নওয়াবে আরবাআ (৪ প্রতিনিধি)

wikishia থেকে

নওয়াবে আরবাআ (আরবি: النواب الأربعة); গায়বাতে সোগরার যুগে ইমাম মাহদি (আ.)-এর ৪ খাছ্ প্রতিনিধি; যারা ছিলেন তৎকালীন শীয়া সমাজ এবং ইমাম মাহদি (আ.)-এর মধ্যকার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তারা হলেন; উসমান বিন সাঈদ, মুহাম্মাদ বিন উসমান, হুসাইন বিন রূহ এবং আলী বিন মুহাম্মাদ বিন সামুরি। নওয়াবে আরবাআ ছিলেন ইমামগণ (আলাইহিমুস সালাম)-এর বিশ্বস্ত সাহাবি; যারা একের পর এক ইমামে যামানার পক্ষ থেকে পূর্ববর্তী নায়েব (প্রতিনিধি) মারফত পরিচয় হতেন। এই ৪ জন নায়েব ৭০ বছর যাবত হযরত ইমামের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এ সময় সাধারণ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দূরবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত শিয়াদের পক্ষ থেকে তাদের নিকট আসা বিভিন্ন প্রশ্ন ইমামের নিকট পৌঁছাতেন এবং সেগুলোর জবাব ইমাম থেকে গ্রহণ পূর্বক পৌঁছে দিতেন। খাছ্ নায়েবদের অপর দায়িত্বগুলো ছিল; ইমাম মাহদি (আ.) সম্পর্কে সৃষ্ট দ্বিধা ও সংশয় নির্মূল করা এবং ইমামের অবস্থানের স্থান ও তাঁর পরিচয় গোপন রাখা ইত্যাদি।

নায়েবে খাছ্

মূল নিবন্ধ: নিয়াবাতে খাছ্ছাহ বা বিশেষ প্রতিনিধিত্ব

নায়েবে খাছ্; পরিভাষাটির অর্থ হলো ইমাম (আ.)-এর পক্ষ থেকে সাধারণ শিয়াদের -যাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব ছিল না- সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য কোন ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করা অর্থে। এমনভাবে যে, ইমাম কোন ব্যক্তিকে নিজের বিশেষ (খাছ্) প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করেন, যাদের প্রথমজনকে স্বয়ং ইমাম (আ.) জনগণের সম্মুখে পরিচয় করান এবং এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী নায়েবকে পূর্ববর্তী নায়েব জনগণের সামনে পরিচয় করিয়ে দেন।[১]

নায়েবগণ ও তাঁদের মেয়াদকাল

ইমাম মাহদি (আ.)-এর খাছ্ নায়েবদের (বিশেষ প্রতিনিধি) তৎপরতা ২৬০ হিজরী থেকে ৩২৯ হিজরী পর্যন্ত (প্রায় ৭০ বছর) তথা গায়বাতে সোগরা (স্বল্প মেয়াদী অন্তর্ধান)-এর যুগে অব্যাহত ছিল। তৎকালে শিয়াদের মাঝ থেকে ৪ জন সুপরিচিত ব্যক্তি -যাদের কেউ কেউ ১০ম ও ১১তম ইমামের সাহাবিও ছিলেন- ইমাম মাহিদ (আ.)-এর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং এ সময় তারা ইমাম ও শিয়াদের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন। ঐ বছরগুলোতে অন্যান্য ইসলামি শহরেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিনিধির উপস্থিতির তথ্য রয়েছে, তবে তারা সকলে ছিলেন এই ৪ জনের প্রতিনিধি।[২]


