ইমাম মাহদি আলাইহিস সালাম

wikishia থেকে

মুহাম্মাদ ইবনে হাসান (আলাইহিস সালাম); ইমাম মাহদি, ইমামে যামানা এবং হুজ্জাত ইবনিল হাসান নামে অধিক পরিচিত (জন্ম ২৫৫ হিজরী)। ১২ ইমামি শিয়াদের দ্বাদশ ও শেষ ইমাম। তাঁর ইমামতকাল ২৬০ হিজরীতে ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) শাহাদাতের পর থেকে শুরু হয়েছে এবং শেষ যুগে তাঁর আত্মপ্রকাশের পরও অব্যাহত থাকবে। শিয়া আকিদা অনুযায়ী তিনি হলেন ‘মাহদিয়ে মাওউদ’ (প্রতিশ্রুত মাহদি) যিনি দীর্ঘ সময় অন্তর্ধানে থাকার পর আত্মপ্রকাশ করবেন।

বিভিন্ন শিয়া সূত্রের বর্ণনার ভিত্তিতে একাদশ ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) সময় তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও তাঁর সন্তান মাহদির (আ.) সন্ধানে ছিল আব্বাসীয় প্রশাসন। এ কারণে ইমাম মাহদির (মহান আল্লাহ তার আবির্ভাবকে ত্বরান্বিত করুন) জন্মের ঘটনা গোপন রাখা হয় এবং ১১তম ইমামের কয়েকজন বিশেষ সাথী ছাড়া আর কেউ তাকে দেখেনি। ফলে ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) শাহাদাতের পর শিয়াদের অনেকে এ বিষয়ে সন্দেহের মুখে পড়ে এবং শিয়াদের মাঝে বেশ কয়েকটি উপদলের সৃষ্টি হয়। শিয়াদের একটি দল ইমামে যামানার (আ.) চাচা জাফার কাজ্জাবের অনুসরণ শুরু করে।

এমতাবস্থায় ইমামের (আ.) তাওকীয়াত (তাঁর চিঠি ও লেখনী বিশেষ) -যা সাধারণত শিয়াদেরকে সম্বোধন করে লেখা হত এবং তাঁর খাস নায়েবগণ (প্রতিনিধি) মারফত জনসাধারণের নিকট পৌঁছুত- শিয়া সমাজে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনে এবং ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) শাহাদাতের পর শিয়াদের মধ্যে যে সকল উপদলের সৃষ্টি হয়েছিল হিজরী চতুর্থ শতাব্দিতে সেগুলোর একটির অস্তিত্বও অবশিষ্ট ছিল না এবং একমাত্র শিয়া এসনা আশারীরাই অবশিষ্ট ছিল।

স্বীয় পিতার শাহাদাতের পর ইমামে মাহদির (আ.) স্বল্পকালীন অন্তর্ধান শুরু হয়। এ সময় তিনি তাঁর ৪ জন বিশেষ নায়েবের মাধ্যমে শিয়াদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। ৩২৯ হিজরীতে দীর্ঘ মেয়াদী অন্তর্ধান শুরু হওয়ার সাথে সাথে বিশেষ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাঁর (আ.) সাথে যোগাযোগের বিষয়টিরও সমাপ্তি ঘটে। শিয়াদের বিশ্বাস হল, ইমাম মাহদি (আ.) জীবিত আছেন এবং শেষ যামানায় তাঁর আবির্ভাব ঘটবে। তার দীর্ঘায়ূর সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি এবং এ সংশ্লিষ্ট খুঁটিনাটি বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা ও ব্যাখ্যা শিয়া মনীষীরা প্রদান করেছেন। আর হাদীসমূহে তাঁর অন্তর্ধানকে মেঘের আড়ালে থাকা সূর্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

শিয়া আকিদা অনুযায়ী দ্বাদশ ইমামের আবির্ভাব শেষ যামানায় ঘটবে এবং তিনি তাঁর সাথীদেরকে নিয়ে বিশ্ব ব্যাপী হুকুমত কায়েম করবেন। এ সময় অত্যাচার-অনাচারে পূর্ণ পৃথিবীকে তিনি ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায়বিচারে পূর্ণ করবেন। বিভিন্ন রেওয়ায়েতে তাঁর আগমনের অপেক্ষা করার জন্য মুসলমানদেরকে বিশেষভাগে তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। আর শিয়ারা এ রেওয়ায়েতগুলোকে ‘ইমাম মাহদির আত্মপ্রকাশের প্রতীক্ষা’ অর্থে জ্ঞান করে থাকে।

মাসুম ইমামগণ (আলাইহিমুস সালাম) থেকে বর্ণিত বিভিন্ন রেওয়ায়েতের উপর ভিত্তি করে শিয়া তাফসীরগুলোতে পবিত্র কুরআনের বেশ কিছু আয়াতে ইমাম মাহদির (আ.) প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের (আ.) থেকে বর্ণিত বহুসংখ্যক রেওয়ায়েতে ইমাম মাহদির (আ.) জীবনী, অন্তর্ধান, হুকুমত সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে এবং এ সকল রেওয়ায়েত বর্ণনার উদ্দেশ্যে বহুসংখ্যক হাদীস গ্রন্থও রচিত হয়েছে। হাদীস গ্রন্থ ছাড়াও ইমাম মাহদি (আ.) সম্পর্কে ইতিহাস ভিত্তিক এবং বিশ্লেষণধর্মী বহুসংখ্যক গ্রন্থও রচিত হয়েছে। আহলে সুন্নত তাদের বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মাহদি নামের এক ব্যক্তিকে শেষ যামানার ত্রাণকর্তা বলে মনে করে। তাদের বিশ্বাস তিনি হবেন মহানবির (সা.) বংশধর। এতদসত্ত্বেও তাদের অনেকের মতে তিনি শেষ যামানায় জন্মগ্রহণ করবেন। তবে সিবতে ইবনে জওযি ও ইবনে তালহা শাফিয়ীর মত অনেক সুন্নি মনীষীর আকিদা শিয়াদের মত; তারা মনে করেন প্রতিশ্রুত মাহদি হলেন ‘ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এরই সন্তান।

গায়বাত তথা অন্তর্ধানের যুগে ইমাম মাহদির (আ.) সাথে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন দোয়া ও যিকিরও বর্ণিত হয়েছে। যেমন: দোয়া আহ্দ, দোয়ায়ে নুদবাহ, যিয়ারতে আলে ইয়াসিন এবং নামাযে ইমামে যামানা। কিছু কিছু রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে গায়বাতের যুগেও ইমামে যামানার (আ.) সাক্ষাত লাভ করা সম্ভব এবং শিয়া মনীষীরা তাদের গ্রন্থসমূহে তাঁর (আ.) সাথে কারো কারো সাক্ষাতের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইমাম মাহদির (আ.) সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন স্থানও রয়েছে, যেমন; ইরাকের সামেররাতে অবস্থিত সেই বেইজমেন্ট যেখান থেকে তিনি গায়বাতে যান, কুফায় অবস্থিত মসজিদে সাহলা এবং ইরানের কোম শহরে অবস্থিত মসজিদে জামকারান

নাম, কুনিয়াত ও উপাধিসমূহ শিয়া সূত্রে বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহে ১২তম ইমামের বিভিন্ন নাম উল্লেখিত হয়েছে তম্মধ্যে মুহাম্মাদ, আহমাদ, আব্দুল্লাহ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অবশ্য তিনি শিয়াদের মাঝে মাহদি নামে অধিক পরিচিত যা তার উপাধিগুলোর অন্যতম।[১] বিভিন্ন হাদীসের ভিত্তিতে, মহানবি (সা.) এবং তিনি একই নামের অধিকারী।[২] আবার আল-কাফীকামালুদ্দীনসহ অন্যান্য গ্রন্থে তার নামের অক্ষরগুলো ((م ح م د)) (মু হা ম্ মা দ) আলাদা আলাদাভাবে লেখা হয়েছে।[৩] আর তাঁর নাম এভাবে লেখার কারণ হল বিভিন্ন হাদীসে তাঁর (আ.) নাম উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।[৪] নাম উচ্চারণে নিষেধাজ্ঞা বিভিন্ন শিয়া গ্রন্থে উল্লেখিত বহুসংখ্যক হাদীসের ভিত্তিতে দ্বাদশ ইমামের নাম উচ্চারণকে নিষিদ্ধ এবং হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।[৫] এ সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েত প্রসঙ্গে দু’ধরনের মতামত রয়েছে: প্রথম মতটি সাইয়্যিদ মুর্তাযা, ফাযিল মেকদাদ, মোহাক্কেক হিল্লি এবং আল্লামা হিল্লিসহ বেশ কয়েকজন আলেমের, তাদের মতে এ হারাম ও নিষিদ্ধ হওয়াটা শুধুমাত্র তাকাইয়্যাকালীন সময়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এর বিপরীতে দ্বিতীয় দলে রয়েছেন মীর দামাদমুহাদ্দেস নূরী; তাদের মতে ইমাম মাহদির (আ.) আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত সকল সময়ের জন্য এ হারাম প্রযোজ্য।[৬]

কুনিয়াত ও উপাধিসমূহ

বিভিন্ন দোয়া ও যিয়ারতসহ অন্যান্য সূত্রে শিয়াদের ১২তম ইমামের জন্য বিভিন্ন কুনিয়াউপাধি উল্লেখিত হয়েছে। মুহাদ্দিস নূরি তার নাজমুস সাকিব গ্রন্থে প্রায় ১৮২টি নাম ও লকবের (উপাধি) প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, [নোট ১] ইমাম মাহদির (আ. ফা.) নামের উপর রচিত গ্রন্থ ‘নাম নামায়ে হযরত মাহদি (আ.)’-তে প্রায় ৩১০টি নাম ও লকব উল্লেখিত হয়েছে। মুহাদ্দিস নূরির উল্লেখকৃত লকবগুলোর মধ্যে রয়েছে: মাহদি, কায়েম, বাকিয়াতুল্লাহ, মুনতাকিম, মাওউদ, সাহেবুয যামান, খাতামুল আওসিয়া, মুন্তাযার, হুজ্জাতুল্লাহ, মুন্তাকিম, আহমাদ, আবুল কাসেম, আবু সালেহ, খাতামুল আইম্মাহ, খালিফাতুল্লাহ, সালেহ, সাহিবুল আমর।[৭]

