বাদরুদ্দীন হুথি

wikishia থেকে

বাদরুদ্দীন হুথি (১৩৪৫-১৪৩১ হি.) (আরবি : بَدرُ الدِّين الحوثی); যাইদি মাযহাবের একজন বিশিষ্ট আলেম এবং ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ মুভমেন্টের আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি আনসারুল্লাহ’র প্রতিষ্ঠাতা হুসাইন আল-হুথি’র পিতা ছিলেন। হুসাইন আল-হুথি নিহত হওয়ার পর মুভমেন্টের নেতৃত্ব তিনি কাঁধে তুলে নেন।

বাদরুদ্দীন হুথি ছিলেন ইরানের ইসলামি বিপ্লবের একজন সমর্থক এবং সর্বদা ইসলামি ঐক্য ও ফিলিস্তিনের প্রতি নিজের সমর্থনের বিষয়টি প্রকাশ করেছেন। তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থের লেখক, ‘আত-তাইসির ফিত তাফসির’ সেগুলোর অন্যতম। ওয়াহাবিয়্যাতের বিরুদ্ধে বাদরুদ্দীনের রচনা সমগ্র ‘আস-সিলসিলাতুয যাহাবিয়াহ ফির রাদ্দি আলাল ওয়াহাবিয়াহ’ নামে সংকলিত হয়েছে।

আনসারুল্লাহ মুভমেন্টের তৃতীয় ও বর্তমান নেতা আব্দুল মালেক হুথিও বাদরুদ্দীনের সন্তান।

অবস্থান

বাদরুদ্দীন হুথি; ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ মুভমেন্টের আধ্যাত্মিক নেতা এবং যাইদিয়া মাযহাবের জারুদিয়া শাখার ধর্মীয় নেতা।[১] তার উপাধিগুলোর মধ্যে আল্লামা, মুজাহিদ,[২] মুফাসসির ও মুজতাহিদ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।[৩]

হুথি, ইসলামি ঐক্যের একজন সমর্থক ছিলেন।[৪] এছাড়া ইসলাম ধর্ম ও আহলে বাইত (আ.)-এর মাযহাব বিরোধী চিন্তাধারা’র মোকাবিলায় তার তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মত।[৫] বিভিন্ন ইসলামি বিষয়সহ ওয়াহাবিয়াতের রদ ও প্রত্যাখ্যানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থও তিনি রচনা করছেন।[৬]

চিন্তাধারা

ফিলিস্তিন ইস্যু এবং ইসরাইলকে প্রতিহত করার বিষয়টি বাদরুদ্দীন হুথির নিকট সবসময় গুরুত্ব পেত। এছাড়া, নিপীড়িতদের সাহায্য করাকে তিনি অপরিহার্য্য মনে করতেন।[৭] মার্কিন ও ইসরাইলি পন্য বয়কট এবং সারখাহ (صَرخه) শ্লোগান প্রদানের মাধ্যমে তিনি তার সন্তান হুসাইন বাদরুদ্দীনের আমেরিকা বিরোধী অবস্থান ও পদক্ষেপের পক্ষে সমর্থন জানাতেন।[৮]

মুসলমানরা যে বড় বিপদের সম্মুখীন ছিল তা রুখতে তিনি ইসলামি ঐক্যকে অপরিহার্য্য মনে করতেন।[৯] এছাড়া আমেরিকা ও ইসরাইলের মোকাবিলায় কার্যকর ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের আহবান জানাতেন।[১০]

হুথির আকিদা অনেকটা ইমামিয়া শিয়াদের কাছাকাছি বলে জ্ঞান করেছেন অনেকে।[১১] ইমাম আলী (আ.)-এর অধিকার এবং তাঁর (আ.) মর্যাদা সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও যে সকল শত্রুরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদেরকে হুথি কাফের জ্ঞান করতেন।[১২]

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রতি সমর্থন

বাদরুদ্দীন হুথি ছিলেন ইরানের ইসলামি বিপ্লবের একজন ঘোর সমর্থক এবং এ বিপ্লব দ্বারা প্রভাবিত।[১৩] ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরানের সামরিক সফলতা ও ইয়েমেনের অভ্যন্তরীন যুদ্ধের সফলতার সংবাদকে তিনি গুলি ছুঁড়ে উদযাপন করতেন।[১৪] এছাড়া তার মতে, ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ মুভমেন্টের চিন্তার জাগরণও মূলতঃ ইরানের ইসলামি বিপ্লব থেকে।[১৫] তার ও তার সন্তানদের নীতি ও পথ ইরানের রাজনীতি’র সাথে একমুখী বলে উল্লেখ করেছেন অনেকে।[১১]