  • উসমান বিন সাঈদ আল-আমরি (মৃত্যুকাল ২৬৭ হিজরীর পূর্বে); ছিলেন হযরত ইমাম মাহদির প্রথম নায়েবে খাছ্। এক রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, ইমাম হাসান আসকারি (আ.) স্বীয় পুত্র ইমাম মাহদি (আ.)-কে নিজের ৪ জন সাহাবির সামনে এনে তাদেরকে বলেছিলেন, দ্বাদশ ইমামের অন্তর্ধান কালীন সময়ে উসমান বিন সাঈদের অনুসরণ করো।[৩] একইভাবে কোমের জনগণের সাথে সাক্ষাতে ইমামে যামানা (ইমাম মাহদি) উসমান বিন সাঈদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং তাদেরকে তার শরণাপন্ন হওয়ার তাগিদ দেন।[৪] উসমান বিন সাঈদ তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত (প্রায় ৬ বছর) ইমামে যামানার প্রতিনিধি ছিলেন।
  • মুহাম্মাদ বিন উসমান বিন সাঈদ আল-আমরি (মৃত্যু: ৩০৫ হিজরী); প্রথম নায়েবের পুত্র এবং ইমামে যামানার দ্বিতীয় নায়েব। প্রথম নায়েবের ইন্তিকালের পর ইমামে যামানা (আ.) প্রথম নায়েবের পুত্র মুহাম্মাদ বিন উসমানের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে সমবেদনা জ্ঞাপন পূর্বক তাকে তার পিতার স্থলাভিষিক্ত করেন।[৫] এর আগে ইমাম হাসান আসকারি (আ.)ও মুহাম্মাদ বিন উসমান আল-আমরি’কে ইমামে যামানার ওয়াকীল ও প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করেছিলেন। মুহাম্মাদ বিন উসমান আল-আমরি প্রায় ৪০ বছর যাবত ইমামের নায়েব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[৬]
  • হুসাইন বিন রূহ নৌবাখতি (মৃত্যু: ৩২৬ হিজরী); ইমাম মাহদি (আ.)-এর তৃতীয় নায়েব। তিনি ছিলেন মুহাম্মাদ বিন উসমানের আস্থাভাজন এবং বাগদাদের বাসিন্দা। মুহাম্মাদ বিন উসমান তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে ইমামে যামানারা নির্দেশে হুসাইন বিন রূহকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে পরিচয় করান। শুরুতে আব্বাসি খেলাফতে বিশেষ সম্মান ও অবস্থানের অধিকারী হলেও পরবর্তী সময়ে তাকে বিভিন্ন সমস্যা মুকাবিলা করতে হয়। এমনকি কিছুকাল তিনি আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য হন, অতঃপর ৫ বছর তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।[৭] প্রায় ২১ বছর যাবত তিনি ইমামে যামানার নায়েব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
  • আলী বিন মুহাম্মাদ সামুরি (মৃত্যুকাল: ৩২৯ হি.); ইমামে যামানার চতুর্থ খাছ্ নায়েব। তিনি ৩ বছর যাবত হযরত ইমামের নায়েব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (৩২৬-৩২৯ হি.)। সামুরির সময়কাল বনি আব্বাসের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপ ও কঠোরতার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হওয়ায় সাযমানে ভেকালাত (প্রতিনিধি নেটওয়ার্ক)-এর তৎপরতা বাধার সম্মুখীন হয়।[৮] আলী বিন মুহাম্মাদ সামুরি’র মৃত্যুর সংবাদ সম্বলিত ইমাম মাহদি (আ.)-এর বিশেষ তাওকী (জনগণের উদ্দেশ্যে ইমাম মাহদি (আ.)-এর বার্তা, চিঠি ও লেখা বিশেষ) জারি হওয়া, নায়েবে খাছ্-গণের যুগের (স্বল্পমেয়াদী অন্তর্ধানের) সমাপ্তি ও গায়বাতে কোবরার (দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ধান) যুগের শুরু ইত্যাদি বিষয় ছিল তার যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর অন্যতম।[৯]

সামুরি’র উদ্দেশে ইমামের তাওকী:

‘মহান আল্লাহ্ তোমার মৃত্যুতে তোমার ভ্রাতাগণকে উত্তম প্রতিদান দিন। ছয় দিনের মধ্যে তোমার মৃত্যু হবে। অতএব, তুমি তোমার কাজগুলো গুছিয়ে নাও (সমাপ্ত করো) এবং নিজের পর কাউকে প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করিও না; কারণ দ্বিতীয় অন্তর্ধানের (দীর্ঘমেয়াদী) সময় শুরু হয়েছে এবং আল্লাহ্ অনুমতি প্রদান না করা পর্যন্ত আর কোনো আবির্ভাব ঘটবে না; (মানুষের) অন্তরগুলো কঠোরতায় ও পৃথিবী অন্যায়-অবিচারে পূর্ণ হয়ে যাওয়া অবধি এবং একটি দল আমার (অনুসারী) সমর্থকদের কাছে এসে আমার সাক্ষাত লাভের দাবি করা অবধি। তবে জেনে রাখো, সুফিয়ানি’র বিদ্রোহ ও আসমানি আহবান আসার আগে যদি কেউ আমার সাথে সাক্ষাত লাভ ও আমাকে দেখার দাবি করে তবে সে অপবাদ আরোপকারী ও মিথ্যুক।’ [তারিখে বায়গানি, সাদুক, কামালুদ্দীন ওয়া তামামুন নি’মাহ, প্রকাশকাল ১৩৯৫ (ফার্সিসন), খণ্ড ২, পৃ. ৫১৬]

পদক্ষেপ ও তৎপরতা

খাছ্ নায়েবদের সকল পদক্ষেপই ছিল ইমামে যামানার নির্দেশ মোতাবেক। তাদের তৎপরতাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:

গোপনে তৎপরতা

ইমাম হাসান আসকারি (আ.)-এর শাহাদাত ও ইমাম মাহদি (আ.)-এর অন্তর্ধানের পর বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে শিয়াদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল নওয়াবে আরবাআ তথা ৪ বিশেষ প্রতিনিধি। আব্বাসীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিদ্যমান চাপ ও কঠোরতার কারণে দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ নায়েবে’র যুগে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তাকাইয়া’র বিকল্প পথ ছিল না।[১০] পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়িয়েছিল যে, হুসাইন বিন রূহ কিছুকাল আত্মগোপন করতে বাধ্য হন। রাসূল জাফারিয়ানের মতে, তাকাইয়া ও গোপন তৎপরতার ফলশ্রুতিতে ইমামি শিয়ারা (বাগদাদে) আব্বাসীয় খেলাফতের কেন্দ্রে নিজেদের উপস্থিতি ধরে রাখতে সক্ষম হন। এছাড়া সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও আব্বাসী খেলাফত এবং বাগদাদের প্রভাবশালী উগ্র আকীদাধারী সুন্নিদের মাঝেও নিজেদের অবস্থান অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হন।[১১]

সরকারের সাথে সম্পর্ক

আব্বাসীয় খেলাফতে অনুপ্রবেশ, এমনকি কোন কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ ইত্যাদি ইমামে যামানার পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থনে শিয়াদের কিছু অংশ -বিশেষ করে নায়েবানে খাছ্- কর্তৃক তৎকালে গৃহীত বিশেষ নীতিগুলোর অন্যতম। আল-মুকাতাদির আব্বাসি’র যুগে নৌবাখতি ও আব্বাসীয় খেলাফতের মন্ত্রীত্বের পদের অধিকারী এবং শিয়াদের সমর্থক বিন ফুরাতের পরিবারের দরবারে বিশেষ প্রভাবের কারণে হুসাইন বিন রূহ তার দায়িত্বের শুরুর দিকে আব্বাসি হুকুমতে বিশেষ প্রভাবের অধিকারী এবং তাদের সম্মানের পাত্র ছিলেন।[১২]


গুলূকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

নাওয়াবে আরবাআ’র যুগে গুলূ (ধর্মীয় আকিদাগত বিষয়ে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি) ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমনভাবে যে, ইমাম হাদী (আ.)-এর পুত্র জা’ফার -জা’ফার কাযযাব নামে যার অধিক প্রসিদ্ধি রয়েছে- গুলূকারীদের সমর্থন করেন। এছাড়া শিয়াদের মধ্য থেকে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও গুলূকারীদের সমর্থন করেছেন।[১৩] মিথ্যা দাবিদার ঐ লোকদের আকিদা ও ভাষ্যের অসারতা ও ভিত্তিহীনতা প্রমাণ এবং ঐ সকল ব্যক্তিদের সম্পর্কে ইমামে যামানার লানত ও সম্পর্কচ্ছেদ সংশ্লিষ্ট বার্তা শিয়াদের উদ্দেশে প্রচার করা ছিল চার প্রতিনিধির দায়িত্বগুলোর অন্যতম।[১৪] যেমন, ‘নুসাইরি’ ফির্কা’র প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ বিন নুসাইর ছিল গুলূকারীদের একজন এবং সে ইমামগণ (আ.)-এর জন্য নবুয়্যতের মাকামে বিশ্বাসী ছিল। এছাড়া, সে মাহরামের সাথে বিবাহ জায়েয করতে প্রচেষ্টা চালায়। মুহাম্মাদ বিন উসমান তাকে লানত ও অভিসম্পাত করেন এবং তার থেকে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন।

শালমাগানি ছিল ইমামগণ (আ.)-এর (সাধারণ) প্রতিনিধিদের একজন। হুসাইন বিন রূহের সমসাময়িক ও বিশেষ অবস্থানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও উচ্চাভিলাষী হওয়ার কারণে সে নিজের অবস্থানের অপব্যবহার করে গুলূ’র দিকে ঝুঁকে পড়ে। হুসাইন বিন রূহ তাকে দূরে সরিয়ে দেন এবং ইমামে যামানা (আ.) থেকে তার বিষয়ে লানত সম্বলিত একটি তাওকীও জারি হয়।

ইমাম মাহদি সম্পর্কে দ্বিধা ও সংশয় দূরীকরণ

শেইখ তুসীর ভাষ্যানুযায়ী, ইমাম হাসান আসকারীর সন্তান আছে কি নেই -এ বিষয়ে শিয়াদের একটি দল ইবনে আবি গানেম কাযভিনি’র সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। শিয়ারা হযরত ইমামের উদ্দেশে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখে বিষয়টির ফয়সালা চান। তাদের উত্তরে ইমাম (আ.) লিখেন, মহান আল্লাহ্ একাদশ ইমামের পর নিজের দ্বীনকে বাতিল করে দেননি এবং নিজের ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন করেননি, আর কিয়ামত পর্যন্ত কখনই এমনটি ঘটবে না (ছিন্ন হবে না)।[১৫]

ইমাম (আ.) থেকে আরেকটি তাওকী’র কথা রেওয়ায়েতে উল্লিখিত হয়েছে। জাফারে কাযযাব নিজেকে ইমাম হাসান আসকারি (আ.)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে জনগণের সম্মুখে উপস্থাপনের পর ঐ তাওকীটি জারি হয়। ইমামে যামানা (আ.) ঐ তাওকী’তে ইমামগণের ইমামত, তাদের ইলম ও ইসমাত (নিষ্পাপত্ব)-এর প্রতি ইশারা করে, হালালহারাম সম্পর্কে জাফারে কাযযাবের অজ্ঞতা এবং হক থেকে বাতিলকে চিহ্নিত করণে তার অপারগতার প্রতি ইঙ্গিত করেন। ইমাম (আ.) ঐ তাওকী’তে এ প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, ‘এমতাবস্থায় সে (জাফার কাযযাব) কিভাবে ইমামতের দাবি করতে পারে’।[১৬]

ইমামে যামানার তাওকী’র মাধ্যমে মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম মাহযিয়ারের দ্বিধাও দূর হয়ে যায়; ইব্রাহিমের পিতাও ছিলেন ইমাম হাসান আসকারি (আ.)-এর একজন প্রতিনিধি ও ওয়াকীল।[১৭] একইভাবে ইমাম থেকে আরেকটি তাওকী’ বর্ণিত হয়েছে, যাতে সংশয়কারীদের বিপরীতে নিজের ইমামত প্রমাণের পাশাপাশি তিনি কিছু ফিকহী বিষয়েরও উত্তর প্রদান করেছিলেন।[১৮]