বিভিন্ন সুন্নি গ্রন্থেও শিয়াদের দ্বাদশ ইমামের নাম ও উপাধি উল্লেখিত হয়েছে। যদিও এ সকল গ্রন্থের বেশীরভাগেই ‘মাহদি’ নামটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং তাঁর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ও উপাধি কম উল্লেখিত হয়েছে। আর ‘কায়েম’ উপাধিটি সুন্নি গ্রন্থসমূহ অত্যন্ত বিরল।[৮]

পরিবার

ইমাম মাহদির (আ.) পিতা শিয়াদের ১১তম ইমাম হযরত হাসান আসকারী (আ.); যিনি স্বীয় পিতা ইমাম হাদি (আ.)-এর ওফাতের পর ২৫৪ হিজরী থেকে ২৬০ হিজরী পর্যন্ত ৬ বছর যাবত ইমামতের মহান দায়িত্ব পালন করেন।[৯]

ইমাম মাহদির (আ.) মায়ের বিভিন্ন নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধ নামগুলো হল; নারজিস, সুসান, ছাকীল, ছীকাল, হাদীসাহ ও হাকিমাহ।[১০] তাঁর জীবনবৃত্তান্ত ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ৪ ধরনের রেওয়ায়েত রয়েছে; প্রথমতঃ শেইখ সাদুক তার ‘কামালুদ্দীন ওয়া তামামুন নি’মাহ’ গ্রন্থে যে রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেছেন[১১] ঐ রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে তিনি ছিলেন রোমের শাহযাদি। দ্বিতীয়তঃ, তার জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে কোন কিছু উল্লেখ না করে শুধুমাত্র ইমামে যামানার মা ইমাম জাওয়াদের কন্যা হাকিমাহ’র বাড়ীতে বেড়ে ওঠা ও প্রশিক্ষিত হওয়ার বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।[১২] তৃতীয়ঃ মাসউদি তার ইসবাতুল ওয়াছিয়াহ[১৩] গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, ইমাম মাহদির মা একাদশ ইমামের ফুপির বাড়িতে শুধু বড়ই হননি বরং তাঁর জন্ম সেখানেই। চতুর্থ ক্যাটাগরির রেওয়ায়েতগুলোর উল্লেখিত ৩ ধরনের রেওয়ায়েতের সাথে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এতে বলা হয়েছে ইমামে যামানার (আ. ফা.) মা ছিলেন কাফ্রী দাসী।[১৪] উপরোক্ত ৪ ধরনের রেওয়ায়েতের বিশেষত চতুর্থ ক্যাটাগরির রেওয়ায়েতের কিছু কিছু রেওয়ায়েত পরস্পর সাংঘর্ষিক ও পাশাপাশি স্থান দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্যই আল্লামা মাজলিসি বলেছেন, চতুর্থ ক্যাটগরির রেওয়ায়েতগুলোর অনেকটাই পরস্পর বিরোধী, তবে একটি বিষয় রয়েছে যে, ঐ রেওয়ায়েতগুলোকে যদি ইমামে যামানার প্রকৃত মা সম্পর্ক নয় বরং তাকে দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা কারো সম্পর্কে বলে ধরা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে আর কোন সমস্যা থাকে না।[১৫]

ইমাম হাসান আসকারির (আ.) মাতা ও ইমাম মাহদির (আ.) দাদী বিভিন্ন রেওয়ায়েতে যার নাম ‘জাদ্দাহ’ বলে উল্লেখিত হয়েছে। গায়বাতে সোগরার যুগে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখিত হয়েছে। ইমাম হাসান আসকারির (আ.) শাহাদাতের পর শিয়াদের বিষয়াদির বেশীরভাগ বিষয়াদি তার উপর অর্পিত হয়েছিল।[১৬] এছাড়া ইমাম জাওয়াদের কন্যা ও ইমাম হাসান আসকারির (আ.) ফুপু হাকিমাহ, যিনি ৪ জন ইমামের ইমামতকাল উপলব্ধি করেছেন এবং শিয়া বিভিন্ন গ্রন্থের সাক্ষ্যানুযায়ী তিনি ইমাম মাহদির (আ.) জন্মের সাক্ষী এবং জন্ম সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েত বর্ণনাকারী; ইমাম মাহদির (আ.) মাতা তার গৃহেই তরবিয়্যত ও বড় হয়েছেন এবং ইমাম মাহদির (আ.) বেলাদাত ও জন্ম সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতের একটি বিরাট অংশ তার থেকে বর্ণিত হয়েছে।[১৭]

ইমাম মাহদির (আ.) চাচা জাফার ইবনে আলী, ইমাম হাসান আসকারির (আ.) ওফাতের পর ইমামতের দাবী করে বসে, আর এ কারণেই তাকে জাফার কাজ্জাব বলা হয়। বিভিন্ন বর্ণনায় তাকে পাপাচারী ও কবিরা গুনাহের অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[১৮] জাফার ইমামতের মিথ্যা দাবী এবং ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) উত্তরসূরীর অস্তিত্বের বিষয়টি অস্বীকার করা ছাড়াও তৎকালীন শাসক গোষ্ঠিকে দ্বাদশ ইমামের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছিল।[১৯] কিছু কিছু সূত্রের ভাষ্যানুযায়ী সে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের দাবীতে অটল ছিল এবং নিজেকে ইমাম বলে মনে করত। কিছু কিছু সূত্র লিখেছে, সে নিজের দাবী থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে তওবা করেছিল, আর তাই শিয়ারা তাকে জাফার কাজ্জাবের স্থলে জাফার তাওওয়াব নামে ডাকত। সে ৪৫ বছর বয়সে ইরাকের সামেররাতে মৃত্যুবরণ করে।[২০]

শিয়া ও সুন্নি বিভিন্ন সূত্রে ইমাম মাহদিকে (আ.) ইমাম হাসান আসকারির (আ.) একমাত্র সন্তান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[২১] অবশ্য অপর এক মত অনুযায়ী তাঁর আরও ২ জন ভাই এবং ৩ জন বোনও ছিল।[২২]

জন্মের সময় ও স্থানের বিষয়ে অস্পষ্টতা

সময়: ২৫৫ হিজরীর শাবান মাসের মাঝামাঝি সময়ে, এবং অন্যান্য মতামত

শিয়াদের দ্বাদশ ইমামের জন্মের বছর নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে; প্রাচীন কিছু কিছু গ্রন্থে তার জন্মের তারিখের বিষয়ে কোন তথ্য না দিয়ে তা গোপন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[২৩] কিন্তু শিয়াদের বহুসংখ্যক এবং সুন্নিদের কিছু কিছু বর্ণনায় শিয়াদের দ্বাদশ ইমামের জন্মের বছর ২৫৫ [২৪] অথবা ২৫৬[২৫] হিজরী বলে উল্লেখিত হয়েছে। এই অস্পষ্টতা তার জন্মের মাসের বেলায়ও রয়েছে। কিন্তু প্রসিদ্ধ মত হল তিনি শাবান মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং শিয়াদের পুরাতন গ্রন্থাদির বেশীরভাগে এ মতকে সমর্থন করা হয়েছে। [২৬] অবশ্য কিছু কিছু শিয়া ও সুন্নি সূত্রে তাঁর জন্মের মাস হিসেবে রমযান, রবিউল আওয়াল বা রবিউস সানীর নাম উল্লেখিত হয়েছে।[২৮]

তাঁর জন্মের তারিখের বিষয়েও বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে, তবে এগুলোর মধ্যে নিমে শাবানের (শাবান মাসের মাঝখানের দিন তথা ১৫ শাবান) তারিখটি অধিক প্রসিদ্ধ।[২৯] শিয়া মনীষীদের মাঝে কুলাইনি, মাসউদি, শেইখ সাদুক, শেইখ মুফিদ, শেইখ তুসি, আমিনুল ইসলাম তাবারসী, ইবনে তাউস, আল্লামা হিল্লি, শাহীদে আওওয়াল, শেইখ বাহায়ী এবং সুন্নি মনীষীদের মাঝে ইবনে খাল্লেকান, ইবনে সাব্বাগ মালেকি, শা’রানি হানাফি ও ইবনে তুলুন এ মতটি উল্লেখ করেছেন।

জন্মের স্থান এবং এর গোপন থাকা

এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকদের ঐকমত্য রয়েছে যে, ইমাম মাহদি (আ.) সামেররাতে তাঁর পিতা ইমাম হাসান আসকারির (আ.) বাড়ীতেই জন্মগ্রহণ করেন;[৩০] বর্তমানে যেখানে ইমাম হাদী (আ.) ও ইমাম হাসান আসকারির (আ.) মাজার অবস্থিত।[৩১] ইতিহাসের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ইমামে যামানার (আ.) জন্মের বহুবছর আগে ইমাম হাদী ও ইমাম আসকারিকে (আলাইহিমাস সালাম) তৎকালীন আব্বাসী খেলাফতের দারুল হুকুমত সামেরাতে ডেকে পাঠানো হয়।[৩২] এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁরা সামেরাতেই ছিলেন।[৩৩] শেইখ মুফিদের মতে, আব্বাসীয় খলিফা এ বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়েছিল যে, শিয়ারা তাঁর আগমনের অপেক্ষায় রয়েছে, তাই তারা কঠোরভাবে ইমাম মাহদিকে (আ.) খুঁজতে থাকে, আর এ কারণেই ইমাম আসকারি (আ.) নিজ সন্তানের জন্মের সংবাদ গোপন রেখেছিলেন।[৩৪] শেইখ তুসি ও শেইখ মুফিদ মারফত বর্ণিত বিভিন্ন রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে ইমাম জাওয়াদের (আ.) কন্যা হযরত হাকিমা ও ইমাম আসকারির (আ.) ২ জন কানিয ইমাম মাহদির (আ.) জন্মের সাক্ষী ছিলেন।[৩৫] শেইখ মুফিদের ভাষ্যের ভিত্তিতে শিয়াদের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং ইমাম হাসান আসকারির (আ.) বিশ্বস্ত লোকও শিশু অবস্থায় ইমাম মাহদিকে (আ.) দেখেছেন, তাদের মাঝে উসমান ইবনে সাঈদ এবং তার পুত্র মুহাম্মাদ বিন উসমানের[৩৬] নাম উল্লেখযোগ্য।

