জান্নাতুল বাকীর ধ্বংস

wikishia থেকে

জান্নাতুল বাকী হচ্ছে ইসলামের অন্যতম ঐতিহাসিক পবিত্র নিদর্শন। বিগত ১৯২৬ ইং মোতাবেক ১৩৪৪ হিজরী সৌদি আরবের ওহাবি শাসক কর্তৃক মদীনা ঘেরাও করা হয়। এ সময় আলে সাউদের রাজতন্ত্রী সরকারের কথিত প্রধান মুফতি শেইখ আব্দুল্লাহ বিন বুলাইহিদ এর নির্দেশে জান্নাতুল বাকী কবরস্থান এবং সেখানে অবস্থিত পবিত্র মাজারসমূহ ধ্বংস করা হয়। এ ঐতিহাসিক কবরস্থানে শিয়া মাযহাবের ৪জন মাসুম ইমাম যথাক্রমে ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.), ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.), ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.) এবং ইমাম জাফর সাদীকের (আ.) পবিত্র মাজার ছিল। ওহাবিরা দু’বার প্রথমে ১৮০৫ সনে মোতাবেক ১২২০ হিজরীতে দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সনে মোতাবেক ১৩৪৪ সনে মদীনার ১৫ জন ওহাবিপন্থী মুফতির ফতোয়ার কারণে জান্নাতুল বাকীর উপর নির্মিত সমস্ত মাজার ও সৌধসমূহ ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ওহাবি মুফতিদের ফতোয়া ছিল যে, কবরের উপর কোন মাজার কিংবা সৌধ নির্মাণ করা জায়েয নয়! জান্নাতুল বাকী ধ্বংসের পর মুসলিম জাহানের বিভিন্ন দেশে যেমন: ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশসমূহের মুসলিম উলামা ও জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং তীব্র প্রতিবাদ ও ধিক্কার জ্ঞাপন করে। এ ঘটনার পর তৎকালীন ইরান সরকার দেশটিতে সাধারণ শোক ঘোষণা করে নব্য গঠিত আলে সাউদ রাষ্ট্র তথা সৌদি আরবের স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকে এবং প্রায় তিন বছর বিলম্বে দেশটির প্রতি স্বীকৃতি জানায়।

জান্নাতুল বাকী ঐতিহাসিক কবরস্থানটি ধ্বংসের পর এক সমতল ভূমিতে পরিণত হয়। কিন্তু শিয়া মাযহাবের চার জন মাসুম ইমামের পবিত্র কবরের স্থান পাথরের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়। চার জন মাসুম ইমামের (আ.) পবিত্র কবর মোবারকের উপর ছাউনি ও কবরের চারিপাশে প্রাচীর নির্মাণে শিয়া বিশ্বের অনেক আলেম এবং ইরান সরকারের বারংবার চেষ্টা ও উদ্যোগ সত্ত্বেও সৌদি সরকারের প্রতিবন্ধকতার কারণে তা কখনও সম্ভব হয়নি।

শিয়া মনীষীবর্গ জান্নাতুল বাকী ধ্বংসের তীব্র ধিক্কার জ্ঞাপনের পাশাপাশি ওহাবিদের কর্তৃক এ পবিত্র কবরস্থানের ইসলামি নিদর্শনসমূহ ধ্বংসের প্রতিবাদে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন: সাইয়েদ মুহসেন আমীন রচিত ‘কাশফুল এরতিয়াব’, মুহাম্মাদ জাওয়াদ বালাগী রচিত ‘দাওয়াতুল হুদা’ উল্লেখযোগ্য। ওহাবি সম্প্রদায় তাদের কথিত গোঁড়া চিন্তাধারা ও বানোয়াট ধর্মীয় আকিদায় প্রভাবিত হয়ে মক্কা ও মদীনার অনেক ঐতিহাসিক ধর্মীয় নিদর্শন ও স্থাপনার ধ্বংস সাধন করে।

জান্নাতুল বাকীর অবস্থান ও গুরুত্ব

জান্নাতুল বাকী (ইসলাম অভ্যুদয়ের পূর্বে এর নাম ছিল বাকী আল গারক্বাদ){১} মদীনার মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কবরস্থান।{২} নির্ভরযোগ্য হাদীস ও রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে জান্নাতুল বাকীর প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন।{৩} এ ঐতিহাসিক কবরস্থানটি ১৯২৬ সনের পূর্বে ওহাবিদের হাতে পুরোপুরি ধ্বংস সাধনের পূর্বে এখানে আহলে বাইতের (আ.) চারজন মাসুম ইমাম (আ.), অনেক বিশিষ্ট সাহাবী ও তাবেঈনদের {৪} কবরসমূহের উপর মাজার ও সৌধ নির্মিত ছিল।{৫}

