আমিন
আমিন (আরবি:آمين); যার অর্থ কবুল করুন। এটি একটি ধর্মীয় শব্দ যা দোয়া বা প্রার্থণা কবুলের আবেদনের প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়। শিয়া এবং সুন্নি ফিকাহশাস্ত্রে, নামাযে এই শব্দটি বলা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সুন্নি ফিকাহবিদরা বিশ্বাস করেন যে, নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠের পর আমিন বলা ওয়াজিব বা মুস্তাহাব। তবে, শিয়া ফিকাহবিদদের ফতোয়া অনুসারে, নামাযে এই শব্দটি উচ্চারণ করা হারাম এবং নামায বাতিল হয়ে যাবে। শিয়া হাদিসসমূহে ইমামদের থেকে বর্ণিত আছে যে, জামাতের নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার পর আমিন বলার পরিবর্তে আলহামদুলিল্লাহ বলা উচিত।
শাব্দিক পরিচিতি
আরবি ভাষায় "আমিন" শব্দটির অর্থ কবুল করুন।[১] বলা হয় যে, এই শব্দটি হিব্রু ভাষা থেকে আরবি ভাষায় প্রবর্তিত হয়েছিল এবং উভয় ভাষায়ই এর ধর্মীয় ব্যবহার রয়েছে। এই শব্দটি ইহুদি এবং খ্রিস্টধর্ম উভয় ভাষায় ব্যবহৃত হয় এবং এটি প্রার্থণা কবুলের আবেদন স্বরুপ ব্যবহার করা হয়।[২]
নামাযে "আমিন" শব্দটির ব্যবহার নিয়ে শিয়া ও সুন্নি মাযহাবের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইমামিয়া শিয়াদের ফিকাহ অনুসারে, সূরা ফাতিহার শেষে "আমিন" শব্দটি উচ্চারণ করা নামায বাতিল হওয়ার কারণগুলোর অন্তর্ভূক্ত।[৩]
তাফসির গ্রন্থসমূহে আমিন
কুরআনে "আমিন " শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি; তবে কিছু তাফসির গ্রন্থে, সূরা ইউনুসের ৮৮ এবং ৮৯ আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে যে, হযরত মূসা (আ.) যখন ফেরাউনকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তখন তিনি এবং তাঁর ভাই হারুন "আমিন" বলেছিলেন।[৪] অনুরূপভাবে, ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে যে, হযরত মূসার প্রার্থণার পর হযরত হারুন ছাড়া ফেরেশতারাও "আমিন " বলেছিল। এই সময়, আল্লাহ বলেন, "আমি তোমাদের দুজনের (মূসা এবং হারুন) প্রার্থণা কবুল করেছি।"[৫]
নামাযে আমিন বলার শারয়ি বিধান
আহলে সুন্নতের ফিকাহ অনুযায়ী, নামাযে আমিন বলা নামাযের আহকামের অন্তর্ভূক্ত। সুন্নিরা সূরা হামদ তিলাওয়াত শেষ করার পর আমীন বলে থাকে। একাকী নামাযে, নামাযরত ব্যক্তি এই শব্দটি পাঠ করে এবং জামাতের নামাযে, জামাতের ইমাম সূরা হামদ তিলাওয়াত শেষ করার পর নামাযিরা সমস্বরে আমিন বলে। তবে বলা হয় যে, কিছু সুন্নি মাজহাব আমিন বলাকে ওয়াজিব বা মুস্তাহাব বলে মনে করে না।[৬]
