আয়াতুল কুরসি
আয়াতুল কুরসি (আরবি: آية الكرسي, সূরা আল-বাকারা: ২৫৫); হল মহান আল্লাহর মহিমা ও সৌন্দর্যের গুণাবলীর একটি সংকলন, যার মধ্যে মহান আল্লাহর সত্তাগত গুণাবলী যেমন- একত্ববাদ, হায়াত (জীবন), চিরস্থায়ীত্ব, জ্ঞান এবং ক্ষমতার পাশাপাশি কার্যসংক্রন্ত গুণাবলী যেমন- মহাবিশ্বের মালিকানা এবং শাফায়াত বা মধ্যস্থতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই আয়াতটি «وَسِعَ كرسِيهُ السَّمواتِ والارضَ» বাক্যটির কারণে আয়াতুল কুরসি নামে পরিচিত। কেউ কেউ সূরা বাকারার ২৫৬ ও ২৫৭ নম্বর আয়াতকে এর অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু কতিপয়, রেওয়ায়েত ও অন্যান্য প্রমাণাদি অনুসারে, সূরা আল-বাকারার শুধুমাত্র ২৫৫ তম আয়াতকে আয়াতুল কুরসি বলেছেন।
হাদিসী বর্ণনার সূত্রে, এ আয়াতের অনেক বৈশিষ্ট্য ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। কিছু বর্ণনায় এ আয়াতটিকে কুরআনের সর্বোত্তম আয়াত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই আয়াতটি সর্বদা এবং সমস্ত পরিস্থিতিতে পড়ার সুপারিশ করা হয়েছে, বিশেষ করে নামাযের পরে, ওযুর পরে, ঘুমানোর আগে, ঘর থেকে বের হওয়ার সময়, বিপদ ও অসুবিধার মুখোমুখি হলে... ইত্যাদি। কিছু মুস্তাহাব নামাজে, যেমন- কবরের প্রথম রাতের নামাজে এই আয়াতটি তেলাওয়াত করার বিষয়টি এসেছে।
টেক্সট ও অনুবাদ
সূরা আল-বাকারার ২৫৫ নং আয়াতকে এই আয়াতে "আল-কুরসি" শব্দের উপস্থিতির কারণে আয়াতুল কুরসি বলা হয়। বলা হয়েছে যে, মহানবী (সাঃ) এবং ইমামগণের সময়ও আয়াতটি এই নামেই পরিচিত ছিল। আয়াতের টেক্সট ও অনুবাদ নিম্নরূপ-
দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে হেদায়াত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এখন যারা গোমরাহকারী ‘তাগুত’দেরকে মানবে না এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল যা ভাংবার নয়। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন। দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে হেদায়াত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এখন যারা গোমরাহকারী ‘তাগুত’দেরকে মানবে না এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল যা ভাংবার নয়। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন। যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কুফরী করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো দোযখের অধিবাসী, চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে।
আয়াতুল কুরসি কয়টি আয়াতের সমন্বয়ে?
শিয়া মুফাসসিরদের মধ্যে এটা সুপরিচিত যে আয়াতুল কুরসি সূরা বাকারার শুধুমাত্র ২৫৫ নং আয়াত এবং পরের দুটি আয়াত এর অংশ নয়। সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন তেহরানী ও আল্লামা তাবাতাবায়ী এর মতে, আয়াতুল কুরসি হল সূরা আল-বাকারার ২৫৫ নং আয়াত এবং এটি (وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ) বাক্যের মাধ্যমে শেষ হয়। শিয়া মুফাসসিরদের মধ্যে অন্যতম একজন, মাকারেম শিরাজী সূরা আল-বাকারার ২৫৫ নং আয়াতকে আয়াতুল কুরসি হিসেবে প্রমাণ করতে নিম্নোক্ত দলিল পেশ করেছেন-
- এই আয়াতের ফযীলতে যে সমস্ত হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তাতে শুধু এই আয়াতটিকেই আয়াতুল কুরসি বলা হয়েছে।
- কুরসি বা চেয়ারের ব্যাখ্যা শুধুমাত্র ২৫৫ নং আয়াতে পাওয়া যায়,
- কোন কোন হাদিসে উল্লেখ আছে যে, আয়াতুল কুরসী পঞ্চাশ শব্দের এবং ২৫৫ নং আয়াতে শব্দ সংখ্যা পঞ্চাশ। তার মতে, যেসব হাদিসে পরের দুই আয়াতসহ পড়তে বলা হয়েছে তাতে আয়াতুল কুরসীর বর্ণনা উল্লেখ নেই।
