শেইখ মুফিদ
মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে নো’মান ওরফে শেইখ মুফিদ (৩৩৬ বা ৩৩৮ হি. – ৪১৩ হি.); হিজরী চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দির বিশিষ্ট শিয়া আলেম, ফকিহ ও মুতাকাল্লিম। বলা হয়, শেইখ মুফিদ ইলমে উসুলে ফিকহ উদ্ভাবনের মাধ্যমে ইজতিহাদের অঙ্গনে নতুন এক পদ্ধতি প্রণয়ন করেন; যা আকলের (বুদ্ধিবৃত্তি) ব্যবহারে বাড়াবাড়ি (ইফরাতি) পদ্ধতি এবং হাদীসের উপর বাড়াবাড়ি রকমের নির্ভরতা -এ দু’য়ের মাঝামাঝি একটি তৃতীয় পদ্ধতি। তাঁর বিশিষ্ট উস্তাদগণের মধ্যে রয়েছেন শেইখ সাদুক, ইবনে জুনাইন ইসকাফী, ইবনে কুলাওয়াইহ প্রমুখ। এছাড়া তাঁর শিষ্যগণের মাঝে শেইখ তুসী, সাইয়্যেদ মুর্তাযা, সাইয়্যেদ রাযী ও নাজ্জাশির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফিকাহ শাস্ত্রে ‘আল-মুকনিআহ’, কালামশাস্ত্রে ‘আওয়ায়েলুল মাকালাত’, শিয়া ইমামগণের ইতিহাসে ‘আল-ইরশাদ’ শেইখ মুফিদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর অন্যতম।
জীবনী ও বংশ পরিচয়
মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে নো’মান [নাজ্জাশি, রেজাল, ১৪০৭ হি., পৃ. ৩৯৯] ৩৩৬ [নাজ্জাশি, রেজাল, ১৪০৭ হি., পৃ. ৪০২] অথবা ৩৩৮ [ইবনে নাদিম, আল ফেহরিস্ত, ১৩৫০ ফার্সি সন, পৃ. ১৯৭; তুসী, আল ফেহরিস্ত, ১৪১৭ হি., পৃ. ২৩৯] হিজরীর ১১ই জিলক্বদ, বাগদাদের নিকটবর্তী উকবারি এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। [শুবাইরি, গুজারি বার হায়াত শেইখ মুফিদ, পৃ. ৭-৮।]
তার পিতা ছিলেন একজন মুয়াল্লিম (শিক্ষক) এ জন্য ‘ইবনুল মুয়াল্লিম’ নামেও তাঁর প্রসিদ্ধি ছিল। ‘উকবারি’ ও ‘বাগদাদী’ তাঁর অপর দুই উপাধি।[শুবাইরি, গুজারি বার হায়াত শেইখ মুফিদ, পৃ. ৭-৮।] আর ‘মুফিদ’ উপাধিতে ভূষিত হওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিশিষ্ট মু’তাযেলি পণ্ডিত আলী ইবনে ঈসা রুম্মানীর সাথে এক মুনাজিরাতে তিনি বিভিন্ন দলীল ও যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডাতে সক্ষম হন; এর ভিত্তিতে রুম্মানী তাঁকে ‘মুফিদ’ উপাধি দেন।[শুবাইরি, গুজারি বার হায়াত শেইখ মুফিদ, পৃ. ৯-৮।]
ইতিহাস গ্রন্থসমূহের বর্ণনার ভিত্তিতে শেইখ মুফিদ ছিলেন এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক; তাঁর পুত্রের নাম আবুল কাসেম আলী এবং তাঁর কন্যার নাম ইতিহাসে উল্লেখিত না হলেও তাঁর কন্যার স্বামী ছিলেন আবু ইয়া’লা জাফারি।[শুবাইরি, গুজারি বার হায়াত শেইখ মুফিদ, পৃ. ৩৭; শুবাইরি, নাগুফতে হায়ি আয হায়াতে শেইখ মুফিদ, পৃ. ১১৮।]
