ঈদে গাদীর
ঈদে গাদীর শিয়াদের অন্যতম বড় ঈদ, যা জিলহজ্ব মাসের ১৮ তারিখে পালন করা হয়; যেদিনে ইমাম আলী (আ.) মহানবি (স.)-এর জানেশীন তথা উত্তরাধিকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। মহানবি (স.) এবং ইমামগণ (আ.) হতে এই দিনের ফযিলত সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে; তদ্রুপভাবে এই দিনে রোযা রাখা, যিয়ারতে গাদীরিয়া পাঠ, গাদীরের নামায আদায় এবং মু’মিনদেরকে আপ্যায়ন করার ব্যাপারেও সুপারিশ করা হয়েছে। শিয়ারা এই দিনে আনন্দ উদযাপন করে থাকেন। গাদীরের দিন ইরানে সরকারী ছুটি পালিত হয়। ইরানে প্রথা রয়েছে যে শিয়ারা এই দিনে সাইয়্যেদদের সাথে সাক্ষাত করতে যান এবং সাইয়্যেদরাও ঈদ সালামি প্রদান করেন।
গাদীরের ঘটনা
রাসূল (স.) ১০ হিজরীর জ্বিলক্বদ মাসে কয়েক হাজার লোকের সাথে হজ্ব পালনের জন্য মদীনা থেকে মক্কায় গমন করেন।[২] এই সফরটি মহানবির (স.) সর্বশেষ হজ্ব হওয়ায় হুজ্জাতুল বিদা’ তথা বিদায় হজ্ব হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে।[৩] রাসূল (স.) হজ্বের আমলসমূহ শেষ করার পর মুসলমানদের সাথে নিয়ে মদীনার দিকে রওয়ানা দেন এবং ১৮ যিলহজ্ব তারিখে গাদীরে খুম নামক স্থানে পৌঁছান,[৪] জিব্রাইল মহাবনির (স.) নিকট অবতীর্ণ হন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ হতে রাসূলুল্লাহ (স.)-কে নির্দেশ প্রদান করেন, যেন আলী (আ.)-কে নিজের জানেশীন হিসেবে মানুষের নিকট পরিচয় করান।[৫] মহানবিও (স.) হাজীদেরকে একত্রিত করেন এবং আলীকে (আ.) তাঁর জানেশীন হিসেবে পরিচয় করান।[৬]
গাদীরের দিনের ফযিলত
গাদীরের ফযিলত সম্পর্কে মা’সুমীনদের (আ.) হতে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
- মহানবি (স.): গাদীরে খুমের দিবস হচ্ছে আমার উম্মতের সবচেয়ে বড় ঈদ; যেদিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমার উম্মতের জন্য দ্বীন এবং নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করেছেন এবং ইসলামকে দ্বীন হিসেবে তাদের জন্য পছন্দ করেছেন।[৭]
- ইমাম সাদিক (আ.): গাদীরে খুমের দিবসটি আল্লাহর বড় ঈদ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোন নবীকেই প্রেরণ করেন নি এই দিনটিকে ঈদ উদযাপন এবং এর তাৎপর্য চেনা ব্যতিত। আর আসমানে এই দিবসটির নাম হচ্ছে শপথের দিন এবং জমিনে কড়া শপথ এবং সকলের উপস্থিতির দিন।[৯]
- ইমাম রেযা (আ.): গাদীর দিবসটি আসমানবাসীদের নিকট জমিনবাসীদের চেয়ে অধিক প্রসিদ্ধ…মানুষ যদি এই দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে জানতো, তবে নিঃসন্দেহে ফেরেস্তাগণ প্রতিদিন ১০ বার তাদের সাথে মুসাফাহ তথা করমর্দন করতো।[১০]
- আহলে সুন্নতের বিশিষ্ট পণ্ডিত নাসিবি শাফেয়ী, মাতালেবুস সাঊল গ্রন্থে ১৮ জ্বিলহজ্ব তারিখটিকে ঈদ হিসেবে ব্যক্ত করেছেন।[১১] তার ভাষ্য মতে, এটি হচ্ছে ঈদের দিন এবং মানুষের সমবেত হওয়ার দিন; কারণ যখন রাসূলুল্লাহ (স.) আলীকে (আ.) এই মহান দায়িত্ব অর্পণ করেন তখন তিনি অন্য কোম মানুষকে এই পর্যায়ে আলীর সাথে শরীক করেন নি।[১২] ওয়াফিয়াতুল আ’ইয়ান গ্রন্থে ইবনে খাল্লেকানের উল্লেখানুসারে, মিশরের অন্যতম শাসক মুস্তা’লি ইবনে মুস্তানসারের প্রতি ৪৮৭ হিজরির ১৮ জ্বিলহজ্ব ঈদে গাদীরে খুমের দিন বাইয়াত করা হয়।[১৩]
