মাহরামগণ

wikishia থেকে
এই নিবন্ধটি মাহরাম বা বেগানা নারী-পুরুষ সম্পর্কে, নিষিদ্ধ বিবাহ সম্পর্কে জানতে চিরস্থায়ী হারাম নিবন্ধটি পড়ুন।

মাহরামগণ (আরবি: مَحارِم); হল, আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে যাদের সাথে বিবাহ করা হারাম। ফকীহগণের মতে তাদের ক্ষেত্রে হিজাবের বিধানও প্রযোজ্য নয়। মাহরামগণ ও তাদের সংশ্লিষ্ট বিধান পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। রক্তীয় সম্পর্ক, বিবাহ বন্ধন এবং দুধপান মাহরাম হওয়ার কারণ হিসেবে গন্য। তাদের দৃষ্টিতে মাহরামগণ ৩ ভাগে বিভক্ত; নাসাবি (রক্ত সম্পর্কীয় সূত্রে) মাহরাম, সাবাবি (বৈবাহিক বন্ধন সূত্রে) মাহরাম ও রিদায়ী (দুধপান সূত্রে) মাহরাম।

মা, দাদী, নানী, বোন, মেয়ে, নাতনী, ভাগ্নি, ভাতিজি, ফুফু ও খালা হলো একজন পুরুষের জন্য নাসাবি মাহরাম। এর বিপরীতে বাবা, দাদা, নানা, ছেল, ভাই, ভাগ্না, ভাতিজা, চাচা ও মামা হলো একজন নারীর জন্য নাসাবি মাহরাম। এছাড়া স্ত্রী, শাশুড়ী, স্ত্রীর নানী ও দাদী, স্ত্রীর কন্যা (সৎ কন্যা), সৎ মা, ছেলের স্ত্রী হলো একজন পুরুষের জন্য সাবাবি মাহরাম। অপরদিকে স্বামী, শ্বশুর, স্বামীর দাদা ও নানা, স্বামীর সন্তান (সৎ ছেলে), সৎ বাবা এবং মেয়ের স্বামী (জামাতা) হলো একজন নারীর জন্য সাবাবি মাহরাম।

ফকীহগণের ফতওয়ার ভিত্তিতে, নাসাবি (রক্ত) সম্পর্কের কারণে যাদের সাথে বিবাহ হারাম, রিদায়ী (দুধ পান) সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ঐ সকল ব্যক্তিদের সাথে বিবাহ করা হারাম। অতএব, দুধ মা (যে নারী শিশুকে স্তন্য পান করিয়েছে), দুধ মায়ের মা, তার দাদী ও নানী, বোন, মেয়ে, নাতনী, ফুপু, খালা একজন পুরুষের জন্য রিদায়ী মাহরাম। একইভাবে দুধ মায়ের স্বামী, তার বাবা, তার দাদা ও নানা, ভাই, চাচা, মামা ও ছেলে একজন নারীর জন্য রিদায়ী মাহরাম।

পরিভাষা পরিচিতি

মাহরাম; আত্মীয়তা ও রক্তীয় সম্পর্কের কারণে যাদের সাথে বিবাহ করা জায়েয নয়।[১] মাহরামগণ ও তাদের সংশ্লিষ্ট বিধানসমূহ পবিত্র কুরআনের দু’টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে; সূরা নিসার ২৩নং আয়াতে মাহরামগণ এবং তাদের সাথে বিবাহ হারাম হওয়ার বিষয় কেন্দ্রীক আলোচনা করা হয়েছে।[২] সূরা নূরের ৩১নং আয়াতে নারীর কয়েকজন মাহরামের কথা উল্লেখিত হয়েছে।[৩] ওয়াসায়েলুশ শিয়ামুস্তাদরাকুল ওয়াসায়েলের মত হাদীস গ্রন্থগুলোতে ‘আবওয়াবুন নিকাহিল মাহরাম’ শিরোনামে এ প্রসঙ্গ লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং এতে মাহরামগণের সাথে বিবাহ অথবা তাদের দিকে তাকানো প্রসঙ্গে ইমামগণ (আ.) থেকে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীস সংকলিত করা হয়েছে।[৪] ফিকাহ গ্রন্থসমূহে নিকাহ, তালাকমৃত ব্যক্তির আহকাম সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে মাহরাম এবং তাদের সম্পর্কিত আহকাম নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে।[৫]