শেইখ মুফিদ ৪১৩ হিজরীর দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় রমযান শুক্রবার ইন্তেকাল করেন।[শুবাইরি, গুজারি বার হায়াত শেইখ মুফিদ, পৃ. ৩৯।] বিভিন্ন মাযহাবের যে সংখ্যক অনুসারী তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করেছিলো শেইখ তুসী’র বর্ণনা অনুযায়ী তা ছিল নজিরবিহীন।[তুসী, আল ফেহরিস্ত, ১৪১৭ হি., পৃ. ২৩৯।] তাঁকে নিজ বাড়িতেই দাফন করা হলেও, পরবর্তীতে কয়েক বছর পর কাযেমাইনে ইমাম জাওয়াদের (আ.) মাজারের নিকটে মাকাবেরে কুরাইশে তাঁকে স্থানান্তরীত করা হয়।[১০- নাজ্জাশি, রেজাল, ১৪০৭ হি., পৃ. ৪০২-৪০৩।]
নৈতিক বৈশিষ্ট্যাবলি
বর্ণিত হয়েছে যে, শেইখ মুফিদ অত্যধিক পরিমাণে সদকা দিতেন, ছিলেন অত্যন্ত নম্র প্রকৃতির, বেশী বেশী নামাজ আদায় করতেন ও রোজা রাখতেন এবং শক্ত ও খসখসে কাপড় পরতেন; এমনকি তাঁকে ‘শাইখুল মাশায়েখিস সূফিয়াহ’ (সুফিগণের উস্তাদদের উস্তাদ) নামেও নামকরণ করা হয়েছে।[শুবাইরি, গুজারি বার হায়াত শেইখ মুফিদ, পৃ. ২৬।] তাঁর জামাতা আবু ইয়া’লা জাফারি বলেন, তিনি রাতে কম ঘুমাতেন এবং রাতের বেশীরভাগ সময় পড়াশুনা, নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত বা শিক্ষকতায় মগ্ন থাকতেন।[শুবাইরি, গুজারি বার হায়াত শেইখ মুফিদ, পৃ. ২৬-২৭।] শেইখ মুফিদকে লেখা এক চিঠিতে ইমাম মাহদি আলাইহিস সালাম তাঁকে ‘সাদীদ’ ও ‘ওয়ালিয়ে রাশিদ’ নামে সম্বোধন করেছেন।[তাবারসী, আল ইহতিজাজ, ১৩৮৬ হি., খ. ২, পৃ. ৩২২।]
পড়াশুনা
কুরআন ও প্রাথমিক শিক্ষা পিতার তত্ত্বাবধানেই সম্পন্ন হয়, এরপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য পিতার সাথে বাগদাদে যান এবং সেখানে শীর্ষস্থানীয় শিয়া ও সুন্নি মুহাদ্দিস, মুতাকাল্লিম ও ফকিহগণের সান্নিধ্য লাভ করেন।[গোরজী, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৩] শেইখ সাদুক (মৃত্যু ৩৮১ হি.), ইবনে জুনাইদ ইসকাফী (মৃত্যু ৩৮১), ইবনে কুলাওয়াইহ (মৃত্যু ৩৬৯ হি.), আবু গালিব যাররারি (মৃত্যু ৩৬৮ হি.) ও আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে উমার জাআবির (মৃত্যু ৩৫৫ হি.) ছিলেন তাঁর প্রসিদ্ধ শিয়া উস্তাদগণ।[গোরজী, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৩।] শেইখ মুফিদ, বিশিষ্ট মু’তাযেলি পণ্ডিত হুসাইন ইবনে আলী বসরি ওরফে জুআল এবং সনামধন্য মুতাকাল্লিম আবুল জাইশ বালখি’র শিষ্য আবু ইয়াসিরের নিকট কালাম শাস্ত্রের শিক্ষা লাভ করেন। এছাড়া তিনি আবু ইয়াসিরের পরামর্শে প্রখ্যাত মু’তাযেলী পণ্ডিত আলী ইবনে ঈসা রুম্মানী’র দরসেও অংশগ্রহণ করেন।[শুবাইরি, গুজারি বার হায়াত শেইখ মুফিদ, পৃ. ৯-৮।]
