আয়াতে সালাওয়াত
এই নিবন্ধটি সূরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াত সম্পর্কিত। সালাওয়াত সম্পর্কে অবগতির জন্য সালাওয়াত নিবন্ধটি পড়ুন।
আয়াতে সালাওয়াত (আরবি: آیه صَلَوات ) হচ্ছে সূরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াত, যেখানে আল্লাহতায়ালা ও ফেরেশতাগণের পক্ষ থেকে মহানবী (স.)-এর উপর সালাওয়াত (দরুদ) প্রেরণের প্রতি ইশারা করা হয়েছে এবং মু’মিনগণকেও রাসুল (স.)-এর প্রতি দরুদ পাঠের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। শিয়াদের অধিকাংশই এই আয়াত শোনার সাথে সাথে দরুদ পাঠ করেন। মাগরিবের নামাজের তা’কিবাতে এই আয়াতটি পড়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
আল্লামা তাবাতাবাঈ তার তাফসীরুল মিযানে, সালাওয়াত প্রেরণকে আল্লাহপাক ও ফেরেশকূলের অনুসরণ বলে জ্ঞান করেন। তাফসীরে পায়ামে কোরআন গ্রন্থে মাকারেম শিরাজী, আহলে সুন্নতের হাদীস ও তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত রেওয়ায়েতের উদ্ধৃতি দিয়ে রাসুল (স.)-এর পরিবার-পরিজনের উপর দরুদ পাঠ করাকে সূরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াতে উল্লেখিত সালাওয়াতের অংশ হিসেবে জ্ঞান করেছেন।
আয়াত এবং অনুবাদ
إِنَّ اللهَ وَ مَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَ سَلِّمُوا تَسْليماً
অনুবাদ: "নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি দরুদ প্রেরণ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরা তাঁর (নবীর) প্রতি দরুদ পাঠ কর এবং যথাযথভাবে সালাম জানাও।" (সূরা : আহজাব, আয়াত : ৫৬)।
গুরুত্ব ও তাৎপর্য
শেইখ মুফিদের মিসবাহুল মুতাহাজ্জাদ গ্রন্থে, এই আয়াতকে মাগরিবের নামাজের তা’কিবাত হিসেবে 'তাসবীহ-এ হযরত যাহরা (সা.আ.)' পাঠ করার পর পড়তে বলা হয়েছে।[১] এবং শেখ আব্বাস কুম্মী’র মাফাতিহুল জিনান গ্রন্থেও মিসবাহুল মুতাহাজ্জাদে’র বর্ণনাটির উল্লেখ করা হয়েছে।[২] ইমাম মুসা কাযিম (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি ফজর ও মাগরিবের নামাজের পর, কারও সাথে কথা বলার পূর্বে বা নামাজের স্থান ত্যাগ করার পূর্বে দরুদের আয়াতটি পড়বে আল্লাহপাক তার একশত হাজত তথা মনোবাসনা পূরণ করবেন; সত্তরটি হাজাত দুনিয়াতে এবং ত্রিশটি হাজাত আখেরাতে।[৩] বলা হয়েছে, প্রত্যেক নামাজের পর দরুদের আয়াতটি রাজা’-এর উদ্দেশ্যে পড়তে কোন বাধা নেই।[৪] ইরানে প্রত্যেকটি জামাআতের নামাজের পর যে কোন এক ব্যক্তি উচ্চস্বরে এই আয়াত পাঠ করেন এবং নামাজ আদায়কারীরা ৩ বার দরুদ পাঠ করেন।
তাফসীর
হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর শিয়া মুফাসসির আল্লামা তাবাতাবাঈ, তাফসীরুল মিযানে শিয়া ও সুন্নিদের হতে বর্ণিত কিছু রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে বলেছেন, দরুদের পদ্ধতি হল এমন যে, মু’মিনগণ আল্লাহর কাছে চান, মহানবী (স.) ও তার বংশধরদের উপর দরুদ পাঠ করতে।[৫] তিনি আরও মনে করেন, মু’মিনদের দরুদ প্রেরণ হল রাসুলের (স.) উপর আল্লাহতায়ালা ও ফেরেশতাগণের পক্ষ থেকে দরুদ প্রেরণকে অনুসরণ করা এবং পরবর্তী আয়াতের নিষেধাজ্ঞার উপর তাগিদ নির্দেশ করে যে, আল্লাহ ও তার রাসুলের (স.) প্রতি নিপীড়নকারীদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত বলে অভিহিত করা হয়েছে।[৭] একটি রেওয়ায়েতে ইমাম মুসা কাযিম (আ.) রাসুলের (স.) উপর আল্লাহ, ফেরেশতা ও মু’মিনদের দরুদের অর্থ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, রাসুলের (স.) জন্য আল্লাহর দরুদ হল তার রহমত এবং তার ফেরেশতাগণের দরুদ হল তাদের প্রশংসা ও গুণকীর্তণ এবং মু’মিনদের দরুদ হল তার জন্য দোয়া।[৮] বিশিষ্ট মারজায়ে তাক্বলীদ মাকারেম শিরাজী তার পায়ামে কোরআন গ্রন্থে শিয়া ও সুন্নি রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, মহানবী (স.)-এর পরিবার-পরিজনদের উপর দরুদ প্রেরণকে দরুদের অংশ হিসেবে জ্ঞান করেছেন। আর এক্ষেত্রে তিনি রেওয়ায়েতের উল্লেখ করেছেন যা আহলে সুন্নতের হাদীস ও তাফসীর গন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে;[৯]যেমন: সহীহ বুখারি,[১০] সহীহ মুসলিম,[১১]তাফসীরে দুররুল মানসুর,[১২] এবং তাফসীরে তাবারি গ্রন্থে।[১৩] ফাযল বিন হাসান তাবারসী’র, তাফসীরে মাজমাউল বায়ানে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) হতে বর্ণিত রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, কেউ যদি রাসুলের (স.) উপর দরুদ পাঠ করে, ফেরেশতারা ১০ বার দরুদ প্রেরণ করে এবং তার দশটি গোনাহ মুছে দেন এবং দশটি নেকী তার নামে লেখেন।[১৪]
সালাওয়াত তথা দরুদ ওয়াজীব হওয়ার প্রমাণ
শিয়া মুফাস্সির নাসের মাকারেম শিরাজীর মতে, সূরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াতটি একথাই প্রমাণ করে যে, মহানবী (স.)-এর উপর দরুদ পাঠ করা সারা জীবনে একবার ওয়াজীব।[১৫] এছাড়াও, ‘কিতাবুত তাজুল জামে’ লিল উসূল’ গ্রন্থের লেখক ও বিশিষ্ট সুন্নি আলেম মনসুর আলী নাসিফ হতে বর্ণিত হয়েছে যে, আলেমগণের ঐক্যমত হচ্ছে আয়াতের বাহ্যিক অর্থ এই যে, মহানবী (স.)-এর উপর দরুদ ও সালাম প্রেরণ করা ওয়াজীব।[১৬] আল-তাজ আল-জামে’ গ্রন্থের লেখক মনে করেন, দরুদ ও সালাম প্রেরণ করা প্রতেক মু’মিনের জন্য ওয়াজীব এবং এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সময়ের পার্থক্য রয়েছে। শাফেয়ী দরুদকে নামাজের শেষে তাশাহুদে, মালেক বিন আনাস সারা জীবনে একবার এবং অন্যরা প্রত্যেক মজলিসে (বৈঠকে) একবার পাঠ করা ওয়াজীব বলে মনে করেন।