গাদীর উৎসব
খাসায়েসুল আইম্মা গ্রন্থের উল্লেখানুসারে, হাস্সান ইবনে সাবেত, ঈদে গাদীরের দিন মহানবি (স.)-এর সামনে গাদীরে খুমে উপস্থিত মুসলমানদের মাঝে উচ্চস্বরে কবিতাসমূহ আবৃত্তি করেন।[১৪]
এছাড়াও মিসবাহুল মুজতাহিদ গ্রন্থে বর্ণিত রেওয়ায়েত অনুসারে, ইমাম রেযা (আ.) গাদীর দিবসটিকে মজলিসের মাধ্যমে উদযাপন করতেন।[১৫] হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আলী ইবনে হুসাইন মাসউদি আত-তানবিহ ওয়াল আশরাখ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইমাম আলী (আ.)-এর সন্তানগণ এবং শিয়ারা এই দিবসটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন।[১৬] হিজরি চতুর্থ শতকের মুহাদ্দিস কুলাইনিও রেওয়ায়েতে শিয়াদের আনন্দ উদযাপনের কথা উল্লেখ করেছেন।[১৭] , হিজরি অষ্টম শতকের সুন্নি ঐতিহাসিক ইবনে কাসিরের দেওয়া তথ্য মতে, শিয়া শাসকদের মধ্যে আলে বুইয়া সরকারও ঈদে গাদীরে ছুটি এবং সার্বজনীন উৎসব হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠান ও জনগণকে আনন্দ উদযাপন এবং শহর সাজানোর জন্য উৎসাহিত করতেন।[১৮] তারা এই উৎসবে তাঁবু স্থাপন করতেন, পতাকা উত্তোলন করতেবন, উট কুরবানি করতেন এবং রাতের বেলা আগুর জ্বালিয়ে আনন্দ উৎসব করতেন।[১৯] হিজরি পঞ্চম শতাব্দীর বিশিষ্ট ঐতিহাসিক গারদিযিও এই দিনটিকে ইসলামের অন্যতম মহিমান্বিত দিন এবং শিয়াদের অন্যতম বড় ঈদ হিসেবে গণ্য করেছেন।[২০]
মিশরে ফাতেমীয় খলিফারা ঈদে গাদীরে আনন্দ উদযাপন করতেন।[২১] ইরানে সাফাভিদের আমলে ঈদে গাদীর ছিল সরকারীভাবে ঘোষিত ঈদের দিন।[২২] ইরানে, ঈদে গাদীরের দিন সরকারী ছুটি ছিল।[২৩]
ঈদে গাদীরের দিন ইরানে সরকারী ছুটি, ২০২৪ সালের ২২ মে ইরাকের পার্লামেন্ট এই দিনটিকে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে সম্মতি জানিয়েছে।[২৪] ইতিপূর্বে, ঈদে গাদীরের দিন শুধুমাত্র ইরাকের কয়েকটি শহর যেমন: কারবালা, নাজাফ এবং যিকারে ছুটি থাকতো।[২৫]
শিয়ারা ঈদে গাদীরের রাতকেও মহিমান্বিত হিসেবে গণ্য করেন এবং রাত্রিজাগরণ করেন।[২৬]
ঈদে গাদীরের আমলসমূহ
- রোযা রাখা; আহলে সুন্নতের গ্রন্থে মহানবি (স.) হতে বর্ণিত রেওয়ায়েত অনুসারে, ১৮ জ্বিলহজ্ব তারিখে যে ব্যক্তি রোযা রাখবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার জন্য ৬ মাসের রোযার সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন।[২৭]
- মু’মিনদের সাথে সাক্ষাতের সময় اَلحمدُ لِلهِ الّذی جَعَلَنا مِنَ المُتَمَسّکینَ بِولایةِ اَمیرِالمؤمنینَ و الائمةِ علیهم السلام অর্থ আল্লাহর নিকট শুকরিয়া যে তিনি আমাদেরকে আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) এবং ইমামদের (আ.) বেলায়েত তথা অভিভাবকত্বকে আঁকড়ে ধরা ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।” এই বাক্যটি বলা।[২৮]
- ইমাম আলী (আ.)-এর মাযার জিয়ারত
- গোসল করা
- যিয়ারতে আমিনুল্লাহ পাঠ করা
- দোয়া-এ নুদবা পাঠ করা
- যিয়ারতে গাদীরিয়া পাঠ করা।[২৯]
- ভাল পোষাক পরিধান করা
- সুগন্ধি ব্যবহার করা
- পরিপাটি থাকা
- সেলে রাহেম তথা আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাত করা এবং তাদেরকে সাহায্য করা