আহলে সুন্নতের কিছু কিছু গ্রন্থে ইমাম হাসান আসকারির সন্তানের (আ.) জন্মের বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে; তারিখে ইবনে আসীর (মৃত্যু ৬৩০ হি.), [৩৭] ইবনে খাল্লেকান (মৃত্যু ৬৮১ হি.) রচিত ‘ওয়াফিয়াতুল আইয়ান’,[৩৯] ইবনে তালহা শাফেয়ী (মৃত্যু ৬৫২ হি.) রচিত মাতালেবুস সুউল, ইবনে সাব্বাগ মালেকি (মৃত্যু ৮৫৫ হি.) রচিত আল-ফুসুলুল মুহিম্মাহ গ্রন্থে ইমাম হাসান আসকারির (আ.) সন্তানের প্রতিশ্রুত মাহদি হওয়া প্রসঙ্গে বিভিন্ন রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন।[৪০]

১৫ শাবানের উদযাপন

শাবান মাসের মাঝের দিন (১৫ শাবান) -যা প্রসিদ্ধ মতের ভিত্তিতে ইমাম মাহদির (আ.) জন্মদিন[৪১]- শিয়াদের গুরুত্বপূর্ণ ঈদ ও আনন্দের দিনগুলির একটি। তারা ঐ রাত এবং দিনে বিভিন্ন আনন্দ মাহফিলের আয়োজন, লাইটিং, কুরবানি প্রদান, দুস্থ ও অসহায়দের মাঝে খাদ্য বিতরণ করে থাকে।[৪২] ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে এ উপলক্ষ ‘মাহদাভিয়্যাত দশক’ শিরোনামে কয়েকদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ সকল আয়োজনের একটি বড় অংশ মসজিদ, বিভিন্ন ধর্মীয় কেন্দ্র, ইমামবাড়ি, পাড়া-মহল্লা ও বাজারে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ইমাম মাহদির (আ.) জন্মদিনকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় আয়োজনগুলোর একটি হয়ে থাকে ইরানের কোম শহরের অদূরে অবস্থিত ঐতিহাসিক জামকারান মসজিদকে কেন্দ্র করে। দিবসটিতে ইরানে সরকারিভাবে ছুটি থাকে এবং দিনটি ‘বিশ্ব মুস্তাদআফ (নিগৃহীত) দিবস’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। ইরাকের শিয়ারা ১৫ই শাবানের মাহফিলে অংশগ্রহণ ছাড়াও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর যিয়ারতে যায়, বাহরাইন, ইয়েমেন, মিসর, লেবানন, সিরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানবাংলাদেশের শিয়ারাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিয়ারা ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে থাকে।[৪৪]

ইমাম মাহদির (আ.) আয়ু

শিয়া আকিদা অনুযায়ী ইমামে যামানা (আ. ফা.) ২৫৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছেন,[৪৫] তিনি বর্তমানে জীবিত এবং শেষ যামানায় হযরত ঈসা ইবনে মারিয়ামকে সাথে নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবেন।[৪৬] এত দীর্ঘ আয়ুর অধিকারী হওয়া প্রসঙ্গে উত্থাপিত প্রশ্নের বিভিন্ন উত্তর শিয়া আলেমগণ প্রদান করেছেন। এছাড়া মানুষের দীর্ঘায়ুর অধিকারী হওয়া সম্ভব হওয়ার বিষয়টি বিজ্ঞান এবং বাস্তবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছেন।[৪৭]

বিশিষ্ট শিয়া ফকীহ ও মুহাদ্দেস শেইখ সাদুক তার কামালুদ্দীন ওয়া তামামুন নি’মাহ গ্রন্থের একটি অধ্যায় ঐ সকল ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করেছেন যারা দীর্ঘায়ুর অধিকারী ছিলেন।[৪৮] এছাড়া বিশিষ্ট শিয়া মারজা লুতফুল্লাহ সাফী গুলপায়গানি প্রমাণ হিসেবে এ সম্পর্কে জীববিজ্ঞানীদের ভাষ্যও উল্লেখ করেছেন, জীববিজ্ঞানীদের মতামতের ভিত্তিতে মানুষ আটশ বা হাজার বছরও বাঁচতে পারে।[৪৯] পবিত্র কুরআন ও রেওয়ায়েতেও দীর্ঘায়ুর অধিকারী অনেক মানুষের কথা উল্লেখিত হয়েছে, যেমন; হযরত নূহ (আ.) জনগণকে ৯৫০ বছর মহান আল্লাহর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দিয়েছিলেন।[৫০] ইমাম সাজ্জাদ (আ.) থেকে বর্ণিত এক রেওয়ায়েতে এসেছে যে, ইমাম মাহদি যে সকল সুন্নত নবিগণ (আলাইহিমুস সালাম) থেকে লাভ করবেন তম্মধ্যে হযরত আদম ও হযরত নূহের (আলাইহিমাস সালাম) দীর্ঘায়ু অন্যতম।[৫১] তাঁর ওফাত বা শাহাদাত কিভাবে ঘটবে সে সম্পর্কে কোন রেওয়ায়েত বর্ণিত হয় নি।[৫২]

বসবাসের স্থান

জন্ম ও অন্তর্ধানের আগে বসবাসের স্থান

ইমাম মাহদি (আ. ফা.) জন্মের পর থেকে গায়বাতে সোগরার (স্বল্প মেয়াদী অন্তর্ধান) আগ পর্যন্ত জন্মস্থান সামেররাতেই থাকতেন। এ সময় পিতা ইমাম হাসান আসকারির (আ.) বাড়ীর বেইজমেন্ট ছিল তার থাকা ও ইবাদতের স্থান। এছাড়া বিভিন্ন বর্ণনা থেকেও এটা প্রমাণিত যে, পিতার জীবদ্দশায় বহুবার তাঁকে ঐ স্থানে দেখা গেছে।[৫৩] জাসেম হুসাইনের মতে তিনি স্বীয় পিতার জীবনের শেষ বছরগুলোতে পিতার সাথে হজ্জে অংশগ্রহণ করেছেন, অতঃপর তিনি মদিনাতে আত্মগোপন করেন।[৫৪] অবশ্য শিয়া সূত্রগুলির বর্ণনার সাথে এ মতের খুব একটা সামঞ্জস্যতা নেই।[৫৫]

গায়বাতের যুগে তার বসবাসের স্থান

গায়বাতের যুগে তাঁর বসবাসের স্থান অজ্ঞাত বলে কিছু কিছু বর্ণনায় ইঙ্গিত করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও অপর কিছু রেওয়ায়েতে তার বসবাসের স্থানের আলোচনায় ‘যী তুবা’,[৫৬] ‘কুহে রাযাভি’[৫৭] ও তাইয়্যিবার (মদিনা)[৫৮] নাম অন্তর্ধানের যুগে তার বসবাসের স্থান হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। একটি ঘটনার উপর ভিত্তি করে কিছু কিছু সূত্র ‘জাযিরাতুল খাযরা’র (সবুজ দ্বীপ) নাম দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধানের সময় ইমাম যামানার (আ. ফা.) অবস্থান ও বসবাসের স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[৫৯] যদিও শিয়া মনীষীরা এ মতের বিষয়ে কঠোর সন্দেহ পোষণ করেছেন এবং এ অভিমতের সমালোচনায় গ্রন্থও রচিত হয়েছে।[৬০]

আবির্ভাবের স্থান, উত্থান, হুকুমত ও জীবন-যাপন

যুহুর তথা আবির্ভাব পরবর্তি সময়ে তিনি কোথায় বসবাস করবেন সে বিষয়ে নিশ্চিত কোন তথ্য নেই। একটি রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে ‘যী-তুওয়া’ নামক স্থানে তার আবির্ভাব ঘটবে। অতঃপর ৩১৩ জন সাথী সমেত তিনি মক্কায় যাবেন এবং হাজারুল আসওয়াদে হেলান দিয়ে নিজের পতাকা উড্ডয়ন করবে।[৬১] এই রেওয়ায়েত এবং অপর কিছু রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে[৬২] ইমাম মাহদির (আ.) কিয়ামের (সংগ্রাম) সূচনা হবে মসজিদুল হারাম থেকে এবং তাঁর সাথীরা রুকনে হাজারুল আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিমের মাঝে তাঁর হাতে বাইয়াত করবেন।[৬৩] অপর কিছু রেওয়ায়েতে ‘তাহামাহ’ (আরব উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত একটি এলাকা) থেকে ইমাম মাহদির (আ.) কিয়ামের সূচনা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৬৪] আরব উপদ্বীপেরই অংশ মক্কাকেও তাহামাহ’ বলা হয়। আবার কিছু কিছু রেওয়ায়েতে তার দারুল খেলাফাহ হিসেবে কুফা শহর,[৬৫] বিচারকার্য পরিচালনার জন্য মসজিদে কুফা[৬৬] এবং জীবন-যাপনএবং তাঁর কিয়ামের পর বাইতুল মাল বন্টনের[৬৮] স্থান হিসেবে মসজিদে সাহলার[৬৭] নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

ইমামে যামানার (আ.) সাথে সম্পৃক্ত স্থানসমূহ

বিভিন্ন স্থানকে ইমামে যামানার (আ.) সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, বলা হয়েছে যে, শিয়ারা গায়বাতে কোবরার সময় তাঁর সাথে যোগাযোগের জন্য ঐ সকল স্থানে উপস্থিত হবে:

সারদাবে গায়বাত: ইমাম হাদি (আ.), ইমাম আসকারি (আ.) ও ইমামে যামানার (আ.) ইবাদতের স্থান। (ইমাম হাসান আসকারির (আ.) বাড়ীর যে বেইজমেন্ট থেকে তিনি অন্তর্ধানে যান)।

