মাসুম ইমামের (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব

wikishia থেকে

মাসুম ইমামের (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব; (যা ইমামতের অন্যতম শর্ত) বলতে বুঝায় যাবতীয় মানবীয় বৈশিষ্ট্য ও পূর্ণতার ক্ষেত্রে অন্যান্য মানুষের তুলনায় ইমামের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। কালামশাস্ত্রবিদগণের দৃষ্টিতে মাসুম ইমামকে (আ.) অবশ্যই ইলম, তাকওয়া, ধার্মিকতা, দানশীলতা, মহানুভবতা, সাহসিকতা এবং অনুরূপভাবে সওয়াব ও পরলৌকিক পুরুস্কারের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী হবে। ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের নিমিত্তে ‘অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অগ্রাধিকার প্রদান’ এবং ‘অধমের উপর উত্তমের শ্রেষ্ঠত্ব দান’ শীর্ষক দু’টি তত্ত্ব এবং রাসূলুল্লাহর (সা.) হাদীস (যদি কেউ কোন গোষ্ঠীর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত থাকে, তবে তাকে উক্ত গোষ্ঠীর লোকদের তুলনায় জ্ঞানী হওয়া জরুরী) ও কুরআনের কিছু আয়াত দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

সুন্নী মাযহাবের অধিকাংশ ফেরকার দৃষ্টিতে ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব অত্যাবশ্যকীয় নয় এবং বিশেষ কোন কারণবশত কিংবা ক্ষেত্র বিশেষের ভিত্তিতে উত্তমের তুলনায় অধমের ইমামতকে জায়েয মনে করে। অষ্টম হিজরীর সুন্নী আশয়ারি সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট কালামশাস্ত্রবিদ সায়াদ উদ্দীন তাফতাযানি উল্লেখ করেছেন: অধিকাংশ সুন্নী মাযহাবের অনুসারীদের দৃষ্টিতে ঐ ব্যক্তি ইমামতের ক্ষেত্রে উপযুক্ত যে তার যুগের লোকদের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী; তবে শর্ত হচ্ছে তার ইমামতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে যেন সমাজে কোনরূপ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ না হয়। সুন্নী মাযহাবের আকিদা অনুযায়ী খোলাফায়ে রাশেদীনের পর বৈশিষ্ট্যাবলির ক্ষেত্রে উত্তমের তুলনায় অধমকে ইমাম বা খলিফা নির্বাচনের বিষয়কে ইজমা এবং খেলাফতের দায়িত্বে সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় খলিফা কর্তৃক খেলাফতের নির্বাচনের দায়িত্ব ছয় সদস্য বিশিষ্ট বোর্ডের নিকট হস্তান্তরকে দলীল হিসেবে তুলে ধরা হয়।

শিয়া মাযহাবের মনীষীদের দৃষ্টিতে মাসুম ইমামগণ (আ.) হলেন রাসূলুল্লাহর (সা.) পর আল্লাহর সর্বোত্তম বান্দা। আল্লামা মাযলিসি’র দৃষ্টিতে কেবল রেওয়ায়েত সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিরাই মাসুম ইমামের (আ.) শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করে। ইমামের শ্রেষ্ঠত্বের দলীলটি আমিরুল মু’মিনিন আলীর (আ.) ইমামতের সনদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে; যেটি বোরহানে আফজালিয়্যাত বা শ্রেষ্ঠত্বের দলীল হিসেবে অভিহিত।

সংজ্ঞা ও ব্যাপ্তি

শিয়া মাযহাবের কালামশাস্ত্রবিদগণের দৃষ্টিতে মাসুম ইমামের (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব বলতে বুঝায় সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যাবলির ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব যথা- ইলম, তাকওয়া, ধার্মিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, মহানুভবতা, সাহসিকতা প্রভৃতি এবং এগুলো ইমামতের অন্যতম শর্ত হিসেবে গণ্য।{১} কালামশাস্ত্রের কিছু কিছু সূত্রে ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব বলতে ইবাদত-বন্দেগী ও খোদায়ী প্রতিদানের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।{২} সুতরাং শিয়া মাযহাবের কালামশাস্ত্রবিদগণের দৃষ্টিতে মাসুম ইমাম (আ.) অবশ্যই যাবতীয় মানবীয় বৈশিষ্ট্যাবলি ও পূর্ণতা যেমন- ইলম, তাকওয়া, ধার্মিকতা, দানশীলতা, মহানুভবতা, সাহসিকতা{৩} এবং অনুরূপভাবে সওয়াব ও পরলৌকিক পুরুস্কারের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হবেন।{৪} এছাড়া মাসুম ইমাম অবশ্যই তাঁর যুগের মানুষদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ইলম, সাহসিকতা, ধৈর্য, তাকওয়া, মহানুভবতাসহ যাবতীয় গুণাবলির অধিকারী হবেন।{৫} যাতে মানুষ খুব সহজেই তাঁকে অনুসরণ করতে পারে।{৬}