ঐতিহাসিক সূত্রমতে ১৮৮০ সনের পূর্বে জান্নাতুল বাকীতে মাসুম ইমামগণের (আ.) কবরের উপর মাজার, বাইতুল আহজান এবং বিশিষ্ট সাহাবীদের কবরের উপর মাজার এবং আরও অনেক ইসলামি নিদর্শন বহাল ছিল।{৬} এ নিদর্শনাবলি প্রথমবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর ১৮১৯ সনে ওহাবিদের হাত থেকে মদীনার দখলমুক্ত হওয়ার পর উসমানি শাসক দ্বিতীয় সুলতান মাহমুদের আদেশে পুনঃনির্মিত হয়েছিল।{৭}

আব্বাস মীর্যার সন্তান মুরাদ মীর্যা যিনি হিসামুল সালতানাহ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন; তিনি স্বীয় গ্রন্থে উল্লেখ করেন: ১৮৮০ সালের পূর্ব পর্যন্ত জান্নাতুল বাকীতে ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.), ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.), ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.) এবং ইমাম জাফর সাদীকের (আ.) সুদর্শন মাজার ছাড়াও সেখানে মিহরাব এবং তাদের পবিত্র কবরসমূহের উপর সবুজ কাঠের সৌধ নির্মিত ছিল। হযরত ফাতিমা যাহরার (আ.) বাইতুল আহযানও চারজন ইমামের (আ.) কবরের পিছনে দৃশ্যমান ছিল।{৮} আইয়াজ খান এর সফরনামা যা ১৯২৩ সনে লিখিত (অর্থাৎ জান্নাতুল বাকী পুরোপুরি ধ্বংসের মাত্র তিন বছর পূর্বে প্রণীত), তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চারজন ইমামের (আ.) কবরের উপর একটি বড় গম্বুজ ছিল; কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের কবর মোবারক পৃথক পৃথকভাবে চিহ্নিত ছিল।{৯} এ সফরনামার বর্ণনা অনুযায়ী জান্নাতুল বাকীতে রাসূলের (সা.) সন্তান ইবরাহীম, আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর, রাসূলের (সা.) ফুফু, আতিক বিনতে আব্দুল মুত্তালিব এবং হযরত আবুল ফাযলিল আব্বাসের মাতা হযরত উম্মুল বনিনসহ বনী হাশিমের আরও অনেক ব্যক্তিত্ববর্গের কবরের উপর সৌধ দৃশ্যমান ছিল।{১০}

সম্পূর্ণ ধ্বংস সাধনের পর

১৯৫১ সনের ১৩ ডিসেম্বর জেদ্দায় নিযুক্ত ইরানের প্রতিনিধি মুজাফফর আ’লাম সৌদি হজ্ব কমিশনে প্রেরিত এক পত্রে উল্লেখ করেন: ১৯২৬ সনে ওহাবি মুফতিদের ফতোয়ার কারণে জান্নাতুল বাকী সম্পূর্ণ ধ্বংস সাধনের পর{১১} সেখানে অবস্থিত পবিত্র ইমামগণ, সাহাবীবর্গ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কবরের উপর নির্মিত সৌধ নিঃচিহ্ন হয়ে গেছে এবং বর্তমানে তাদের কবরসমূহের কোন আলামত নেই।{১২} তিনি উক্ত পত্রে সৌদি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান যে, আহলে বাইতের (আ.) চার ইমামের (আ.) পবিত্র কবরের চারিপাশে যাতে বেষ্টনী ও ছাউনি নির্মাণ করা হয়।{১৩} বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রাসুল জাফারিয়ান উল্লেখ করেছেন: ইরানের খ্যাতনামা আলেম আব্দুর রাহীম তৎকালীন সৌদি বাদশাহ আব্দুল আজিজের সাথে সাক্ষাতকালে তার প্রতি আনুরোধ করেন যে, জান্নাতুল বাকীতে অবস্থিত আহলে বাইতের (আ.) চার ইমামের (আ.) পবিত্র কবর যাতে অন্যান্য সাধারণ কবরের ন্যায় নিঃচিহ্ন করা না হয় এবং কমপক্ষে সে কবরগুলো যাতে নির্দিষ্ট ও বেষ্টনীর মধ্যে সংরক্ষিত থাকে।{১৪}

