বিষয়বস্তুতে চলুন

হযরত ফাতেমা (সা.)-কে কোথায় দাফন করা হয়েছে?

wikishia থেকে

হযরত ফাতেমা (সা.)-এর সমাধিস্থল; ইতিহাসের রহ্স্যময় একটি অধ্যায় যার প্রকৃত স্থান আরোও বেশি রহস্যজনক ভাবে গোপন রয়েছে। তবে, এর সম্ভাব্য অবস্থান হিসেবে হযরত ফাতেমা (সা.)-এর ঘর, মহানবীর (সা.) রওজা মুবারক, জান্নাতুল বাকি এবং আকিলের ঘরকে (ইমামদের বাকী', বাকি') বিবেচনা করা হয়েছে। শিয়া আলেমদের প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী, হযরত ফাতেমা (সা.)-কে তার ঘরে দাফন করা হয়েছে; যদিও শেইখ তুসী বিশ্বাস করেন যে, অধিকাংশ শিয়া আলেম ফাতেমা (সা.)-কে মহানবীর (সা.) রওজা মুবারকে দাফন করা হয়েছে বলে মনে করেন। {{আল্লামা মাজলিসির মতে, শিয়া বিশ্বাসে, মাজারে ফাতেমা (সা.)-এর ঘরও অন্তর্ভুক্ত। এই কারণে, কিছু পণ্ডিত মাজারের কথাটিকে ঘরের কথার সমর্থন বলে মনে করেছেন।}}

ঐতিহাসিক সাইয়্যেদ জাফর মুর্তজা আমেলি, হযরত ফাতেমা (সা.)-এর কবরের সঠিক অবস্থান নির্ধারণ করা অসম্ভব বলে মনে করেন। শেইখ তুসী এবং আমিন আল-ইসলাম তাবারসীর মতে, তিনটি স্থানেই হযরত ফাতেমা (সা.)-এর যিয়ারত করা উত্তম: মহানবীর (সা.) রওজা মুবারক, হযরত ফাতেমা (সা.)-এর ঘর এবং জান্নাতুল বাকি। শিয়া সম্প্রদায় আকিদা অনুযয়ী, হযরত ফাতেমা (সা.)-এর কবর জানা না থাকার কারণ হল, তাকে গোপনে দাফন করা হয়েছিল, যা হযরত ফাতেমার (আ.) নিজের অসিয়তেই হয়েছিল। তাদের মতে, তিনি ইমাম আলী (সা.)-এর খেলাফতের প্রকৃত হক্ক জবরদখল, তাঁর অধিকার আদায়ে মুসলমানদের এগিয়ে না আসা এবং পিতা থেকে প্রাপ্ত হাদিয়া বাগে ফাদাক কেড়ে নেওয়ার কারণে মুসলমানদের থেকে অসন্তুষ্ট হয়ে হযরত ফাতেমা (সা.) অসিয়ত করেছিলেন, তাকে যেন গোপনে দাফন করা হয়। অধিকাংশ সুন্নি পণ্ডিত মনে করেন যে, হযরত ফাতেমা (সা.)-এর কবর বাকিতে ইমামদের পাশে অবস্থিত। কিছু শিয়া গবেষক সুন্নি পণ্ডিতদের এই অভিমতের কারণ হিসেবে ফাতেমা (সা.)-এর কবরের গোপনীয়তা সম্পর্কে শিয়া অনুসারীদের মতাদর্শগত অতীব গুরুত্ব কমানোর হীন প্রয়াসকে উল্লেখ করেছেন। হযরত ফাতেমা (সা.)-এর সমাধিস্থল সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে, যেমন- "মারকাদু সাইয়্যিদাতিন নিসাই ফাতিমাতিশ শাহিদাতি আয্-যাহরা ফি আইয়্যি মাকান?" এবং " আইনা কাবরু ফাতেমা (সা.)?"।

