ভীতি প্রদর্শনের আয়াত

wikishia থেকে

ভীতি প্রদর্শনের আয়াত (আরবি: آية الإنذار) হচ্ছে পবিত্র কুরআনের সূরা শু’আরা এর ২১৪নং আয়াত। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূলকে (সা.) আদেশ করেন যে, তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভীতি (সতর্ক) প্রদর্শন কর এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দাও। এ আয়াত নাযিলের পর মহানবী (সা.) তাঁর নিকটাত্মীয়দের মধ্য থেকে ৪০ জনকে দাওয়াত দিয়ে তাদেরকে প্রকাশ্যে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানান এবং আলী ইবনে আবি তালিবকে (আ.) স্বীয় স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ঘোষণা দেন। শিয়া মাযহাবের কালামশাস্ত্রবিদগণ এ আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কিত রেওয়ায়েতসমূহের আলোকে ইমাম আলীর (আ.) স্থলাভিষিক্তের বিষয়টি প্রমাণ করেছেন।

ইমাম আলীর (আ.) ইমামতের সর্বপ্রথম সনদ

সূরা শু’আরা এর ২১৪নং আয়াতটি ভীতি প্রদর্শনের আয়াত হিসেবে প্রসিদ্ধ ও পরিচিত। এছাড়া সূরা শুরা’র ৭নং আয়াত এবং সূরা মাদ্দাসসিরের ১ ও ২ নং আয়াতও ভীতি প্রদর্শন ও সতর্ককারী আয়াত হিসেবে পরিচিত।[১] আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে রাসূলের (সা.) প্রতি আদেশ দিয়েছেন যে, তোমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি সতর্ক ও ভীতিপ্রদর্শন কর। তাফসীরে নমুনাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শিরক ও খোদাদ্রোহীতা হতে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।[২]

ভীতি প্রদর্শনের আয়াতটি (সূরা শু’আরা এর ২১৪নং আয়াতটি) ইসলাম ধর্মের প্রকাশ্য দাওয়াতের সর্বপ্রথম আদেশ সম্বলিত আয়াত।[৩] এ আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে যে সব হাদীস ও রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোর আলোকে এ আয়াতকে শিয়া পণ্ডিতগণ আলী ইবনে আবি তালিবের (আ.) বেলায়েত ও স্থলাভিষিক্তের বিষয়ে সবচেয়ে অকাট্য দলিল হিসেবে গণ্য করেছেন।[৪] ইতিহাসবিদগণ বর্ণনা করেছেন যে, আলোচ্য আয়াতটি রাসূলের (সা.) বে’সাতের তৃতীয় বর্ষে নাযিল হয়েছে।[৫]

মূল আয়াতটি হচ্ছে, وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ  ‘তোমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভীতি (সতর্ক) প্রদর্শন কর।’ (সূরা শু’আরা, আয়াত নং ২১৪)

রাসূলের (সা.) স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ইমাম আলীকে (আ.) ঘোষণা

শিয়াসুন্নী উভয় মাযহাবের প্রথমসারির তাফসীরের বর্ণনা অনুযায়ী ভীতি প্রদর্শনের আয়াত নাযিলের পর রাসূল (সা.) স্বীয় নিকটাত্মীয়দের মধ্যে ৪০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অতিথেয়তার দাওয়াত দেন। এ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত সবাইকে আল্লাহর একত্ববাদ ও স্বীয় রেসালতের প্রতি সাক্ষ্য দানের আহ্বান জানান। অতঃপর তিনি পর পর দুই অথবা তিনবার এ বাক্যটি উচ্চারণ করেন: তোমাদের মধ্যে কে আমাকে এ কাজে সহযোগিতা করবে, যে হবে আমার ভাই, সাহায্যকারী এবং স্থলাভিষিক্ত? এ সময় সবাই নীরব ও নিশ্চুপ ছিল। শুধুমাত্র ইমাম আলী (আ.) প্রতিবারই রাসূলকে (সা.) উদ্দেশ্য করে বলেন: হে রাসূলুল্লাহ! আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই! তারপর মহানবী (সা.) বলেন: এই আলী হলো তোমাদের মাঝে আমার স্থলাভিষিক্ত, খলিফা এবং সাহায্যকারী। তোমরা তাকে মান্য করবে।[৬] মাজমাউল বায়ান কিতাবে এ শানে নুযুলকে শিয়াআহলে সুন্নত উভয় মাযহাবের নিকট প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[৭]

শিয়া কালামশাস্ত্রবিদগণ উপরোক্ত রেওয়ায়েতকে সহীহ ও মুতাওয়াতির হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[৮] আর এ রেওয়ায়েতকে রাসূলের (সা.) পর আমিরুল মু’মিনিন আলীর (আ.) খেলাফত ও ইমামতের পক্ষে সুদৃঢ় সনদ হিসেবে গণ্য করা হয়।[৯]