আহকাম

কারও মাহরাম হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত হলে সেই মাহরামের দিকে তাকানো এবং তার সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ করা জায়েয এবং তার সাথে বিবাহ করা হারাম।[৬] ফকীহগণের মতানুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী ব্যতীত অন্য মাহরামের লজ্জাস্থানের দিকে তাকানো জায়েয নয়। আর লজ্জাস্থান ব্যতীত অন্য স্থানের দিকে তাকানো শুধু ঐ অবস্থায় জায়েয যখন তা কামুক দৃষ্টিতে না হয়।[৭] একইভাবে লজ্জাস্থান ব্যতীত শরীরের অপর অঙ্গ মাহরামের সামনে ঢেকে রাখা একজন নারীর জন্য ওয়াজিব নয়।[৮]

মাহরাম হওয়ার কারণসমূহ

মাহরাম হওয়ার কারণসমূহ; ঐ সকল বিষয় যার কারণে দু’ জন মানুষের মাঝে মাহরামের সম্পর্ক তৈরী হয় এবং মাহরাম সংশ্লিষ্ট বিধান তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।[৯] ফিকাহ শাস্ত্রের গ্রন্থসমূহে মাহরাম হওয়া এবং বিবাহ হারাম হওয়া প্রসঙ্গে ১১টি কারণ উল্লেখিত হয়েছে।[১০] সার্বিকভাবে এগুলোকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়; নাসাবি, সাবাবি ও রিদায়ী।[১১]

নাসাবি: রক্তীয় সম্পর্ক যা বৈধ বিবাহ অথবা (وطی بالشبهه) এর মাধ্যমে তৈরি হয়; অতএব, মাহরামে নাসাবি হলো, যাদের সাথে জন্ম থেকে মাহরামিয়্যাতের সম্পর্ক রয়েছে।[১২]

রিদায়ী: রিয়াদী মাহরাম; এক প্রকার আত্মীয়তার সম্পর্ক যা কোন শিশুর মা ব্যতীত অন্য কোন নারীর দুধ পানের মাধ্যমে তৈরি হয়।[১৩] অবশ্য রিদায়ী মাহরামিয়্যাতের ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত রয়েছে, যেমন: স্তন্যদানকারী নারী যেন শরয়ী ও হালাল উপায়ে গর্ভবতী হয়ে থাকে, শিশু ধারাবাহিকভাবে যেন ঐ নারী দুধ পান করে এবং এর মাঝে যেন অপর কোন নারীর দুধ পান না করা বা অন্য কোন খাবার না খায় এবং শিশুর বয়স ২ বছরের (চন্দ্রবর্ষ) কম হওয়া ইত্যাদি।[১৪]

সাবাবি: আকদে নিকাহ পড়ার মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের মাহরাম হওয়ার পাশাপাশি তাদের দু’জনের কিছু কিছু আত্মীয় তাদের জন্য মাহরাম হয়ে যায়, এদেরকে নাসাবি মাহরাম বলা হয়।[১৫]

মাহরামগণের প্রকার

উল্লিখিত কারণের ভিত্তিতে মাহরামগণ ৩ প্রকারের:

নাসাবি মাহরাম

বংশীয় ও রক্তসম্পর্কীয় মাহরামগণ; পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ২৩নং আয়াতের ভিত্তিতে ফকিহগণের মত হলো[১৬] নাসাবে’র কারণে ৭ নারী, ৭ পুরুষের জন্য মাহরাম:[১৭]