দাফনের জায়গার গুরুত্ব

হযরত ফাতেমা (সা.)-এর কবরের বিষয়টি শিয়া ধর্মতাত্ত্বিক বইগুলিতে স্থান পেয়েছে এবং এর গোপনীয়তাকে প্রথম খলিফা আবু বকরের সমালোচনা করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।[1] শিয়া সম্প্রদায় হযরত ফাতেমা (সা.)-এর কবর গোপন থাকা কে আবু বকর ও উমরের প্রতি হযরত ফাতিমার (সা.) অসন্তুষ্টি এবং ইমাম আলীর খিলাফতরে প্রকৃত হক্ব ও ফাদাক জবরদখলের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদের প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করে।[2] সাইয়্যিদ মুহাম্মদ হুসেন জালালি (মৃত্যু ১৩৯৯) -এর মতে, ফাতিমা অসিয়ত করেছিলেন যে, তাকে গোপনে দাফন করা হোক, যাতে ইতিহাস তার শাহাদাতের কারণগুলি ভুলে না যায়।[3]

সম্ভাব্য স্থানসমূহ

শিয়া আলেম ও গবেষকরা হযরত ফাতেমা (সা.)-এর সমাধিস্থল সম্পর্কে বেশ কিছু সম্ভাবনার কথা বলেছেন।[6] শিয়া আলেমদের মধ্যে প্রসিদ্ধ মতামত হল যে, ফাতেমা (সা.)-কে তার ঘরেই দাফন করা হয়েছে;[7] যদিও শিয়া মুহাদ্দিস শেইখ তুসির মতে, বেশিরভাগ শিয়া আলেমগণ বিশ্বাস করেন যে, হযরত ফাতেমাকে মহানবীর (সা.)-এর রওজায় দাফন করা হয়েছে।[8] শিয়া সূত্রগুলিতে অন্যান্য সম্ভাবনার কথাও বলা হয়েছে, যার মধ্যে জান্নাতুল বাকি'[9] এবং আকিলের ঘর।[10] শিয়া ঐতিহাসিক সাইয়্যেদ জাফর মুর্তজা আমেলি, হযরত ফাতেমা (সা.)-এর কবরের অবস্থান নির্ধারণ করা অসম্ভব বলে মনে করেন।[11] শেইখ তুসী [12] এবং আমিন আল-ইসলাম তাবারসির [13] মতে, তিনটি স্থানেই হযরত ফাতেমা (সা.)-এর যিয়ারত করা উত্তম: মহানবীর (সা.)-এর রওজায়, ফাতেমা (সা.)-এর ঘরে এবং জান্নাতুল বাকিতে।[14] সাইয়্যেদ ইবনে তাউস তাঁর মিসবাহুয্-যাইর গ্রন্থে মহানবীর (সা.)-এর রওজা[15] যিয়ারতের স্থান বলে মনে করেন; কিন্তু তাঁর আল-ইকবাল গ্রন্থে মহানবী (সা.)-এর হুজরা বা কক্ষকে উল্লেখ করেছেন।[16]

ফাতেমা (সা.)-এর ঘর

শিয়া গবেষকদের মধ্যে প্রসিদ্ধ মত হলো, ফাতেমা (সা.আ.)-কে তার ঘরে দাফন করা হয়েছিল।[17] শেখ সাদুক,[18] ইবনে ইদ্রিস হিল্লি,[19] ইবনে তাউস,[20] আল্লামা মাজলিসি,[21] এবং সাইয়্যিদ মোহসেন আমিন,[22] এই সম্ভাবনাকে অন্যান্য সম্ভাবনার চেয়ে শক্তিশালী বলে মনে করেছেন। তারা ইমাম রেযা (আ.)-এর একটি হাদিস [23] উদ্ধৃত করেছেন যে, ফাতেমা (সা.আ.)-কে তার ঘরে দাফন করা হয়েছিল, পরবর্তীতে বনি উমাইয়া কর্তৃক মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ করা হলে, ফাতেমা (সা.)-এর কবরন মধ্যে পড়ে।[24]

