লাইলাতুল কদর

wikishia থেকে

লাইলাতুল কদর তথা শবে কদর মানুষের ভাগ্য রজনী হিসেবে পরিগণিত। এ রজনীতে মানুষের এক বছরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। পবিত্র কুরআনের সূরা কদরসূরা দুখানে এ রজনী সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনের আয়াতহাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী লাইলাতুল কদরের রাত এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতটি বছরের সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ রজনী; যে রাতে আল্লাহর রহমত ও বরকত নাযিল হয়। এ রাতে ফেরেশতারা আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও রহমত নিয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়। শিয়া মাযহাবের বর্ণনা অনুযায়ী এ রাতে মানুষের পরবর্তী এক বছরের ভাগ্যলিপি যুগের ইমাম তথা ইমাম মাহদীর (আ.) নিকট পেশ করা হয়।

লাইলাতুল কদর সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত নয়। তবে নির্ভরযোগ্য হাদীস ও রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে এ রাতটি মাহে রমযানের কোন এক রজনীতে বিদ্যমান; বিশেষ করে ১৯, ২১ ও ২৩ রমযানের কোন এক রজনীতে শবে কদর হওয়ার সম্ভবণা অনেক বেশি। শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা ২৩ রমযানের রাতকে এবং সু্ন্নী মাযহাবের অনুসারীরা ২৭ রমযানের রাতকে সর্বাধিক সম্ভব্য শবে কদর হিসেবে পালন করে।

শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা এ রজনীসমূহে মাসূমগণের (আ.) আদর্শ অনুসরণ করে রাত্র জাগরণ, কুরআন তেলাওয়াত, দোয়া-প্রার্থনা এবং ইবাদত-বন্দেগীতে মগ্ন থাকে। ১৯ রমযানে ইমাম আলী (আ.) মসজিদে কুফাতে তরবারীর আঘাতে আহত এবং ২১ রমযানে শাহাদত বরণ করায় এ দিনগুলিতে শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা শোকানুষ্ঠান ও আযাদারি পালন করে থাকে।

নামকরণ

‘কদর’ একটি আরবী শব্দ, এর অর্থ হচ্ছে কোন কিছুর মূল্যায়ন, ভাগ্য কিংবা নিয়তি। [১] এ রজনীকে কেন লাইলাতুল কদর বলা হয়, এ সম্পর্কে কিছু মতামত ও প্রমাণাদি রয়েছে। আমরা সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি এখানে তুলে ধরছি:

  • প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা তাবাতাবায়ী উল্লেখ করেছেন যে, যেহেতু লাইলাতুল কদরের রাতে মানুষের এক বছরের ভাগ্যলিপি, নিয়তি এবং পরবর্তী বছরে মানুষের জীবনে সংঘটিতব্য ঘটনাবলি নির্ধারিত হয়; এ কারণে এ রজনীকে লাইলাতুল কদর বলা হয়। [২]
  • যদি কেউ এ রজনীতে ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে জাগ্রত থাকে, তবে সে বিশেষ ভাগ্য ও মর্যাদার অধিকারী হবে। [৩]
  • এ রজনীর বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার কারণে ‘কদর’ নামকরণ করা হয়েছে।[৪]
  • যেহেতু আল কুরআন এ রজনীতে নাযিল হয়েছে। [৫]

এছাড়া এ রজনীকে লাইলাতুল উযমা এবং লাইলাতুল শারাফ নামেও অভিহিত করা হয়। [৬]

গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ইসলামে শবে কদর হচ্ছে সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ রজনী। রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, লাইলাতুল কদর মুসলিম উম্মাহর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ স্বরূপ, যা পূর্বেকার কোন জাতিকে দেয়া হয়নি।[৭] পবিত্র কুরআনে শবে কদরের ফজিলত ও তাৎপর্য সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা অবতীর্ণ হয়েছে; যা সূরা কদর নামে পরিচিত। {প্রাগুক্ত, ১৭৮} এ সূরাতে শবে কদরকে এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। [৮] সূরা দুখানের এক থেকে ছয় পর্যন্ত আয়াতগুলোতেও শবে কদরের ফজিলত তুলে ধরা হয়েছে। ইমাম জাফর সাদিক থেকে বর্ণিত এক রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সর্বোত্তম মাস হচ্ছে রমযান এবং রমযান মাসের প্রাণ হচ্ছে লাইলাতুল কদর। {তাফসীরে নুরুস সাকালাইন, খণ্ড ৫, পৃ. ৯১৮} রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে, লাইলাতুল কদর সমস্ত রাতসমূহের সর্দার। {আল্লামা মাযলিসী, বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৪০, পৃ. ৫৪} ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত এক রেওয়ায়েতে শবে কদরকে বছরের মধ্যমণি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। [৯] এছাড়া বহু হাদীস ও রেওয়ায়েতের বর্ণনা অনুযায়ী কদরের দিনগুলোও এর রজনীসমূহের ন্যায় ফজিলতপূর্ণ ও বরকতময়। [১০]

ইমামগণ (আ.) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতে নবী নন্দিনী ফাতেমা যাহরাকে (আ.) শবে কদরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যদি কেউ তাকে যথাযথভাবে চিনতে সক্ষম হয়, তবে সে শবে কদরকেও চিনতে পারবে। [১১]