প্রায় ৪০ বছর বয়স থেকে শিয়া ফিকাহ, কালাম ও হাদীস শাস্ত্রের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। শিয়া আকিদার পক্ষে তিনি বিভিন্ন মাযহাবের আলেমদের সাথে মুনাজিরা করেছেন।[শুবাইরি, গুজারি বার হায়াত শেইখ মুফিদ, পৃ. ২৩-২৪।]
ইলমি অবস্থান
শেইখ তুসী তাঁর আল-ফেহরিস্ত গ্রন্থে ‘শেইখ মুফিদ’কে তীক্ষ্ম বোধসম্পন্ন, উপস্থিত জবাব প্রদানে প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এবং ফিকাহ ও কালাম শাস্ত্রে অগ্রগামী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[তুসী, আল ফেহরিস্ত, ১৪১৭ হি., পৃ. ২৩৮] ইবনে নাদিম ‘শিয়া মুতাকাল্লিমগণের রঈস (প্রধান)’ হিসেবে তাঁকে স্মরণ করেছেন এবং কালাম শাস্ত্রে অনন্য হিসেবে তাঁর নাম উল্লেখ করে তাঁকে অন্যদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। [ইবনে নাদিম, আল ফেহরিস্ত, ১৩৫০ ফার্সি সন, পৃ. ২২৬ ও পৃ. ২৪৭।]
শেইখ মুফিদকে বাগদাদের কালাম শাস্ত্রের প্রতিনিধি এবং সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব হিসেবে গন্য করেছেন, যিনি কোমের কালাম শাস্ত্র কেন্দ্রীক চিন্তা-ভাবনার সমালোচক ছিলেন।[২০- জাফারি, মুকায়েসে ই মিয়ানে দো মাকতাবে ফেকরি শিয়ে দার কোম ওয়া বাগদাদ দার কারনে চাহারুমে হিজরী, পৃ. ১৪ ও পৃ. ১৫] বলা হয়েছে যে, বাগদাদের ফিকাহ বিষয়ক চিন্তাধারা শেইখ মুফিদের মাঝে নিজ উচ্চতায় পৌঁছায়।[জাফারি, মুকায়েসে ই মিয়ানে দো মাকতাবে ফেকরি শিয়ে দার কোম ওয়া বাগদাদ দার কারনে চাহারুম হিজরী, পৃ. ১৫] তিনি চরম যুক্তিবাদীও (চরম আকলপন্থী) ছিলেন না আবার চরম হাদীসবাদীও ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন মধ্যপন্থী।[ফার্মানিয়ান ও সাদেকিয়ে কাশানি, নেগাহি বে তারিখে তাফাক্কুরে ইমামিয়ে, ১৩৯৪ ফার্সি সন, পৃ. ৬১; জিবরাইলি, সেইরে তাতাউরে কালামে শিয়ে, ১৩৮৯ ফার্সি সন, পৃ. ১৯৮ ও পৃ. ১৯৯।]
শিয়াদের সনামধন্য অনেক আলেমই শেইখ মুফিদের শিষ্যত্ব লাভ করেছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন[গোরজী, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৩।]:
সাইয়্যেদ মুর্তাযা (মৃত্যু ৪৩৬ হি.)
সাইয়্যেদ রাযী (মৃত্যু ৪০৬ হি.)
শেইখ তুসী (মৃত্যু ৪৬০ হি.)
নাজ্জাশি (মৃত্যু ৪৫০ হি.)
সাল্লার দাইলামি (মৃত্যু ৪৫০ হি.)
আবুল ফুতুহ কারাজাকি (মৃত্যু ৪৪৯ হি.)