জামকারান মসজিদ: ইরানের কোম শহরের অদূরে অবস্থিত জামকারান নামক গ্রামের পাশে অবস্থিত একটি মসজিদ। প্রসিদ্ধি রয়েছে যে, স্বয়ং ইমাম মাহদির (আ.) নির্দেশে ‘হাসান বিন মুসলাহ’ জামকারান মসজিদটি নির্মাণ করেন।

সাহলাহ মসজিদ: এ মসজিদের একটি মাকাম (স্থান) ইমামে যামানার (আ.) সাথে সম্পৃক্ত; যা মসজিদের মাঝামাঝি স্থানে মাকামে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ও নবি হযরত ইউনুসের (আ.) মাকামের মাঝে অবস্থিত। কিছু কিছু রেওয়ায়েতে আবির্ভাবের পর এটাই হবে তাঁর বসবাসের স্থান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৬৯]

‘যী-তুওয়া’: মক্কায় অবস্থিত একটি স্থান যা মক্কি হারামের অভ্যন্তরে অবস্থিত এবং কিছু কিছু রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে ইমাম মাহদি (আ.) ঐ স্থানে জীবন-যাপন করবেন। আবার কিছু কিছু বর্ণনায় আবির্ভাব ও সাথীদের সমবেত হওয়ার স্থান হিসেবেও ঐ স্থানের নাম উল্লেখিত হয়েছে। এক বর্ণনার ভিত্তিতে কা’বার পাশ থেকে নিজের উত্থান শুরু করার আগে তিনি এ স্থানে ৩১৩ জন সাথীর জন্য অপেক্ষা করছেন।[৭০]

কুহে রাযাভি: গায়বাতের সময়ে তার অবস্থানের স্থান হিসেবে কিছু কিছু বর্ণনায় কুহে রাযাভির কথা উল্লেখ হয়েছে।[৭১] ‘রাযাভি’ পাহাড়টি মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী তাহামা’র পাহাড়গুলোর একটি।[সূত্র]

ওয়াদিউস সালাম: ওয়াদিউস সালাম কবরস্থানে ইমামে যামানার (আ.) মাকামের স্থানে একটি গুম্বুজ ও বারগাহ রয়েছে যা ১৩১০ হিজরীতে ভারতীয় রাজা সৈয়দ মুহাম্মাদ খান কর্তৃক নির্মিত। পূর্বের স্থাপনাটি বাহরুল উলুম (মৃত্যু ১২১২ হি.) কর্তৃক পূণঃসংস্কার করা হয়। ইমাম মাহদির (আ.) মাকামের মেহরাবে একটি পাথরের ফলক রয়েছে যাতে একটি যিয়ারতনামা খোদাই করা হয়েছে। পাথরটির খোদাইয়ের তারিখ ১২০০ হিজরীর ৯ই শাবান।

খাযরা দ্বীপ: ইমামে যামানার (আ. ফা.) সাথে সম্পৃক্ত একটি স্থান; কিছু কিছু বর্ণনার ভিত্তিতে তাঁর সন্তানগণ ওখানেই বাস করেন। এই দ্বীপের ঘটনা কিছু কিছু সূত্রে উল্লেখিত হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে দু’ধরণের মত রয়েছে; কেউ কেউ বিষয়টিকে গ্রহণ করেছেন এবং কেউ কেউ এটাকে কল্পকাহিনী বলে আখ্যা দিয়েছেন, এর সমালোচনায় গ্রন্থও রচিত হয়েছে।[৭২]

তাইয়্যিবাহ: বিভিন্ন রেওয়ায়েতে গায়বাত তথা অন্তর্ধানকালীন সময়ে ইমামে যামানার (আ.) বসবাসের যে সকল স্থানের নাম উল্লেখ হয়েছে সেগুলোর অন্যতম। বলা হয়েছে যে, এখানে তাইয়্যিবাহ বলতে মদিনাকে বোঝানো হয়েছে।[৭৩]

কারবালায় ইমাম মাহদির (আ.) মাকাম: ইমাম হুসাইনের (আ.) মাজারের অদূরে আলকামা নামক ছোট নদের পাশে অবস্থিত। নামায আদায় ও দোয়ার জন্য মানুষ সেখানে সমবেত হয়।[৭৪]

ইমামতের সময়কাল

ইমাম মাহদির (আ.) ইমামতকাল ২৬০ হিজরীতে ইমাম হাসান আসকারীর (আ.) শাহাদাতের পর থেকে শুরু হয়েছে[৭৫] এবং শেষ যুগে তাঁর আত্মপ্রকাশের পরও অব্যাহত থাকবে।

ইমাম মাহদির (আ.) ইমামতের প্রমাণাদি

ইমাম মাহদির (আ.) ইমামত প্রমাণে শিয়া মনীষীগণ বিভিন্ন দলীল ও যুক্তি পেশ করেছেন যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলীলগুলো হল বর্ণনা ভিত্তিক। অর্থাৎ মহানবি হযরত মুহাম্মদের (সা.) নবুয়্যত এবং পবিত্র কুরআনের আসমানি গ্রন্থ হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করার পর পবিত্র কুরআনের আয়াত ও মহানবির (স) হাদীস থেকে উপকৃত হয়ে হযরত আলী থেকে ইমাম মাহদি (আ.) পর্যন্ত সকল ইমামের ইমামত প্রমাণ করা হয়েছে। এ দলীলগুলোর কিছু কিছু সার্বিক ও সাধারণ (আম) যেগুলো সর্বযুগে ইমামের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি প্রমাণ করে, আর কিছু দলীল হল খাস ও নির্দিষ্ট এবং নির্দিষ্ট ব্যক্তির ইমামতের প্রমাণ স্বরূপ।

আল্লামা মাজলিসি বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থের ‘আবওয়াবুন নুসুস মিনাল্লাহি তাআলা ওয়া মিন আবাইহি আলাইহ (সালাওয়াতুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈন)’ শীর্ষক অধ্যায়ে মহানবি (সা.) ও অপর আইম্মাহগণ (আ.) হতে ১৫৩টি হাদীস উল্লেখ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ মহানবি (সা.) থেকে ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন: ‘আমার পর আমার ওয়াছি (ওয়াছিয়ত বাস্তবায়নকারী), জানশীন, স্থলাভিষিক্ত ও আল্লাহর হুজ্জাতগণের সংখ্যা হল ১২ জন। তাদের প্রথমজন হল আমার ভাই এবং শেষজন হল আমার সন্তান। লোকেরা বলল: আপনার ভাই কে? তিনি (সা.) বললেন: আলী ইবনে আবি তালিব। জিজ্ঞাসা করলো: আপনার সন্তান কে? তিনি (সা.) উত্তরে বললেন: মাহদি, যে পৃথিবীকে ন্যায়-নিষ্ঠায় পূর্ণ করবে।[৭৬]

এছাড়া ইমাম মাহদির (আ.) ইমামত প্রমাণে অপর যে সকল দলীল প্রণয়ন করা যায় সেগুলো মধ্যে রয়েছে-

ইমামত অব্যাহত থাকা সংশ্লিষ্ট হাদীস: পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত রেওয়ায়েতসমূহ যেমন- সূরা রাআদের ৭নং আয়াত ((إنَّما أنتَ مُنْذِرٌ و لِكُلِّ قَومٍ هادٍ)) ‘তুমি তো একজন সতর্ককারী মাত্র, এবং প্রত্যেক জাতির জন্যে একজন পথপ্রদর্শক।’ এবং সূরা ফাতিরের ২৪নং আয়াত ((إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِیرًا وَنَذِیرًا وَإِن مِّنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِیهَا نَذِیرٌ)) ‘আমি তোমাকে সত্যসহ পাঠিয়েছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। এমন কোন সম্প্রদায় নেই যাতে সতর্ককারী আসেনি।’ ইত্যাদি। আল্লাহ রাসূল (সা.) বলেছেন: ((أنا المُنذِر و علیّ الهادی، وَ كُلُّ اِمامٍ هادٍ لِلقرنِ الّذی هو فیه)) ‘আমি হলাম ভীতি প্রদর্শনকারী এবং আলী হল পথপ্রদর্শক, আর প্রত্যেক ইমামই নিজের যুগের পথপ্রদর্শক’,[বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৩৫, পৃ. ৪০৪, হাদীস নং ২২।] ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন: ((لَو لَم‌یكُنْ فی الأرضِ إلّا إثنانِ لَکانَ الاِمامُ أحدَهُما)) ‘পৃথিবীতে যদি ২ জনের বেশী আর কেউ অবশিষ্ট না থাকে তবে তাদের একজন হবেন ইমাম।’ [কাফী, খণ্ড ১, পৃ. ১৮০।]

হাদীসে সাকালাইন:[৭৭] হাদীসটি শিয়া ও সুন্নি উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য। শিয়াদের আকিদা অনুযায়ী যদি মহানবির (সা.) আহলে বাইতের সিলসিলা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত না থাকে তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে আঁকড়ে ধরার উপদেশ হবে অর্থহীন ও বৃথা। ১২ খলিফার হাদীস[৭৮]; যা শিয়া ও সুন্নি উভয় সূত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং উভয়ের নিকটই গ্রহণযোগ্য।[৮৬]

জাহিলিয়্যাতের মৃত্যুর হাদীস: শিয়া ও সুন্নি উভয়ের নিকটই হাদীসটি গ্রহণযোগ্য। আল্লাহর রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত ((مَنْ مَاتَ وَ لَمْ یعْرِفْ إِمَامَ زَمَانِهِ مَاتَ مِیتَةً جَاهِلِیةً.)) ‘যে নিজের যুগের ইমামকে না চিনে মৃত্যুবরণ করবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়্যাতের মৃত্যু’।[বিহারুল আনওয়ার, বৈরুতে প্রকাশিত, খণ্ড ৩২, পৃ. ৩৩১।] আর একই বিষয়বস্তুতে ৩৬টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[৭৯]