প্রতিনিধিদেরকে সুসংগঠিতকরণ

বিভিন্ন অঞ্চলে কার্যক্রম পরিচালনা এবং শিয়া জনগোষ্ঠী ও ইমামগণ (আলাইহিমুস সালাম)-এর মধ্যকার যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে ওয়াকীল ও প্রতিনিধি নির্বাচন, অন্তত ইমাম কাযিম (আ.)-এর যুগ থেকে প্রচলিত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত। অন্তর্ধানের যুগ শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে ইমামের সাথে ওয়াকীলগণের সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং মূলতঃ ইমামের সাথে শিয়াদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ইমাম কর্তৃক মনোনীত খাছ্ নায়েবগণ। ওয়াকীলগণ খুমস ও যাকাতসহ অন্যান্য খাতে যে সকল অর্থ জনগণের পক্ষ থেকে তাদের নিকট পৌঁছুত সেগুলোকে বিভিন্ন উপায়ে বাগদাদে অবস্থানরত খাছ্ নায়েবদের কাছে পাঠাতেন এবং তারা ইমাম (আ.)-এর নির্দেশনা মোতাবেক ধার্যকৃত খাতে সেই অর্থ ব্যয় করতেন।[১৯]


তৎকালে আহভায, সামেররা, মিসর, হিজায, ইয়েমেনসহ খোরাসান, রেই ও কোমের মত ইরানের কিছু কিছু এলাকায় প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন, যাদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য রেওয়ায়েতগুলোতে বর্ণিত হয়েছে।[২০]

ইমাম মাহদির উপস্থিতি সম্পর্কিত তথ্যাদি গোপন রাখা

ইমাম ও তাঁর পরিচয় গোপন রাখা ছিল নায়েবানে খাছদের গুরুত্বপূর্ণ অজিফাগুলোর একটি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রতিবেদন ও রেওয়ায়েত থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতীয়মান যে, ইমাম (আ.) ইরাক, মক্কামদিনায় এমনভাবে বসবাস করতেন যে, খাছ্ নায়েবরা তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে পারতেন। যখন হুসাইন বিন রূহ নায়েব হন, তাঁর অবস্থান ও মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে আবু সাহল নৌবাখতি বলেন: ইমামে যামানা (আ.) সম্পর্কে আবুল কাসেম (বিন রূহ) যতটুকু জানে তা যদি আমি জানতাম, তাহলে হয়তোবা বিরোধীদের বা প্রতিপক্ষের সাথে তর্ক-বিতর্কের সময় ইমামের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করে দিতাম; অথচ আবুল কাসিম যদি ইমামকে নিজের আবা’র ভেতরও লুকিয়ে রেখে থাকেন এবং ইমামের খোঁজে যদি তাঁর শরীর কেটে টুকরো টুকরোও করে ফেলা হয় তবুও তিনি কাউকে ইমামের সন্ধান দিবেন না।[২১]

ইমাম (আ.)-এর অস্তিত্ব প্রমাণের বিষয়টি নাওয়াবে খাছ্-এর পক্ষ থেকে বিশেষ গুরুত্ব পেলেও তারা শিয়াদেরকে বলতেন, শিয়ারা যেন হযরত ইমাম (আ.)-এর সন্ধানে ও তাঁকে চেনার বিষয়ে জোরাজুরি না করে; বিষয়টি তাঁর (আ.) নিরাপত্তা বিবেচনায় করা হতো বলে উল্লিখিত হয়েছে।[২২]

আকিদা ও ফিকাহ সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তর

নাওয়াবে আরবাআ, শিয়াদের আকিদা ও ফিকাহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশ্ন ইমাম মাহদি (আ.)-এর উদ্দেশে উত্থাপন করতেন এবং তাঁর (আ.) থেকে উত্তর গ্রহণ করে সেগুলোকে শিয়াদের নিকট পৌঁছে দিতেন। তাদের তৎপরতা শুধু শরয়ী বিষয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং নায়েবগণ ইলমি ও আকিদাগত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন ইলমি সভাতে এবং জনগণকে সঠিক ও সত্য পথ প্রদর্শনে বিভিন্ন মুনাযিরাতেও অংশগ্রহণ করতেন।[২৩] ইসহাক বিন ইয়াকুবের উদ্দেশে লেখা তাওক্বী ও মুহাম্মাদ বিন জাফার আসাদির উদ্দেশে লেখা তাওক্বী[৩২] -যা ছিল ফিকাহ সংশ্লিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বলিত- এবং বিভিন্ন ইলমি ও আকিদাগত মুনাযিরায় হুসাইন বিন রূহের অংশগ্রহণ ছিল নওয়াবে আরবাআ’র তৎপরতার অন্যতম দৃষ্টান্ত।[২৪]