বর্ণিত হয়েছে যে, পার্থিব বিষয়াদি যেমন- ধন-সম্পদ, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক থেকে অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী হওয়া মাসুম ইমামের জন্য জরুরী নয়। কেননা ইমামের প্রতি আনুগত্যের ক্ষেত্রে তাঁর আধ্যাত্মিক ও ঈমানি শ্রেষ্ঠত্বই মুখ্য বিষয়, না তাঁর পার্থিব ও বাহ্যিক দিকগুলি।{৭}

শিয়া মাযহাবের দৃষ্টিতে ইমামকে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়া জরুরী

শিয়া মাযহাবের কালামশাস্ত্রবিদরা শ্রেষ্ঠত্বকে ইমামতের ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন{৮} এবং এক্ষেত্রে সবাই ঐকমত্যপোষণ করেন।{৯} মাসুম ইমামের (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ধৃতিগত দলীলও তুলে ধরা হয়ছে।

বুদ্ধিবৃত্তিক দলীলাদি

১- ইমাম শ্রেষ্ঠত্ব ও গুণাবলির ক্ষেত্রে অন্যদের সমপর্যায়ে কিংবা নিম্নপর্যায়ে অথবা অন্যদের তুলনায় সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হবেন। যদি তিনি অন্যদের সমপর্যায়ে হন তাহলে তাঁকে ইমাম হিসেবে মনোনীত করলে অগ্রাধিকারের প্রাপ্য না হওয়া সত্ত্বেও অগ্রাধিকার দেয়া হবে (অর্থাৎ দু’টি সমপর্যায়ের বিষয়ের মধ্যে কোন কারণ ব্যতিরেকে একটিকে প্রাধান্য দেয়া); কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে এমন বিষয় গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত নয় এবং প্রজ্ঞাময় আল্লাহ কখনও এমন আদেশ দিবেন না। পক্ষান্তরে ইমাম যদি শ্রেষ্টত্ব ও গুণাবলির দিক থেকে অন্যদের তুলনায় নিম্নপর্যায়ে থাকেন; তাহলে উত্তমকে ত্যাগ করে অধমকে মনোনয়ন আকলের দৃষ্টিতে প্রত্যাখ্যাত ও নিন্দনীয়। সুতরাং ইমামকে অন্যদের তুলনায় সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হওয়া অপরিহার্য।{১০}

২- ইমামকে মাসুম তথা পাপশুণ্য ও ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে হওয়া জরুরী। মাসুম হলেন অমাসুম তথা ইসমাতবিহীন ব্যক্তির তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।{১১}

৩- মাসুম ইমাম হলেন রাসূল (সা.) কর্তৃক মনোনীত; কাজেই স্বাভাবিকভাবেই রাসূল (সা.) কাউকে ইমাম বা নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যোগ্যতা, উপযুক্ততা ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়সমূহ প্রাধান্য দিবেন।{১২}

উদ্ধৃতিগত দলীলাদি

মাসুম ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সূরা ইউনুসের ৩৫নং আয়াত{১৩}, আয়াতে সাদেকীন (সূরা তওবার ১১৯ নং আয়াত){১৪} এবং সূরা জুমার ৯নং আয়াত বর্ণিত হয়েছে।{১৫} এ সব আয়াতে হেদায়েতকারীকে হেদায়েতপ্রাপ্তদের উপর, সাদেকীন বা সৎকর্মশীলকে গাইরে সাদেকীন বা সৎকর্মশীল নয় এমন ব্যক্তিদের উপর, জ্ঞানীকে অজ্ঞদের উপর, উত্তমকে অধমদের উপর প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে।{১৬}