বিপরীতে, শিয়া ফিকাহবিদগণ মনে করনে, এই বিষয়টি মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে আসেনি এবং তারা এটিকে নামাযের মধ্যে বিদাত বলে মনে করেন, তাই নামাযে এই শব্দটি বলা হারাম এবং নামায বাতিল হওয়ার কারণগুলোর অন্তর্ভূক্ত বলে বিবেচনা করেন।[৭] ১৩শ শতাব্দীর একজন ফকীহ জাওয়াহের গ্রন্থপ্রণেতা বলেছেন, প্রসিদ্ধ হচ্ছে, বরং ইমামিয়া ফকীহদের মধ্যে ইজমা রয়েছে যে, নামাযে আমিন বলা হারাম এবং নামায বাতিল হওয়ার কারণগুলোর অন্তর্ভূক্ত।[৮]
সূরা হামদ শেষ করার পর আমিন বলা হারাম এবং নামায বাতিল করে দেয়, তা ওয়াজিব নামাযে হোক বা মুস্তাহাব নামাযে এবং জামাতের ইমাম কর্তৃক হোক বা মুসল্লি কর্তৃক।[৯] অনুরূপভাবে, নামাযের অংশ হওয়ার নিয়তে বলা হোক বা দোয়া অর্থে বলা হোক, তাতেও কোন পার্থক্য নেই।[১০] অবশ্য, ভুলবশত অথবা তাকিয়ার নিয়তে আমিন বলায় কোন সমস্যা নেই; বরং, তাকিয়ার প্রয়োজনে আমিন বলা ওয়াজিব।[১১]
কিছু হাদিসে আমিন বলার পরামর্শ
কিছু শিয়া হাদিসে, আমিন বলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।[১২] অন্যদিকে, এমন কিছু হাদিসও আছে যেখানে বলা হয়েছে যে, জামাতের নামাজে সূরা হামদ পাঠের পর আমিন বলার পরিবর্তে "আল-হামদুলিল্লাহ" বলা উচিত।[১৩] আমিন বলা হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইজমার কারণে ইমামিয়া ফকীহগণ বলেছেন যে, আমিন বলার পক্ষের হাদিসগুলো তাকিয়াহর দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণিত।[১৪]
তথ্যসূত্র
- ↑ তাহকিকে গুরুহি, মাউসুয়াতুল ফিকহিল ইসলামি তিবকান লিমাযাহিবি আহলে বাইত (আ.), ১৩৮১ হি., খ: ১, পৃ: ২৮০।
- ↑ অযারনুশ, ‘আমিন’, দায়েরাতুল মায়ারেফে বুজুর্গে ইসলামি।
- ↑ সাইয়্যেদ মুর্তুজা, রাসাইলুশ শারিফ আল-মুর্তুজা, ১৪০৫ হি., খ: ১, পৃ: ২১৯ ও শহিদে আউয়াল, আদ্-দুরুশ শারইয়্যাতি ফি ফিকহিল ইমামিয়্যাতি, ১৪১৭ হি., খ: ১, পৃ: ১৭৪।
- ↑ তাবারী, তাফসিরে তাবারী, ১৪২০ হি., খ: ১১, পৃ: ১১০।
- ↑ শেইখ কুলাইনী, উসুলে কাফি, ১৪০৭ হি., খ: ২, পৃ: ৫১০।
- ↑ ইবনে কিদামা, মুগনি, কায়রো, ১৩৮৮ হি., খ: ১, পৃ: ৩৫২-৩৫৩।
- ↑ শেইখ তূসী, আল্-ইস্তিবসার, তেহরান, ১৩৬৩ (ফার্সি সন), খ: ১, পৃ: ৩১৮-৩১৯; আমেলী, মাফাতিহুল কারামাহ, ১৪১৯ হি., খ: ৭, পৃ: ১১৯ ও নাজাফী, জাওয়াহিরুল কালাম, ১২৬২ (ফার্সি সন), খ: ১০, পৃ: ৬।
- ↑ নাজাফী, জাওয়াহিরুল কালাম, ১২৬২ (ফার্সি সন), খ: ১০, পৃ: ২।
- ↑ অল্লামা হিল্লি, তাহরিরুল আহকাম, ১৪২০ হি., খ: ১, পৃ: ২৪৯।
- ↑ তাহকিকে গুরুহি, ফারহাঙ্গে ফেকহে মুতাবেকে মাযহাবে আহলে বাইত (আ.), ১৪২৬ হি., খ: ১, পৃ: ১৫১।
- ↑ তাহকিকে গুরুহি, ফারহাঙ্গে ফেকহে মুতাবেকে মাযহাবে আহলে বাইত (আ.), ১৪২৬ হি., খ: ১, পৃ: ১৫১।