আবু ইয়া’লা মুহাম্মাদ ইবনে হাসান জাফারী (মৃত্যু ৪৬৩ হি.)[গোরজী, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৩ ও পৃ. ১৪৪।]
রচিত গ্রন্থ
শেইখ মুফিদ বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন; ফেহরিস্তে নাজ্জাশির ভিত্তিতে তাঁর প্রণীত গ্রন্থ ও রিসালাহ’র সংখ্যা ১৭৫টি।[নাজ্জাশি, রেজাল, ১৪০৭ হি., পৃ. ৩৯৯-৪০২।] বলা হয়েছে যে, ঐ সকল রচনার অর্ধেক ইমামত সম্পর্কে।[২৬] ফিকাহ শাস্ত্রে শেইখের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল ‘আল-মুকনিআহ’, কালাম শাস্ত্রে ‘আওয়ায়েলুল মাকালাত’ এবং ইমামগণের (আ.) জীবনীতে ‘আল-ইরশাদ’।[গোরজী, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৩-১৪৪।] শেইখ মুফিদের রচনাসমগ্র ১৪ খণ্ডে ‘মুসান্নাফাতে শেইখ মুফিদ’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। সংকলনটি শেইখ মুফিদ ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস আয়োজনের সময়ে ১৩৭১ ফার্সি সনে প্রকাশিত হয়।[গোরজী, আবুল কাসেম, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন।]
ফিকাহ শাস্ত্রে নতুন পদ্ধতি
শিয়া ফিকাহ’তে শেইখ মুফিদ নিজের পূর্ববর্তী পদ্ধতির ব্যতিক্রম নতুন এক পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটান। সুবহানী ও গোরজীর ভাষ্যানুযায়ী শেইখ মুফিদের পূর্বে ফিকাহ শাস্ত্রে মূলতঃ দু’টি পদ্ধতি প্রচলিত ছিল; প্রথমটি হলো হাদীসের উপর বাড়াবাড়ি রকমের নির্ভরতা, এতে হাদীসের সনদ ও মতন (মূল টেক্সক্ট)-এর প্রতি যথেষ্ঠ সূক্ষ্মতা দেখানো হতো না।[সুবহানি, মাওসুআতু তাবাকাতিল ফুকাহা, ১৪১৮ হি., পৃ. ২৪৫-২৪৬; গোরজী, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৫।] দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো রেওয়ায়েত ও হাদীসের প্রতি প্রয়োজনীয় গুরুত্ব না দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বুদ্ধিবৃত্তি ভিত্তিক নিয়ম-বিধানের প্রতি গুরুত্ব প্রদান, এক্ষেত্রে কিয়াসের মতো বিষয়াদি নসসে’র (ধর্মীয় ডিক্রী) সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও।[৩০- সুবহানি, মাওসুআতু তাবাকাতিল ফুকাহা, ১৪১৮ হি., পৃ. ২৪৬; গোরজী, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৫।] শেইখ মুফিদ মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন এবং ফিকাহ শাস্ত্রে নতুন এক পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন করেন; এই প্রথম পর্যায়ে বুদ্ধিবৃত্তি ও আকলের সহযোগিতায় আহকাম ও বিধানসমূহ ইস্তিখরাজের জন্য মূলনীতি ও নিয়ম লেখা হত। অতঃপর এই মূলনীতিগুলোর মাধ্যমে ধর্মীয় মতন (মূল টেক্সক্ট) থেকে আহকাম বের করা হত।[সুবহানি, মাওসুআতু তাবাকাতিল ফুকাহা, ১৪১৮ হি., পৃ. ২৪৫; গোরজী, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৫] আর এ কারণেই তাঁকে উসুলে ফিকহ শাস্ত্রের প্রণেতা বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।[গোরজী, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৬]