অনেক হাদীস ও রেওয়ায়েতেও শ্রেষ্ঠত্বকে ইমামতের অন্যতম শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।{১৭} যেমন- রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,

مَنْ أَمَ قَوْماً وَ فِیهِمْ مَنْ هُوَ أَعْلَمُ مِنْهُ لَمْ یزَلْ أَمْرُهُمْ إِلَی السَّفَالِ إِلَی یوْمِ الْقِیامَةِ؛  

যদি কেউ কোন সম্প্রদায়ের ইমাম তথা নেতৃত্ব দান করে এবং সে সম্প্রদায়ে যদি তার তুলনায় অন্য কেউ অধিক জ্ঞানী থাকে; তাহলে উক্ত সম্প্রদায় কিয়ামত পর্যন্ত ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে।{১৮} এ রেওয়ায়েতে আলোকে অধমকে উত্তমের উপর প্রাধান্য দেয়াকে অগ্রহণযোগ্য ও কদর্যপূর্ণ কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।{১৯}

সুন্নী মাযহাবের হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আবু দারদাহ একদা হযরত আবু বকরের সম্মুখভাগে পথ চলছিলেন; এমন সময় মহানবী (সা.) তাকে বলেন: তুমি কি তাঁর সম্মুখভাগে হাটছো যে দুনিয়া ও পরকালে তোমার তুলনায় উত্তম?{২০} এ রেওয়ায়েত অনুযায়ী কোন উত্তম ব্যক্তির সম্মুখভাগে তুলনামূলক অধম ব্যক্তির পথ চলাকে মন্দকর্ম মনে করা হয়েছে। এমতাবস্থায় ইমামত ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে উত্তমের তুলনায় অধমকে প্রাধান্য দেয়া অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য ও কদর্যপূর্ণ কাজ হিসেবে গণ্য হবে।{২১}

সুন্নী মাযহাবের দৃষ্টিতে ইমামকে সর্বোত্তম হওয়া জরুরী নয়

সুন্নী মাযহাবের অধিকাংশের মতানুযায়ী ইমামকে সর্বোত্তম হওয়া জরুরী নয়; বরং তুলনামূলক অধম ব্যক্তিও ইমাম তথা নেতা হতে পারবেন।

আশয়ারি সম্প্রদায়: আশায়ারি সম্প্রদায়ের কালামশাস্ত্রবিদদের দৃষ্টিতে ইমামতের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের শর্ত জরুরী নয়। এ কারণে তারা অশ্রেষ্ঠ কিংবা উত্তম নয় এমন ব্যক্তিকেও ইমাম হিসেবে উপযুক্ত মনে করেন।{২২} অবশ্য পঞ্চম হিজরীর আশয়ারী সম্প্রদায়ের মনীষী কাযী আবু বকর বাকলানি এ সম্পর্কে কিছুটা ভিন্নমতপোষণ করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন: শ্রেষ্ঠত্ব ইমামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য; কিন্তু যদি শ্রেষ্ঠ ও উত্তম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কাউকে ইমাম মনোনয়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয়, তবে সেক্ষেত্রে অশ্রেষ্ঠ কাউকে ইমামের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করা জায়েয।{২৩} তিনি ইমামতের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের শর্তকে জরুরী হওয়ার সপক্ষে অনেক দলীলও উপস্থাপন করেছেন। যেমন- এক্ষেত্রে রাসূলের (সা.) এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন- یَؤُمُّ القَومَ اَفْضَلُهُم অর্থাৎ কোন জাতির মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সে জাতির ইমাম হিসেবে মনোনীত হবে।{২৪} কিন্তু যদি এক্ষেত্রে যদি কোন বিশৃঙ্খলা, প্রতিবন্ধকতা, ইসলামি বিধানাবলি কার্যকরে বিগ্ন সৃষ্টি কিংবা শত্রুদের কোন চক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে তবে সে অবস্থায় সর্বোত্তম ব্যক্তির পরিবর্তে কম উত্তম বক্তিকে ইমামতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করা যাবে।{২৪} অনুরূপভাবে অষ্টম হিজরীর সুন্নী আশয়ারি সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট কালামশাস্ত্রবিদ সায়াদ উদ্দীন তাফতাযানি উল্লেখ করেছেন: অধিকাংশ সুন্নী মাযহাবের অনুসারীদের দৃষ্টিতে ঐ ব্যক্তি ইমামতের ক্ষেত্রে উপযুক্ত যে তার যুগের লোকদের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী; তবে শর্ত হচ্ছে তার ইমামতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে যেন সমাজে কোনরূপ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ না হয়।{২৬}

