ফাতেমার মানাকিব ও ফযিলত বর্ণনায় রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • ‘মানাকিবু ফাতেমাতুয যাহরা ওয়া উলদিহা’ (মুহাম্মাদ বিন জারির তাবারী রচিত)
  • নাছের মাকারেম শিরাজি রচিত ‘ফাযায়েলে ফাতেমাতুয যাহরা’
  • মোহাম্মাদ ওয়াছেফ রচিত ‘ফাতেমা যাহরা আয নাযারে রেওয়ায়েতে আহলে সুন্নাত’

হযরত ফাতেমা সম্পর্কিত আহলে সুন্নাতের আলেমদের সঙ্কলিত মুসনাদসমূহের মধ্যে জাওহারী বাছরী সঙ্কলিত ‘আস সাকিফাহ ওয়া ফাদাক’, ইবনে উকদাহ জারুদি সঙ্কলিত ‘মান রাওয়া আন ফাতেমা মিন উলদিহা’, দারে কুতনী শাফেয়ী রচিত ‘মুসনাদে ফাতেমা’ এবং তাদের রচিত মানাকিব গ্রন্থগুলোর মধ্যে হাকিম নিশাপুরি রচিত ‘ফাযায়িলু ফাতিমাতিয যাহরা’, জারালুদ্দীন সুয়ূতী রচিত ‘আস সুগুরুল বাসিমাতি ফি ফাযায়িলিস সাইয়েদাতি ফাতিমাহ’, মুহাম্মাদ আলী মানাভী রচিত ‘ইতহাফিস সায়িল বিমা লি ফাতিমাতি মিনাল মানাকিব ওয়াল ফাযায়িল’।

জনাব আলী আকবার রাশাদের তত্ত্বাবধানে ‘ফাতেমা সম্পর্কিত বিশ্বকোষ’ (দানেশনামেয়ে ফাতেমা) রচিত হয়েছে। এ গ্রন্থসমগ্রে হযরত ফাতেমার জীবনী, মর্যাদা, তাঁর রেখে যাওয়া জ্ঞানগত ও আধ্যাত্মিক সম্পদসমূহ এবং ইসলামে নারী সম্পর্কিত বিধিবিধান (ফিকাহ), আইন-কানুন, নারী অধিকার, নারিদের পারিবারিক ও সামাজিক ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও পর্যালোচনা সঙ্কলিত হয়েছে। এ বিশ্বকোষটি ১৩৯৪ ফার্সি সালের (২০১৫ খ্রি.) দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রকাশিত বর্ষসেরা বই হিসাবে নির্বাচিত হয়।

নাট্য প্রদর্শনী

সাইয়্যেদ ফাদায়ী হোসাইন বনুয়ে বি নেশন (চিহ্নহীন মহিয়সী নারী) নামে একটি নাটকের পাণ্ডুলিপি লিখেছেন। মূলত এটি সাইয়্যেদ মাহদী শোজায়ী রচিত ‘কেশতি পাহলু গেরেফতেহ’ (নৌকা তীরে ভিড়েছে) বইয়ের নাট্যরূপ। এ নাটকটি ইরানের বিভিন্ন শহরে অসংখ্যবার মঞ্চায়িত হয়েছে।

মারকাযে তওলিদ ভা নাশরে ডিজিটালে ইনকিলাবে ইসলামী (মাতনা) প্রতিষ্ঠানের প্রযোজনায় ১৩৯৭ ফার্সি সালে (১৯১৮ খ্রি.) ‘বেহেশতী নারী’ শীর্ষক একটি এনিমেশন তৈরী ও প্রচারিত হয়েছে যাতে হযরত যাহরার (আ.) শাহাদাতের ঘটনাটি চিত্রায়িত হয়েছে।

তথ্যসূত্র


গ্রন্থপঞ্জি