কুরআন নাযিলের রাত

সূরা কদরের ১নং আয়াত এবং সূরা দুখানের ৩নং আয়াতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, শবে কদরে কুরআন নাযিল হয়েছে। {শাকের, শাবি বারতার আয হিজার মাহ, পৃ. ৫০} কোন কোন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, শবে কদর থেকে ধারাবাহিকভাবে কুরআন নাযিল হয়েছে। [১২] অবশ্য অধিকাংশ শীর্ষ মুফাসসিরবর্গের বর্ণনামতে কুরআন শবে কদরের রাতে একবারে আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলের (সা.) প্রতি নাযিল হয়েছে; আর এমন নাযিল হওয়ার বিষয়কে কুরআনের সামগ্রিক নাযিল হিসেবে অভিহিত করা হয়।[১৩]

ভাগ্য নির্ধারণ

৫ম ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.) সূরা দুখানের ৪নং আয়াতের (এ রজনীতে সমুদয় জ্ঞানগর্ভ ও যুক্তিসিদ্ধ বিষয়ের ফাসলালা করা হয়) তাফসীরে উল্লেখ করেনঃ প্রতি বছর এ রজনীতে মানুষের পরবর্তী বছরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। [১৪] প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা তাবাতাবায়ী বলেনঃ কদরের অর্থ হচ্ছে মূল্যায়ন, পরিমাণ নির্ধারণ। আল্লাহ এ রাতে মানুষের জীবন, মৃত্যু, জীবিকা, সৌভাগ্য কিংবা দূর্ভাগ্য প্রভৃতি নির্ধারণ করেন। [১৫] কোন কোন রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে এ রজনীতে আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.)আহলে বাইতের ইমামগণের (আ.) বেলায়েত নির্ধারিত ও চুড়ান্ত হয়েছে। [১৬]

গুনাহ থেকে মুক্তি

নির্ভরযোগ্য ইসলামি সূত্র অনুযায়ী লাইলাতুল কদর হচ্ছে আল্লাহর বিশেষ রহমত ও গুনাহ থেকে মুক্তির রজনী। এ রাতে শয়তান ছিকল বন্দি ও বেহেশতের দরজা মু’মিনদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে জাগ্রত অবস্থাতে থাকবে; যদি সে মু’মিন হয় ও পরকালের প্রতি ঈমানপোষণ করে, তাহলে আল্লাহ সমস্ত গুনাহকে ক্ষমা করে দিবেন। [১৭]

ফেরেশতাদের অবতরণ

সূরা কদরে বর্ণিত হয়েছে যে, এ রজনীতে ফেরেশতাগণ ও রুহুল কুদস (জিবরাঈল) আল্লাহর আদেশক্রমে প্রত্যেক বিষয়ের আদেশসহ অবতীর্ণ হয়। [১৮] আবার রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, এ রাতে ফেরেশতারা পরবর্তী বছরে বান্দাদের ভাগ্যের বিবরণি নিয়ে যুগের ইমামের (আ.) নিকট হাজির হয় এবং তার সম্মতি গ্রহণ করে থাকে। [১৯] ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.) বলেনঃ এ রাতে ফেরেশতারা আমাদের চারিপাশে পরিবৃষ্ট হয় এবং এ থেকে লাইলাতুল কদরের উপস্থিতি অনুভব করি। অপর এক রেওয়ায়েতে শিয়া মাযহাবের অনুসারীদের প্রতি সুপারিশ করা হয়েছে যে, তারা যেন এ বিষয়টিকে ইমামের অপরিহার্যতা এবং শিয়া মাযহাবের সত্যতার দলিল হিসেবে তুলে ধরে। কেননা উক্ত রেওয়ায়েতের আলোকে প্রত্যেক যুগে আল্লাহ মনোনীত মাসুম ইমামের অপরিহার্যতা রয়েছে, যার নিকট ফেরেশতারা শবে কদরে পরবর্তী বছরের ভাগ্য বিবরণী উপস্থাপন করবে। [২০]

সময়

লাইলাতুল কদর বা শবে কদর বছরের কোন রজনী; এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। আমরা এখানে এ সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর প্রধান দু’টি মাযহাব তথা শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মতামত তুলে ধরব।

শিয়া মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গি

শিয়া মাযহাবের শীর্ষ মুফাসসিরগণ সূরা কদরের ভাষ্য অনুযায়ী মতামত প্রকাশ করেছেন যে, লাইলাতুল কদর শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহর (সা.) যুগে কুরআন নাযিল রাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রতি বছর এ রাতের পুনরাবৃত্তি ঘটে। [২১] এ সম্পর্কে অনেক সহীহ ও মুতাওয়াতির হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। [২২] কিন্তু শবে কদর নির্দিষ্টভাবে স্পষ্ট নয়। এমনকি পবিত্র কুরআনের আয়াত, রাসূল (সা.) ও মাসুম ইমামগণের হাদীসেও বছরের কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তা সুনির্দিষ্টভাবে স্পষ্ট করা হয় নি। অবশ্য শবে কদরের রাতটি যে পবিত্র রমযান মাসের যে কোন একটি রাত এটি কুরআনের আয়াত ও রেওয়ায়েতে মুটামুটি স্পষ্ট করা হয়েছে। [২৩]

আল্লামা মাজলিসী বর্ণনা করেছেন যে, শিয়া মাযহাবের প্রথমসারির মনীষীগণের ঐকমত্যের ভিত্তিতে শবে কদর রমযান মাসের ১৯, ২১ ও ২৩ তারিখের মধ্যে যে কোন একদিন হওয়ার সম্ভবণা সব থেকে বেশি। এ সম্পর্কে অনেক রেওয়ায়েতও বর্ণিত হয়েছে। [২৪]