  • মা, দাদী ও নানী[১৮]
  • মেয়ে, নাতনী ও নাতনীর সন্তানরা,[১৯]
  • বোন,[২০]
  • ভাতিজী (ভাইয়ের মেয়ে), ভাইয়ের নাতনীরা এবং তাদের সন্তানরা এভাবে যত নীচের দিকে যাবে,[২১]
  • ভাগ্নি (বোনের মেয়ে), তার সন্তানরা এবং তাদের সন্তানরা এভাবে যত নীচের দিকে যাবে,[২২]
  • ফুপু, বাবার ফুপু এবং মায়ের ফুপুও এর মাঝে শামিল,[২৩]
  • খালা, বাবার খালা ও মায়ের খালাও এর মাঝে শামিল,[২৪]

একইভাবে বাবা, দাদা-নানা, ছেলে, নাতি, ভাই, ভাগ্না, ভাতিজা, চাচা, বাবা ও মায়ের চাচা, মামা, বাবা ও মায়ের মামা এরা সকলে একজন নারীর জন্য মাহরাম।[২৫]

রিদায়ী মাহরাম

মূল নিবন্ধ: রিদায়ী মাহরাম

মহানবি (স.) থেকে বর্ণিত: ‘যা কিছু নাসাবের মাধ্যমে হারাম হয়, রিদা তথা দুধপানের মাধ্যমেও সেগুলো হারাম।’ এই রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে ফকীহগণ নাসাবি সম্পর্কের কারণে যে সকল নারীদের সাথে বিবাহ করা হারাম, রিদা’র মাধ্যমে মাহরাম হওয়া ঐ সকল নারীদের সাথেও বিবাহ হারাম বলে জেনেছেন।[২৬] এক্ষেত্রে যদি শিশু ছেলে হয়ে থাকে, তাহলে যে নারী তাকে স্তন্য দিয়েছে (দুধ মা), স্তন্যদানকারীর মা, তার দাদী ও নানী, বোন, নাতনী, ফুপু ও খালা ঐ শিশুর জন্য মাহরাম।[২৮] আর যদি দুধ পানকারী শিশু কন্যা হয়ে থাকে, তবে স্তন্যদানকারী নারীর স্বামী, তার বাবা, ভাই, চাচা, মামা, ছেলে ও নাতিরা ঐ শিশুর জন্য মাহরাম। একইভাবে ভাই, ছেলে, নাতি, বাবা, দাদা, নানা, চাচা ও মামাও ঐ শিশুর জন্য মাহরাম।[২৯]

সাবাবি মাহরাম

বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্রে মাহরাম হওয়া নারীরা হলো; স্ত্রী, শাশুড়ী, স্ত্রীর দাদী ও নানী, স্ত্রীর মেয়ে (অন্য স্বামী থেকে), স্ত্রীর সৎ মা, স্ত্রীর ছেলের স্ত্রী।[৩০]

একইভাবে স্বামী, শ্বশুর, স্বামীর দাদা ও নানা, স্বামীর ছেলে (অন্য স্ত্রী থেকে), সৎ বাবা এবং জামাই (মেয়ের স্বামী) বিবাহের কারণে নারীর জন্য মাহরাম হয়ে যায়।[৩১] এছাড়া, শ্যালিকার সাথে বিবাহ (প্রথম স্ত্রীর সাথে আকদে থাকা অবস্থায়) জায়েয নয়।[৩২] তবে বোনের স্বামীর কাছে তার (শ্যালিকা) হিজাবের আহকাম বলবৎ থাকবে।[৩৩]

