হাদীসে বেলায়াত

wikishia থেকে

হাদীসে বেলায়াত; মহানবি (স.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস এবং আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর ইমামত প্রমাণে শিয়াদের অন্যতম দলীল। হাদীসটি বর্ণনা ভিন্নতায় শিয়াসুন্নি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে; তবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বর্ণনাটি হল (هُوَ وَلِیُّ کُلِّ مُؤْمِنٍ بَعْدی)-আমার পরে সে (আলী) প্রত্যেক মু’মিনের ওয়ালি।

হাদীসে উল্লেখিত ‘ওয়ালি’ শব্দটিকে শিয়ারা ইমাম ও অভিভাবক অর্থে গ্রহণ করে এবং এর মাধ্যমে ইমাম আলী (আ.)-এর বেলায়াতকে প্রমাণ করে। তাদের বিশ্বাস আভিধানিক দৃষ্টকোণ থেকে ‘ওয়ালি’ এই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে শাইখাইন, সাহাবা, তাবেঈন এমনকি আহলে সুন্নতের অনেক আলেমও শব্দটিকে এ অর্থেই ব্যবহার করেছেন; এতদসত্বেও আহলে সুন্নতের দাবী শব্দটি ‘বন্ধু’ ও ‘অভিভাবক’ অর্থে এসেছে এবং হযরত আলীর (আ.) ইমামত ও বেলায়েতের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

মূল হাদীস

ইমরান ইবনে হুছাইন থেকে জাফর ইবনে সুলাইমান বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসূল (স.) একটি দলকে এক যুদ্ধে প্রেরণ করলেন এবং তাদের নেতৃত্বের ভার দিলেন হযরত আলী ইবনে আবি তালিবকে। তারা ঐ যুদ্ধে বেশ কিছু গণিমত লাভ করে। হযরত আলীর (আ.) গনিমত বন্টনের পদ্ধতি তাদের মনপূত না হওয়ায় তাদের ৪ জন সিদ্ধান্ত নিল যে তারা মহানবি (স.)-এর সাথে সাক্ষাতে হযরত আলীর (আ.) এ আচরণ সম্পর্কে অভিযোগ করবে। তারা একে একে মহানবি (স.)-এর কাছে অভিযোগ করে বললো: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি জানেন আলী (আ.) এমন আচরণ করেছে?

আল্লাহর রাসূল (স.)-এর চেহারা মোবারকে রাগের চিহ্ন স্পষ্ট হল, তিনি বললেন: আলীর (আ.) কাছ থেকে তোমরা কি চাও? আলীর (আ.) কাছ থেকে তোমরা কি চাও? ‘আমি আলী থেকে, আর আলী আমার থেকে এবং আমার পর আলী হল প্রত্যেক মু’মিনের ওয়ালি’।[১]

বর্ণনার শব্দে ভিন্নতা

হাদীসে বেলায়াত শব্দ ভিন্নতায় শিয়া ও সুন্নি সূত্রসমূহে বর্ণিত হয়েছে; যেমন: ১, علی ولیّ کل مؤمن بعدی ২, هو ولی کل مؤمن بعدی ৩, انت ولی کل مؤمن بعدی ৪, أنت ولی کل مؤمن بعدی و مؤمنه ৫, انت ولیی فی کل مؤمن بعدی ৬, فانه ولیکم بعدی ৭, ان علیا ولیکم بعدی ৮, هذا ولیکم بعدی ৯, انک ولی المؤمنین من بعدی ১০, انت ولیی فی کل مؤمن بعدی ১১, و انت خلیفتی فی کل مؤمن من بعدی ১২, و فهو اولی الناس بکم بعدی ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বিষয়বস্তু

