হাদীসে তাইর-এ মাশভি

wikishia থেকে

ভাজা পাখির হাদীস (আরবি: حدیث الطیر المشوی); হযরত আলীর (আ.) শানে বর্ণিত একটি হাদীস। বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবি (স.) একটি ভাজা পাখির মাংস খাওয়ার সময় মহান আল্লাহর দরবারে আবেদন জানালেন যেন তিনি ঐ পাখিটি আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টির সাথে বসে তা খেতে পারেন। কিছুক্ষণ পার না হতেই হযরত আলী (আ.) এলেন এবং তাঁর (স.) সাথে বসে সেই পাখির গোশত খেলেন। মালিক ইবনে আনাসের সূত্রে রাভিগণ এ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

কিছু কিছু শিয়া কালামশাস্ত্রবিদ এই রেওয়ায়েতকে প্রমাণ হিসেবে নিয়ে (মহানবির (স.) পর)  ইমাম আলীকে (আ.) আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা হিসেবে জ্ঞান করে থাকেন। আর এর থেকে তারা এ ফলাফলে পৌঁছেছেন যে, তিনিই মহানবির (স.) স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি।

মূল হাদীস:

إنَّ النَّبِی(ص) کانَ عِندَهُ طائِرٌ، فَقالَ: اللَّهُمَ ائتِنی بِأَحَبِّ خَلقِک إلَیک؛ یأکلُ مَعی مِن هذَا الطَّیرِ. فَجاءَ أبو بَکرٍ، فَرَدَّهُ، ثُمَّ جاءَ عُمَرُ، فَرَدَّهُ، ثُمَّ جاءَ عَلِی، فَأَذِنَ لَهُ.

‘মহানবির (স.) জন্য একটি (ভাজা) পাখি আনা হলে তিনি (স.) বললেন: হে আল্লাহ্! তোমার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টিকে আমার নিকট পাঠিয়ে দাও যাতে তার সাথে এ পাখির গোশত খেতে পারি। এরপর আবু বকর এলেন কিন্তু মহানবি (স.) তাকে গ্রহণ করলেন না, অতঃপর উমর এলেন তিনি (স.) তাকেও গ্রহণ করলেন না, অতঃপর আলী এলেন এবং তিনি (স.) তাকে অনুমতি প্রদান করলেন।[১]

হাদীসটি শিয়া সূত্রে সামান্য পার্থক্যে বর্ণিত হয়েছে।[২]

বিষয়বস্তু

তাইরে মাশভি হাদীসের সাক্ষ্যানুযায়ী মহানবির (স.) পর ইমাম আলী (আ.) আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি।[৩] হাদীসটিতে এসেছে যে, একটি ভাজা পাখি মহানবির (স.) কাছে আনা হলে তিনি মহান আল্লাহর দরবারে আকুতি জানালেন যেন আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা তাঁর সাথে ঐ পাখির গোশত খান। এমন সময় আলী (আ.) এলেন এবং তাঁর (স.) সাথে ঐ পাখির গোশত খেলেন।[৪] হযরত আলীর (আ.) আগে আবুবকর ও উমর এসেছিলেন, কিন্তু আল্লাহর রাসূল (স.) তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।[৫] কিছু কিছু বর্ণনায় এসেছে যে, মহানবির (স.) দোয়ার পর আয়েশা ও হাফসা উভয়েই দোয়া করেছিলেন যেন তাদের পিতা রাসূলের (স.) সাথে ঐ পাখির গোশত খেতে পারেন।[৬] এছাড়া, আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমি পছন্দ করতাম ঐ ব্যক্তি সায়াদ ইবনে উবাদাহ হোক; এ কারণে যখন আলী মহানবির (স.) দরজায় এলেন আমি তাকে গ্রহণ করলাম না, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আলী আবারও এলেন এবং মহানবির (স.) সাথে ঐ পাখির গোশত খেলেন।[৭] ভাজা পাখিটির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া এবং কিছু কিছু বর্ণনার ভিত্তিতে মহানবির (স.) ((و سالتُ اللهَ الـقـریـب المُجیب))-এ দোয়ার পর জীবরাইল (আ.) বেহেশত থেকে ঐ পাখি এনেছিলেন ((فهبط عَلَىّ حبیبى جبرئیل (ع ) و معه هذا الطیر)) এবং মহানবির (স.) দোয়া ও আলীর (আ.) সাথে  ঐ পাখির গোশত খাওয়ার বিষয়ে তাঁর (স.) পীড়াপীড়ি ((فرفعت یدى الى السماء فقلت : اللهم یَسّر عبداً یُحبّک و یُحبنى یاکل معى هذا الطائر)) সবকিছুই মহানবির (স.) নিকট হযরত আলীর (আ.) বিশেষ স্থান ও মাকামের অধিকারী হওয়ার বিষয়টিকে প্রমাণ করে।[সূত্র প্রয়োজন]

হাদীসের মূল্যায়ন

হাদীসে তাইর’কে শিয়া আলেমগণ মুতাওয়াতির জ্ঞান করেছেন।[৯] এছাড়া, আহলে সুন্নাতের মুহাদ্দিসদের একটি দল হাদীসটি সহিহ হওয়ার পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন।[১০]

হাদীসটি বেশ কয়েকজন সাহাবা মারফত সামান্য পার্থক্যে বর্ণিত হয়েছে। এদের মাঝে রাসূলের (স.) খাদেম ‘সাফিনাহ’,[১১] আনাস ইবনে মালিক থেকে, সোদা কাবির[১২] আনাস ইবনে মালিক থেকে, ইয়াহিয়া ইবনে কাসীর[১৩] আনাস ইবনে মালিক থেকে, উসমান ইবনে তাউইল[১৪] আনাস ইবনে মালিক থেকে, আব্দুল্লাহ্ ইবনে আনাস ইবনে মালিক তার পিতা থেকে[১৫] এবং আলী ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস তার পিতা থেকে[১৬] বর্ণনা করেছেন।

