লাইলাতুল মাবিত-এর আয়াত
লাইলাতুল মাবিত-এর আয়াত (আরবি: آية ليلة المبيت); হযরত আলী (আ.)-এর আত্মত্যাগ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে যিনি মহানবি (সা.) -এর জীবন বাঁচাতে তাঁর বিছানায় শুয়েছিলেন। এই আয়াতে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে যারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের বিনিময়ে তাদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।
আয়াত ও অনুবাদ
আয়াতে লাইলাতুল মাবিত বা আয়াতে শিরা হিসেবে প্রসিদ্ধ হচ্ছে-
অনুবাদ: আর মানুষের মাঝে এক শ্রেণীর লোক রয়েছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে নিজেদের জানের বাজি রাখে, আর আল্লাহ হলেন তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান। (সূরা: আল-বাকারা:২০৭)
শানে নুযূল
- মূল নিবন্ধ: লাইলাতুল মাবিত
আল্লামা তাবাতাবায়ী তাফসিরে আল-মিজান গ্রন্থে লিখেছেন, অনেক হাদিসে বলা হয়েছে যে এই আয়াতটি লাইলাতুল মাবিত সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।[১] ইবনে আবি আল-হাদিদ নামে একজন মুতাযিলি পণ্ডিত, তার নাহজুল আল-বালাগার ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সকল তাফসীরকাররা একমত যে এই আয়াতটি ইমাম আলী (আ.)-এর সম্মানে এবং লাইলাতুল মাবিত ঘটনা সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছিল।[২] লাইলাতুল মাবিত রাতে মক্কার মুশরিকরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিল যে একত্রে আক্রমণ করে মহানবি (সা) কে হত্যা করবে। এই রাতে, ইমাম আলী (আ.) মহানবির (সা) জীবন বাঁচানোর জন্য তাঁর বিছানায় শুয়েছিলেন এবং এভাবেই নবী মুশরিকদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পান।[৩]
অবশ্য, কিছু সুন্নী পন্ডিত, কতিপয় রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করে, এই আয়াতটিকে আবু যার, সোহাইব বিন সিনান[৪], আম্মার ইয়াসির এবং তার পিতামাতা, খাব্বাব বিন আরাত এবং বিলাল হাবশী [৫] এর মতো সাহাবিদের আত্মত্যাগ সম্পর্কে অবতিীর্ণ হয়েছে বলে মনে করেছেন। তবে, এই হাদিসগুলির বৈধতা নিয়ে সন্দেহ করা হয়েছে এবং কিছু গবেষকের মতে, এই হাদিসগুলিকে ইমাম আলী (আ.) প্রতি বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে এবং তাঁর শান-শৌকত ও মর্যদাকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে জাল করা হয়েছে।[৬]
তাফসির ভিত্তিক টীকা
আয়াতে শেরাকে তাদের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে যারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে এবং এর জন্য তাদের জীবন দিতে ইচ্ছুক।[৭] এই দলটি সূরা বাক্বারা এর ২০৫-২০৬ এ বর্ণিত দলটির বিপরীত যারা স্বার্থপর, একগুঁয়ে, শত্রুভাবাপন্ন, মুনাফিক এবং পরোপকারী হওয়ার ভান করে, কিন্তু তাদের লক্ষ্য ফিতনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা।[৮] আল্লামা তাবাতায়ীর মতে, আয়াতের বর্ণনার ধারা থেকে প্রতীমান হয় যে মহানবি (সা.) এর সময়ে এই দুটি দলের প্রকৃত চেহারা বিদ্যমান ছিল।[৯]
আয়াতে শিরা এর ব্যাখ্যায় কিছু মুফাসসির শিরায়ে নাফস বা আত্মা বিক্রয়কে তিন ভাগে ভাগ করেছেনঃ জাহান্নামের ভয়ে, বেহেশত কামনায়, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে শিরায়ে নাফস বা আত্মা বিক্রয়ের সর্বোচ্চ স্তর হিসাবে বিবেচনা করেছেন যারা এর বিনিময়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছুই আশা করে না এবং লাইলাতুল মাবিত-এ রাসূল (সা.)-এর বিছানায় ইমাম আলী (আ.)-এর ঘুমানোর বিষয়টি এই স্তরের অন্তর্ভূক্ত।[১০]
আল্লামা তাবাতাবায়ী এর মতে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবন বিক্রি করার অর্থ হল এই যে, এই সকল ব্যক্তিরা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছুই চায় না এবং তারা তাই চায় যা আল্লাহ চান।[১১]
তথ্যসূত্র
- ↑ তাবাতাবায়ী, তাফসিরুল মিযান, ১৩৯০ হিঃ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-১০০।
- ↑ ইবনে আবিল হাদিদ,শারহে নাহজুল বালাগাহ, ১৪০৪ হিঃ, খণ্ড-১৩, পৃষ্ঠা নং-২৬২।
- ↑ সাদুক, আমালী, ১৪১৪ হিঃ, পৃষ্ঠা নং-৪৬৬।
- ↑ তাবারী, জামেউল বায়ান, ১৪২২ হিঃ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা নং-৫৯১
- ↑ ফখরুদ্দীন রাযী, তাফসিরে আল-কাবির, ১৪২০ হিঃ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা নং-৩৫০।
- ↑ হাশেমী, বাররাসিয়ে সাবাবে নুযুলে আয়াতে ইশতেরায়ে নাফস, পৃষ্ঠা নং-১৫৩।
- ↑ তালেক্বানী, পার্তুই আয কুরআন, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-১০০।
- ↑ মাকারেম শিরাজী, তাফসিরে নেমুনেহ, ১৩৭১ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-৭৯।
- ↑ তাবাতাবায়ী, তাফসিরুল মিযান, ১৩৯০ হিঃ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-৯৮।
- ↑ সাদেকী তেহরানী, আল-ফুরকানু ফি তাফসিরিল কুরআন, ১৪০৬ হিঃ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা নং-২২৫-২২৬।
- ↑ তাবাতাবায়ী, তাফসিরুল মিযান, ১৩৯০ হিঃ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-৯৮।
গ্রন্থপঞ্জি
- ইবনে আবিল হাদিদ, আব্দুল হামিদ বিন হেবাতুল্লাহ, শারহে নাহজুল বালাগাহ, তাছহিহ: ইবরাহিম মুহাম্মাদ আবুল ফাযল, কোম, মাকতাবাতু আয়াতুল্লাাহ আল-মারাশী নাজাফী, ১৪০৪ হিঃ।
- সাদেকী তেহরানী, মুহাম্মাদ, আল-ফুরকানু ফি তাফসিরিল কুরআন, কোম, ফারহাঙ্গে ইসলামী, ১৪০৬ হিঃ।
- তালেক্বানী, সাইয়্যেদ মাহমুদ, পার্তুই আয কুরআন, তেহরান, শেরকাতে সাহামিয়ে ইন্তেশার, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ)।
- তাবাতাবায়ী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন, তাফসিরুল মিযান, বৈরুত, মুয়াস্সাসাতুল আলামী লিল্ মাতবুয়াত, ১৩৯০ হিঃ।
- মাকারেম শিরাজী, নাসের, তাফসিরে নেমুনেহ, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৩৭১ (সৌরবর্ষ)।