নিকটাত্মীয়দের প্রতি প্রথম ইসলামের দাওয়াতের কারণ

বিশিষ্ট মুফাসসিরগণ রাসূল (সা.) কর্তৃক স্বীয় নিকটাত্মীয়দের প্রতি সর্বপ্রথম ইসলামের দাওয়াত দানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণের কথা উল্লেখ করেছেন; সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-

  1. ধর্মের ব্যাপারে নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভীতিপ্রদর্শন ও সতর্ক করার ক্ষেত্রে বৈষম্য পরিহার করা এবং  অন্যদের প্রতি অবহেলা না করা।[১০]
  2. নিকটাত্মীয়দের একত্রিত করা এবং তাদের প্রতি ভীতিপ্রদর্শন ও সতর্ক করা অন্যান্য গোত্রের লোকদের তুলনায় রাসূলের (সা.) জন্য সহজসাধ্য ছিল।[১১]
  3. নিকটাত্মীয়রা যদি ইসলামের প্রতি ঈমান আনয়ন করে তাহলে তাদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সম্ভব হবে।[১২]
  4. বড় ধরনের কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা প্রথমে নিজস্ব গণ্ডি থেকে হওয়া উচিত।[১৩]
  5. নিকটাত্মীয়রা  রাসূলকে (সা.) অন্যদের তুলনায় ভালভাবে চিনতেন ও জানতেন এবং আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে তারা  সহজেই তাঁর কথা শ্রবণ করবেন। এছাড়া তারা অন্যদের তুলনায় রাসূলের (সা.) প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতাপোষণ থেকে দূরে থাকবে।[১৪]

তথ্যসূত্র

  1. বেশাভি, আয়ে ইনযার, পৃ.১৪৯।
  2. মাকারেম, তাফসীরে নমুনা, ১৩৭৪ ফার্সি সন, খণ্ড ১৫, পৃ. ৩৬৬।
  3. মাওলাঈ নিয়া ওয়া মু’মিনি, তাফসীরে তাতবিকি আয়ে ইনযার আয দিদগাহে ফারিকাঈন, পৃ. ১৬৪।
  4. মাওলাঈ নিয়া ওয়া মু’মিনি, তাফসীরে তাতবিকি আয়ে ইনযার আয দিদগাহে ফারিকাঈন, পৃ. ১৬৪।
  5. দ্র: ইবনে আসির, আল-কামেলু ফিত তারিখ, ১৩৮৫ ফার্সি সন, খণ্ড ২, পৃ. ৬০; বালাযুরি, আনসাবুল আশরাফ, ১৪১৭ হি., খণ্ড ১, পৃ. ১১৬; ভেশনাভি, হায়াতুন নাবী ওয়া সীরুতুহ, ১৪২৪ হি., খণ্ড ১, পৃ. ১০৫।
  6. বাহরানি, আল-বুরহান, আল-মাক্তাবাতুল ইলমিয়্যাহ, খণ্ড ৪, পৃ. ১৮৬-১৮৯; ফুরাত আল-কুফি, তাফসীরে ফুরাত আল-কুফি, ১৪১০ হি., পৃ. ৩০০; ইবনে কাসির, তাফসীরুল কুরআনিল আযিম, ১৪০৬ হি., খণ্ড ৬, পৃ. ১৫১-১৫৩; সুয়ুতি, আল-দুররুল মানসুর, ১৪০৪ হি., খণ্ড ৫, পৃ. ৯৭; হাসকানি, শাওয়াহেদুত তানযিল, ১৪১১ হি., খণ্ড ১, পৃ. ৫৪২-৫৪৩; তাবারসি, মাজমাউল বায়ান, ১৪০৬ হি., খণ্ড ৭, পৃ. ৩২২-৩২৩।
  7. তাবারসি, মাজমাউল বায়ান, ১৩৭২ ফার্সি সন, খণ্ড ৭, পৃ. ৩২২।
  8. বেশাভি, আয়ে ইনযার, পৃ.১৪৯।
  9. শেইখ মুফিদ, রিসালাতু ফি মা’নিল মাওলা, ১৪১৩ হি., পৃ. ৩৯ ও ৪০; শেইখ মুফিদ, আল-ফুসুল আল-মুখতারাহ, ১৪১৩ হি., পৃ. ৯৬; নুবাতি বায়াদ্বি, আল-সীরাতুল মুস্তাকিম, ১৩৮৪ হি., খণ্ড ১, পৃ. ৩২৫; খণ্ড ২, পৃ. ২৯।
  10. তাবারসি, মাজমাউল বায়ান, ১৩৭২ ফার্সি সন, খণ্ড ৭, পৃ. ৩২২।
  11. তাবারসি, মাজমাউল বায়ান, ১৩৭২ ফার্সি সন, খণ্ড ৭, পৃ. ৩২২।
  12. মুগনিয়াহ, তাফসীরুল কাশেফ, দারুল আনওয়ার, খণ্ড ৫, পৃ. ৫২১।
  13. মাকারেম, তাফসীরে নমুনা, ১৩৭৪ ফার্সি সন, খণ্ড ১৫, পৃ. ৩৬৬।
  14. মাকারেম, তাফসীরে নমুনা, ১৩৭৪ ফার্সি সন, খণ্ড ১৫, পৃ. ৩৬৬।