শেইখ মুফিদের পর তাঁর ছাত্র সাইয়্যেদ মুর্তাযা ‘আয-যারিয়াতু ইলা উসুলিশ শারিয়াহ’ গ্রন্থে এবং শেইখ তুসী ‘আল-উদ্দাতু ফীল উসুল’ গ্রন্থে তাঁর এ পদ্ধতি অব্যাহত রাখেন।[সুবহানি, মাওসুআতু তাবাকাতিল ফুকাহা, ১৪১৮ হি., পৃ. ২৪৫; গোরজী, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৫।]
ইলমি মুনাজিরায় অংশগ্রহণ
শেইখ মুফিদের সময়কালে বাগদাদে বিভিন্ন ইসলামি মাযহাবের মাঝে ইলমি আলোচনা আয়োজিত হত। এ মুনাজিরাগুলোর অনেকটাই আব্বাসী খলিফাদের উপস্থিতিতেই অনুষ্ঠিত হত। শেইখ মুফিদও এসব সভায় অংশগ্রহণ করতেন এবং শিয়া মাযহাবের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সমালোচনা ও সংশয়ের জবাব দিতেন।[গোরজী, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, ১৩৮৫ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৬।] শেইখ মুফিদের বাড়িতেও এ ধরনের জলসা অনুষ্ঠিত হত; এতে মু`তাযিলা, যাইদিয়া ও ইসমাইলিয়াসহ বিভিন্ন মাযহাবের আলেমরা উপস্থিত থাকতেন।[মুনতাজাম, খ. ৮, পৃ. ১১; শেইখ মুফিদ বর্ণনা করেছেন, গুজারি বার হায়াত শেইখ মুফিদ, পৃ. ২৩-২৪।]
ভুল ফতওয়া প্রদান ও সংশোধন
বর্ণিত আছে যে, একদা শেইখ মুফিদ একটি ফতওয়ায় ভুল করার পর ইমামে যামানা (আ.) সেই ফতওয়া সংশোধন করে দেন।[কারিমিয়ান, ওয়াকাভি ফাতওয়ায়ে মানসুব বে শেইখ মুফিদ, পৃ. ৩০।] এ ঘটনা বর্ণনাকারী সবচেয়ে পুরাতন গ্রন্থটি হলো ১৫০ বছর আগের।[কারিমিয়ান, ওয়াকাভি ফাতওয়ায়ে মানসুব বে শেইখ মুফিদ, পৃ. ৩০।] তাওকী’র (ইমাম মাহদীর (আ.) চিঠি ও লেখনী বিশেষ; যা সাধারণত শিয়াদেরকে সম্বোধন করে লেখা হত এবং তাঁর খাস নায়েবগণ (প্রতিনিধি) মারফত জনসাধারণের নিকট পৌঁছুত) সূত্রের দূর্বলতা, ফতওয়ার সাথে রেওয়ায়েত ও মশহুর ফতওয়ার সংঘর্ষ, শেইখের প্রতি অজ্ঞতা ও ফতওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করার মতো অপবাদ আরোপ ইত্যাদি ঐ ঘটনার অসত্য হওয়ার দলীল হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।[দ্র: কারিমিয়ান, ওয়াকাভি ফাতওয়ায়ে মানসুব বে শেইখ মুফিদ, পৃ. ৩৩-৩৭।]
এছাড়াও শেইখ মুফিদ তাঁর ফিকাহ ভিত্তিক গ্রন্থ আল-মুকনিআহ’তে ঐ মাসআলা’তে প্রসিদ্ধ ফতওয়া উল্লেখ করেছেন। অতএব, এ ধরনের ভুল তাঁর সাথে সম্পৃক্ত করা কল্পকাহিনী বৈ কিছুই নয়।[কারিমিয়ান, ওয়াকাভি ফাতওয়ায়ে মানসুব বে শেইখ মুফিদ, পৃ. ৩৯।]
