হুসাইন বাদরুদ্দীন হুথি

wikishia থেকে

হুসাইন বাদরুদ্দীন হুথি (১৯৬০-২০০৪ খ্রি.) (আরবি: حسین بدرالدین الحوثی); ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম নেতা। যায়দিয়া মাযহাবের অনুসারী হুসাইন বাদরুদ্দীন হুথি, ইমাম খোমেনীর চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে আমেরিকা ও ইসরাইলের সাথে শত্রুতাকে নিজের শ্লোগানে পরিণত করেন এবং ফিলিস্তিন ইস্যুকে তার নিজের এবং তার দলের অন্যতম অগ্রাধিকারমূলক বিষয় বলে আখ্যা দেন। তিনি তার রাজনৈতিক কার্যক্রমকে শুরু করেছিলেন ওহাবী মতবাদের ন্যায় বিচ্যুত চিন্তাধারার অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। আমেরিকার সাথে হুসাইন হুথির শত্রুতার কারণে, ইয়েমেনের তৎকালীন সরকার প্রধান আলী আব্দুল্লাহ সালেহ তাকে শহীদ করে।

অবস্থান

সাইয়্যেদ হুসাইন ১৩৭৯ হিজরীর শা’বানে (১৯৬০ খ্রি.) ইয়েমেনের সা’দা প্রদেশের রুয়াস অঞ্চলে জন্ম গ্রহণ করেন।[১] তিনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, সামরিক কমাণ্ডার ও ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম নেতা।[২] সাইয়্যেদ হুসাইন এবং তার পরিবারের মাযহাবকে যায়দীয়া জারুদী মাযহাব বলে উল্লেখ করা হয়।[৩] তার ওস্তাদ ও বন্ধু-বান্ধবের মতে, তিনি ব্যাপক পড়াশোনার মাধ্যমে তিনি সুবিস্তৃত জ্ঞান অর্জন করেন[৪] এবং তারা তাকে অত্যন্ত সাহসী ও বিচক্ষণ হিসেবে জানেন।[৫] তার বংশ ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সংযুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৬] বলা হয় তার পিতা বদরুদ্দীন আল-হুতী ছিলেন যায়দীয়া মাযহাবের সবচাইতে প্রসিদ্ধ মারজাদের একজন।[৭] হুসাইন হুতী, শীয়া ইসনা আশারীদের আক্বীদা-বিশ্বাস, ইমামগণের নিষ্পাপত্ব এবং প্রতিশ্রুত মাহদী সংক্রান্ত আক্বীদার প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন বলে মনে করা হয়।[৮]তিনি বারো ইমামি শীয়াদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বলেও কেউ কেউ উল্লেখ করেন।[৯]

কোন কোন গবেষকের মতে, ওহাবি, ইখওয়ানুল মুসলিমিন, সমাজতন্ত্রবাদ, নাসেরিয়া এবং ইরানে ইসলামী বিপ্লবের ন্যায় বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ হুসাইন হুতীর চিন্তাধারা গঠনের ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে।[১০] দলভিত্তিক কার্যক্রম এবং ইয়েমেন ও অন্যান্য দেশের ওলামাদের সাথে পরামর্শ তার সুশৃঙ্খল চিন্তাধারা গঠনের অপরাপর কারণ বলে মনে করা হয়।[১১]তার বক্তবসমূহ অপরিহার্যরূপে সংকলিত হয়েছে এবং আনসারুল্লাহ দলের ইশতেহার হিসেবে এই দলের সদস্যরা ব্যবহার করে থাকেন।[১২] হুথি তার পিতার নিকট থেকে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেন।[১৩]সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি সুদানে গিয়ে পড়াশুনা শেষ করেন। তার বিভিন্ন রচনাসামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হলো আল-সারখা ফি ওয়াজহিল মুস্তাকবেরীন।

চিন্তাধারা

হুসাইন হুথি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিম বিশ্ব অধঃপতন ও অবক্ষয়ের সম্মুখীন হয়েছে এবং এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় কুরআন এবং কুরআনিক শিক্ষার দিকে প্রত্যাবর্তন করা।[১৫]

ইসরাইল ও আমেরিকা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি

হুসাইন হুথির অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বাধীনচেতাকে বিবেচনা করা হয়। তিনি ইয়েমেনের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিশেষ করে দেশটিতে আমেরিকার অনুপ্রবেশ সম্পর্কে লোকজনকে সতর্ক করতেন।[১৬] তিনি ফিলিস্তিনের মুক্তিকে মুসলমানদের জাগরণ ও গতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করতেন।[১৭] তিনি কুদস দিবসকে বাঁচিয়ে রাখা এবং ইসরাইলি ও আমেরিকান পণ্য বয়কটের প্রয়োজনীয়তার উপর দাগিদ দেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শাসকদের নিকট সাইয়্যেদ হুসাইনের কোন আশা ছিল না।[১৮] ইসরাইলের সাথে যে কোন ধরনের আপসকে তিনি অসম্ভব জ্ঞান করেন।[১৯]

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এবং ইমাম খোমেনী সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি

সাইয়্যেদ হুসাইন হুথি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পথকে মুসলিম জাতির একমাত্র মুক্তির পথ বলে মনে করতেন।[২০] তিনি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সরকার ব্যবস্থাকে মুসলমানদের জন্য একটি উপযুক্ত মডেল ও আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন, যে কেউ ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে শাস্তি প্রদান করবেন।[২১] হুথি বিশ্বাস করতেন, ইমাম খোমেনী মুশরিকদের থেকে মুক্তির ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করে হজ্বের সঠিক ও কুরআনিক অর্থের সাথে মানুষকে পরিচয় করিয়েছেন।[২২] সাইয়্যেদ হুসাইন ইসলামী প্রজাতন্ত্র শাসন ব্যবস্থার স্থপতিকে ইমাম বলে সম্বোধন করতেন এবং তার চিন্তাধারাকে ত্রাণকর্তা হিসেবে মনে করতেন।[২৩]তিনি ইমাম খোমেনীকে আরব জাতির জন্য আল্লাহর রহমত বলে মনে করতেন এবং বলতেন আরব জাতি নিজেদেরকে এই নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করেছে।[২৪] তিনি ইমাম খোমেনীকে এক ন্যায়পরায়ন, পরহেযগার ও মকবুল ইমাম মনে করতেন[২৫]

রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম

হুসাইন হুথি তার রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন ইয়েমেনে ওহাবি চিন্তাধারার অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে।[২৬] ১৯৯৩ সালে সা’দা প্রদেশের বঞ্চনা দূর করার লক্ষ্যে,[২৭] হাক্ক পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে,[২৮]তিনি ইয়েমেনের প্রতিনিধি পরিষদে প্রবেশ করেন।[২৯] সাইয়্যেদ হুসাইন পরবর্তী ধাপে প্রতিনিধি পরিষদে যোগদান থেকে বিরত থাকেন এবং আঞ্জুমানে শাবাবুল মু’মিন প্রতিষ্ঠা করেন,[৩১] যাকে পরবর্তীতে ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ আন্দোলন বলা হয়।[৩২] এই আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা।[৩৩] এগারোই সেপ্টেম্বরের ঘটনা, আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন হামলা এবং এই অঞ্চল ও এডেন উপসাগরে তাদের সামরিক উপস্থিতির পর সাইয়্যেদ হুসাইনের, আগ্রাসন বিরোধী ও আমেরিকা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।[৩৪] তার বিশ্বাস ছিল, এগারোই সেপ্টেম্বরের ঘটনা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, যারা কিনা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে হামলা করার লক্ষ্যে অজুহাতের খোঁজ করছিল।[৩৫] হুথি কুদস দিবসকে নিজেদের আন্দোলনের সূচনা বিন্দু করে তোলেন এবং এই দিবসে তিনি প্রথম বক্তব্য দিয়ে, কুদস দিবস সম্পর্কে ইমাম খোমেনীর বক্তব্যকে জনগণের উদ্দেশ্যে পুনরাবৃ্ত্তি করেন।[৩৬] তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেন[৩৭] এবং আমেরিকা ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে হুথিদের প্রসিদ্ধ সারখা নামক শ্লোগানের উদ্ভাবন করেন।[৩৮] হুসাইন হুথি তার নিজের অঞ্চলের লোকজনের জন্য বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে: মাররান দাতব্য গোষ্ঠী তৈরি করা, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপনসহ বিভিন্ন নির্মাণ কার্যক্রম।

হুথিকে কাফের সাব্যস্তকরণ এবং হত্যা

আমেরিকা ও ইসরাইল বিরোধী কার্যকলাপের কারণে ইয়েমেনের ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট আলেমরা হুথিকে কাফের সাব্যস্ত করে ফতোয়া দেয় এবং তাকে হত্যা করে।[৪০] তারা দাবী করে যে, সাইয়্যেদ হুসাইন নিজেকে পয়গম্বর, মাহদী এবং ইমাম হিসেবে দাবী করেন।[৪১] ২০০৪ সালে হুসাইন হুথির ৬৪০ সমর্থককে মিছিল করা অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়।[৪২] অতঃপর ইয়েমেনের ক্ষমতাসীন সরকার তাকে গ্রেপ্তার করার লক্ষ্যে যথাযথ তথ্য দানকারীর জন্য ৫৫০০০ ডলার পুরস্কার নির্ধারণ করে। ইয়েমেনি সরকারের হাতে তার ২৫ জন আত্নীয় নিহত হওয়ার পর অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার।[৪৪] আব্দুল্লাহ সালেহ আমেরিকা থেকে ফিরে আসার ৬ দিন পর, হুথিদের বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ আরম্ভ হয়।[৪৫] গোপন নথি অনুসারে, এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ওয়াশিংটনে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং আলী আব্দুল্লাহ সালেহ’র মধ্যকার সমঝোতার ভিত্তিতে।[৪৬]

শাহাদাৎ

২০০৪ সালে তথা ১৪২৫ হিজরীতে আব্দুল্লাহ সালেহ’র নেতৃত্বাধী ইয়েমেনি সরকারের সেনাবাহিনী হুসাইন হুথিকে মাররান অঞ্চলে অবরুদ্ধ করে।[৪৭] এক বর্ণনানুসারে, তিনি ৮০ দিন প্রতিরোধ করার পর, সম্মুখ লড়াইয়ে শাহাদাৎবরণ করেন।[৪৮] অন্য একটি প্রতিবেদন অনুসারে, তিনি মাথা ও পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং দৃষ্টিশক্তি হারান, তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়; অথচ তাকে আটক করার পর শহীদ করা হয়।[৪৯] বলা হয় যে, এই যুদ্ধে হুথিদের ৭০০ এবং ইয়েমেনি সরকারি বাহিনীর ১৫০০০ সেনা নিহত হয়।[৫০] সাইয়্যেদ হুসাইন হুথির মৃত্যুর পর আমেরিকান সেন্ট্রাল ফোর্সের কমাণ্ডার একটি চিঠির মাধ্যমে আলী আব্দুল্লাহ সালেহকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে।[৫১] সাইয়্যেদ হুসাইনের মরদেহ ২০২৩ সালে তার পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয় এবং মাররানে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাহিত করা হয়।[৫২] তার মাযারে একটি দরবারও নির্মাণ করা হয়, যা ২০১৫ সালে সৌদি জোটের হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়।

তথ্যসূত্র

==

গ্রন্থপঞ্জি