- ↑ শেইখ তূসী, আল্-ইস্তিবসার, ১৩৬৩ (ফার্সি সন), খ: ১, পৃ: ৩১৯।
- ↑ শেইখ কুলাইনী, উসুলে কাফি, ১৪০৭ হি., খ: ৩,পৃ: ৩১৩ ও হুর আমেলী, ওয়াসায়েলুশ শিয়া, ১৪০৯ হি., খ: ৬, পৃ: ৬৭-৬৮।
- ↑ শেইখ তূসী, আল্-ইস্তিবসার, ১৩৬৩ (ফার্সি সন), খ: ১, পৃ: ৩১৯।
গ্রন্থপঞ্জি
- অযারনুশ, অযারতাশ, ‘আমিন’, দায়েরাতুল মায়ারেফে বুজুর্গে ইসলামি, مقاله
- ইবনে কিদামা, আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ, মুগনি, কায়রো, মাকতাবাতুল কায়রো, ১৩৮৮ হি.,
- তাহকিকে গুরুহি, ফারহাঙ্গে ফেকহে মুতাবেকে মাযহাবে আহলে বাইত (আ.), কোম, নাশরে মুয়াসসেসেয়ে দায়েরাতুল মায়ারেফে ফেকহে ইসলামি বার মাযহাবে আহলে বাইত (আ.), ১৪২৬ হি.,
- তাহকিকে গুরুহি, মাউসুয়াতুল ফিকহিল ইসলামি তিবকান লিমাযাহিবি আহলে বাইত (আ.), কোম, নাশরে মুয়াসসেসেয়ে দায়েরাতুল মায়ারেফে ফেকহে ইসলামি বার মাযহাবে আহলে বাইত (আ.), ১৩৮১ হি.,
- হুর আমেলী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, ওয়াসায়েলুশ শিয়া, কোম, মুয়াসসেসেয়ে আলিল বাইত, ১৪০৯ হি.,
- দেহখোদা, আলী আকবার, লুগাতনামা দেহখোদা,
- রাযিউদ্দিন উস্তুরাবাদী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, শারহুর রাযি আলাল কাফিয়াতি, তেহরান, মুয়াসসাসাতু আস্-সাদিক লিত্ তাবাতি ওয়ান নাশরি, ১৩৮৪ (ফার্সি সন),
- সাইয়্যেদ মুর্তুজা, আলী বিন হোসাইন, রাসাইলুশ শারিফ আল-মুর্তুজা, কোম, দারুল কুরআনিল কারিম, ১৪০৫ হি.,
- শহিদে আউয়াল, মুহাম্মাদ বিন মাক্কী, আদ্-দুরুশ শারইয়্যাতি ফি ফিকহিল ইমামিয়্যাতি, কোম, জামেয়ে মুদাররেসিনে হাউসা ইলমিয়্যাহ কোম, ১৪১৭ হি.,
- তাবারী, মুহাম্মাদ বিন জারির, তাফসিরে তাবারী; তাহকিক- আহমাদ মুহাম্মাদ শাকের, বৈরুত, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০ হি.,
- শেইখ তূসী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, আল্-ইস্তিবসার, তেহরান, দারুল কিতাবিল ইসলামিয়্যাহ, ১৩৬৩ (ফার্সি সন),
- আমেলী, সাইয়্যেদ জাওয়াদ মুহাম্মাদ, মাফাতিহুল কারামাহ, কোম, জামেয়ে মুদাররেসিনে হাউসা ইলমিয়্যাহ কোম, ১৪১৯ হি.,
- অল্লামা হিল্লি, হাসান বিন ইউসুফ, তাহরিরুল আহকাম, কোম, মুয়াসসেসেয়ে ইমাম সাদেক (আ.), ১৪২০ হি.,
- শেইখ কুলাইনী, মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব, উসুলে কাফি, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪০৭ হি.,
- নাজাফী, মুহাম্মাদ হাসান, জাওয়াহিরুল কালাম, বৈরুত, দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরাবি, ১২৬২ (ফার্সি সন)।