আমিরুল মু’মিনীন (উপাধি)

wikishia থেকে
নিবন্ধটি আমিরুল মু’মিনীন উপাধি সম্পর্কে। শিয়াদের প্রথম ইমাম হজরত আলী (আঃ) সম্পর্কে পড়ুন।

আমিরুল মু’মিনীন (আরবি: أمير المؤمنين); উপাধিটি শিয়াদের আকিদা অনুযায়ী হজরত আলী (আ.)-এর জন্য নির্ধারিত এবং শিয়ারা এ উপাধি অপর ইমামদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে না। তাদের আকিদার ভিত্তিতে উপাধিটি প্রথমবার মহানবী (স.)-এর যুগে হজরত আলী ইবনে আবি তালিবে’ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে এবং একান্ত তার জন্যই।

৫ম হিজরীর বিশিষ্ট শিয়া মনীষী শেইখ মুফিদের ভাষ্যানুযায়ী, গাদীরের ঘটনায় মহানবি (স.) আলী ইবনে আবি তালিবকে নিজের স্থলাভিষিক্ত ও সমস্ত মুসলমানদের মাওলা তথা অভিভাবক হিসেবে পরিচয় করান এবং তাকে আমিরুল মু’মিনীন উপাধি ধরে সালাম করার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানান। দলিল হিসেবে এ প্রসঙ্গে উম্মে সালমাআনাস বিন মালিক থেকে বর্ণিত কয়েকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, স্বয়ং মহানবি (স.)-এর জীবদ্দশাতেই ‘আমিরুল মু’মিনীন’ উপাধি’র ব্যবহার করা হয়েছে।

বিশিষ্ট সুন্নি ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের ভাষ্যমতে, দ্বিতীয় খলিফার ক্ষেত্রে ‘আল্লাহর রাসুলের খলিফার খলিফা’ উপাধিটির ব্যবহার করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় এ উপাধি ব্যবহার করা হয়েছিল।

আমিরুল মু’মিনীনের অর্থ

আমিরুল মু’মিনীন হল মুসলমানদের আমীর, সেনাপতি ও নেতা অর্থে।[১] শিয়াদের দৃষ্টিতে উপাধিটি শুধুমাত্র ইমাম আলী (আ.)-এর ক্ষেত্রে ব্যবহার যোগ্য। এমনকি কিছু কিছু রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে আহলে বাইত (আ.)-এর অপর মাসুম (নিষ্পাপ) ইমামদের ক্ষেত্রেও তারা এ উপাধিটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকেন।[২] প্রসিদ্ধ মাফাতিহুল জিনান গ্রন্থে এ বিষয়ে তাগিদ করা হয়েছে যে, গাদীর দিবসে যখন পরস্পরের সাথে সাক্ষাত করবে তখন বিশেষ একটি বাক্য ব্যবহারের মাধ্যমে পরস্পরকে অভিবাদন জানাও, যে বাক্যতে আমিরুল মু’মিনীন (আ.)-এর বেলায়েতের সাথে তোমাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি তাগিদ করা হয়েছে।[৩]

আমিরুল মু’মিনীন উপাধির প্রথম ব্যবহার

শিয়া আকিদার ভিত্তিতে, আমিরুল মু’মিনীন উপাধির প্রথম ব্যবহার স্বয়ং মহানবি (স.) করেছেন এবং তিনি আলী ইবনে আবি তালিবের উদ্দেশ্যে এ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফত থেকে দূরে থাকার কারণে বিশেষভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলিফা তথা উমার ও উসমানের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।[৪]

শিয়া মনীষীগণ এ প্রসঙ্গে শিয়াসুন্নি উভয় সূত্র থেকেই বিভিন্ন রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন। উম্মু সালামাহ[৫] এবং আনাস বিন মালিক থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে ‘মহানবি (স.) তাঁর দু’জন স্ত্রীর সাথে কথোপকথনের সময় আলী ইবনে আবি তালিবকে ‘আমিরুল মু’মিনীন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।[৬]

বিশিষ্ট সুন্নি মনীষী ইবনে মারদাভাইহ ইসফাহানী’র ‘মানাকেব’ গ্রন্থে উল্লেখিত কতিপয় রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, মহানবি (স.) কয়েকবার ইমাম আলী (আ.)-কে আমিরুল মু’মিনীন উপাধি দ্বারা পরিচয় করিয়েছেন। এ রেওয়ায়েতগুলোর একটিতে এসেছে যে, আল্লাহর রাসুল (স.)-এর সমীপে হজরত জীবরাইল (আ.) আলী (আ.)-কে আমিরুল মু’মিনীন বলে সম্বোধন করেছেন।[৭]