- পরিবারের জন্য খরচ করা
- হাসি-খুশি থাকা
- মু’মিনদেরকে হাদীয়া তথা উপহার দেওয়া
- মু’মিন ভাইদের সাথে সাক্ষাত করা
- মহান নেয়ামত হিসেবে বেলায়েতের শুকরিয়া আদায় করা
- বেশী বেশী সালাওয়াত পাঠ করা
- অধিক পরিমানে ইবাদত আঞ্জাম দেওয়া
- মু’মিনদেরকে আপ্যায়ন করা
- রোযাদার ব্যক্তিদেরকে ইফতার করানো
- ইদে গাদীরের নামায পড়া: ইমাম সাদিক (আ.) হতে বর্ণিত রেওয়ায়েত অনুসারে, দুই রাকাত বিশিষ্ট নামায রয়েছে যার প্রতি রাকাতে সূরা হামদের পর ১০ বার সূরা ইখলাছ, ১০ বার আয়াতুল কুরসি এবং ১০ বার সূরা ক্বদর পাঠ করতে হয়। এই নামাযের পুরস্কার ১০০ হজ্ব, ১০০ উমরাহ এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সকল হাজত পূরণের সমপরিমান মনে করা হয়েছে।[৩১] যোহরের সময় এই নামায পড়তে হয়। জামাআতবদ্ধভাবে এই নামায আদায় করা জায়েয কি জায়েয নয় সে ব্যাপারে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য বিদ্যমান।[৩২]
প্রচলিত রীতি
সাইয়্যেদদের সাথে সাক্ষাত
ইরান এবং অন্যান্য কিছু মুসলিম দেশে শিয়ারা ঈদে গাদীরের দিন সাইয়্যেদদের সাথে সাক্ষাত করতে যান। সাইয়্যেদরাও এই দিন উপলক্ষে ঈদি হিসেবে টাকা অথবা কোন পণ্য প্রদান করেন।[৩৩]
গাদীর দিবসে আহার করানো
শিয়ারা গাদীর দিবসে মসজিদ ও অন্যান্য স্থানসমূহে খাবার খাওয়ানোর জন্য দস্তরখানা বিছান।[৩৪] অনুরূপভাবে রাস্তাগুলোতে শরবত ও মিষ্টি বিতরণ করেন। মিসবাহুল মুজতাহিদ গ্রন্থে বর্ণিত রেওয়ায়েত অনুসারে, গাদীর দিবসে একজন মু’মিন ব্যক্তিকে আহার করানোর সওয়াব হচ্ছে, দশ লক্ষ নবী ও সিদ্দিক এবং দশ লক্ষ শহীদকে আহার করানোর সমপরিমান।[৩৫] এই রেওয়ায়েত অনুসারে, ইমার রেযা (আ.) ঈদে গাদীরের দিন মজলিসের আয়োজন করতেন এবং তাঁর আসহাবের বিশেষ একটি দলকে ইফতারের জন্য নিজের কাছে রেখে দিতেন এবং তাদের পরিবারের জন্য খাদ্য ও উপহার সামগ্রী প্রেরণ করতেন।[৩৬]
ভ্রাতৃত্বের আকদ
শেইখ আব্বাস কুম্মি’র ভাষ্যানুযায়ী, ঈদে গাদীরের দিনে অন্যতম রীতি হচ্ছে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যার বিষয়বস্তু হচ্ছে দুনিয়াতে ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতি এবং আখেরাতে পারস্পরিক সহযোগিতা।[৩৭] এরই উপর ভিত্তি করে, কিছু কিছু শিয়াদের অন্যতম রীতি হচ্ছে গাদীর দিবসে ভ্রাতৃত্বের আকদ পাঠ করা। ইরানের ‘ফারহাঙ্গে সারায়ে আন্দিশে’ নামক সংস্থা, ঈদে গাদীরের সময়টাতে ‘বারাদারানে’ নামক একটি ভার্চুয়াল ক্যাম্পেইন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার মধ্য দিয়ে শিয়া এবং আহলে বাইতের (আ.) প্রেমিকদের মধ্যে সংহতির চেতনা এবং বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য শক্তিশালী হয়।[৩৮]
গ্রন্থপরিচিতি
ঈদে গাদীর সম্পর্কে রচিত গ্রন্থাবলী: আল্লামা আমিনীর লেখা ঈদুল গাদীর বাইনাস সাবুত ওয়াল ইসবাত আল্লামা আমিনীর লেখা ঈদুল গাদীর ফিল ইসলাম ওয়াল তাতউয়িজি ওয়াল কুরবাতি ইয়াওম আল-গাদীর (আরবি ভাষায় লেখা পুস্তিকা) মুহাম্মাদ হাদী আমিনীর লেখা ঈদুল গাদীর ফি আহদিল ফাতেমীন: বইটি ফাতেমীয়দের সময়ে গাদীর সম্পর্কে লেখা হয়েছে।[৩৯] সাইয়্যেদ আদেল আলাভি কর্তৃক রচিত ঈদুল গাদীর বাইনাস সাবুত ওয়া ইসবাত, ঈদুল গাদীর বাইনাস সাবুত ওয়াল ইসবাত।