নওয়াবগণের যিয়ারত নামা

সাইয়্যেদ বিন তাউস তার ‘মিসবাহুয যায়ের’ গ্রন্থে একটি যিয়ারতনামা বর্ণনা করেছেন যা ইমাম মাহদি (আ.)-এর এই ৪ নায়েবের প্রত্যেকের জন্য পড়া যায়। তিনি ঐ যিয়ারতানামা হুসাইন বিন রূহের পিতার সাথে সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করেছেন।[২৫] একইভাবে আল্লামা মাজলিসী তার বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থে উসমান বিন সাঈদের জন্য একটি যিয়ারতনামা বর্ণনা করে লিখেছেন যে, ঐ যিয়ারতনামাটি তিনি কোন এক শিয়া আলেমের নিকট বিদ্যমান পুরাতন এক গ্রন্থে দেখেছেন।[২৬]

গ্রন্থ পরিচিতি

আলী গাফফার যাদেহ ‘পেঝুহেশী পিরামুনে যেন্দেগানী নাওয়াবে খাছ্-এ ইমামে যামান (আ. ফা.)’ শিরোনামে এ বিষয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন জাফার সুবহানি এবং এন্তেশারাতে ‘নুবুগ’ বইটির প্রথম সংস্করণ ১৩৭৫ ফার্সিসনে প্রকাশ করে।[৩৬]

তথ্যসূত্র

  1. আহমাদী, নওয়াবে আরবায়া ওয়া সাখছিয়্যাতে ইজতেমাইয়ে আনান, ১৩৯০ (সৌরবর্ষ)।
  2. আহমাদী, নওয়াবে আরবায়া ওয়া সাখছিয়্যাতে ইজতেমাইয়ে আনান, ১৩৯০ (সৌরবর্ষ)।
  3. সাদুক, কামালুদ্দিন, ১৩৯৫ হি:, খ: ২, পৃ: ৪৩৫।
  4. সাদুক, কামালুদ্দিন, ১৩৯৫ হি:, খ: ২, পৃ: ৪৭৬।
  5. সাদুক, কামালুদ্দিন, ১৩৯৫ হি:, খ: ২, পৃ: ৫১০।
  6. সাদর, তারিখুল গাইবাহ, ১৪১২ হি:, খ: ১, পৃ: ৪০৪।
  7. জাফারিয়ান, হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, ১৩৮১ (সৌরবর্ষ), পৃ: ৫৮৩।
  8. জাব্বারী, সাযমানে ভেকালাত ওয়া নাকশে অন দার আসরে আইম্মা আলাইহিমুস সালাম, ১৩৮২ (সৌরবর্ষ), খ: ২, পৃ: ৪৮০।
  9. সাদুক, কামালুদ্দিন, ১৩৯৫ হি:, খ: ২, পৃ: ৫১৬।
  10. গাফফার যাদেহ, যেন্দেগানিয়ে নওয়াবে খাছছে ইমাম যামান, ১৩৭৯ (সৌরবর্ষ), পৃ: ৩০৪।
  11. জাফারিয়ান, হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, ১৩৮১ (সৌরবর্ষ), খ: ১ পৃ: ৫৮১।
  12. জাফারিয়ান, হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, ১৩৮১ (সৌরবর্ষ), পৃ: ৫৮৩।
  13. জাফারিয়ান, হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, ১৩৮১ (সৌরবর্ষ), পৃ: ৫৮৫।
  14. জাব্বারী, সাযমানে ভেকালাত ওয়া নাকশে অন দার আসরে আইম্মা আলাইহিমুস সালাম, ১৩৮২ (সৌরবর্ষ), খ: ২, পৃ: ৬৮৮।
  15. তুসী, আল-গাইবাহ, ১৪১১ হি:, পৃ: ২৮৫-২৮৬।
  16. তুসী, আল-গাইবাহ, ১৪১১ হি:, পৃ: ২৮৭-২৮৯।
  17. শেইখ কুলাইনী, উসুলে কাফি, ১৩৮৮ হি:, খ: ১, পৃ: ৫১৮।
  18. শেইখ কুলাইনী, উসুলে কাফি, ১৩৮৮ হি:, খ: ১, পৃ: ১৭৬।
  19. জাফারিয়ান, হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, ১৩৮১ (সৌরবর্ষ), পৃ: ৫৮৮।
  20. জাফারিয়ান, হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, ১৩৮১ (সৌরবর্ষ), পৃ: ৫৮৮।
  21. তুসী, আল-গাইবাহ, ১৪১১ হি:, পৃ:৩৯১।
  22. জাফারিয়ান, হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, ১৩৮১ (সৌরবর্ষ), পৃ: ৫৮৮।
  23. গাফফার যাদেহ, যেন্দেগানিয়ে নওয়াবে খাছছে ইমাম যামান, ১৩৭৯ (সৌরবর্ষ), পৃ:৮৬-৮৭।
  24. আল্লামা মাজলেসী, বিহারুল আনওয়ার, ১৩৬৩ (সৌরবর্ষ), খ: ৫৩, পৃ: ১৯২।
  25. ইবনে তাউস, মিসবাউয্ যায়ের, ১৩৭৫ (সৌরবর্ষ), পৃ: ৫১৬।
  26. আল্লামা মাজলেসী, বিহারুল আনওয়ার, ১৩৬৩ (সৌরবর্ষ), খ: ৯৯, পৃ: ২৯৩।