কিছু শিয়া গবেষকের মতে, ইমাম আলী (আ.) তার খুতবাতে ফাতিমা (আ.)-কে "মহানবী (সা.)-এর পাশে দাফনকৃত" হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, [25] যা তাকে ঘরে দাফন করার সম্ভাবনা শক্তিশালী করে, কারণ মহানবী (সা.)-এর কবর মুবারকের সবচেয়ে কাছের স্থান ছিল ফাতিমা (আ.)-এর ঘর। [26] মহানবী (সা.)-এর কবরের পাশে দাফন হওয়া মর্যাদাপূর্ণ হওয়া বলে বিবেচিত হওয়ায়, এই সম্ভাবনার আরেকটি প্রমাণ; কারণ ইমাম হাসান (আ.)ও ইচ্ছাপোষণ করেছিলেন যে, সম্ভব হলে তাকে যেন মহানবী (সা.)-এর কবরের পাশে দাফন করা হয়। [27]

কিছু শিয়া গবেষক, নিজ ঘরে দাফনের সম্ভাবনাকে ইমাম আলী (আ.) কর্তৃক ফাতেমা (সা.)-এর মৃতদেহ জানাজার জন্য ঘর থেকে বাইরে বের করে নিয়ে যাওয়ার হাদিসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করেছেন।[28] এর উত্তরে বলা হয় যে, জানাজাটি আসল জানাজা ছিল না, বরং একটি নকল জানাজা ছিল,[29] অথবা নকল কবর তৈরি করার জন্য এবং মূল কবরের অবস্থান সনাক্তকরণ এড়াতে এরূপ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।[30] একজন শিয়া গবেষক বিশ্বাস করেন যে, জানাজাটি আলী (আ.) এবং ফাতেমা (সা.)-এর এক ঘর থেকে ফাতেমা (সা.)-এর অন্য একটি ঘরে, যা জান্নতুল বাকি'-এর কাছে অবস্থিত ছিল, নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।[31] তার মতে, ফাতেমা (সা.)-এর বাড়িতে আক্রমণসহ মহানবী (সা.)-এর শাহাদাতের পরের ঘটনাগুলি বাকি'-এর কাছে অবস্থিত বাড়িতে সংঘটিত হয়েছিল।[32]

রওজাতুন নবী

শেখ মুফিদ তাঁর আল-মুকনা গ্রন্থে ফাতিমা (সা.)-কে মহানবীর কবরে দাফন করা হয়েছে, এই বিষয়টিকে সঠিক বলে মনে করেন।[33] শিয়া মুহাদ্দিস শেখ তুসির মতে, অধিকাংশ শিয়া গবেষক বিশ্বাস করেন যে, ফাতিমা (সা.)-কে রওজাতুন্নবীতে দাফন করা হয়েছিল।[34] রওজাতুন্নবীতে মসজিদে নববীর (সা.) মিম্বর এবং মহানবীর কবর মুবারকের মধ্যবর্তী স্থান, যাকে মহানবী জান্নাতের রওজাগুলির মধ্যে একটি বলেছিলেন।[36] মা'আনি আল-আখবার গ্রন্থের একটি বর্ণনা অনুসারে, নবী (সা.) এই স্থানটিকে রওজা বলে বিবেচনা করেছিলেন; কারণ ফাতিমা (সা.)-কে সেখানে দাফন করা হয়েছিল।[37]

ষষ্ঠ শতাব্দীর মুফাসসির ও ধর্মতত্ত্ববিদ আমিন আল-ইসলাম তাবারসি [38] এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর মুফাসসির ও মুহাদ্দিস ইবনে শাহর আশুব [39] ঘর এবং রওজার দুটি সম্ভাবনাকে বিশুদ্ধতার কাছাকাছি বলে মনে করেছেন। শেখ তুসী এই দুটি সম্ভাবনাকে একে অপরের কাছাকাছি বলে মনে করেছিলেন [40] এবং আল্লামা মাজলিসি এগুলিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন, কারণ শিয়া বিশ্বাস অনুসারে, রওজা-তে ফাতেমা (সা.)-এর ঘরও অন্তর্ভুক্ত। [41] এই কারণে, কিছু পণ্ডিত রওজার সম্ভাবনাকে ঘরের সম্ভাবনার সমর্থক বলে মনে করেছেন। [42]