শিয়া আকিদার ভিত্তিতে হাদীসে বেলায়েতের বিষয়বস্তু হল হযরত আলী (আ.)-এর ইমামত ও বেলায়াত।[১৪] তাদের মতে ‘ওয়ালি’ শব্দের অর্থ হল অভিভাবক, ইমাম, নেতা ও খলিফা।[১৫] কিন্তু আহলে সুন্নত মনে করে হাদীসটি হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের স্থলাভিষিক্ততার বিষয়ে নির্দেশক নয়, কেননা তাদের দাবী ‘ওয়ালি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল বন্ধুত্ব ও সাহায্য করা।[১৬] নিজেদের বিশ্বাস প্রমাণে শিয়ার বলে: ‘ওয়ালি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল অভিভাবক, নেতা, খলিফা, এখতিয়ারের অধিকারী এবং ইমাম; এছাড়া ইসলামের প্রাথমিক যুগে এবং পরবর্তী সময়েও শব্দটি খলিফা ও অভিভাবক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম খলিফা[১৭] দ্বিতীয় খলিফা[১৮], সাহাবা[১৯], তাবেঈ[২০] এবং আহলে সুন্নতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আলেম[২১] শব্দটি খলিফা ও অভিভাবক অর্থে ব্যবহার করেছেন, যুক্তি হিসেবে তারা এ বিষয়টিকে উপস্থাপন করে থাকে।[নোট ০১]

সনদ

আব্দুল কাদের বাগদাদী ও ইবনে হাজার আসকালানী বলেছেন, হাদীসটি তিরমিযী নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী সনদে ইমরান ইবনে হুছাইন থেকে বর্ণনা করেছেন।[২২] মুত্তাকী হিন্দীও হাদীসটি সহীহ আখ্যায়িত করেছেন।[২৩] হাকিম নিশাবুরির মতে হাদীসের সনদ সহীহ, অবশ্য মুসলিম ও বুখারি তাদের সাহীহাইনে হাদীসটি আনেন নি।[২৪] একইভাবে শামসুদ্দীন যাহাবী ও নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।[২৫]

যে সকল গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখিত হয়েছে

হাদীসে বেলায়াত সহীহ তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল,[২৬] সুয়ূতী প্রণীত জামেউল আহাদীস,[২৭] কানযুল উম্মাল,[২৮] মুসনাদে আবি দাউদ,[২৯] ফাদ্বায়েলুস সাহাবা, [৩০] আল-আহাদ ওয়াল মাসানী, [৩১] সুনানে নাসাঈ,[৩২] মুসনাদে আবু ইয়া’লা, [৩৩] সাহীহ ইবনে হাব্বান, [৩৪] তাবরানী প্রণীত আল-মুজামুল কাবির,[৩৫] তারিখু মাদিনাতি দামেশক,[৩৬] আল-বেদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ,[৩৭] আল-ইসাবাহ,[৩৮] আল-জওহারাহ ফি নাসাবিল ইমাম আলী ও আলিহি,[৩৯] খাযানাতুল আদাব ওয়া লুব্বু লুবাবি লিসানিল আরাব,[৪০] আল-গাদীর,[৪১] আল-ইস্তিয়াব[৪২] ও কাশফুল গুম্মাহতে[৪৩] বর্ণিত হয়েছে।

সনদের বিশ্লেষণ

মুবারাকফুরি দাবী করেছেন যে, (بعدی) শব্দটি হাদীসে বেলায়েতের কিছু কিছু বর্ণনায় উল্লেখ না হলেও শিয়া রাভিরা শব্দটিকে সংযুক্ত করেছেন। তিনি নিজের দাবী সত্য প্রমাণে মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বালের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, মুসনাদে হাদীসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, তার দাবী ‘কোন এক বর্ণনাতেও (بعدی) শব্দটি নেই’।[৪৪] অবশ্য আহমাদ ইবনে হাম্বাল হাদীসটি তার মুসনাদ [৪৫] ও ফাদ্বায়েলুস সাহাবা গ্রন্থে (بعدی) শব্দসহ উল্লেখ করেছেন।[৪৬]