শেইখ সাদুক (রহ.) বলেছেন যে, আমাদের উস্তাদগণ ঐকমতপোষণ করতেন যে, ২৩ রমযানের রাত হচ্ছে শবে কদর। [২৫] মোল্লা ফাতহুল্লাহ কাশানী স্বীয় মিনহাজুস সাদেকীন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, অধিকাংশ শিয়া আলেমগণের দৃষ্টিতে ২৩ রমযানের রাত শবে কদর হিসেবে বিবেচিত। [২৬] অনেক মুতাওয়াতির ও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে ২৩ রমযানের রাত হচ্ছে শবে কদর। [২৭] এছাড়া কিছু কিছু রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, ১৯ রমযানের রাতে ভাগ্য নির্ধারিত হয়, ২১ রমযানের রাতে উক্ত পরিমাণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং ২৩ রমযানের রাতে তা চুড়ান্ত করা হয়। {শেখ কুলাইনী, উসূলে কাফী, খণ্ড ৪, পৃ. ১৫৯ ও ১৬০} আবার কিছু রেওয়ায়েতে ২৭শে রমযানের রাত কিংবা ১৫ শাবানের রাতকে শবে কদর হিসেবে অভিহিত করা হয়েছ। [২৮]

সুন্নী মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গি

সুন্নী মাযহাবের অধিকাংশ মনীষীবর্গ আকিদাপোষণ করেন যে, রাসূলুল্লাহ’র (সা.) হাদীস অনুযায়ী মাহে রমযানের শেষ ১০ দিনের মধ্যে যে কোন একদিন হচ্ছে সম্ভব্য শবে কদর। [২৯]} আল্লামা তাবাতাবায়ী উল্লেখ করেছেনঃ সুন্নী মাযহাবের মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে ২৭ রমযানের রাত শবে কদর। [৩০]

সুন্নী মাযহাবের কিছু মনীষী আকিদাপোষণ করেন যে, রাসূলুল্লাহ’র (সা.) জীবদ্দশাতে প্রতি বছর শবে কদর সংঘঠিত হত। কিন্তু রাসূলের (সা.) ওফাতের পর আর শবে কদর সংঘটিত হয় নি। [৩১]} আবার কেউ কেউ ধারণাপোষণ করেন যে, শবে কদর নির্দিষ্ট কোন রাত নয়; বরং বছর পরিক্রমায় সারা বছরের যে কোন একটি রাতে এটি সংঘটিত হয়। তারা আরও বিশ্বাস করেন যে, লাইলাতুল কদর রাসূলের (সা.) বে’সাত তথা নবুয়্যাত ঘোষণার বছর মাহে রমযানে সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে হয়তো ভিন্ন ভিন্ন মাসে সংঘটিত হয়। [৩২]

দিগন্তের ব্যবধান এবং শবে কদর নির্ধারণ প্রক্রিয়া

বছরের একটি মাত্র রাত হচ্ছে লাইলাতুল কদর। [৩৩] কিন্তু ভৌগলিক ও দিগন্তের ব্যবধানের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে (যেমন ইরানসৌদি আরবে) পবিত্র রমযান মাসের সূচনার ক্ষেত্রে সময়ের কিছু পার্থক্য ও ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। এরই ফলে ১৯, ২১ এবং ২৩ তারিখে শবে কদরের সময়ের মধ্যেও পার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক। [৩৪] ফিকাহবিদগণ দিগন্তের এ তারতম্য সম্পর্কে বলেছেনঃ বিভিন্ন দেশের দিগন্ত ও সময়গত পার্থক্যের কারণে লাইলাতুল কদরে কোন পার্থক্য ঘটবে না। বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অধিবাসীরা নিজ নিজ অঞ্চলের সময় অনুযায়ী এ রজনী পালন করবে; যেমনভাবে অন্যান্য ধর্মীয় উপলক্ষ্য যথাঃ ঈদুল ফিতর কিংবা ঈদুল আযহার দিন নির্ধারণ ও তা পালন করে থাকে।

হযরত আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজীর দৃষ্টিতে রাত হচ্ছে ভূ-পৃষ্ঠের অর্ধাংশ; অর্থাৎ দিবারাতের ২৪ ঘন্টায় এ পৃথিবী যখন প্রদক্ষিণ করে, এ সময় এর এক অর্ধাংশে যখন সূর্যের আলো বিকরিত হয় তখন সেখানে থাকে দিন এবং অপর অর্ধাংশে থাকে রাত। সুতরাং ২৪ ঘন্টায় পৃথিবী প্রদক্ষিণের সময় বিশ্বের যে অঞ্চলে রাত থাকবে সেখানে শবে কদর এবং পরবর্তী ১২ ঘন্টার দিন শেষে আবার যে অর্ধাংশে রাত হবে সেখানে তখন শবে কদর। [৩৫]

আহলে বাইতের (আ.) আদর্শ

রাসূলের (আ.) পবিত্র আহলে বাইতের (আ.) আদর্শ আমাদের জন্য অবশ্য পালনীয়। তাই এ রজনীকে কিভাবে অতিবাহিত করতেন তা জানা এবং তদানুযায়ী আমল করা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, “রাসূলুল্লাহ (সা.) রমযান মাসের শেষ ১০ দিনে স্বীয় বিছানাপত্র উঠিয়ে ফেলতেন এবং মসজিদে এতেকাফ পালন করতেন। তখনকার সময়ে মসজিদুন্নবীতে কোন ছাদ ছিল না। এ কারণে যদি বৃষ্টিপাতও হত, তবুও তিনি মসজিদ ত্যাগ করতেন না। [৩৬] এছাড়া আরও বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) লাইলাতুল কদরগুলোতে সারা রাত জাগ্রত থাকতেন এবং যদি তন্দ্রাভাব আসতো তাহলে চোখে-মুখে পানি দিতেন। [৩৭]