জান্নাতুল বাকী সম্পূর্ণ ধ্বংস সাধনের পর তা পুনঃনির্মাণ ও সংস্কারের নিমিত্তে ইরান{১৫} ও আফগানিস্তান{১৬} সরকারের বারাংবার উদ্যোগ এবং একই সাথে নাজাফ{১৭}, কোম, ভারত{১৮} ও পাকিস্তানের{১৯} শিয়া আলেমগণ সেখানে অবস্থিত চারজন মাসুম ইমামের (আ.) মাজার ও ইসলামি নিদর্শনসমূহ পুনঃনির্মানের জোর দাবি জানানো সত্ত্বেও কোন সুফল পাওয়া যায় নি। এমনকি চারজন ইমামের (আ.) কবরের চারিপার্শ্বে বেষ্টনী নির্মাণে আলে সাউদের তদানীন্তন প্রথম সরকারের সম্মতি প্রকাশ সত্ত্বেও পরবর্তীতে ওহাবি মুফতিদের বিরোধীতার কারণে কার্যকর হয় নি।{২০} অবশ্য বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজের শাসনামলে জান্নাতুল বাকী কবরস্থানের চারিপাশে সীমানা প্রাচীর নির্মিত এবং ১৯৯৮ সনে এ ঐতিহাসিক কবরস্থান জিয়ারতকারীদের সুবিধার্তে কবরস্থানের বিভিন্ন অংশে চলাচলের রাস্তা তৈরি করা হয়।{২১}

প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, বর্তমানে সৌদি আরবের ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নেহি আনীল মুনকার’ তথা ন্যায় কাজে আদেশ ও অন্যায় কাজে বাধা দান নামক একটি বিশেষ ফোর্স জান্নাতুল বাকী কবরস্থানের প্রধান ফটকে একটি স্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করেছে। সাধারণ জিয়ারতকারীদের সেখানে প্রবেশ এবং মাজারসমূহের নিকটে দোয়া ও প্রার্থনার ক্ষেত্রে বাধা দান এ ফোর্সের প্রধান কাজ।{২২} বর্তমানে মাসুম ইমামগণের (আ.) পবিত্র কবর ছাড়াও বিশিষ্ট সাহাবীবর্গ ও অন্যান্য সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের কবরসমূহের উপর একখণ্ড পাথর ছাড়া আরও কোন নিশানা নেই।{২৩} যদিও বর্তমান সময়ে জান্নাতুল বাকী কবরস্থানের সার্বিক অবস্থা এ ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংসের প্রাথমিক বছরগুলোর তুলনায় সন্তোষজনক অবস্থাতে রয়েছে।

জান্নাতুল বাকী ধ্বংসের ঘটনাপ্রবাহ

১৮০৫ সনে মোতাবেক ১২২০ হিজরীতে ওহাবি গোষ্ঠি কর্তৃক প্রায় দেড় বছর যাবত মদীনা শহর অবরুদ্ধ করে রাখার ফলে সেখানে দূর্ভিক্ষ দেখা দেয় ফলে তারা সে সুযোগে মদীনা দখল করে নেয়। ঐতিহাসিক সূত্র মতে মদীনা দখলের পর সাউদ বিন আব্দুল আজিজের আদেশে রাসূলুল্লাহর (সা.) পবিত্র মাজারের ভীতরে রক্ষিত সিন্দুকের মধ্যে যে সব মূল্যবান ধন-সম্পদ ছিল, সেগুলো লুট করা হয়। একই সাথে রওজার আশে-পাশে যত গম্বুজ ও উচু নিদর্শনাবলি আছে সেগুলো সব ধ্বংস করার  আদেশ দেয়া হয়।{২৬} এরই প্রেক্ষিতে জান্নাতুল বাকীতে অবস্থিত চারজন মাসুম ইমামের (আ.) কবরের উপর নির্মিত মাজার এবং হযরত ফাতিমা যাহরার (আ.) বায়তুল আহযানের গম্বুজ ধ্বংস সাধিত হয়। এভাবে সর্বপ্রথম ১৮০৫ সনে ওহাবিদের আক্রমনে জান্নাতুল বাকীর পবিত্র মাজারসমূহ ক্ষতিসাধিত কিংবা আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।{২৭}

এ ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর তুরস্কের উসমানি সাম্রাজ্যের শাসক মদীনা শহর ওহাবিদের হাত থেকে দখলমুক্ত করতে একটি বিশাল বাহিনী মদীনা অভিমুখে প্রেরণ করে। এ বাহিনী ১৮১২ সনের ডিসেম্বর মাসে মদীনা শহর থেকে ওহাবিদের বিতাড়িত করে। অতঃপর উসমানি শাসক দ্বিতীয় মাহমুদের আদেশে ১৮১৯ সনে জান্নাতুল বাকীর পবিত্র মাজারসমূহ পুনঃনির্মাণ করা হয়।{২৮}