ইমাম আসকারির (আ.) শাহাদাতের পর শিয়াদের অবস্থা

১১তম ইমামের শাহাদাতের পর পরবর্তী ইমামের সাথে পরিচিত না থাকায় শিয়াদের অবস্থা ছিল বিশৃঙ্খল। বিভিন্ন বর্ণনার ভিত্তিতে ইরাক ও মেসোপটেমিয়ার (বাইনুন নাহরাইন) অঞ্চলের অনেক শিয়া দিশেহারা হয়ে পড়ে।[8০] শিয়ারা একাদশ ইমামের সন্তানের অস্তিত্বের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে জনৈক ব্যক্তিকে মদিনায় পাঠায়। কারণ তারা শুনেছিল যে, ইমাম হাসান আসকারি (আ.) স্বীয় পুত্রকে মদিনায় প্রেরণ করেছেন।[৮১] আরও বর্ণিত আছে যে, স্বল্পমেয়াদি অন্তর্ধানের সময়কার বিশিষ্ট আলেম আহমদ ইবনে সাহল বালখী নিজের ইমামের সন্ধানে খোরাসান থেকে ইরাক গিয়েছিলেন এবং সেখানে ইমামের খোঁজে বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত করেন।[৮২]

ইমাম আসকারীর (আ.) বাড়িতেও ছিল বিভক্তি। কারণ ইমাম আসকারীর মা হুদাইস এবং তাঁর ফুপু হাকিমা ইমাম আসকারীর (আ.) সন্তানের ইমামতকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন, পক্ষান্তরে ইমাম আসকারীর (আ.) একমাত্র বোন জাফারকে।[৮৩] নেতৃত্ব বিপর্যয় এ সময় এতটা প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে, ইমামি শিয়াদের একটি দল স্বীয় মাযহাব ত্যাগ করে বিভিন্ন শিয়া ও অশিয়া ফির্কার অনুসরণ শুরু করে। [৮৪] আরেকটি দল ইমাম আসকারীর মৃত্যুকে না মেনে তাকে মাহদি (আ.) বলে বিশ্বাস পোষণ করা শুরু করে। অপর একটি দল ইমাম হাদীর (আ.) পুত্র সাইয়্যিদ মুহাম্মদকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে নেয় এবং ইমাম মাহদির (আ.) ইমামতকে অস্বীকার করে। [৮৫] শিয়াদের আরেকটি অংশ জাফারকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।[৮৬]

উল্লিখিত মতবিরোধ সত্ত্বেও, অবশেষে শিয়াদের অধিকাংশই ইমাম হাসান আসকারির (আ.) পুত্রের ইমামতকে গ্রহণ করে নেয়। পরবর্তীতে এই শিয়ারাই ইমামি শিয়াদের মূল নেতৃত্ব হাতে তুলে নেয় এবং হিজরী চতুর্থ শতাব্দিতে শুধু এসনা আশারি শিয়া হিসেবে অবশিষ্ট থাকেন।[৮৭] ফিরাকুশ শিয়া গ্রন্থের প্রণেতা হাসান ইবনে মুসা নৌবাখতি থেকে একটি ঘটনা বর্ণনার পর শেইখ মুফিদ ইমাম হাসান আসকারির (আ.) ওফাতের পর যে চৌদ্দটি ফির্কার উদ্ভব হয়েছিল সে সম্পর্কে বলেছেন: "যে উপদলগুলোর কথা উল্লেখ করেছি তাদের মধ্যে আমাদের সময়ে ৩৭৩ হিজরিতে, বারো ইমামি ছাড়া অন্য কোন ফির্কাহ অবশিষ্ট নেই। অর্থাৎ যারা (বারো ইমামি) হাসানের [আসকারি] পুত্রের ইমামতকে গ্রহণ করেছে যাকে আল্লাহর রাসূলের (সা.) নামে ডাকা হয়, এবং তলোয়ারসহ উত্থান ও আন্দোলনের দিন পর্যন্ত তাঁর জীবন ও বেঁচে থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত আকিদা পোষণ করে।[৮৮]

স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে তাওকীয়াতের ভূমিকা

ইমাম হাসান আসকারির (আ.) ওফাত এবং দ্বাদশ ইমাম মাহদির (আ.) ইমামতের সূচনার পর বিভিন্ন ‘তাওকী’ (চিঠি বিশেষ) জনগণের নিকট পৌঁছেছে যার কিছু সংখ্যক ছিল তাঁর ইমামতের বিষয়টি প্রমাণ সম্পর্কিত। ঐ তাওকীগুলোতে যে সকল যুক্তি-দলীল তিনি (আ.) নিজের ইমামতের সপক্ষে প্রণয়ন করেছেন, তাতে হযরত আদম (আ.) থেকে ইমাম হাসান আসকারির (আ.) সময় পর্যন্ত ঐশী হেদায়েতের রাস্তা অব্যাহত থাকা এবং পৃথিবী আল্লাহর হুজ্জত শূন্য না হওয়ার বিষয়ে তাগিদ প্রদান করা হয়েছে।[৮৯] এছাড়া তিনি ইমামতের দাবীদ্বারদের মধ্য থেকে প্রকৃত ইমামকে চেনার ক্ষেত্রে ৩টি মানদণ্ড দেখিয়ে দিয়েছেন: ইসমাত (নিষ্পাপত্ব), জ্ঞান ও মহান আল্লাহ কর্তৃক সত্যায়ন।[৯০] ইবনে আবি গানেম কাযভিনী এবং শিয়াদের একটি দল কর্তৃক ইমাম হাসান আসকারির (আ.) স্থলাভিষিক্ত ও জানশীন প্রসঙ্গে করা করার প্রশ্নের জবাবে দ্বাদশ ইমাম কর্তৃক প্ররিত বিশেষ উত্তর (তাওকী)[৯১]সহ মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহিম মাহযিয়ারের উদ্দেশ্যে প্রেরিত তাওকী, শিয়াদের উদ্দেশ্যে ইমাম মাহদির (আ.) পাঠানো তাওকীগুলোর অন্যতম।[৯২]

গায়বাতে সোগরা

আল-ইরশাদ[৯৩] গ্রন্থে শেইখ মুফিদের (মৃত্যু ৪১৩ হি.) ভাষ্য অনুযায়ী, আ’লামুল ওয়ারা[৯৪] গ্রন্থে তাবারসির (মৃত্যু ৫৪৮ হি.) ভাষ্য অনুযায়ী, ২৫৫ হিজরীতে ইমামে যামানার জন্মের পর থেকেই গায়বাতে সোগরা তথা স্বল্প মেয়াদী অন্তর্ধানের সময় শুরু হয়। এরই ভিত্তিতে এ গায়বাতের মেয়াদ ছিল ৭৪ বছর। কিন্তু তারিখুল গাইবাতিস সোগরা গ্রন্থে সাইয়্যিদ মুহাম্মাদ সাদরের মতে ২৬০ হিজরীতে ইমাম হাসান আসকারির (আ.) শাহাদাতের পর থেকে গায়বাতের সোগরার সূচনা হয়, এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প মেয়াদি অন্তর্ধানের স্থায়িত্ব ছিল ৬৯ বছর।[৯৫]

গায়বাতে সোগরার সময় তিনি নিজের ৪ জন নায়েব ও প্রতিনিধি উসমান বিন সাঈদ, মুহাম্মাদ বিন উসমান, হুসাইন বিন রুহ নৌবাখতি ও আলী ইবনে মুহাম্মাদ সামুরি মাধ্যমে শিয়াদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদের বিষয়াদির দেখভাল ও সমাধান করতেন। আকিদাগত ও ফিকহী বিষয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়াদিও এর শামিল ছিল।[৯৬] গায়বাতে সোগরার সময়ে আহমাদ ইবনে হিলাল কারাখি, মুহাম্মাদ ইবনে নুসাইর নুমাইরিমুহাম্মাদ ইবনে আলী শালমাগানী তাঁর প্রতিনিধি হওয়ার দাবী করে, জবাবে তারা ইমাম মাহদির (আ.) তাওকী’র মুখোমুখি হয় যাতে তাদেরকে অভিসম্পাত (লানত) করা হয়েছে এবং তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।[৯৭]

গায়বাতে কোবরা

গায়বাতে কোবরার (দীর্ঘ মেয়াদী অন্তর্ধান) যুগ ৩২৯ থেকে শুরু হয়।[৯৮] গায়বাতে সোগরার সময় ইমাম মাহদির (আ.) সর্বশেষ নায়েব ছিলেন আলী ইবনে মুহাম্মাদ সামুরি, তিনি ৩২৯ হিজরীর ১৫ই শাবান ইন্তিকাল করেন।[৯৯] তাঁর মৃত্যুর ৬ দিন আগে ইমাম মাহদির (আ.) পক্ষ থেকে তাকে সম্বোধন করে এক তাওকী প্রেরিত হয়, যাতে আলী ইবনে মুহাম্মাদ সামুরির মৃত্যুর দিন ঘোষণার পাশাপাশি, পরবর্তী প্রতিনিধি মনোনয়নে তাকে নিষেধ করা হয়; কেননা ঐ তাওকীর ভিত্তিতে দ্বিতীয় গায়বাত তথা গায়বাতে কোবরা শুরু হয়েছে এবং যতদিন মহান আল্লাহ অনুমতি না দেবেন ততদিন তাঁর আবির্ভাব ঘটবে না।[১০০] বেশীরভাগ শিয়া গ্রন্থে চতুর্থ নায়েবের মুত্যুর বছর ৩২৯ হিজরী বলে উল্লেখ করা হলেও শেইখ সাদুক ও ফাযল বিন হাসান তাবারসী ৩১৮ হিজরীতে আলী ইবনে মুহাম্মাদ সামুরি (রহ.) ইন্তিকাল করেন বলে উল্লেখ করেছেন।[১০১]

ইমাম মাহদির (আ.) সাক্ষাত লাভ

শিয়াদের দ্বাদশ ইমামের দীর্ঘ জীবনে তাঁর সাথে সাক্ষাত লাভ সংশ্লিষ্ট বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যেগুলোর কতক গায়বাতে কোবরা শুরু হওয়ার আগের এবং কতক তাঁর গায়বাতে কোবরা চলাকালীন সময়ের। গায়বাতে কোবরার আগে সাক্ষাতের ঘটনা: ইতিহাস ও রেওয়ায়েতের বর্ণনার ভিত্তিতে গায়বাতে সোগরার ৬৯ বছর সময়কালে ৪ জন বিশেষ নায়েব ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়া ব্যক্তিত্ব তাঁর সাথে সাক্ষাত করেছেন; উদাহরণ স্বরূপ ইব্রাহিম ইবনে ইদ্রিস,[১১১] ইব্রাহিম ইবনে আব্দুহ নিশাবুরি ও তার খাদেম,[১১২] ইমাম হাসান আসকারির (আ.) খাদেম আবুল আদইয়ান,[১১৩] আবু সাঈদ গানেম হিন্দি[১১৪] এবং আবু আব্দিল্লাহি ইবনে সালেহসহ[১১৫] আরও অনেকে।[১১৬]