বাদরুদ্দীন হুথি ১৯৯৪ সালে তার পুত্র হুসাইনের সাথে ইরান সফর করেন।[১৬] তিনি ২০০২ সালে ইয়েমেনে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে।[১৭] আবার কেউ বলেছেন তিনি ১ বছর ইরানে অবস্থান করেছিলেন।[১৮] কারো কারো মত হল তিনি এবং তার পুত্র শিয়া এসনা আশারি মাযহাব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, আর এ কারণেই তারা আনসারুল্লাহ মুভমেন্টকে একটি শিয়া মুভমেন্ট হিসেবে জ্ঞান করেছেন। তবে হুথিরা এ দাবী প্রত্যাখ্যান করে তারা নিজেদেরকে যাইদি মাযহাবের অনুসারী হিসেবে পরিচয় করিয়েছেন। [১৯]

রজনৈতিক তৎপরতা

বাদরুদ্দীন, তার পুত্র হুসাইনের শাহাদাতের পর আনসারুল্লাহ মুভমেন্টের নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নেন।[২০] তিনি কতিপয় যাইদি আলেমের সহযোগিতায় ‘আল-হাক্ক’ পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।[২১] দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের একজন হওয়া সত্ত্বেও দলটির মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়ায় তিনি দল থেকে পৃথক হয়ে ‘শাবাবুল মু’মিনীন’ নামক আরেকটি দল গঠন করেন।[২৩]

আল-কায়েদাকে দমনের নামে মার্কিনীদের ইয়েমেনে প্রবেশ এবং ইয়েমেনের অভ্যন্তরীন বিষয়ে বিদেশীদের হস্তক্ষেপের ঘটনায় বাদরুদ্দীন হুথি তার শিষ্যদেরকে সরকার বিরোধী আন্দোলনের আহবান জানান।[২৪] এ পদক্ষেপের পর, ইয়েমেন সরকার তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে ইয়েমেন ত্যাগে বাধ্য করে।[২৫]

বলা হয়েছে যে, বাদরুদ্দীনকে হত্যার কয়েকটি অভিযান ব্যর্থ হয়। আল-খারব গ্রামে তাকে লক্ষ্য করে চালানো হামলায় তার পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত হন।[২৬] এছাড়া ২০০৫ সালে তাকে লক্ষ্য করে চালানো ব্যর্থ হামালার পর ইয়েমেন সরকারের সাথে হুথিদের যুদ্ধ দ্বিতীয়বারের মত যুদ্ধ শুরু হয় এবং বাদরুদ্দীন শহীদ হয়েছে এই ভেবে যুদ্ধ থেমে যায়।[২৭]

নৈতিক বৈশিষ্ট

বাদরুদ্দীন হুথির সমসাময়িক আলেমরা তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।[২৮] মাজদুদ্দীন মুওয়াইয়েদি তাকে আলেমে বা আমাল (আমলের অধিকারী আলেম) বলে আখ্যায়িত করে তার প্রশংসা করছেন।[২৯] হুসাইন ইবনে হাসান তাকে তাকওয়াবান, দুনিয়া বিমূখ, নম্র ও ইবাদতকারী এবং আহলে বাইত (আ.)-এর মাযহাবের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন।[৩০] এছাড়া আব্দুল মালেক হুথির ভাষায়, তার পিতা বাদরুদ্দীনের কুরআনের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল এবং তিনি কুরআনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন।[৩১] কুরআনের সাথে তার ঘনিষ্টতার কারণে তাকে ‘ফাকিহুল কুরআন’ উপাধি প্রদান করা হয়।[৩১]

রচিত গ্রন্থাবলি

বাদরুদ্দীন হুথি, প্রায় ১০০ গ্রন্থের লেখক।[৩৩] তার ‘আত তাইসির ফিত তাফসির’ গ্রন্থে তাফসিরুল কুরআন বিল কুরআন (আয়াতের মাধ্যমে অপর আয়াতের তাফসির) এবং তাফসিরুল কুরআন বির-রেওয়ায়াত (রেওয়ায়েতের মাধ্যমে তাফসির) পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন হয়েছে। তিনি তার তাফসিরে মহানবি (স.) ও হযরত আলী (আ.) থেকে বর্ণিত বিভিন্ন রেওয়ায়াত থেকে উপকৃত হয়েছেন।[৩৪] ‘আল-মাজমুআতুল ওয়াফিয়াহ ফি ফিআতিল বাগিয়াহ’ গ্রন্থে তিনি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের শাহাদাত সংশ্লিষ্ট হাদীসটির বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন।[৩৫]