মু’তাজেলা সম্প্রদায়: ইমামের শ্রেষ্ঠত্বের শর্ত জরুরী নয় এবং সর্বোত্তম ব্যক্তিকে তুলনামূলক কম উত্তম ব্যক্তির উপর প্রাধান্য দেয়াকে মু’তাজেলা সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে জায়েয হিসেবে গণ্য।{২৭} চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দির মু’তাজেলা সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট মনীষী কাযি আব্দুল জাব্বার উল্লেখ করেছেন: কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ব্যক্তির তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম উত্তম ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেয়া জায়েয ও উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত; যথা-

-  যদি সর্বোত্তম ব্যক্তি ইমামতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন- ইলম বা জ্ঞান ও রাজনীতিতে পারদর্শিতার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা না রাখেন।

-  যদি সর্বোত্তম ব্যক্তি কারও অধীনস্ত হন, বিশেষ কোন রোগে আক্রান্ত থাকেন কিংবা প্রয়োজনীয় জনসমর্থনের অধিকারী না হন অথবা ইসলামি বিধানাবলি কার্যকর ও জিহাদ পরিচালনার ক্ষেত্রে অক্ষম থাকেন।

-  সর্বোত্তম ব্যক্তি যদি কুরাইশ বংশোদ্ভূত না হন কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম উত্তম ব্যক্তি কুরাইশ বংশের হয়ে থাকেন।{২৮}

কারণসমূহ

সুন্নী মাযহাবের দৃষ্টিতে সর্বোত্তম ব্যক্তিকে বাদ রেখে তুলনামূলক কম উত্তম বৈশিষ্ট্যের ব্যক্তিকে ইমাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, তম্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-

১- খোলাফায়ে রাশেদীনের পর সর্বোত্তম ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও কুরাইশ বংশোদ্ভূত কোন (সর্বোত্তম নয় এমন) ব্যক্তিকে ইমাম বা খলিফা মনোনয়নের ক্ষেত্রে আলেমগণের ইজমা বা ঐকমত্য

২- দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর বিন খাত্তাব পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের বিষয়কে ৬ ছয় সদস্য বিশিষ্ট বোর্ডের নিকট হস্তান্তর করেন; অথচ তখন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ও হযরত উসমান তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন।

৩- শ্রেষ্ঠত্ব একটি গোপনীয় বিষয় এবং তা চিহ্নিত ও নির্ণয় করা একদিকে কষ্টসাধ্য এবং অপরদিকে মতভেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।{২৯}

পরকালে ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব

মাসুম ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের নিমিত্তে পারলৌকিক সওয়াবের অধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু দলীলাদি তুলে ধরা হয়েছে{৩০}; যথা-

ইসমাত: ইমামকে ইসমাতের অধিকারী তথা মাসুম হওয়া জরুরী। যে ইসমাতের অধিকারী হবে, স্বভাবিকভাবে সে পারলৌকিক সওয়াবের ক্ষেত্রে অন্যদের অগ্রগামী হবে।{৩১} কেননা ইমাম মাসুম হওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দিকে থেকে এক ও অভিন্ন হবে। এ কারণে বাহ্যিক মহিমান্বিত বৈশিষ্ট্যাবলি ছাড়াও আত্মিক ও সত্ত্বাগত শ্রেষ্ঠত্বের পাশাপাশি অন্য যে কারও তুলনায় অধিকতর পারলৌকিক পূ্ণ্যের অধিকারী হবে।{৩২}

অধিক দায়িত্ববোধ ও অধিক পুরুস্কার: মাসুম ইমামকে (আ.) ইমামতের গুরুদায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে অন্যদের তুলনায় অধিকতর দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ কারণে সে তুলনামূলক অধিক সওয়াব ও পুরস্কারের অধিকারী হবেন।{৩৩}

হুজ্জাত: মাসুম ইমামগণ (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.) ন্যায় আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা প্রতিনিধি। যেমনভাবে রাসূল (সা.) অন্যদের তুলনায় অধিক সওয়াব ও পুরুস্কারের অধিকারী, তেমনভাবে ইমামও সাধারণ মানুষদের তুলনায় বেশি সওয়াব ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হবেন।{৩৪}