গ্রন্থপঞ্জি

  • ইবনে তাউস, আলী বিন মুসা, মিসবাউয্ যায়ের, কোম, আলুল বাইত, ১৩৭৫ (সৌরবর্ষ)।
  • আহমাদী, মুহাম্মাদ হোসাইন, নওয়াবে আরবায়া ওয়া সাখছিয়্যাতে ইজতেমাইয়ে আনান, মাজাল্লায়ে সিমায়ে তারিখ, তাবেস্তান-১৩৯০ (সৌরবর্ষ)।
  • জাব্বারী, মুহাম্মাদ রেযা, সাযমানে ভেকালাত ওয়া নাকশে অন দার আসরে আইম্মা আলাইহিমুস সালাম, কোম, মুয়াসসেসেয়ে পাজুহেশীয়ে ইমাম খোমিনী, ১৩৮২ (সৌরবর্ষ)।
  • জাফারিয়ান, রাসুল, হায়াতে ফেকরি ওয়া সিয়াসিয়ে ইমামানে শিয়া, কোম, আনসারিয়ান, ১৩৮১ (সৌরবর্ষ)।
  • সাদর, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ, তারিখুল গাইবাহ, বৈরুত, দারুত্ তায়ারুফ, ১৪১২ হি:।
  • সাদুক, মুহাম্মাদ বিন আলী, কামালুদ্দিন, তেহরান, ইসলামিয়্যাহ, ১৩৯৫ হি:।
  • তুসী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, নওয়াবে খাছছে ইমাম যামান, কোম, দারুল মায়ারিফিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪১১ হি:।
  • গাফফার যাদেহ, আলী, যেন্দেগানিয়ে নওয়াবে খাছছে ইমাম যামান, ইন্তেশারাতে নুবুগ, ১৩৭৯ (সৌরবর্ষ)।
  • শেইখ কুলাইনী, মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব, উসুলে কাফি; তাহকিক- আলী আকবার গাফফারী, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, ১৩৮৮ হি:।
  • আল্লামা মাজলেসী, মুহাম্মাদ বাকের, বিহারুল আনওয়ার, তেহরান, ইসলামিয়্যাহ, ১৩৬৩ (সৌরবর্ষ)।