শবে কদরের রজনীতে নবী নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার (আ.) পদ্ধতি ছিল, এ রাতে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে ঘুমাতে দিতেন না এবং তাঁদের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতেন এবং দিনের বেলায় তাঁদেরকে ঘুমাতে দিতেন যেন তাঁরা রাতের বেলা ঘুমিয়ে না যায়। তিনি বলতেন: প্রকৃতপক্ষে সে বঞ্চিত যে এই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। [৩৮]

আমাদের মাসুম ইমামগণ (আ.) শবে কদরের রাতগুলিতে মসজিদে অবস্থান করতেন এবং ঘুমাতেন না। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) কোন এক লাইলাতুল কদরে অসুস্থ ছিলেন। এ কারণে এ রাতে তাঁর গৃহভৃত্যদেরকে বললেন তাঁকে মসজিদে বহন করে নিয়ে যেতে, যাতে সেখানে ইবাদত-বন্দেগী করতে পারেন। [৩৯]

লাইলাতুল কদরের আমলসমূহ

লাইলাতুল কদরের আমল দু’ধরনের, যথাঃ

  • প্রথমত, সে আমলসমূহ যা ১৯, ২১২৩ তিনটি লাইলাতুল কদরেই পালন করতে হয়। যেগুলো সাধারণ আমল হিসেবে গণ্য। [৪০]
  • দ্বিতীয়ত, সে সব আমল যেগুলো প্রতিটি কদরের রাতে ভিন্ন ভিন্নভাবে সম্পন্ন করতে হয়। যেগুলো বিশেষ আমল হিসেবে গণ্য। [৪১]}

সবগুলো (১৯,২১, ২৩) কদরের রাতে পালনীয় আমলসমূহ-

নিয়ত: লাইলাতুল কদরের দুই রাকাত নামায পড়ছি কুরবাতান ইলাল্লাহ।

নামাযটি পড়ার পদ্ধতি: প্রথম রাকাতে সুরা ফাতিহার পর ৭ বার সুরা ইখলাস পাঠ করতে হবে। দ্বিতীয় রাকাতটিও অনুরূপ পদ্ধতিতে পড়তে হবে।

  • নামাযান্তে ৭০ বার “أَسْتَغْفِرُ اللّه وَ أَتوبُ الَيْهِ”(আসতাগফিরুল্লাহা ওয়া আতুবু ইলাই) পাঠ করতে হবে।

রাসুল (সা.) হতে রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: এই আমলকারী তার স্থান হতে ওঠার পূর্বেই আল্লাহ তাকে এবং তার পিতা-মাতাকে ক্ষমা করে দিবেন।

  • নিজের গুনাহসমূহকে স্মরণ করে ১০০ বার বলতে হবে (আসতাগফিরুল্লাহা রাব্বি ওয়া আতুবু ইলাই) أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ رَبِّي وَ أَتُوبُ إِلَيْه‏
  • পবিত্র কুরআন শরীফ খুলে নিজের সামনে রেখে বলতে হবে : اَللَّهُمَّ اِنّي اَسئَلُك بِكِتَابِكَ المُنْزَلِ وَ مَا فِيْهِ اسْمُكَ الاَكْبَرُ و اَسمَاؤُكَ الحُسنَي وَ مَا يُخَافُ وَ يُرجَي اَن تَجعَلَنِي مِن عُتَقائِكَ مِنَ النَّارِ.

“হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার অবতীর্ণ করা কিতাবের মাধ্যমে বিনীত অনুরোধ করছি এবং এর ভেতরে যা রয়েছে এবং এর ভেতরে আপনার সবচেয়ে বড় নামের মাধ্যমে এবং আপনার সুন্দর নামগুলোর মাধ্যমে এবং যে সকল বিষয়ে ভয় করা উচিত এবং যা আশা করা হয়, আপনি যেন আমাকে আগুন থেকে রক্ষাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত করেন।”

তারপর মনোবাসনা পূরণের উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে।

اَللّهمَّ بِحَقِّ هذاالقُرآنِ وَ بِحَقِّ مَن اَرسَلتَهُ بِه وَ بِحَقِّ كُلِّ مُومِنٍ مَدَحْتَهُ فِيْهِ وَ بِحَقِّكَ عَلَيْهِمْ فَلاَ اَحَدَ اَعرَفُ بِحَقِّكَ مِنْكَ.