শিয়া ইমামগণের (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব

শিয়া মাযহাবের মনীষীবর্গের দৃষ্টিতে রাসূলুল্লাহর (সা.) পর মাসুম ইমামগণ (আ.) অন্যান্যদের (চাই সে কোন নবি, ফেরেশতা হোক না কেন) তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।{৩৫} সমস্ত সৃষ্টি জগতের উপর মাসুম ইমামগণের (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অনেক সহীহ ও মুতাওয়াতির হাদীস রয়েছে।{৩৬} আল্লামা মাজলিসি উল্লেখ করেছেন: যদি কেউ হাদীস ও রেওয়ায়েত নিয়ে বিশ্লেষণ করবে, তার নিকট রাসূল (সা.) ও ইমামগণের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র তারাই অস্বীকার করবে যারা এ বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ ও ওয়াকিবহাল নয়। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, ইমামতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অগণিত হাদীস ও রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে।{৩৭}

ইমাম রেযা (আ.) তাঁর পিতামহ আমিরুল মু’মিনিন আলীর (আ.) উদ্ধৃতি দিয়ে এবং তিনি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন:

… হে আলী! নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলগণকে নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং আমাকে সমস্ত নবী-রাসূলগণের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেছেন। আর আমার পর শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে অবস্থান হচ্ছে তোমার এবং তোমার পর এ অবস্থান হচ্ছে তোমার পরবর্তী ইমামগণের জন্য নির্ধারিত। নিশ্চয়ই ফেরেশতারা হচ্ছে আমাদের সেবক ও শুভাকাঙ্খি।{৩৮}

অন্যান্য সাহাবিদের তুলনায় আমিরুল মু’মিনিন আলীর (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব সম্পর্কে কোরআনিক ও রেওয়ায়েত ভিত্তিক অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে।{৩৯} আল্লামা হিল্লী আমিরুল মু’মিনিন আলীর (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ‘কাশফুল মুরাদ’{৪০} গ্রন্থে ২৫টি এবং ইবনে মিসাম বাহরানি ‘আন্ নাযাহ ফীল কিয়ামাহ’{৪১} গ্রন্থে ২২টি দলীল বর্ণনা করেছেন। এ দলীলসমূহের মধ্যে রয়েছে মুহাবিলার আয়াত, মুয়াদ্দাতের আয়াত, হাদীসে তাঈর, হাদীসে মানজিলাত প্রভৃতি।{৪২}

বর্ণিত হয়েছে যে, বাগদাদের মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের মনীষীবর্গ যেমন- ইবনে আবিল হাদীদ (নাহযুল বালাগা’র ব্যাখ্যাকারী) এবং বসরা’র অধিকাংশ কালামশাস্ত্রবিদরা খেলাফায়ে রাশেদীদের প্রথম তিন খলিফা ও অন্যান্য সাহাবিদের তুলনায় ইমাম আলীকে (আ.) শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম মনে করতেন।{৪৩}

শ্রেষ্ঠত্বের বোরহান

ইমামতের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি ইমাম আলীর (আ.) ক্ষেত্রে সুপ্রমাণের নিমিত্তে কিছু বোরহান তথা দর্শন বা দলীল উপস্থাপিত হয়েছে। কালামশাস্ত্রে এ বোরহানকে শ্রেষ্ঠত্বের বোরহান নামে অভিহিত করা হয় এবং এটি তিনটি স্তরে সুপ্রমাণিত; আর সেটি হচ্ছে  নিম্নরূপ-

প্রথমস্তর- পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং সহীহ হাদীস ও রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) হলেন অন্যান্য সাহাবি ও লোকদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ।

দ্বিতীয়স্তর- ইমামের অন্যতম শর্ত হচ্ছে মানবীয় ও পূর্ণতার গুণাবলির ক্ষেত্রে অন্যান্য মানুষদের তুলনায় উত্তম ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হবেন।

ফলাফল- সুতরাং আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) হলেন ইমাম ও রাসূলুল্লাহর (সা.) স্থলাভিষিক্ত।{৪৪}