উল্লিখিত ঐ সূত্রের বর্ণনার ভিত্তিতে -যা বর্তমান সময়ের কিছু কিছু গ্রন্থেও স্থান পেয়েছে-[৪০- দ্র: মুহাম্মাদিয়ে এশতেহার্দি, হযরত মাহদি ফুরুগে তাবানে ওয়েলায়াত, ১৩৮৭ ফার্সি সন, পৃ. ২১২-২১৩; নাহাওয়ান্দি, আলআবকরিয়া আল ইহসান, ১৩৮৬ ফার্সি সন, খ. ৫, পৃ. ৪৪৭।] জনৈক গ্রাম্য ব্যক্তি শেইখ মুফিদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন যে, যদি কোন গর্ভবতী নারী মারা যায় এবং তার গর্ভের বাচ্চা জীবিত থাকে এমতাবস্থায় মায়ের সাথে বাচ্চাকে দাফন করে দিতে হবে নাকি বাচ্চাকে বের কর নিতে হবে? শেইখ মুফিদ উত্তরে বললেন, বাচ্চাকে বের না করেই ঐ নারীকে দাফন করে দিন। ফেরার পথে অজ্ঞাত এক ঘোড়সওয়ার ঐ ব্যক্তির নিকট এসে বললেন: শেইখ (মুফিদ) বলেছে, মৃত নারীর পেট কেটে বাচ্চা বের করে ঐ নারীকে দাফন করো। কিছুদিন পর ঐ লোক ঘটনাটি শেইখ মুফিদকে বললে শেইখ আশ্চর্য হয়ে ফতওয়া সংশোধনের জন্য কোন ব্যক্তিকে প্রেরণের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, ঐ ঘোড়সওয়ার ছিলেন ইমামে যামানা (আ.)। এ ঘটনার পর শেইখ মুফিদ ফতওয়া দেওয়া বন্ধ করে দিলেন, অতএব, ইমামে যামানা’র পক্ষ থেকে এক তাওকী মারফত তাঁকে অবগত করা হলো যে, ফতওয়া দাও! আমরা সেগুলো সংশোধন ও প্রতিষ্ঠিত করবো।[কারিমিয়ান, ওয়াকাভি ফাতওয়ায়ে মানসুব বে শেইখ মুফিদ, পৃ. ৩১-৩২।][নোট ০১]
শেইখ মুফিদ সম্পর্কে রচিত গ্রন্থাবলী
শেইখ মুফিদকে নিয়ে বহুসংখ্যক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে, যেমন-
- শেইখ মুফিদ পারচামদারে আযাদীয়ে আন্দিশেহ, সাইয়্যেদ জাফার মুর্তাযা আমেলী।
- মার্টিন ম্যাক ডারমুট রচিত ‘আন্দিশেয়ে কালামিয়ে শেইখ মুফিদ।
- আলী আকবার বেলায়েতি রচিত শেইখ মুফিদ।
- কাসেমালী কুচনানী রচিত মুদাফেয়ে হারিমে তাশাইয়্যু (মুরুরি বার যেন্দিগী ওয়া আসারে শেইখ মুফিদ)
- আহমাদ লোকমানী রচিত শেইখ মুফিদ; মুয়াল্লেমে উম্মাত।
হিজরী ১৪১৩ সালের ২৩ থেকে ২৬শে শাওয়াল ‘শেইখ মুফিদ ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস’ ইরানের কোম শহরে অনুষ্ঠিত হয়। ঐ কংগ্রেসে ২৩টি দেশের ২৫০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন এবং তারা শেইখ মুফিদের কালাম শাস্ত্র, ফিকাহ শাস্ত্র, ইতিহাস ও হাদীস ভিত্তিক চিন্তাধারা এবং তৎকালীন যুগের বৈশিষ্ট্য কেন্দ্রীক বিভিন্ন প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে ঐ সকল প্রবন্ধ কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
এছাড়া ১৩৭৩ ফার্সি সনে শেইখ মুফিদের জীবনীর উপর একটি টিভি সিরিয়াল ‘খুরশিদে শাব’ নামে নির্মিত হয়। সিরিয়ালটি রচনা ও গ্রন্থনা করেছেন মাহমুদ হাসানি এবং পরিচালনা করেছেন সিরুসে মোকাদ্দাম। এটি ১৩৭৪ সনে ইরানের ২নং চ্যানেল থেকে সম্প্রচারিত হয়।