আহলে বাইত (আ.) সম্পর্কে যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছেন, সেগুলোর মাঝে ‘ফাদ্বায়েলু আলি মুহাম্মাদ আলাইহিমুস সালাম’ ও ‘আহাদিসু মুখতারাহ ফি ফাদ্বায়িলি আলিল বাইত ও আলি মুহাম্মাদ লাইসু কুল্লুল উম্মাহ ওয়া আয়াতুল মাওয়াদ্দাহ’ উল্লেখযোগ্য।[৩৬] ওয়াহাবিয়্যাতের বিরুদ্ধে ‘মান হুমুল ওয়াহাবিয়াহ’ এবং আল-ইজায ফির রাদ্দি আলা ফাতাওয়াল হিজাযি আলাইহি’ রচনা করছেন। এছাড়া ওয়াহাবিয়াতের প্রত্যাখ্যানে তার রচনা সমগ্র ‘আস-সিলসিলাতুয যাহাবিয়া ফির রাদ্দি আলাল ওয়াহাবিয়াহ’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।[৩৭]

জীবনী

তিনি ১৩৪৫ হিজরীর ১৭ জামাদিউল আওয়াল ইয়েমেনের দ্বাইহান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন এবং সায়াদাহ -ইয়েমেনে যাইদিদের মুল কেন্দ্রে- বেড়ে ওঠেন।[৩৮] তার বংশ ইমাম হাসান (আ.)-এর পুত্র হাসানে মুসান্না’র সাথে সংযুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৩৯] সায়াদা’তে বসবাসরত হুথিদের বংশ হুসাইন ইবনে মুহাম্মাদের সাথে সংযুক্ত যিনি হুস বা হুথ (حوث) শহর থেকে দ্বাইহানে হিজরত করেছিলেন।[৪০]

পড়াশুনা

বাদরুদ্দীন হুথির পড়াশুনার হাতেখড়ি তার পিতা আমিরুদ্দীন হুসাইন হুথি (১৩৯৪ হি.) এবং চাচা হাসান ইবনে হুসাইন হুথির (১৩৮৮ হি.) কাছেই।[৪১] এছাড়া তিনি আব্দুল আযিয গালেবি ও ইয়াহিয়া ইবনে হুসাইন হুথির সান্নিধ্যও পেয়েছেন।[৪২] বাদরুদ্দীন হুথি বেশ কয়েকজন আলেমের নিকট থেকে ইজতিহাদের অনুমতি পেয়েছেন, যাদের নাম মিফতাহু আসানিদিয যাইদিয়া গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে।[৪৩]

মৃত্যু

বাদরুদ্দীন হুথি ২০১০ইং সালের শেষের দিকে মৃত্যুবরণ করেন। হুথিদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তিনি ফুসফুস জনিত সমস্যার কারণে ইন্তেকাল করেন। অবশ্য ইয়েমেনের আল-কায়েদার একটি দল দাবী করেছিল যে, তাদের একটি অভিযানে তিনি নিহত হয়েছেন।[৪৪] তবে কিছু কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-কায়েদার হামলায় তার মৃত্যুর তথ্যকে গ্রহণ করে নি।[৪৫]

সন্তান-সন্তুতি

কিছু কিছু প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাদরুদ্দীন হুথির স্ত্রী সংখ্যা ছিল ৪ জন।[৪৬] এছাড়া তিনি ছিলেন ৭ কন্যা এবং ১৩ পুত্রের জনক।[৪৭] তার পুত্ররা হলেন; হুসাইন, ইয়াহিয়া, আব্দুল কাদির, মুহাম্মাদ, আহমাদ, হামিদ, আমিরুদ্দীন, ইব্রাহিম, আব্দুল মালেক, আলী, আব্দুল খালেক, আব্দুস সালাম ও নাজমুদ্দীন। ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা তারই পুত্র হুসাইন বাদরুদ্দীন; আব্দুল কাদির ও আলী যুদ্ধে প্রাণ হারান এবং আরেক পুত্র ইব্রাহিমের উপর হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।[৫০] আনসারুল্লাহ’র তৃতীয় ও বর্তমান নেতা আব্দুল মালেক হুথিও তারই সন্তান।