“হে আল্লাহ! এই কোরআনের অধিকারের মাধ্যমে বিনীত নিবেদন করি এবং তার অধিকারের মাধ্যমে যাকে দিয়ে কোরআন পাঠিয়েছেন এবং ঐ সকল মুমিনদের অধিকারের মাধ্যমে যাদের প্রশংসা এর ভেতরে করেছেন এবং তাদের ওপরে আপনার অধিকারের মাধ্যমে এমন কেউ নেই যে, আপনার অধিকারের বিষয়ে আপনার চেয়ে বেশি জানে।”

তারপর বলতে হবে : ১০ বার : ((بِكَ يَا اللَّهُ))- বিকা ইয়া আল্লাহু

১০ বার : ((بِمُحَمَّدٍ))- বিমুহাম্মাদিন

১০ বার : ((بِعَليٍّ))- বিআলী য়্যিন

১০ বার : ((بِفاطِمَةَ))- বিফাতিমাহ

১০ বার : ((بِالحَسَنِ))- বিল হাসানী

১০ বার : ((بِالحُسَينِ))- বিল হুসাইনী

১০ বার : ((بِعلي بنِ الحُسين))- বিআলী ইবনিল হুসাইন

১০ বার : ((بِمُحَمَّدِ بنِ عَلِى))- বিমুহাম্মাদ ইবনি আলী

১০ বার : ((بِجَعفَر بنِ مُحَمَّدٍ))- বিজাফার ইবনি মুহাম্মাদ

১০ বার : ((بِموُسي بنِ جَعفَرٍ ))- বিমুসা ইবনি জাফার

১০ বার : ((بِعلي بنِ مُوسي))- বিআলী ইবনি মুসা

১০ বার : ((بِمُحَمَّدِ بنِ عَلَى))- বিমুহাম্মাদ ইবনি আলী

১০ বার : ((بِعَلَى بنِ مُحَمَّدٍ))- বিআলী ইবনি মুহাম্মাদ

১০ বার : ((بِالحَسَنِ بنِ عَلَى))- বিল হাসান ইবনি আলী

১০ বার : ((بِالحُجَّةِ))- বিল হুজ্জাহ

তারপর দোয়া করতে হবে।

  • ইমাম হুসাইন (আ.)এর যিয়ারত পাঠ করা। রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, শবে কদরে সপ্তম আসমান থেকে আহবান জানানো হয় যে, যারা ইমাম হুসাইন (আ.)’র কবর যিয়ারতের জন্য এসেছে মহান আল্লাহ ঐ সকল ব্যক্তিদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
  • রাত জাগরণ করা। রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে জাগ্রত থাকে, তাহলে তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়; যদিও তার গুনাহ আকাশের নক্ষত্রের সমপরিমাণ এবং পাহাড়সমূহের ন্যায় ভারী হয়....।
  • লাইলাতুল কদরে ১০০ রাকাত নামায পড়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে।

নামাযটি পড়ার পদ্ধতি: প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহার পর ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করতে হবে।

  • এই দোয়াটি পাঠ করা:

اللَّهُمَّ إِنِّي أَمْسَيْتُ لَكَ عَبْداً دَاخِراً لا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعاً وَ لا ضَرّاً وَ لا أَصْرِفُ عَنْهَا سُوءاً أَشْهَدُ بِذَلِكَ عَلَى نَفْسِي وَ أَعْتَرِفُ لَكَ بِضَعْفِ قُوَّتِي وَ قِلَّةِ حِيلَتِي فَصَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَ آلِ مُحَمَّدٍ وَ أَنْجِزْ لِي مَا وَعَدْتَنِي وَ جَمِيعَ الْمُؤْمِنِينَ وَ الْمُؤْمِنَاتِ مِنَ الْمَغْفِرَةِ فِي هَذِهِ اللَّيْلَةِ وَ أَتْمِمْ عَلَيَّ مَا آتَيْتَنِي فَإِنِّي عَبْدُكَ الْمِسْكِينُ الْمُسْتَكِينُ الضَّعِيفُ الْفَقِيرُ الْمَهِينُ اللَّهُمَّ لا تَجْعَلْنِي نَاسِياً لِذِكْرِكَ فِيمَا أَوْلَيْتَنِي وَ لا لِإِحْسَانِكَ فِيمَا أَعْطَيْتَنِي وَ لا آيِساً مِنْ إِجَابَتِكَ وَ إِنْ أَبْطَأَتْ عَنِّي فِي سَرَّاءَ أَوْ ضَرَّاءَ أَوْ شِدَّةٍ أَوْ رَخَاءٍ أَوْ عَافِيَةٍ أَوْ بَلاءٍ أَوْ بُؤْسٍ أَوْ نَعْمَاءَ إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاءِ.

“হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার একজন হীন দাস রূপে সন্ধ্যায় উপনীত হয়েছি, আমি আমার আত্মার জন্য লাভ ও ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করি না এবং এর কাছ থেকে খারাপকে দূর করে দিতে পারি না আমি আমার আত্মার ওপর এই বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি আর আমি আমার শক্তির দূর্বলতা এবং স্বল্প উপায়ের কথা আপনাকে জানাচ্ছি তাই কল্যাণ বর্ষণ করুন মুহাম্মাদ এবং তাঁর পরিবারের ওপর, এবং যা আমার কাছে আপনি অঙ্গীকার করেছেন তা পূরণ করুন এবং সব মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য এই রাতেই আপনার ক্ষমা এবং যা আপনি আমাকে দান করেছেন তা পূর্ণ করে দিন কারণ আমি আপনার নিঃস্ব ও বিনীত, দূর্বল, দরিদ্র ও নগণ্য একজন দাস। হে আল্লাহ! আপনার স্মরণকে যেন আমি ভুলে না যায় যে বিষয়ে আপনি আমাকে যোগ্য করেছন এবং আমাকে উদাসীন হতে দিবেন না আপনার উপকার স্মরণের বিষয়ে যা আপনিই আমাকে দান করেছেন এবং আমাকে আপনার সাড়া দেওয়ার বিষয়ে নিরাশ হতে দিবেন না যদি আপনি তা আমার জন্য স্থগিতও করে থাকেন সমৃদ্ধি অথবা ক্ষতির সময়ে, কঠিন বা সহজ সময়ে, সুস্থতায় বা দূর্যোগে, দূর্দশায় বা স্বাচ্ছন্দে নিশ্চয় আপনি দোয়াকে শোনেন।”