প্রসিদ্ধ এ মতের বিপরীতে, কতিপয় কিছু রেওয়ায়েতের উপর ভিত্তি করে সূরা আল-বাকারার ২৫৬ এবং ২৫৭ নং আয়াতকে আয়াতুল কুরসির অংশ বলে মনে করেছেন। আল-উরওয়াতুল উসকা প্রণেতা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ কাজেম তাবাতাবায়ী ইয়াজদি এহতিয়াত (সতর্কতা) হিসেবে লাইলাতুদ্ দাফন নামাজে ২৫৭ নং আয়াতের শেষ পর্যন্ত পড়ার কথা বলেছেন।
শব্দ পরিচিতি
আল-কুরসি শব্দের বেশ কিছু অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে: ১. খাট ২, রাজত্ব ৩, রাজত্ব ও শাসন কেন্দ্র ৪. জ্ঞান বলা হয়েছে যে, আয়াতে কুরসি দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে হুকুমাত, চিরস্থায়ীত্ব, আধিপত্য এবং আল্লাহর পরিকল্পনা।
শিয়া ইমামদের (আ.) বিভিন্ন বর্ণনায়, এই আয়াতটিকে মহান আল্লাহর জ্ঞান অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং আয়াতের অর্থ নিম্নরূপ: “আল্লাহ জানেন তাদের সামনে কি আছে এবং তাদের পিছনে কি আছে এবং তিনি যা চান তা ছাড়া তার "জ্ঞান" থেকে অন্য কিছু সম্পর্কে অবগত হন না। তাঁর জ্ঞান আসমান ও জমিনকে আবৃত করে রেখেছে।" ইমাম সাদিক (আ.)-এর একটি হাদিস অনুসারে, "কুরসি" হল মহান আল্লাহর এক বিশেষ জ্ঞান, যা সম্পর্কে তাঁর নবী, রাসূল এবং অন্যান্য বিশেষ ব্যক্তিদের কাউকেই অবহিত করেননি।
বিষয়বস্তু
আয়াতুল কুরসি আয়াতটিকে মহান আল্লাহর মহিমা ও সৌন্দর্যের গুণাবলীর সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং এই আয়াতে মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলী ১৬ বার উল্লেখ করা হয়েছে; এ কারণে আয়াতুল কুরসির আয়াতটিকে একত্ববাদের শ্লোগান ও বার্তা বলা হয়েছে। এই আয়াতে মহান আল্লাহর সত্তাগত গুণাবলী, যেমন- একত্ববাদ, হায়াত (জীবন), চিরস্থায়ীত্ব, জ্ঞান এবং ক্ষমতা, সেইসাথে তাঁর কার্যক্রম সংক্রান্ত গুণাবলী যেমন- মহাবিশ্বের মালিকানা এবং শাফায়াত (সুপারিশ) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ফযিলত ও বৈশিষ্ট্য
সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন তাবাতাবায়ী, তাফসিরে আল-মিজানে বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদ এবং মহান আল্লাহর নিরঙ্কুশ অভিভাবকত্ব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করার কারণে আয়াতুল কুরসির মাহাত্ম্য বিবেচনা করেছেন। আয়াতুল কুরসির ফযিলতে নবী (সাঃ) থেকে বলা হয়েছে যে, আয়াতুল কুরসি হলো আয়াতসমুহের সর্দার ও তাদের মধ্যে সর্বোত্তম এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কল্যাণ এতে রয়েছে। অন্য একটিতে বর্ণিত হয়েছে যে, বার্তাসমুহের নেতা হল কুরআন, এবং কুরআনের নেতা হল সূরা আল বাকারাহ এবং সূরা আল বাকারাহ এর সর্দার হল আয়াতুল কুরসি।
এই আয়াতটি সর্বদা মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ মনোযোগ ও শ্রদ্ধা পেয়েছে। এর কারণ হল যে, সমস্ত ইসলামী জ্ঞান ও শিক্ষা তাওহীদ কেন্দ্রিক এবং আয়াতুল-কুরসিতে তাওহীদকে ব্যাপক ও সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতে মহান আল্লাহর সত্তা এবং তাঁর গুণাবলী ও কর্ম উভয়ই বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি এই আয়াতটি একবার পাঠ করবে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার এক হাজার বিপদ দূর করবেন, যার মধ্যে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে দারিদ্র্য এবং আখেরাতে এক হাজার কষ্ট দূর করবেন, যার মধ্যে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে কবরের আযাব।
আল্লামা মাজলেসীর কোন এক বর্ণনা মতে, আয়াতুল কুরসিতে আল্লাহর ইসমে আযম নাম রয়েছে।
পাঠের ক্ষেত্র সমুহ