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

  • ইমাম খোমেনি, সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ, তাহরীরুল ওয়াসিলাহ, কোম, মুআসসিসাতু তানযীমি ওয়া নাশরি আসারিল ইমামিল খুমাইনি, প্রথম সংস্করণ ১৪৪৩।
  • বানি হাশেমী খোমেইনি, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হাসান, রেসালায়ে তৌযিহুল মাসায়েলে মারাজে মোতাবেকে ফাতাওয়ায়ে ১৩ নাফার আয মারাজেয়ে তাকলীদ, কোম, দাফতারে এন্তেশারাতে জামেয়ে মুদাররিসীনে হওযা ইলমিয়ায়ে কোম, ১৩৮৫ ফার্সিসন।
  • হুররে আমেলি, মুহাম্মাদ ইবনে হাসান, ওয়াসায়েলুশ শিয়া, কোম, মুআসসিসাতু আলিল বাইত আলাইহিমুস সালাম লি-ইহিয়াইত তুরাস, ১৪১৬ হি.।
  • শাহীদে আওয়াল, মুহাম্মাদ ইবনে মাক্কি, আল-লুমআতুদ দামেশকিয়া, বৈরুত, দারুত তুরাস, ১৪১০ হি.।
  • শাহীদে সানী, যাইনুদ্দীন ইবনে আলী, মাসালেকুল আফহাম, কোম, মুআসসিসাতুল মাআরিফিল ইসলামিয়া, ১৪১৩ হি.।
  • ফাযেল মিকদাদ, আব্দুল্লাহ, কানযুল ইরফান ফি ফিকহিল কুরআন, কোম, মানশুরাতিল মাকতাবাতিল মুর্তাযাভিয়াতি লি-ইহিয়াইল আসারিল জাফারিয়াহ।
  • ফারাহিদী, খালিল ইবনে আহমাদ, আল-আইন, কোম, নাশরে হিজরাত, তাসহীহ: মাহদী মাখযুমি ওয়া ইব্রাহিম সামেরায়ী ১৪১০ হি.।
  • মুআসসিসাতু দায়েরাতিল মায়ারেফিল ফিকহিল ইসলামি, ‘আমিযেশ’, মুআসসিসাতু দায়েরাতিল মায়ারেফিল ফিকহিল ইসলামি, ১৩৮৭ ফার্সিসন।
  • মুজতাহেদি তেহরানি, আহমাদ, সেহ রেসালেয়: গুনাহানে কাবিরা, মাহরাম ওয়া নামাহরাম, আহকামুল গীবাহ, কোম, মোআসসেসেয় দার রাহে হাক, ১৩৮১ হি.।
  • মোহাক্কেক হিল্লী, জাফার ইবনে হুসাইন, শারায়েউল ইসলাম, কোম, মোআসসেসেয়ে ইসমাঈলিয়ান, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪০৮ হি.।
  • মিশকিনী, আলী আকবার, মুস্তালাহাতুল ফিকহ, কোম, নাশরুল হাদী, তৃতীয় সংস্করণ, ১৩৮১ ফার্সিসন।
  • মাগরেবি, কাযী নো’মান, দাআয়েমুল ইসলাম, মোআসসেসেয়ে আলুল বাইত আলাইহিস সালাম, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৮৫।
  • মুফিদ, মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ, আল-মুকনিআহ, কোম, শেইখ মুফিদ কংগ্রেস, ১৪১৩ হি.।
  • মুকাদ্দাসে আরদেবিলী, আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ, যুবদাতুল বায়ান ফি আয়াতিল আহকাম, তেহরান, আল-মাকতাবাতুল মুর্তযাভিয়াতি লি-ইহিয়াইল আসারিল জাফারিয়াহ, প্রথম সংস্করণ।
  • নাজাফি, মুহাম্মাদ হাসান, জাওয়াহেরুল কালাম ফি শারহি শারায়েউল ইসলাম, বৈরুত, দারু ইহিয়াইত তুরাসিল আরাবি, ১৪০৪ হি.।
  • নুরী, হুসাইন, মুস্তাদরাকুল ওয়াসায়েল, কোম, মুআসসিসাতু আলিল বাইত আলাইহিমুস সালাম, লি-ইহিয়াইত তুরাস, ১৪০৮।