গায়বাতে কোবরায় সাক্ষাত

গায়বাতে কোবরা চলাকালীন সময়ে সাক্ষাত ও দর্শনের বিষয়ে শিয়া মনীষীগণের মাঝে দু’টি মত রয়েছে: প্রথমতঃ কেউ কেউ বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন, দ্বিতীয়তঃ কেউ কেউ তার সাথে সাক্ষাতের সম্ভাবনার পক্ষে বিভিন্ন দলীল ও দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। সাক্ষাতের বিষয়টি অস্বীকারের পক্ষে দলীল হিসেবে ঐ হাদীসগুলোকে উত্থাপন করা হয়েছে যেগুলোতে গায়বাতে কোবরার যুগে যে কোন ধরনের দর্শন ও সাক্ষাতের দাবীকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[নোট ৬] এছাড়া এ সময় তার সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি অস্বীকার প্রসঙ্গে যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হল, ইমামে যামানার সাথে সাক্ষাতের দাবীদ্বার ব্যক্তির দাবীর সত্যতার বিষয়ে সন্দেহ। আবার কেউ কেউ সুবিধাবাদীদের পথরোধ করতে সকল প্রকার দর্শনকেই অস্বীকার করেছেন।[১০৮]

অন্যদিকে, ইমামে যামানার সাক্ষাত লাভের জন্য বিভিন্ন হাদীসে দোয়া ও আমলের পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।[১০৯] অন্তত নির্ভরযোগ্য দু’টি হাদীসে ইমামের সাথে তাঁর বিশেষ অনুসারীদের সাক্ষাত ও তাঁর সাথে যোগাযগোর বিষয়টি সম্ভব বলে জ্ঞান করা হয়েছে।[নোট ৭] শেইখ সাদুক, শেইখ মুফিদ ও শেইখ তুসীর মত বড় বড় মনীষী নিজেদের গ্রন্থসমূহ দ্বাদশ ইমামের সাক্ষাত লাভকারীদের নাম উল্লেখ করতে আলাদা অধ্যায় রচনা করে এ বিষয়টি সম্ভব হওয়াকে সত্যায়ন করেছেন।[১১০]

ইমামে যামানার আবির্ভাব ও উত্থান

শিয়া শিক্ষা অনুসারে, ইমাম মাহদির (আ.) দীর্ঘ সময় অন্তর্ধানের থাকার পর শেষ যুগে স্বীয় সঙ্গীদের নিয়ে তাঁর উত্থান ঘটবে এবং তিনি বিশ্বজনীন সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন।[১১১] ইসলামি গ্রন্থসমূহে তার আবির্ভাবের বেশ কিছু আলামত উল্লেখিত হয়েছে, যেমন: সুফিয়ানি’র বিদ্রোহ, আসমানি আওয়াজ, নাফসে যাকিয়াহ’কে হত্যা ইত্যাদি।[১১২]

শিয়াদের বর্ণিত রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে আবির্ভাবের সময় বিশ্ব ৩টি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে: সর্বত্র জুলুম ও অনাচার ছেয়ে যাবে, এমন ফেতনা যা সকল গৃহে প্রবেশ করবে,[১১৩] সুফিয়ানি ও নাসেবিসহ অপর শত্রুদের উপস্থিতি; যারা ইরাকসহ অন্যান্য ইসলামি ভূখণ্ডে শিয়া বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত থাকবে, অতঃপর তারা সিরিয়াকে দখল করে নেবে[১১৪] এবং অবশেষে ইমামে যামানার সাথীরা দ্বাদশ ইমামের নাম ও চর্চা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবে।[১১৫]

কিছু কিছু রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে ইমাম মাহদি (আ.) নিজ আন্দোলন মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে শুরু করবেন বলে উল্লেখিত হয়েছে, তিনি তাঁর সাথীদের সঙ্গে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন এবং কুফাকে রাজধানী বানাবেন।[১১৬]

‘ইন্তেযারে মাহদি’ (ইমামে যামানার আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় থাকা) শিয়া সংস্কৃতির মূল শিক্ষাগুলোর অন্যতম, যা ‘ইন্তেযারে ফারাজ’ নামেও প্রসিদ্ধ; অর্থাৎ অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি অবসানের আশা এবং ইমামে যামানার আবির্ভাবের মাধ্যমে উজ্জ্বল ভবিষ্যত আগমনের আকাঙ্খা করা। বিষয়টির ক্ষেত্রে শিয়া রেওয়ায়েতসমূহে ((اَلْمُنتظَرُ لِأمْرِنا)), ((مُنتظِرٌ لِهذا الاَمر)), ((اِنْتِظارُ قائِمِنا)), ((تَوَقُّعُ الْفَرَج)), ((اَلمُنتظِرینَ لِظُهورِهِ)), ((مُنْتظِرونَ لِدَوْلَةِ الْحَق)), ((اَلمُنتظِرُ لِلّثانی عَشَر)) ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে।[১১৭] এ সকল রেওয়ায়েতে ইমাম মাহদির (আ.) প্রতীক্ষায়রতদের জন্য বহু পুরস্কার ও সওয়াবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আর তাদেরকে আল্লাহর ওলি এবং সর্বোত্তম মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যেন তারা বদরের যুদ্ধে মহাবনির (সা.) পাশে থেকে যুদ্ধ করেছেন অথবা ইমামে যামানার (আ.) সাথে তাঁর তাবুতে অবস্থান করছেন এবং তার পাশে থেকে যুদ্ধ করছেন।[১১৮]

বিভিন্ন দোয়া ও যিয়ারত

ইমামে যামানা (আ.) থেকে বেশ কয়েকটি দোয়া ও যিয়ারত বর্ণিত হয়েছে; যেমন: দোয়ায়ে ফারাজ (ইলাহি আযুমাল বালা...), ইয়া মান আযহারাল জামিল, আল্লাহুম্মা রাব্বিন নূরিল আযিম, আল্লাহুম্মারযুকনা তাওফিকাত তাআহ, সাহমুল লাইল নামক দোয়া, রজব মাসের প্রতিদিনের দোয়া (আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বিল মাওলুদাইনি ফির রাজাব...), আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বিমাআনি জামিয়ী মা ইয়াদউকা বিহি উলাতু আমরিক, যিয়ারতে নাহিয়া মুকাদ্দাসা এবং যিয়ারাতে শুহাদা ইত্যাদি।[১১৯]

ইমামে যামানার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য জামেআহ যিয়ারাতসমূহ -যার মাধ্যমে সকল ইমামের যিয়ারত করা সম্ভব- ছাড়াও বিভিন্ন দোয়া ও যিয়ারত শিয়া রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয়েছে:

দোয়ায়ে নুদবাহ, ইমামে যামানার (আ.) সালামাতির জন্য দোয়া, ইমামে যামানার (আ.) প্রতি ইস্তিগাসার (সালামুল্লাহিল কামিলুত তাম...), যিয়ারতে আলে ইয়াসীন, দোয়ায়ে গারীক, দোয়ায়ে আহদ, দোয়ায়ে ফারাজ, দোয়ায়ে আল্লাহুম্মা আররিফনি নাফসাক...,[১২০] ইমামে আসরের জন্য দোয়া (আল্লাহুম্মা ইদফা আন ওয়ালিয়েক,[১২১] ইমাম যামানার (আ.) বিশেষ সালাওয়াত (দরুদ), জুমআর দিনের যিয়ারত।

আহলে সুন্নতের দৃষ্টিতে ইমাম মাহদি (আ.)

আহলে সুন্নতের বিভিন্ন রেওয়ায়েত ভিত্তিক গ্রন্থে ইমাম মাহদি ও শেষ যুগের মুনজি (ত্রাণকর্তা) সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস উল্লেখিত হয়েছে।[১২২] আবেরি শাফেয়ী, আব্দুল হাক্ব দেহলাভি, ইসফারায়েনি ও শৌকানি’র মত আরও অনেক সুন্নি মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এ সকল হাদীস মুতাওয়াতির।[১২৩] এ সকল রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে আহলে সুন্নত ‘মাহদি’র অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে।[১২৪] কিন্তু এ বিষয়ে আহলে সুন্নতের অনেকের শিয়া মতের সাথে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে, যেমন; আহলে সুন্নতের দৃষ্টিতে ইমাম মাহদির (আ.) নাম হবে হযরত মুহাম্মাদের (সা.) পিতার নামে অর্থাৎ ‘আব্দুল্লাহ’। অথচ শিয়ারা তাঁকে ইমাম হাসান আসকারির (আ.) সন্তান বলে মানে। একইভাবে আহলে সুন্নতের প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী ‘মাহদি’ শেষ যুগে জন্মগ্রহণ করবেন, আহলে সুন্নতের একটি দল তাঁকে ইমাম হাসানের (আ.) বংশধর বলে জ্ঞান করে, অথচ শিয়া আকিদা অনুযায়ী তিনি ইমাম হুসাইনের (আ.) বংশধর।[১২৫]

কিছু কিছু বিষয়ে মতের অমিল থাকলেও শেষ যুগের ‘ত্রাণকর্তা’ প্রসঙ্গে শিয়া ও সুন্নিদের মাঝে মিলের ক্ষেত্রগুলো বহু। যেমন, তিনি আল্লাহর রাসুলের (সা.) বংশধর এবং তার নাম হবে তাঁর (সা.) নামে এবং তার উপাধি হল ‘মাহদি’। শেষ যুগে সুনিশ্চিতভাবে তার উত্থান ঘটবে এবং তিনি সকল অত্যাচারীর উপর বিজয়ী হয়ে বিশ্বব্যাপী ন্যায়-নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করবেন; হযরত ঈসাও (আ.) তাঁর সাথে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করবেন।[১২৬]