গ্রন্থপঞ্জি

  • ইবনে আসির, আলী বিন মুহাম্মাদ, আল-কামেল ফিত তারিখ, বৈরুত, দারু সাদের, ১৩৮৫-১৩৮৬ ফার্সি সন।
  • ইবনে কাসির দামেস্কি, ইসমাঈল বিন উমর, তাফসীরুল কুরআনিল আযিম, বৈরুত, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ মানশুরাতু ‍মুহাম্মাদ আলী বেইদ্বুন, ১৪১৯ হি.।
  • বাহরানি, সাইয়্যেদ হাশেম, আল-বুরহান ফি তাফসীরিল কুরআন, তেহরান, বুনিয়াদে বেসাত, ১৪১৬ হি.।
  • বেশাভি, মুহাম্মাদ ইয়াকুব, ((আয়ে ইনযার)), দার দানেশনামেয়ে হাজ্ব ওয়া হারামাইন শারীফাইন, খণ্ড ১, স্থান অজ্ঞাত, পেঝুহেশকাদে হাজ্ব ওয়া যিয়ারাত, ১৩৯২ ফার্সি সন।
  • বালাযুরি, আহমাদ বিন ইয়াহইয়া, আনসাবুল আশরাফ, তাহকিক: মুহাম্মাদ বাকের মাহমুদি, বৈরুত, দারুল মাআরেফ, ১৪১৭ হি.।
  • হাসকানি, উবায়দুল্লাহ বিন আহমাদ, শাওয়াহেদুত তানযিল লি কাওয়ায়েদিত তাফদ্বীল, তেহরান, সাযেমানে চাপ ওয়া ইন্তেশারাতে ভেযারাতে আরশাদে ইসলামী, ১৪১১ হি.।
  • সুয়ুতি, জালালুদ্দিন, আল-দুররুল মানসুর, কোম, কিতাব খানেয়ে আয়াতুল্লাহ মারআশি নাজাফি, ১৪০৪ হি.।
  • শেইখ মুফিদ, মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ, রিসালাতু ফি মা’নিল মাওলা, কোম, ইন্তেশারাতে কংগ্রেয়ে জাহানিয়ে শেইখ মুফিদ, ১৪১৩ হি.।
  • শেইখ মুফিদ, মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ, আল-ফুসুল আল-মুখতারাহ, কোম, ইন্তেশারাতে কংগ্রেয়ে জাহানিয়ে শেইখ মুফিদ, ১৪১৩ হি.।
  • তাবারসি, ফাযল বিন হাসান, মাজমাউল বায়ান ফি তাফসীরিল কুরআন, বৈরুত, দারুল মা’রেফাহ ওয়া আফাসাতু তেহরান, নাসের খসরু, ১৪০৬ হি.।
  • ফুরাত কুফি, ফুরাত বিন ইব্রাহিম, তাফসীরে ফুরাত আল-কুফি, তেহরান, সাযেমানে চাপ ওয়া ইন্তেশারাতে ভেযারাতে এরশাদে ইসলামী, ১৪১০ হি.।
  • মুগনিয়াহ, মুহাম্মাদ জাওয়াদ, আত তাফসীরুল কাশেফ, বৈরুত, দারুল আনওয়ার, তারিখ অজ্ঞাত।
  • মাকারেম শিরাজী, নাসের, তাফসীরে নমুনা, তেহরান, দারুল কুতুব আল-ইসলামিয়্যাহ, ১৩৭৪ হি.।
  • মাওলাঈ নিয়া, ইযযাতুল্লাহ ওয়া মুহাম্মাদ আমিন মু’মিনি, তাফসীরে তাতবিকি আয়ে ইনযার আয নেগাহে ফারিকাঈন, দার পেঝুহেশহায়ে তাফসীরে তাতবিকি, সংখ্যা ১, ১৩৯৪ ফার্সি সন।
  • নুবাতি বায়াদ্বি, আলী বিন ইউনুস, আল-সীরাতুল মুস্তাকিম, নাজাফ, চাপে কিতাব খানেয়ে হাইদারিয়া, ১৩৮৪ ফার্সি সন।
  • ভেশনাভি, মুহাম্মাদ কাওওয়াম, হায়াতুন নাবী ওয়া সীরাতুহ, কোম, সাযেমানে ঔকাফ ওয়া উমুরে খেইরিয়ে, ১৪২৪ হি.।