শিয়া সূত্রাবলিতে বর্ণিত বিভিন্ন রেওয়ায়েতে এসেছে যে, গাদীরের ঘটনায় মহানবি (স.) আলী (আ.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত ও মুসলমানদের অভিভাবক হিসেবে পরিচয় করানোর পর তিনি ইমাম আলীকে ‘আমিরুল মু’মিনীন’ উপাধি ধরে সালাম করার আহবান জানান। সুতরাং মুসলমানরাও মহানবি (স.)-এর আহবান অনুসরণ করতঃ দলে দলে হজরত আলী (আ.)-এর তাবুতে প্রবেশ করেন এবং তাঁর (স.) নির্দেশ অনুযায়ী তারা ইমাম আলী (আ.)-কে সালাম করেন।[৮] অপর রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, মহানবি (স.) আবু বকর, উমর, তালহা ও যুবাইরসহ মোট ৭ জনকে নির্দেশ দেন তারা যেন এ বিশেষ উপাধি ধরে ইমাম আলীকে সালাম করেন। তারাও মহানবি (স.) এর নির্দেশ পালন করেন।[৯]

আমিরুল মু’মিনীন উপাধিটি যে, ইমাম আলী (আ.)-এর জন্য নির্ধারিত তা প্রমাণ করতে শিয়ারা উমার ইবনে খাত্তাবের একটি বাক্যকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। তিনি গাদীর দিবসে ইমাম আলী’কে সমস্ত মু’মিন পুরুষ ও নারীর অভিভাবক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।[১০] কারো কারো মতে এ সম্বোধনে ব্যবহৃত মু’মিন শব্দটি ব্যবহারের অর্থ হল, ইমাম আলী (আ.)-এর জন্য আমিরুল মু’মিনীন উপাধিটি তিনি মেনে নিয়েছিলেন।[১১]

উপাধির রাজনৈতিক ব্যবহার

দ্বিতীয় খলিফার যুগে ‘আমিরুল মু’মিনীন’ খেতাবের উৎপত্তি ও উমার বিন খাত্তাবের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার সম্পর্কে বিশিষ্ট সুন্নি ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেছেন: সাহাবাগণ আবু বকরকে আল্লাহর রাসূলের খলিফা বলে ডাকতো এবং তারপর উমার বিন খাত্তাবকে আল্লাহর রাসুলের খলিফার খলিফা বলে ডাকতো। কিন্তু দ্বিতীয় খেতাবটির ব্যবহার কষ্টসাধ্য হওয়ায় ঘটনাক্রমে সাহাবাদের কেউ একজন উমার বিন খাত্তাবকে আমিরুল মু’মিনীন বলে সম্বোধন করেন। তবে কে প্রথম এই খেতাব ধরে সম্বোধন করেছিলেন সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে তবে আব্দুল্লাহ বিন জাহেশ, আমর বিন আস, মুগাইরাহ ইবনে শো’বাহ অথবা আবু মুসা আশআরীর নাম এক্ষেত্রে উল্লেখিত হয়েছে। সাহাবারা এ খেতাবটি পছন্দ করলেন এবং তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, দ্বিতীয় খলিফাকে এ উপাধি ধরে ডাকা হবে।[১২] কিছু কিছু বর্ণনার ভিত্তিতে এ নামকরণে দ্বিতীয় খলিফার ভূমিকা ছিল।[১৩] হিজরী তৃতীয় শতাব্দির বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ইয়াকুবীর বর্ণনানুযায়ী ঘটনাটি ১৮ হিজরীর।[১৪]

ইবনে খালদুনের বর্ণনানুযায়ী তৎকালীন সময় সেনাপতিকে আমীর বলে সম্বোধন করা হত। এ কারণে সাহাবারা (১৪ হিজরিতে সংঘটিত) কাদিসিয়ার যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সেনাপ্রধানের দায়িত্বে থাকা সায়াদ বিন আবি ওয়াকাসকে আমিরুল মু’মিনীন বলে ডাকতো।[১৫]