গ্রন্থপঞ্জি
- ইবনে নাদিম, মুহাম্মাদ ইবনে আবি ইয়াকুব ইসহাক, আল-ফেহরিস্ত, তাহকীক: রেযা তাজাদ্দুদ, তেহরান, ১৩৫০ ফার্সি সন।
- ইবনে তাগরি বার্দি, আন-নুজুমুয যাহেরাহ ফী মুলুকি মিসর ওয়াল কাহেরা, কায়রো, মিসরের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
- জীবরাইলী, মুহাম্মাদ সাফার, সেইরে তাতাওউরে কালামে শিয়েহ, দ্বিতীয় নোট, গায়বাত থেকে খাজা নাসিরুদ্দীন তূসী পর্যন্ত, তেহরান, পেঝুহেশগাহে ফারহাঙ্গ ওয়া আন্দিশেয়ে ইসলামি প্রকাশনী, প্রথম সংস্করণ, ১৩৮৯ ফার্সি সন।
- জাফারি, ইয়াকুবি, ‘মোকায়েসে-ই মিয়ানে দো মাকতাবে ফিকরিয়ে শিয়েহ দার কোম ওয়া বাগদাদ দার কারনে চাহারোমে হিজরী’
- খাতিব বাগদাদী, আহমাদ ইবনে আলী, তারিখে বাগদাদ, তাহকীক: আতা, মুস্তাফা আব্দুল কাদের, দারুল কুতুবিল আলামিয়া প্রকাশনী, বৈরুত, ১৪১৭ হি.।
- সুবহানী, জাফার, মাওসুআতু তাবাকাতিল ফুকাহা, ভূমিকা (দ্বিতীয় পর্ব), ইমাম সাদিক ইনস্টিটিউট, কোম, ১৪১৮ হি.।
- শুবাইরি, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ জাওয়াদ, ‘গুযারি বার হায়াতে শেইখ মুফিদ’, শেইখ মুফিদ ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের ফার্সি প্রবন্ধ বিভাগ, সংখ্যা ৫৫, প্রকাশকাল ১৩৭২ ফার্সি সন।
- শুবাইরি, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ জাওয়াদ, ‘নাগোফতে হায়ী আয হায়াতে শেইখ মুফিদ’, শেইখ মুফিদ ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের ফার্সি প্রবন্ধ বিভাগ, ১৩৭২ ফার্সি সন।
- তুসী, মুহাম্মাদ ইবনিল হাসান, আল-ফেহরিস্ত, তাহকীক: জাওয়াদ কাইয়ুমি, নাশরুল ফিকাহাহ ইনস্টিটিউট, ১৪১৭ হি.।
- ফারমানিয়ান, মাহদি ও মুস্তাফা সাদেকী কাশানি, ‘নেগাহী বে তারিখে তাফাক্কোরে ইমামিয়েহ; আয আগায তা যুহুরে সাফাভিয়েহ’, কোম, পেঝুহিশগাহে উলুম ওয়া ফারহাঙ্গে ইসলাম, প্রথম সংস্করণ, ১৩৯৪।
- কারিমিয়ান, মাহমুদ, ‘ওয়াকাভিয়ে ফাতওয়ায়ে মানসুব বে শেইখ মুফিদ’ হাদীসে হাওযা পত্রিকা, ১৩৯৩ সালের প্রকাশিত, সংখ্যা ৯।
- গোরজী, আবুল কাসেম, তারিখে ফিকহ ওয়া ফুকাহা, তেহরান, সামত প্রকাশনী, ১৩৮৫ ফার্সি সন।
- মুহাম্মাদি ইশতাহারদি, মুহাম্মাদ, হাযরাত মাহদি ফুরুগে তাবানে ভেলায়াত, জামকারান মসজিদ প্রকাশনা, ১৩৮৭ ফার্সি সন।
- নাজ্জাশি, আহমাদ ইবনে আলী, রেজালে নাজ্জাশী, তাসহীহ: সাইয়্যেদ মুসা শুবাইরি যানজানী, কোম, দাফতারে ইন্তিশারাতে ইসলামি, ১৪০৭ হি.।
- নাহাভান্দি, আলী আকবার, আল-আবকারিয়িল হিসান ফি আহওয়ালি মাওলানা সাহিবিয যামান’, তাহকীক ওয়া তাসহীহ: হুসাইন আহমাদি কুম্মি ও সাদিক বারযগার, কোম, জামকারান মসজিদ প্রকাশনী, ১৩৮৬ ফার্সি সন।
- আই ফিল্ম চ্যানেলে প্রকাশিত ‘খুরশিদে শাব’ টিভি সিরিয়াল।