আবার কোন কোন সুন্নি আলেম প্রতিশ্রুত মাহদিকে শিয়াদের দ্বাদশ ইমাম বলে জ্ঞান করেছেন। হিজরী ৭ম শতাব্দির বিশিষ্ট মনীষী সিবতে ইবনে জাওযি তার ‘তাযকিরাতুল খাওয়াছ’ গ্রন্থে ইমাম হাসান আসকারির (আ.) সন্তানের পরিচয় উল্লেখ করার পর লিখেছেন: ((وهو الخلف الحجة صاحب الزمان القائم و المنتظَر)) তিনি হলেন সাহেবুয যামান এবং কায়েম (উত্থানকারী) [মুসলমানরা] যার আগমনের প্রতীক্ষায় রয়েছে।[১২৭] হিজরী ৭ম শতাব্দির বিশিষ্ট মনীষী ইবনে তালহা শাফেয়ী তার ‘মাতালেবুস সাউল’ গ্রন্থে ‘প্রতীক্ষিত মাহদি’কে ইমাম হাসান আসকারির (আ.) সন্তান বলে জেনেছেন এবং শেষ যুগে তার আবির্ভাব সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন।[১২৮]

বাহ্যিক ও নৈতিক বৈশিষ্ট্য

শিয়াদের বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে ইমাম মাহদির (আ. ফা.) নৈতিক ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় উল্লেখিত হয়েছে।

বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যাবলি

কিছু কিছু বর্ণনায় এসেছে যে, শারীরীক গঠনের দিক থেকে ইমাম মাহদিকে (আ.) মহানবি (সা.) নিজের সবচেয়ে সদৃশ বলে আখ্যায়িত করেছেন।[১২৯] একই ধরনের আখ্যা ইমাম হাসান আসকারির (আ.) হাদীসেও আমরা পেয়ে থাকি।[১৩০] ইমাম আলীর (আ.) এক রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে উত্থান সময় তাঁর বয়স হবে ৩০ থেকে ৪০ বছর।[১৩১] চেহারার দিক থেকে ইমাম সাদিক (আ.) তাঁকে নিখুঁত ও মধ্যপন্থী যুবক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা মাজলিসি’র ভাষায় এমন সংজ্ঞায়িত করার অর্থ হল ইমামে যামানা (আ. ফা.) হবেন মধ্যবয়স্ক অথবা যুবকাবস্থার শেষের দিকে।[১৩২]

ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত এক রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, একদা ইমাম আলী (আ.) মিম্বরে থাকা অবস্থায় বললেন যে, তাঁর সন্তানদের মধ্য থেকে শেষ যামানায় এক পুরুষের আবির্ভাব ঘটবে যার মুখের রঙ হবে লালচে সাদা, তার বক্ষ হবে প্রশস্ত..., তার স্কন্ধ হবে মজবুত, আর তার পিঠে দু’টি তিল থাকবে যার একটি হবে তার চামড়ার বর্ণের আরেকটি হবে মহানবির (সা.) তিলের রঙের।[১৩৩]

তাঁর নৈতিক বৈশিষ্ট্য

কিছু কিছু রেওয়ায়েতে ইমাম মাহদিকে (আ.) আখলাক তথা নৈতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মহানবির (সা.) সবচেয়ে সাদৃশপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর তাই বিভিন্ন আয়াত ও রেওয়ায়েতে মহানবির (সা.) ক্ষেত্রে যেসকল বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখিত হয়েছে সেগুলো অনুসারে ইমাম মাহদির নৈতিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা সম্ভব। আবার কিছু কিছু রেওয়ায়েতে স্বতন্ত্রভাবে ইমাম মাহদির (আ.) নৈতিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ ইমাম রেজা (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, জনগণের বিষয়ে (সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে) তিনি তাদের নিজেদের চেয়ে অধিক যোগ্য, তাদের পিতা-মাতার চেয়ে তাদের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল, আল্লাহর সমীপে সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিক বিনয়ী ও নম্র, অপরকে যা করার আদেশ দেন তা নিজে আঞ্জাম দেয়ার ক্ষেত্রে অধিক পরিশ্রমী এবং যা করতে নিষেধ করেন তা এড়িয়ে চলতে অধিক সংযত।[১৩৪]

ইমাম হুসাইন (আ.) থেকে বর্ণিত এক রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, ইমাম মাহদিকে (আ.) তার শান্ত-শিষ্ঠতা ও মর্যাদা, মার্জিত আচরণ, হালাল ও হারাম সম্পর্কে তার জ্ঞান, তার প্রতি মানুষের মুখাপেক্ষিতা এবং মানুষের প্রতি তার অমুখাপেক্ষিতা থেকে চিহ্নিত করা উচিত। [১৩৫] ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে যে, ইমাম মাহদি হবেন অত্যন্ত দুনিয়া বিমুখ, যিনি পুরু এবং অমসৃণ পোশাক পরবেন এবং যার খাদ্য হবে যবের রুটি।[১৩৬] সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তার আচরণ হবে কঠোর, জনগণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দানশীল এবং দরিদ্র ও অভাবিদের প্রতি তার আচরণ হবে দয়াসুলভ।[১৩৭]

গ্রন্থ পরিচিতি

ইমাম মাহদি (আ.) সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বহুসংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে; সাইয়্যিদ মাজিদ পুর তাবাতাবাঈ রচিত ‘দার জুস্তুজুয়ে কায়েম (আ. ফা.)’ গ্রন্থে ১৮৫১টি বই, পুস্তিকা, থিসিস, পত্রিকা এবং বিভিন্ন কবিতা ও সাহিত্য গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া আলী আকবার মাহদিপুর রচিত ‘কিতাব নমেয়ে হাযরাত মাহদি (আ. ফা.) গ্রন্থে আরবি, ফার্সি, তুর্কি, থাই, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি ও রুশ ভাষাসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় ২০০০ এর অধিক গ্রন্থের কথা উল্লেখিত হয়েছে।[১৩৯]

একনজরে এ বিষয়ে রচিত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি গ্রন্থ:

আল-বায়ান ফি আখবারি সাহিবিয যামান’: হিজরী ৭ম শতাব্দির শাফেয়ী মাযহাবের বিশিষ্ট আলেম মুহাম্মাদ ইউসুফ গাঞ্জি শাফেয়ী (মৃত্যু ৬৫৮ হি.) কর্তৃক রচিত। গ্রন্থটি ২৫টি অধ্যায়ে আহলে সুন্নতের বিভিন্ন সূত্রের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে।

কিফায়াতুল মুহতাদি ফি মা’রিফাতিল মাহদি’: হিজরী একাদশ শতাব্দির বিশিষ্ট শিয়া আলেম সাইয়্যিদ মুহাম্মাদ মুসাভি সাবযেভারি কর্তৃক ফার্সি ভাষায় রচিত।

নাজমুস সাকিব’: ১৪ শতাব্দির বিশিষ্ট শিয়া মুহাদ্দিস মীর্যা হুসাইন নূরী (১২৫৪-১৩২০ হি.) কর্তৃক ফার্সি ভাষায় রচিত। গ্রন্থটি ইমামের ব্যক্তিগত জীবন, দ্বাদশ ইমামের অস্তিত্ব প্রমাণ, তাঁর সাক্ষাত লাভের বিভিন্ন ঘটনা এবং গায়বাতের যুগে শিয়াদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে রচিত হয়েছে।

মুন্তাখাবুল আসার ফিল ইমামিস সানী আশার (আ. ফা.): লুতফুল্লাহ সাফী গুলপায়গানী (১২৯৭-১৪০০ হি.) কর্তৃক আরবি ভাষায় রচিত। এতে ইমামে যামানা (আ.) সম্পর্কিত বিভিন্ন রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়েছে।

মওসুআতুল ইমামিল মাহদি: ইরাকের বিশিষ্ট শিয়া আলেম সাইয়্যিদ মুহাম্মাদ সাদর কর্তৃক ৪ খণ্ডে রচিত। কুরআন ও হাদীস ও ইতিহাসের ভিত্তিতে ‘ইমাম মাহদি বিশ্বকোষ’: মুহাম্মাদ মুহাম্মাদি রেই শাহরি একদল লেখকের সহযোগিতায় গ্রন্থটি রচনা করেছেন।