মহানবি (স.)-এর পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের উপর শাসনকার্য চালানো বিভিন্ন শাসকদের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় আমিরুল মু’মিনীন উপাধিটি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অঙ্গনে ব্যবহৃত হয়েছে এবং আবু বকর ব্যতীত খোলাফায়ে রাশেদীনের সকল খলিফা এবং বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাসের সকল খলিফাদের ক্ষেত্রেও এ উপাধিটি সবসময় ব্যবহার করা হয়েছে।[১৬]

স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা

হিজরী ৭ম শতাব্দির বিশিষ্ট শিয়া মুহাদ্দিস সাইয়্যিদ ইবনে তাউস ‘আল-ইয়াক্বীন বিইখতিসাসি মাওলানা আলী বিইমরাতিল মু’মিনীন’ গ্রন্থে বিভিন্ন সুন্নি সূত্রে উল্লিখিত ২২০টি রেওয়ায়েতের উপর ভিত্তি করে বলেছেন, ‘আমিরুল মু’মিনীন’ উপাধিটি একমাত্র আলী (আ.)-এর জন্য।[১৭] সাইয়্যিদ ইবনে তাউসের ভাষ্যানুযায়ী, ‘আমিরুল মু’মিনীন’ এমন একটি উপাধি যা স্বয়ং মহানবি (স.) আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর জন্য নির্ধারণ করেছেন।[১৮]

তথ্যসূত্র

  1. দায়েরাতুল মাআরেফ তাশায়্যো, ১৩৬৮ সৌরবর্ষ, মাদখালু আমিরুল মু'মিনীন, খন্ডঃ ২, পৃঃ ৫২২
  2. মাজলিসি, বিহারুল আনওয়ার, ১৪০৩ হিঃ, খন্ডঃ ৩৭, পৃঃ ৩৩৪, হুররে আমোলি, ওয়াসায়েলুশ শিয়ে, ১৪১৬ হিঃ, খন্ডঃ ১৪, পৃঃ ৬০০
  3. কুম্মি, মাফাতিহুল জিনান, ১৮ ই জিলহজ্জের আমলের অন্তরভুক্ত
  4. শেখ মুফিদ, আল-এরশাদ, ১৪১৩ হিঃ খন্ডঃ ৪৮, ইবনে ওকদা, কুফি, ফাযায়েলে আমিরুল মু'মিনীন, ১৩৭৯ সৌরবর্ষ, পৃঃ ১৩, আরো দেখুনঃ ইবনে আসাকের, তারিখে মাদিনাতু দামেস্ক, ১৪২৫ হিঃ, খন্ডঃ ৪২, পৃঃ ৩০৩ ও ৩৮৬, আবু নাঈম ইস্পাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া, ১৪০৭ হিঃ খন্ডঃ ১, পৃঃ ৬৩
  5. শেখ মুফিদ, আল-এরশাদ, ১৪১৩ হিঃ, খন্ডঃ ১, পৃঃ ৪৮
  6. ইবনে আসাকের, তারিখে মাদিনাতু দামেশক, ১৪২৫ হিঃ, খন্ডঃ ৪২, পৃঃ ৩০৩ ও ৩৮৬, শেখ মুফিদ, আল-এরশাদ, ১৪১৩ হিঃ, খন্ডঃ ১, পৃঃ ৪৮, আবু নাঈম ইস্পাহানী, জালিয়্যাতুল আওলিয়া, ১৪০৭ হিঃ, খন্ডঃ ১, পৃঃ ৬৩।
  7. ইবনে মারদাভিয়া, মানাকেব, ১৩৮২ সৌরবর্ষ, পৃঃ ৬২-৬৪।
  8. শেখ মুফিদ, আল-এরশাদ, ১৪১৩ হিঃ, খন্ডঃ ১, পৃঃ ১৭৬।
  9. শেখ মুফিদ, আল-এরশাদ, ১৪১৩ হিঃ, খন্ডঃ ১, পৃঃ ৪৮
  10. শেখ মুফিদ, আল-এরশাদ, ১৪১৩ হিঃ, খন্ডঃ ১, পৃঃ ১৭৭।
  11. মুন্তাযারি মুকাদ্দাম, “বাররাসিয়ে করবোর্দ হয়ে লাকাবে আমিরুল মু’মিনীন দার বাস্তারে তারিখে ইসলাম, পৃঃ ১৩৬,
  12. ইবনে খালদুন, দিভানে আল-মুবতাদা ওয়াল খাবার, ১৪০৮ হিঃ, খন্ডঃ ১, পৃঃ ২৮৩
  13. তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, বেইরুত, খন্ডঃ ৪, পৃঃ ২০৮
  14. ইয়াকুবি, তারিখুল ইয়াকুবি, দ্বারে সাদের, খন্ডঃ ২, পৃঃ ১৫০
  15. ইবনে খালদুন, দিভানে আল-মুবতাদা ওয়াল খাবার, ১৪০৮ হিঃ, খন্ডঃ ১, পৃঃ ২৮৩
  16. ইবনে খালদুন, দিভানে আল-মুবতাদা ওয়াল খাবার, ১৪০৮ হিঃ, খন্ডঃ ১, পৃঃ ২৮৩
  17. তাকাদ্দোমি মাসুমি, নুরুল আমির ফি তাসবিতি খুতবাতুল গ্বাদীর, ১৩৭৯ সৌরবর্ষ, পৃঃ ৯৭
  18. আল-ইয়াকিন বি-ইখতিসাসি মাওলানা আলী (আঃ) বি’মিরাতিল মু’মিনীন, হাদিস নেট সাইট।