একইভাবে মোবারকফুরির (আবুল আলা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুর রহমান ১২৮৩-১৩৫৩ হি.) দাবী হাদীসটি শুধুমাত্র জাফর বিন সুলাইমানইবনে আজলাহ কেন্দি বর্ণনা করেছেন। আর তারা উভয়েই শিয়া হওয়ার কারণে তাদের হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। মোবারকফুরির দৃষ্টিতে শিয়ারা আহলে বিদআত, আর কোন বিদআতি যদি এমন কোন রেওয়ায়েত বর্ণনা করে যা তার মাযহাব শক্তিশালী হওয়ার কারণ হয় তবে তা অগ্রহণযোগ্য।[৪৭] অথচ আলবানী’র ভাষ্যানুযায়ী কারো নিকট থেকে হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নতের মানদণ্ড হল সত্যবাদিতা ও হাদীস বর্ণনায় অধিক যত্নবান হওয়া এবং হাদীস গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষেত্রে রাভি’র মাযহাব কোন ভূমিকা রাখে না। এ কারণেই বুখারিমুসলিম সাহীহাইনে এমন কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন যেগুলোর রাভি আহলে সুন্নতের মাযহাব বিরোধী যেমন খাওয়ারেজ ও শিয়া।[৪৮] আলবানী (মুহাম্মাদ নাসীরুদ্দীন ১৯১৪ থেকে ১৯৯৯ ইং) বলেন, হাদীসটি আহলে সুন্নতের বিভিন্ন সূত্র ও বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর (কোন কোনটির) সনদে কোন শিয়া রাভি’র উপস্থিতি নেই।[৪৯] সাইয়্যেদ আলী মিলানী বলেছেন যে, হাদীসটি ইমাম আলী (আ.), ইমাম হাসান (আ.), আবুযার, আবু সাঈদ খুদরিবাররা বিন আযেব[৫১]সহ হাদীসটি মোট ১২ জন সাহাবী[৫০] থেকে বর্ণিত হয়েছে। যেগুলোর বেশীরভাগই ইমরান ইবনে হুছাইন, ইবনে আব্বাস ও বুরাইদা ইবনে হাছীবে গিয়ে শেষ হয়েছে।[৫২]

একইভাবে জাফার ইবনে সুলাইমান হলেন সহীহ মুসলিমের রাভিদের[৫৩] একজন। যাহাবী তাকে ইমাম বলে সম্বোধন করেছেন[৫৪] এবং ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন থেকে বর্ণনা করেছেন যে তাকে ‘সিকাহ’ (নির্ভরযোগ্য) বলে মনে করতেন।[৫৫] আলবানী জাফার সম্পর্কে বলেছেন: তিনি নির্ভরযোগ্য রাভি এবং মুতকান (সুদৃঢ়) ও শক্তিশালী রেওয়ায়েতের অধিকারী। তিনি আহলে বাইতের একজন অনুরাগী ছিলেন, তবে কাউকে নিজের মাযহাবের প্রতি আহবান জানাতেন না। তিনি বলেছেন, আমাদের ধর্মগুরুদের মাঝে এ বিষয়ে মত ভিন্নতা নেই যে, যদি সত্যবাদী কোন ব্যক্তি আহলে বিদআত হয়ে থাকে এবং নিজের মাযহাবের প্রতি অপরকে আমন্ত্রণ না জানায়, তার থেকে হাদীস গ্রহণ করা সঠিক।[৫৬] কোন কোন সুন্নি আলেম ইবনে আজলাহ’কে সিকাহ বলেছেন এবং তার থেকে বর্ণিত হাদীসকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেছেন।[৫৭] মুবারাকফুরি বলেছেন যে, ইবনে তাইমিয়্যা’র দাবী ছিল, আল্লাহর রাসূলের (সা.) সাথে সম্পৃক্ত করা এ হাদীসটি মিথ্যা।[৫৯], অথচ সুন্নি স্কলার আলবানী ইবনে তাইমিয়্যা কর্তৃক হাদীসটি অস্বীকারের ঘটনায় অবাক হয়েছেন।[৬০]

স্বতন্ত্র গ্রন্থাবলী

  • হাদীসে বেলায়াত ওয়া মান রাওয়া গাদীরা খুম মিনাস সাহাবাহ, ইবনে উকদাহ কুফী, প্রকাশক দালীলে মা, প্রকাশকাল ১৪২৭ হিজরী, কোম, ইরান।
  • হাদীসুল বেলায়াহ; সাইয়্যেদ আলী হুসাইনী মিলানী, মারকাযু হাকায়েকিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪২১ হিজরী।

তথ্যসূত্র