বিশিষ্ট সুন্নি আলেম ইবনে কাসীর দামেশকী’র মতে, শুধুমাত্র আনাস ইবনে মালিক থেকে ৯০ জন হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।[১৭] এতদসত্ত্বেও ইবনে কাসীর বলেছেন: হাদীসটির রাভির সংখ্যা অনেক হলেও আমার মন হাদীসটি গ্রহণে সাঁয় দেয় না।[১৮] ইবনে কাসীরের জবাবে আল্লামা আমিনী, তার (ইবনে কাসীর) অন্তরে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মোহর মেরে দেওয়া হয়েছে এ কথা উল্লেখ করে বলেছেন: উল্লিখিত সূত্রের সংখ্যাধিক্য থাকার পরও ‘হাদীসে তাইর’কে অস্বীকার করার কোন অর্থ হয় না।[১৯]

হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দির বিশিষ্ট কবি সাইয়্যেদ ইসমাঈল হিমইয়ারি (মৃত্যু ১৭৯ হি.) হাদীসে তাইরের ঘটনাটি পংতিতে আবদ্ধ করেছেন।

نُبِّئتُ اَنَّ اَبانا كان عن اَنَس          يَروی حديثاً عجيباً مُعجِباً عَجَباً

فی طائرٍ جاء مَشويّاً بِه بَشَرٌ         يوماً و كان رسولُ الله مُحتَجِباً

ادناه منه فلما ان رآه دعا            ربا قریبا لاهل الخیر منتجبا

ادخل الی احبّ الخلق کلهم          طرا الیک فاعطاه الذی طلبا

আমি খবর পেয়েছি যে, আমার পিতা আনাস থেকে আশ্চর্যজনক এক হাদীস বর্ণনা করেছেন,

একদিন জনৈক ব্যক্তি একটি ভাজা পাখি আনা প্রসঙ্গে এবং আল্লাহর রাসূল তার গৃহেই জনগণ থেকে দূরে ছিলেন।

পাখিটি যখন তার কাছে আনা হলো, যখন তাঁর দৃষ্টি তাতে পড়লো তখন তিনি সকলের নিকটবর্তী ও সৎকর্মশীলদের নির্বাচনকারী প্রভুর প্রতি আহবান জানালেন এবং বললেন:

তোমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও, আর তিনি যা চাইলেন আল্লাহ্ তাকে তা দিলেন।

কালাম শাস্ত্রে হাদীসের ব্যবহার

হাদীসে তাইরে মাশভি, ইমাম আলীর (আ.) ফজিলত হিসেবে গণনা করা হয়।[২০] ইমামত ও খেলাফতের ক্ষেত্রে ইমাম আলীর (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে শিয়া মুতাকাল্লিমগণ এ হাদীসটিকে দলিল হিসেবে এনেছেন।[২১]

হাদীসটিতে মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হওয়া প্রসঙ্গে তাগিদ প্রদান করে শেইখ মুফিদ ইমাম আলীকে (আ.) (মহানবির (স.) পর) সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আখ্যায়িত করেছেন। কেননা তার বিশ্বাস মহান আল্লাহর ভালোবাসা সত্যকে কেন্দ্র করেই, নফসের চাওয়ার ভিত্তিতে নয়। এ কারণে আলী (আ.) সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টির মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, তিনি ইমাম; কারণ নবুয়্যত ও খেলাফাতে আম-এর ক্ষেত্রে মাফযুলকে ফাযেলের উপর অগ্রাধিকার প্রদান বৈধ নয়।[২২] সাইয়্যেদ মুর্তাযা তার আল-ফুসুলুল মুখতারাহ গ্রন্থে শেইখ মুফিদের মন্তব্য বর্ণনা করে লিখেছেন, মহান আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি, অপর সকল সৃষ্টি অপেক্ষা অধিক সওয়াবের অধিকারী। আর নিঃসন্দেহে এমন ব্যক্তির আমল ও ইবাদত অপর সকল সৃষ্টি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। আর মহানবি (স.) ব্যতীত সকল জনগণের উপর ইমাম আলীর (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এটাই দলীল।[২৩]

সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাদি

সুন্নি মনীষী ইবনে কাসীর দামেশকি’র ভাষায়, হাদিসে তাইর সম্পর্কে স্বতন্ত্র বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হয়েছে: আবু বাকর ইবনে মারদুভিয়্যাহ, মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ ইবনে হামদান ও মুহাম্মাদ ইবনে জারির তাবারি এ বিষয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। সুন্নি কালাম শাস্ত্রবিদ আবু বকর বাকলানী বিষয়টি প্রত্যাখ্যানে গ্রন্থ রচনা করেছেন।[২৪] এছাড়া, মীর হামেদ হুসাইন তার আবাকাতুল আনওয়ার গ্রন্থের ১৩তম খণ্ডটি এ হাদীস সংশ্লিষ্ট এবং সুন্নি সূত্রে বর্ণিত হাদীসটির রাভীদের নাম উল্লেখ ও পর্যালোচনা করেছেন।[২৫] ১৩০৬ হিজরীতে লাখনৌ থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির ৭৩৬নং পৃষ্ঠায় হাদীসটির উপরোক্ত আলোচনা বিদ্যমান রয়েছে।[২৬]