তথ্যসূত্র


গ্রন্থপঞ্জি

  • এরবেলি, আলী ইবনে ঈসা, কাশফুল গাম্মা ফি মা’রেফাতুল আইম্মাহ, তাবরিজ, মাকতেবাতু বানি হাশেমি, প্রথম সংস্করণ, ১৩৮১ হিজরি।
  • ইবনে আসির আল-জাযারি, আলী ইবনে মুহাম্মদ, আল-কামেল ফীত তারিখ, বৈরুত, দারুস সাদর, ১৩৮৫ হিজরি।
  • ইবনে জোওযি, আবদুর রহমান ইবনে আলী, কাশফুল মুশকিল মান হাদীসুল সহীহীন, গবেষণা আলী হোসেন আল-বাওয়াব, রিয়াদ, দারুল ওয়াতান, ১৪১৮ হিজরি।
  • ইবনে জোওযি, ইউসুফ বিন কাযাউগলী, তাজকিরাতুল খাওয়াছ, কোম, মানশুরাতুল শরীফ আল-রাজী, ১৪১৮ হিজরি।
  • ইবনে হাযার আসকালানী, আহমদ ইবনে আলী, ফাতহুল বারী শারহুল সহীহ আল-বুখারী, তাহকিকে আবদুল্লাহ ইবনে বায, বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৩৭৯ হিজরি।
  • ইবনে খাশাব, আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ, তারিখুল মাওয়ালিদুল আইম্মা ওয়া ফিআতাহুম, তাহকিকে আয়াতুল্লাহ মারাশি নাজাফি, কোম, আয়াতুল্লাহ মারাশি নাজাফি লাইব্রেরি, ১৪০৬ হিজরি।
  • ইবনে খালদুন, আবদুর রহমান, তারিখে ইবনে খালদুন, বৈরুত, দারুল আহইয়াউত তারাস আল-আরাবী, ৪র্থ সংস্করণ, বিতা।
  • ইবনে খালকান, আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ, ওয়াফইয়াতুল আ’ইয়ান, বে-তাহকিকে এহসান আব্বাস, কোম, মানশুরাতুশ শরীফ আল-রাজি, বিতা।
  • ইবনে শা’বে হাররানী, হাসান ইবনে আলী, তোহফুল ওকুল, তাহকিক ও তাসহীহ আলী আকবর গাফ্ফারী, কোম, জমে মুদাররেসিন, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৬৩-১৪০৪ হিজরি।
  • ইবনে শাহর আশুব, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, মোনাকেব আলে আবি তালিব (আ.), কোম, আল্লামে, ১৩৭৯ হিজরি।
  • ইবনে তালহা শাফেঈ, মুহাম্মদ, মাতালেবুস সউল ফি মানাকিবুর রাসূল, বৈরুত, আল-বালাগ, ১৪১৯ হিজরি।
  • ইবনে তুলুন, আল-আইম্মা আসসানি আশার, তাহকিকে সালাহউদ্দিন মোনজেদ, কোম, মানশুরাতুর রাযী, বিতা।
  • ইবনে কাইয়ুম, মুহাম্মদ ইবনে আবি বাকর, আল-মানারুল মানিফ, তাহকিক আব্দুল ফাত্তাহ আবু গাদা, হালব, মাকতাবাহুল মাতবুআতুল ইসলামিয়া, ১৩৯০ হিজরি।
  • ইবনে মাশহাদি, মুহাম্মদ বিন জাফর, আল-মাজারুল কাবীর, সম্পাদনা: কাইয়ুমি ইস্পাহানি, জাওয়াদ, দাফতারে ইনতেশারাতে ইসলামী, কোম, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৯ হিজরি।
  • "এযরায়ে চাহার হেজার বিজেয়ে বারনামেয়ে এয়াদে শাবানিয়ে দার মাসজিদ”, ওয়াবগাহে সাজেমানে তাবলিগাতে ইসলামী।
  • আশআরী, সা’দ বিন আবদুল্লাহ, আল-মাকালাত ওয়াল ফারক, সম্পাদনা ডক্টর মোহাম্মদ জাভেদ মাশকুর, তেহরান, মারকাজে ইনতেশারাতে ইলমিয়ে ফারহাঙ্গি, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৬১ সৌরবর্ষ।
  • আল-আমিদি, সৈয়দ হাশেম সামের, দার ইন্তেযারে কাকনুস, অনুবাদ ও গবেষণা: মেহেদি আলী যাদেহ, ইনতেশারাতে মুআসসেসেয়ে আমুযেশী ও পাযুহেশী-এ ইমাম খোমেনী (ইমাম খোমেনী শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট পাবলিকেশন্স), কোম, ২য় সংস্করণ, ১৩৮২ সৌরবর্ষ।
  • আল-আমিদি, সৈয়দ হাশেম সামের,মাহদী মুন্তাযার দার আনদিশেয়ে ইসলামী (ইসলামিক চিন্তাধারায় মেহেদী মুন্তাযার), অনুবাদ ও গবেষণা: মেহেদি আলী যাদেহ, ইনতেশারাতে মুআসসেসেয়ে আমুযেশী ও পাযুহেশী-এ ইমাম খোমেনী (ইমাম খোমেনি শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট পাবলিকেশন্স), কোম, ১৩৭৫।
  • আমিন, সাইয়্যেদ মোহসেন, সিরেয়ে মা’সুমান, অনুবাদ: আলী হোজ্জাতি কেরমানি, তেহরান, সরুশ, দ্বিতীয়, ১৩৭৬ সৌরবর্ষ।
  • পুর তাবাতাবাঈ, সাইয়্যেদ মাজিদ, দার জুসতোজুয়ে কায়েম (আ.ফা.), কোম, মসজিদে মুকাদ্দাসে জামকারান, ১৩৭০ সৌরবর্ষ।
  • "যাশনহায়ে নিমে শাবানে মারদুমি বারগুযার মিশাওয়াদ”, খাবার গুযারী শাবেস্তান, পরিদর্শন তারিখ: ১৪ ইসফান্দ, ১৪০১ সৌরবর্ষ।
  • জা’ফারিয়ান, রাসুল, হায়াতে ফিকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়ে, কোম, ইনতেশারাতে আনসারিয়ান, পঞ্চম সংস্করণ, ১৩৮১ সৌরবর্ষ।
  • জামই আজ নেবিসান্দেগানে মাযাল্লে হোওযে (হাওযার ম্যাগাজিন লেখকদের একটি দল, চেশম বে রাহে মাহদি, কোম, দাফতারে তাবলিগাতে ইসলামীয়ে হাওযে, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৭৮ সৌরবর্ষ।
  • হুসাইন, জসিম, তারিখে সিয়াসি গায়বাতে ইমামে দাওয়াযদাহোম (দ্বাদশ ইমামের অন্তর্ধানের রাজনৈতিক ইতিহাস), অনুবাদ: আয়াতুল্লাহি, মোহাম্মদ তাকি, তেহরান, আমিরে কাবির, তৃতীয়, ১৩৮৫ সৌরবর্ষ।
  • হোসেইনি জালালী, মোহাম্মদ রেজা, তারিখে আহলে বাইত (আহলে বাইতের ইতিহাস), কোম, মুআসসে সেয়ে আলে বাইত, ১৪১০ হিজরি।
  • হোসেইনি দাশতি, সাইয়্যেদ মোস্তফা, মাআরেফ ও মাআরিফ, চতুর্থ খণ্ড, তেহরান, মুআসসেসেয়ে ফারহাঙ্গি আরায়েহ, ১৩৭৮ সৌরবর্ষ।
  • রাভান্দি, কুতুবুদ্দিন, আল-খারায়েজ ওয়াল জারায়েহ, তাহকিক মুআসসেসাতুল ইমামুল মাহদী (আ.),মুআসসেসেয়ে তাহকিকাত ওয়া নাশরে আহলে বাইত (আ.), ১৪১১ হিজরি।
  • রশিদ রেজা, মোহাম্মদ, তাফসির আল-মানার, আল হাইয়াতুল মিসরিয়াতুল আম্মাতু লিল কিতাব, ১৯৯০ সন।
  • সালিমিয়ান, খুদামোরাদ, দারস নামেয়ে মাহদাভিয়াত: ‘হযরত মাহদী আয বেলাদাত তা ইমামত’ কোম, বুনিয়াদে ফারহাঙ্গি মাহদী মৌউদ, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৩৮৯ সৌরবর্ষ।
  • সালিমিয়ান, খুদামোরাদ, ফারহাঙ্গ নামেয়ে মাহদাভিয়াত, বুনিয়াদে ফারহাঙ্গি মাহদী মৌউদ (আ.), ২য়, ১৩৮৮ সৌরবর্ষ।
  • http://shabestan.ir/detail/News/915085 "সাঙ্গ তামামে মাসজিদিহা বারায়ে নীমে শাবান", খাবার গুযারিয়ে শাবেস্তান, পরিদর্শন তারিখ: ১৪ ইসফান্দ, ১৪০১ সৌরবর্ষ।
  • সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, আলী ইবনে মুসা, আত তারায়েফ ফি মা’রেফাতি মাযাহেবু তাওয়েফ, সম্পাদনা: আশুর, আলী, কোম, নাশরে খিয়াম, ১ম সংস্করণ, ১৪০০ হিজরি।
  • সাইয়্যেদ ইবনে তাউস, আলী ইবনে মুসা, মুলাহেম ওয়াল ফিতান, কোম, আল-শরীফ আল-রাজি, ১৩৯৮ হিজরি।
  • সাইয়্যেদ মোর্তজা, আল-ফুসুলুল মুখতারা, মুনদারাজ দার মেসকাতুল শেখ আল-মুফিদ, ১ম সংস্করণ: কোম, মুঅতারেমুল আলেমী লি আলফিয়াতিল শেখ আল-মুফিদ, ১৪১৩ হিজরি।
  • শুশতারী, শরীফুদ্দিন হুসাইনী, আহকাকুল হাক্ব ওয়া আযহাকুল বাতিল, আয়াতুল্লাহ মুরাশি নাজাফির গবেষণা, কোম, আয়াতুল্লাহ মারাশি নাজাফি গ্রন্থাগার, ১৪০৯ হিজরি।
  • শেখ মুফিদ, মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মাদ, আল-ইরশাদ ফী মা’রেফাতি হুযাজুল্লাহ আলাল ইবাদ, বে কৌশিশে মুআসসাসে আলে বাইত, কোম, আল মুআতমারুল আলেমী লি আলফিয়াতিল শেখুল মুফিদ, ১৪১৩ হিজরি।
  • সাবেরি, হোসেইন, তারিখে ফারকে ইসলামি, ৭ম, তেহরান, সজেমানে মুতালেয়ে ওয়া তাদবিনে কুতুবে উলুমে ইনাসানি দানেশগাহহা, ১৩৯০ সৌরবর্ষ।
  • সাফি গুলপাইগানি, লুৎফুল্লাহ, মুন্তাখাবুল আসার, তেহরান, মাকতাবাতুস সাদর, বিতা।
  • সাফি গুলপাইগানি, লুৎফুল্লাহ, নাভিদ আমান ওয়া আমন, তেহরান, দাফতারে তানযিমে নাশর ওয়া অসারে আয়াতুল্লাহ সাফি গুলপাইগানি, ১৩৮৬ সৌরবর্ষ।
  • সাদর, সৈয়দ মুহাম্মাদ, পাযুহেশি দার জিন্দেগীয়ে ইমাম মাহদী ওয়া নেগারেশি বার তারিখে গায়বাতে ছোগরা [ইমাম মাহদী (আ.) এর জীবনী নিয়ে একটি গবেষণা এবং স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ], তারজমেয়ে মোহাম্মদ ইমামী শিরাজী, কোম, দারুল তাবলীগ ইসলামী, বিতা।
  • সাদর, সৈয়দ মোহাম্মদ, তারিখুল গায়বাতিস সোগরা, বৈরুত, দারুত তাআরুফ, ১৩৯২ হিজরি।
  • সাদর, সৈয়দ মুহাম্মদ, তারিখ মাবআ’দুজ জহুর, বৈরুত, দারুত তাআরুফ লিল মাতবুআ’হ, ১৪১২ হিজরি।