শেখ কাফআমি (রহ.) এই দোয়াটি ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি এই দোয়াটি লাইলাতুল কদরের রাতগুলোতে কিয়াম, রুকু ও সেজদারত অবস্থায় পাঠ করতেন।

  • আল্লামা মাযলিসি (রহ.) বলেছেন: এই রাত্রির উত্তম আমল হচ্ছে ইস্তিগফার পাঠ করা, নিজের পিতামাতা, ভাই, মৃত ব্যক্তি ও নিজের জন্য দোয়া করা এছাড়া যতটুকু সম্ভব যিকির, দুরুদ পাঠ করা।
  • দোয়া-এ-জওশান কাবীর পাঠ করা। রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, এই তিন রাতে দোয়া-এ-জওশান কাবীর পাঠ করা উত্তম। রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, একজন ব্যাক্তি রাসুল (সা.)কে জিজ্ঞাসা করে লাইলাতুল কদরে আল্লাহর কাছে আমাদের কি চাওয়া উচিত? তিনি বলেন: লাইলাতুল কদরে চাওয়া উচিত হচ্ছে আল্লাহ যেন আমাদের প্রতি সহায় হন।

১৯শে রমযান রাতের বিশেষ আমলসমূহ:

১৯শে রমযান রাতের বিশেষ আমলসমূহ নিন্মরূপ:

  • ১০০ বার পাঠ করতে হবে: (اَسْتَغْفِرُاللَّهَ رَبّي‏ وَ اَتُوبُ إلَيهِ)।
  • ১০০ বার পাঠ করতে হবে: (اَللَّهُمَّ الْعَنْ قَتَلَةَ اَميرِ الْمُؤْمِنينَ)।
  • এ দোয়াটি পাঠ করতে হবে। দোয়াটি নিন্মরূপ:

اللَّهُمَّ اجْعَلْ فِيمَا تَقْضِي وَ تُقَدِّرُ مِنَ الْأَمْرِ الْمَحْتُومِ وَ فِيمَا تَفْرُقُ مِنَ الْأَمْرِ الْحَكِيمِ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ وَ فِي الْقَضَاءِ الَّذِي لا يُرَدُّ وَ لا يُبَدَّلُ أَنْ تَكْتُبَنِي مِنْ حُجَّاجِ بَيْتِكَ الْحَرَامِ الْمَبْرُورِ حَجُّهُمْ الْمَشْكُورِ سَعْيُهُمْ الْمَغْفُورِ ذُنُوبُهُمْ الْمُكَفَّرِ عَنْهُمْ سَيِّئَاتُهُمْ وَ اجْعَلْ فِيمَا تَقْضِي وَ تُقَدِّرُ أَنْ تُطِيلَ عُمْرِي وَ تُوَسِّعَ عَلَيَّ فِي رِزْقِي وَ تَفْعَلَ بِي كَذَا وَ كَذَا.

২১ রমযান রাতের বিশেষ আমলসমূহ:

  • রমযানের শেষ ১০ দিন রাতের বিশেষ দোয়াসমূহ পাঠ
  • ২১ রমযান রাতের বিশেষ দোয়া পাঠ করা। দোয়াটি হচ্ছে:

يَا مُولِجَ اللَّيْلِ فِي النَّهَارِ وَ مُولِجَ النَّهَارِ فِي اللَّيْلِ وَ مُخْرِجَ الْحَيِّ مِنَ الْمَيِّتِ وَ مُخْرِجَ الْمَيِّتِ مِنَ الْحَيِّ وَ رَازِقَ مَنْ يَشاءُ بِغَيْرِ حِسابٍ يَا اللَّهُ يَا رَحْمَانُ يَا رَحِيمُ يَا اللَّهُ يَا اللَّهُ يَا اللَّهُ لَكَ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى وَ الْأَمْثَالُ الْعُلْيَا وَ الْكِبْرِيَاءُ وَ الْآلَاءُ أَسْأَلُكَ أَنْ تُصَلِّيَ عَلَى مُحَمَّدٍ وَ آلِ مُحَمَّدٍ وَ أَنْ تَجْعَلَ اسْمِي فِي هَذِهِ اللَّيْلَةِ فِي السُّعَدَاءِ وَ رُوحِي مَعَ الشُّهَدَاءِ وَ إِحْسَانِي فِي عِلِّيِّينَ وَ إِسَاءَتِي مَغْفُورَةً وَ أَنْ تَهَبَ لِي يَقِيناً تُبَاشِرُ بِهِ قَلْبِي وَ إِيمَاناً يُذْهِبُ الشَّكَّ عَنِّي وَ تُرْضِيَنِي بِمَا قَسَمْتَ لِي وَ آتِنا فِي الدُّنْيا حَسَنَةً وَ فِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَ قِنا عَذابَ النَّارِ الْحَرِيقِ وَ ارْزُقْنِي فِيهَا ذِكْرَكَ وَ شُكْرَكَ وَ الرَّغْبَةَ إِلَيْكَ وَ الْإِنَابَةَ وَ التَّوْبَةَ وَ التَّوْفِيقَ لِمَا وَفَّقْتَ لَهُ مُحَمَّداً وَ آلَ مُحَمَّدٍ عَلَيْهِ وَ عَلَيْهِمُ السَّلَام‏