সন্দেহের উদ্রেগ

সুন্নী মাযহাবের কিছু লোক ইমামের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে কিছু সন্দেহের উদ্রেগ ও আপত্তি তুলে ধরেছেন; সেগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ-

শ্রেষ্ঠত্ব অগ্রগণ্য ও প্রাধান্যের বাধ্যবাধ্যকতা সৃষ্টি করে না- কখনও কখনও তুলনামূলক কম উত্তম (মাফজুল) ব্যক্তি সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির চেয়ে ক্ষেত্র বিশেষে অগ্রগণ্য প্রধান্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ-

মাফজুল তথা অশ্রেষ্ঠ কিংবা সর্বোত্তম নয় এমন কোন ব্যক্তি যদি সমাজে নেতৃত্ব দান, দিকনির্দেশনা, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার দিক থেকে আফজাল তথা সর্বোত্তম ব্যক্তির তুলনায় অধিক উপযুক্ত হয়; তাহলে সেই ইমামতের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে।{৪৬} এরূপ আপত্তির জবাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এমন ধারণার নেপথ্য কারণ হচ্ছে তারা (এরূপ ধারণাপোষণকারীরা) ইমামতের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়কে কেবল ধর্মীয় ও ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করেছে। কিন্তু তাদের এহেন ধারণা আদৌ সঠিক নয়। কেননা ইমামতের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের বিষয় বলতে এ গুরুদায়িত্বে সমাসীন হওয়ার ক্ষেত্রে যে সব বৈশিষ্ট্যাবলি অত্যবশ্যকীয় সেগুলোর সবই একজন ইমামের মধ্যে থাকা জরুরী; এ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিচক্ষণতা ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার ক্ষমতাও অন্তর্ভূক্ত। এছাড়া এ আপত্তিতে শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়কে একটি আপেক্ষিক বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়েছে; অথচ এখানে ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব বলতে ইমামতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে যাবতীয় বৈশিষ্ট্যাবলি ও পূর্ণতার দিক থেকে নিরঙ্কুশ যোগ্যতা ও ক্ষমতার অধিকারী হওয়া জরুরী।{৪৭}

শ্রেষ্ঠত্বের উপমার ক্ষেত্রে অসঙ্গতি- বলা হয়ে থাকে যে, রাসূলের (সা.) যুগে এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে ইমাম কিংবা সেনাপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু উপমা শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার সাথে কোন সামঞ্জস্যতা রাখে না।{৪৮} উদাহরণস্বরূপ- মুতার যুদ্ধে হযরত জাফর বিন আবু তালিব থাকা সত্ত্বেও জায়েদ বিন হারেসেকে সেনাপতি নির্ধারণ কিংবা আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) থাকা সত্ত্বেও রাসূলের (সা.) জীবন সায়াহ্নে উসামা বিন জায়দের নেতৃত্বে যুদ্ধবাহিনী গঠন{৪৯} এবং অনুরূপভাবে দ্বিতীয় খলিফ হযরত উমর কর্তৃক ইমাম আলী ও হযরত উসমানের ন্যায় যোগ্য সাহাবি থাকা সত্ত্বেও ৬ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড গঠন{৫০} প্রভৃতি ঘটনাবলি।

এরূপ আপত্তির জবাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোন বাহিনীর কমান্ডার নিয়োগের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্বতার প্রয়োজন হয় না; বরং এক্ষেত্রে রণকৌশল ও সামরিক দক্ষতাই যথেষ্ট। হযরত জায়েদ ও হযরত উসামা এমন দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। এছাড়া হযরত উসামা’র বাহিনী গঠন সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম আলী (আ.) সে সময় রাসূলুল্লাহর শয্যাপাশে তাঁর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন এবং রাসূলও (সা.) উসামার বাহিনীতে আলীর (আ.) যোগদানের বিষয়ে কোন ইশারা করেন নি। এ কারণে উসামার বাহিনীর সাথে আলোচ্য বিষয়ের কোন সম্পৃক্ততা নেই।{৫১} পক্ষান্তরে খলিফা উমর কর্তৃক ৬ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড গঠন তাঁর নিজস্ব কর্মনীতির অংশ এবং শিয়া মাযহাবের মৌলিক আকিদা অনুসারে এমন কর্মের কোন স্বীকৃতি কিংবা হুজ্জাত বা বাধ্যতা নেই।{৫২}