গ্রন্থপঞ্জি

  • আবু নাঈম ইস্পাহানী, আহমাদ ইবনে আব্দিল্লাহ, হিলইয়াতুল আউলিয়া ওয়া তাবাকাতুল আস্ফিয়া, বেইরুত, দারুল কিতাবুল আরাবী, ১৪০৭ হিঃ
  • ইবনে খালদুন, আব্দুর রাহমান ইবনে মোহাম্মাদ, দিওয়ানুল মুবতাদা ওয়াল খাবার ফি তারিখিল আরাবে ওয়াল বিরার ওয়া মান আসারাহুম মিন যাভি শানিল আকবর, তাহকিকে খালিল শাহাদাত, বেইরুত, দারুল ফিকর, ১৪০৮ হিঃ/১৯৮৮ খ্রীঃ
  • ইবনে আসাকের, তারিখু মাদিনাতু দামেস্ক, তাহকিকে আলী শিরি, বেইরুত, দারুল ফিকর, ১৪২৫ হিঃ
  • ইবনু উকদাহ কুফি, ফাযায়েলু আমিরুল মুমিনীন, সংকলকঃ আব্দুর রাজ্জাক মোহাম্মাদ হুসাইন হেরয উদ্দিন, কোম, দলিল প্রকাশনী, ১৩৭৯ সৌরবর্ষ
  • ইবনু মারদাভিয়ে, আহমাদ ইবনে মুসা, মানাকিবে আলী ইবনে আবি তালিব, কোম, দারিল হাদিস, ১৩৮২ সৌরবর্ষ
  • উম্মে তালাব মুস্তাফা, দভারি দার আন্দিশে হ'য়ে ইবনে খালদুন দারব'রেয়ে ইমাম আলী আলাইহিস সালাম ওয়া মাসআলেয়ে খেলাফাত, মিশকাত, সংখ্যা ৮৭, ১৩৮৪ সৌরবর্ষ
  • তাকাদ্দুমি মাসুমি, আমির, নুরুল আমির আলাইহিস সালাম ফি তাসবিতি খুতবাতুল গাদ্বীর, মুয়াইয়িদাতু হাদিসিয়্যাতু মিন কুতুবি আহলিস সুন্নাতু লি খুতবাতিন নাবিয়্যিল আযাম আল-গ্বাদীরিয়্যা,কোম, মোউলুদুল কাবে, ১৩৭৯ সৌরবর্ষ
  • হুররে আমেলী, মোহাম্মাদ ইবনে হাসান, ওয়াসেয়েলুশ শীয়া, তাহকিকে মোহাম্মাদ রেযা হুসাইনী জালালী, কোম, মুআসসাসাতু আ'লুল বাইত লি এহইয়াউত তুরাস, ১৪১৬ হিঃ
  • দায়েরাতুল মাআরেফে তাশায়্যু,আহমাদ সাদর, হাজ্বী সায়্যেদ জাওয়াদি, কামরান ফানই ও বাহাউদ্দীন খোররামশাহী, খন্ডঃ ২, তেহরান, মুআসসেসেয়ে ইন্তেশারাতে হেকমাত, ১৩৬৮ সৌরবর্ষ।