“হে তিনি যিনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান, হে তিনি যিনি দিনকে রাতের ভেতরে প্রবেশ করান, যিনি জীবিতদেরকে বের করে আনেন মৃতদের মাঝ থেকে, হে যিনি মৃতদেরকে বের করে আনেন জীবিতদের মাঝ থেকে হে রিযিক দানকারী যাকে ইচ্ছা হিসাব ছাড়া রিজিক দান করেন হে আল্লাহ হে সর্বদয়ালু হে আল্লাহ হে সর্বমমতাময় হে আল্লাহ হে আল্লাহ হে আল্লাহ আপনারই হলো সুন্দর নামগুলো এবং উচ্চতম দৃষ্টান্তগুলো এবং সব বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব ও দানসমূহ। আপনার কাছে চাই যেন আপনি কল্যাণ বর্ষণ করেন মুহাম্মাদ ও তার পরিবারের ওপর এবং আমার নামকে এই রাতে আনন্দিতদের মাঝে অন্তর্ভূক্ত করেন এবং আমার ভাল কাজগুলোকে ইল্লিয়্যিনে অধিষ্ঠিত রাখেন এবং আমার অপকর্মগুলোকে ক্ষমা করেন এবং আমাকে নিশ্চিত বিশ্বাস দান করেন যা আমার অন্তরকে সুসংবাদ দিবে এবং এমন এক ঈমান দিন যা আমার কাছ থেকে সন্দেহকে দূর করে দিবে এবং আমাকে তাতে সন্তুষ্ট করুন যা আপনি আমার জন্য নির্ধারণ করেন এবং আমাদেরকে কল্যাণ দান করুন এই পৃথিবীতে এবং কল্যাণ দান করুন আখেরাতে এবং আমাদেরকে রক্ষা করুন তীব্র আগুনের শাস্তি থেকে এবং এই বিষয়ে আমাকে দান করুন আপনার স্মরণ এবং আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং আপনাকেই চাওয়া এবং অনুতপ্ত হয়ে ফেরা এবং ঐ সফলতা যে বিষয়ে আপনি সফলতা দিয়েছেন মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারকে তার ওপর ও তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।

২৩শে রমযান রাতের বিশেষ আমলসমূহ

  • সুরা আনকাবুত ও সুরা রূম পাঠ করতে হবে। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন: কেউ যদি এই সুরা দুইটি পাঠ করে তাহলে তাকে বেহেশতের লোকদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
  • সুরা দুখান পাঠ করা।
  • এক হাজার বার সুরা ক্বদর পাঠ করা।
  • দোয়া হুজ্জাত পাঠ করা। (আল্লাহুম্মা কুঁলি ওয়ালি ইকাল হুজ্জাতিবনিল হাসান……….)
  • ইমাম হুসাইন (আ.)’র রওযা যিয়ারত করা।
  • এই রাতে পূর্বের রাতগুলোর ন্যায় বর্ণিত দোয়া ও নামায পড়তে হবে।
  • দোয়া-এ-জওশান কাবীর পাঠ করা।
  • কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করা। [৪২]

অনুষ্ঠানাদি ও রীতি-প্রথা

শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা প্রতি বছর লাইলাতুল কদরকে সামনে রেখে মসজিদ, ইমামবাড়ি, মাসুম ইমামগণের (আ.) পবিত্র মাজারসমূহে উপস্থিত হয়ে ব্যাপক উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতার সাথে রাত্র জাগরণ ও ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে ফজর পর্যন্ত অতিবাহিত করে থাকেন। শবে কদরের রাতসমূহে এ সব পবিত্র স্থানগুলোতে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা সমবেত হয়। এ পবিত্র রাতসমূহের প্রধান অনুষ্ঠানাদির মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় আলোচনা, জামাতের নামায, কুরআন তেলাওয়াত প্রভৃতি। বিশেষত, এ রজনীতে দোওয়া-এ-জাওশানে কাবীরদোওয়া-এ-আবু হামজা সুমালিও পাঠ করা হয়। রোযাদারদের মাঝে ইফতারিসেহরি বিতরণ, গরীব ও নিঃস্বদের মাঝে খাদ্য দ্রব্য প্রদান, মৃত ব্যক্তিদের জন্য প্রার্থনা, কবর জিয়ারত প্রভৃতি। [৪৩] মাহে রমযানের ২১ তারিখ আমিরুল মু’মিনিন আলীর (আ.) শোকাবহ শাহাদত দিবস হওয়াতে এ দিনগুলিতে আহলে বাইতের (আ.) অনুসারীরা শোকানুষ্ঠান পালন, মাতমমজলিসে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া এ মহান ইমামের (আ.) হত্যাকারী ইবনে মুলজিমের উপর আহলে বাইতের (আ.) অনুসারীরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য লা’নত বর্ষণ করে থাকে। [৪৪]

ফার্সী সাহিত্যে শবে কদর

ফার্সী কবি ও সাহিত্যিকদের লেখনীতে শবে কদরের বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে. প্রখ্যাত ফার্সী কবি শেখ সাদী প্রণীত ‘গুলিস্তান’ নামক মহাকাব্য গ্রন্থে শবে কদর সম্পর্কে লিখিত হয়েছে,‘যদি রজনীগুলো সব কদর হত, তবে কদরের রজনী কদরহীন হত।’ [৪৫] বুস্তান নামক এক খ্যাতনামা ফার্সী কাব্যগ্রন্থেও শবে কদর সম্পর্কে কাব্য রচিত হয়েছে। ফার্সী সাহিত্যের খ্যাতনামা কবিগণ যেমন: হাফেজ শিরাজী [৪৬], নাসের খসরু [৪৭] তাদের স্ব স্ব কাব্য গ্রন্থাবলীতে শবে কদরের গুরুত্ব ও ফজিলত তুলে ধরেছেন।