হাদিস অনুসারে, আয়াতুল কুরসি সর্বদা পাঠ করার কথা বলা হয়েছে, বিশেষ করে নামাজের পরে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে, ঘর থেকে বের হওয়ার সময়, বিপদ ও অসুবিধার সম্মুখীন হলে, বাহনে আরোহনের সময়, নজর লাগা থেকে বাঁচার ও সুস্থ্যতার জন্য... পড়ার সুপারিশ করা হয়েছে। ইমাম আলী (আ.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, যদি জানো যে এই আয়াতটি কী বা এতে কী আছে, তবে কোনো অবস্থাতেই এটিকে ত্যাগ করবে না।
অনেক আলেম স্বতন্ত্রভাবে এই আয়াতের তাফসির লিখেছেন, উদাহরণস্বরূপ- আব্দুর রাজ্জাক কাশানি, শামসুদ্দিন খাফারি এবং মুল্লা সাদরা। এছাড়াও, মুহাম্মাদ তাকী ফালসাফী “আয়াতুল কুরসি, তাওহীদের স্বর্গীয় বার্তা" নামে একটি বই লিখেছেন। এই বইটি হোসেইন সোজাঞ্চি দ্বারা সংকলিত এবং বিভিন্ন প্রকাশক দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে।
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- হোসাইনী তেহরানী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন, মেহরে তাবান, মাশহাদ, নুরে মালাকুতে কুরআন, ১৪২৬ হি.।
- দাশ্তী, সাইয়্যেদ মাহমুদ, আয়াতুল কুরসি দার দায়েরাতুল মায়ারেফে কুরআন, কোম, বুস্তানে কিতাব, ১৩৮২ (সৌরবর্ষ)।
- সুয়ুতী, আব্দুর রহমান বিন আবি বাকর, আল-জামিউস সাগির ফি আহাদিসিল বাশিরিন নাযির, কায়রো, ১৩৭২ (সৌরবর্ষ)।
- সুয়ুতী, আব্দুর রহমান বিন আবি বাকর, তাফসিরে দুররূল মানসুর, কোম, কিতাবখানা উমুমিয়ে আয়াতুল্লাহ মারাশী, প্রথম সংস্করণ, ১৪০৪ হি.।
- শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ বিন আলী, মায়ানিউল আখবার; তাছহিহ-আলী আকবার গাফফারী, তেহরান, দারুল মারিফা...
- তাবাতাবায়ী, সাইয়্যেদ কাযেম, حرز, দানেশনামা জাহানে ইসলাম, তেহরান, বুনিয়াদে দায়েরাতুল মায়ারিফুল ইসলামি, ১৩৮৮ (সৌরবর্ষ)।
- তাবাতাবায়ী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন, তাফসিরে আল-মিযান, বৈরুত, মুয়াসসেসেয়ে আলামি, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৯০ হি.।
- তাবাতাবায়ী ইয়াযদি, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ কাযেম, উরওয়াতুল উসকা, কোম, মুয়সসাসাতুন নাশরিল ইসলামি, আত্-তাবায়াতুল উলা, ১৪১৯ হি.।
- শেইখ তুসী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, আল-অমালী, কোম, দারুস সিকাফা, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৪ হি.।
- আসকারী, সাইয়্যেদ মুর্তাজা, আকাইদুল ইসলাম মিনাল কুরআনিল কারিম, কোম, কুলিয়্যাতু উসুলিদ দ্বীন, ১৪২৬ হি.।
- আইয়াশী, মুহাম্মাদ বিন মাসুদ, তাফসিরে আইয়াশী; তাহকিক-হাশেম রাসুলী, তেহরান, মাকতাবাতুল ইলমিয়্যাতুল ইসলামিয়্যাহ, প্রথম সংস্করণ, ১৪৮০ হি.।
- গাজ্জালী, মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ, জাওয়াহিরুল কুরআন; তাছহিহ ও মুকাদ্দামা-মুহাম্মাদ রশিদ রেযা আল-কাবানী, বৈরুত, দারু ইহয়াইল উলুম, ১৪১১ হি.।
- কুরতুবী, মুহাম্মাদ বিন আহমাদ, আল-জামিউল আহকামিল কুরআন, তেহরান, নাসরে খুসরু, ১৩৬৪ (সৌরবর্ষ)।
- কাফআশী, ইবরাহিম বিন আলী, আল-মিসবাহ, কোম, দারুর রাযি, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪০৫ হি.।
- শেইখ কুলাইনী, মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব, আল-কাফি; তাহকিক ও তাছহিহ-আলী আকবার গাফফারী ও আখুন্দী, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, চতুর্থ সংস্করণ, ১৪০৭ হি.।
- মাজলেসী, মুহাম্মাদ বাকের, বিহারুল আনওয়ার, বৈরুত, দারুল ইহয়াইত তুরাসিল আরাবি, ১৪০৩ হি.।
- মুগনিয়াহ, মুহাম্মাদ জাওয়াদ, তাফসিরুল কাশ্শাফ, কোম, দারুল কিতাবিল ইসলামি, ১৪২৪ হি.।
- মাকারে শিরাজী, নাসের, তাফসিরে নেমুনেহ, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, দশম সংস্করণ, ১৩৭১ (সৌরবর্ষ)।