গ্রন্থসূত্র

  1. শাকের, শাবি বারতার আয হিজার মাহ, পৃ, ৪৮
  2. তাবাতাবায়ী, তাফসীরে আল মিযান, খণ্ড ২০, পৃ. ৫৬১
  3. মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনেহ, খণ্ড ২৭, পৃ. ১৮৭
  4. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৮
  5. প্রাগুক্ত
  6. মাজিদী খামেনেহ, শাবহায়ে কাদর দার ইরান, পৃ. ১
  7. মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনেহ, খণ্ড ২৭, পৃ. ১৯০
  8. সূরা কদর, আয়াত ২
  9. আল্লামা হুররে আমুলি, ওয়াসায়েলুস শিয়া, খণ্ড ১০, পৃ. ৩৫৩
  10. শেখ তুসী, আত তাহজীব, খণ্ড ৪, হাদীস ১০১, পৃ. ৩৩১
  11. শেখ কালাইনী, উসূলে কাফী, খণ্ড ১, পৃ, ৪৭৯; তাফসীরে আল কুফী, পৃ. ৫৮১ এবং আল্লামা মাযলিসী, বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ২৫, পৃ. ৯৭
  12. আনসারী, নুযুল এযমালি কুরআন, পৃ. ২২৭
  13. মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনেহ, পৃ. ১৮২
  14. শেখ হুররে আমুলী, ওয়াসায়েলুস শিয়া, খণ্ড ১০, পৃ.৩৫৩
  15. আল্লামা তাবাতাবায়ী, তাফসীরে আল মিযান, খণ্ড ২০, পৃ. ৫৬১
  16. শেখ সাদুক, মায়ানিউল আখবার, পৃ. ৩১৫ ও ৩১৬
  17. কাশানী, তাফসীরে মিনহাযুজ সাকালাঈন, খণ্ড ১০, পৃ. ৩০৮
  18. সূরা কাদর, আয়াত নং ৪
  19. শাবে কাদর আয মানযারে কুরআন, পৃ. ৮৭
  20. আবেদীন যাদের, ইমাম ও শাবে কাদর, পৃ. ৬২
  21. মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনেহ, খণ্ড ২৭, পৃ. ১৯০; তাবারসি, মাযমাউল বায়ান, খণ্ড ১০, পৃ, ৭৮৬
  22. শেখ হুররে আমুলী, ওয়াসায়েলুস শিয়া, খণ্ড ১০, পৃ. ৩৫৬
  23. তাবারসি, মাযমাউল বায়ান, খণ্ড ১০, পৃ, ৭৮৬
  24. আল্লামা মাযলিসী, মিরআতুল উকুল, খণ্ড ১৬, পৃ. ৩৮১
  25. শেখ সাদুক, আল খিসাল, পৃ. ৫১৯
  26. কাশানী, মিনহাজুস সাদেকীন, খণ্ড ১০, পৃ. ৩০৬
  27. আল্লামা মাযলিসী, মিরআতুল উকুল, খণ্ড ১৬, পৃ. ৩৮১
  28. কাশানী, মিনহাজুস সাদেকীন, খণ্ড ৪, পৃ. ২৭৪
  29. জালালুদ্দীন সিয়ুতি, তাফসীরে দুররুল মানসুর, খণ্ড ৮, পৃ. ৫৭১
  30. আল্লামা তাবাতাবায়ী, তাফসীরে আল মিযান, খণ্ড ২০, পৃ. ৫৬৬
  31. আল কাসেমী, তাফসীরে কাসেমী, খণ্ড ১৭, পৃ. ২১৭
  32. ইবনুল মিফতাহ, শারহে আল আজহার, খণ্ড ১, ৫৭
  33. শেখ তুসী, আত তাহজীব, খণ্ড ৩, পৃ. ৮৫
  34. মুখতারি, রুয়্যাতে হেলাল, খণ্ড ৪, পৃ. ২৯৭২
  35. মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনেহ, পৃ. ১৯২
  36. আল্লামা মাযলিসী, বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৯৫, পৃ. ১৪৫
  37. প্রাগুক্ত, খণ্ড ৯৭, পৃ. ৯ ও ১০
  38. মুসতাদরাকুল ওয়াসায়েল, খণ্ড ৭, পৃ. ৪৭০
  39. আল্লামা মাযলিসী, বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৯৭, পৃ. ৪
  40. মাকারেম শিরাজী, মাফাতিহুল নোবীন, লাইলাতুল কদরের আমল অধ্যায়, পৃ. ৭৫৯
  41. প্রাগুক্ত, লাইলাতুল কদরের আমল অধ্যায়, পৃ. ৭৬৩
  42. দ্র: মাকারেম শিরাজী, মাফাতিহুল নোবীন, লাইলাতুল কদরের আমল অধ্যায়, পৃ. ৭৮৩-৭৯৫
  43. মাজিদী, খামেনেহ, শাবহায়ে কাদর দার ইরান, পৃ. ২২
  44. প্রাগুক্ত, পৃ. ২১
  45. শেখ সাদী, গুলিস্তান, আদাব অধ্যায় পৃ. ১০০
  46. দিওয়ানে হাফেজ, গজল নং ২০৬ পৃ.১৬৪
  47. দিওয়ানে নাসের খসরু, কাসিদা, পৃ. ১৪১