ওহাবি গোষ্ঠী ১৯২৫ সনের সেপ্টেম্বর মাসে আবার মদীনায় হামলা চালায়।{২৯} এ হামলায় খোদ রাসূলের (সা.) রওজা মোবারকসহ মদীনার অনেক ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নিদর্শনাবলি মারাত্মক ক্ষতিসাধিত হয়। এ ঘটনার ৭ মাস পর সৌদি রাজতন্ত্রি সরকারের মক্কার তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শেইখ আব্দুল্লাহ বিন বুলাইহিদ (যিনি ১৯২৪ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন) মদীনায় আসেন এবং এ শহরের মুফতিদের নিকট থেকে জান্নাতুল বাকীর পবিত্র মাজারসমূহ ধ্বংসের ফতোয়া গ্রহণ করেন।{৩২} অবশেষে ১৯২৬ সনের ২১ এপ্রিল মোতাবেক ১৩৪৪ হিজরীর ৮ শাওয়াল শেইখ আব্দুল্লাহ বিন বুলাইহিদ মদীনার কিছু ওহাবিপন্থি মুফতিদের ফতোয়ার ভিত্তিতে জান্নাতুল বাকী সম্পূর্ণ ধ্বংসের আদেশ দেন।{৩৩} এ সময় মদীনার ১৫ জন ওহাবি মতাদর্শের মুফতি{৩৪} কবরের উপর সৌধ নির্মাণ জায়েয নয় এ কারণে জান্নাতুল বাকীতে অবস্থিত সব কবরের উপর বিদ্যমান সৌধ ও গম্বুজগুলো ভেঙ্গে ফেলার ফতোয়া জারি করেন।{৩৫} অথচ ওহাবি মতাদর্শের বিপরীতে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের দৃষ্টিতে কবরের উপর সৌধ ও গম্বুজ নির্মাণ জায়েয এবং মহামানব ও ওলীগণের মাজার জিয়ারত মুস্তাহাব আমল হিসেবে গণ্য।{৩৬} নির্ভরযোগ্য সনদ অনুযায়ী জান্নাতুল বাকী ধ্বংসের মাত্র ৪ দিন পর ১৯২৬ সনের ২৫ এপ্রিল মোতাবেক ১৩৪৪ হিজরীর ১২ শাওয়াল তৎকালীন সৌদি বাদশাহ আব্দুল আজিজ এক পত্রে এমন পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে শেইখ আব্দুল্লাহ বিন বুলাইহি’র প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।{৩৭}

প্রতিক্রিয়াসমূহ

ওহাবি গোষ্ঠি কর্তৃক মদীনার ইসলামি নিদর্শনসমূহ বিশেষ করে জান্নাতুল বাকী ধ্বংসের প্রতিবাদে সাইয়েদ আবুল হাসান ইসফাহানি এবং শেখ আব্দুল কারীম হায়েরী তথা নাজাফ ও কোমের সর্বোচ্চ ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্রের দু’জন কর্ণধার তীব্র প্রতিবাদ ও ধিক্কার জ্ঞাপন করে। এমনকি এ ঘটনার প্রতিবাদে ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্রসমূহ এবং বাজার ও দোকানপাট বন্ধ ঘোষণা করা হয়।{৩৮} মুহাম্মাদ খালেসি জাদেহ ও সাইয়েদ হাসান মুদার্রেস জান্নাতুল বাকী ধ্বংসের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং এ ন্যাক্কারজনক কাজের সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি তুলেন।{৩৯} বিশিষ্ট মারজায়ে তাকলীদ হযরত আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ হুসাইন তাবাতাবায়ী কুম্মী এ ঘটনার পর বহু বছর পর্যন্ত জান্নাতুল বাকী’র চারজন মাসুম ইমামের (আ.) পবিত্র মাজারের পুনঃনির্মাণের জোর প্রচেষ্টা চালান। এমনকি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ বিশিষ্ট মারজায়ে তাকলীদের দাবি পুরণের নিমিত্তে সৌদি সরকারের সাথে সংলাপে মিলিত হয়।{৪০} ইমাম খোমেনী (রহ.) অজ্ঞতা ও চিন্তাগত বক্রতাকে জান্নাতুল বাকী এবং সেখানে অবস্থিত আল্লাহর ওলীগণের মাজারসমূহ ধ্বংসের প্রধান কারণ হিসেবে অভিহিত করেনে। বিশিষ্ট শিয়া মনীষী হযরত আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ হুসাইন কাশেফুল গাতা এক ঐতিহাসিক পত্রের মাধ্যমে সৌদি আরবের ওহাবি গ্রান্ড মুফতি শেখই আব্দুল্লাহ বিন বুলাইহিদের প্রতি তওহীদ সম্পর্কে শিয়া মাযহাবের দলিলনির্ভর সুদৃঢ় আকিদা-বিশ্বাস তুলে ধরার পাশাপাশি ধর্মীয় আলোচনার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তিনি উক্ত পত্রে এটাও উল্লেখ করেন যে, যদি সে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণে ব্যর্থ হয়, তবে সেটা তার দূর্বল আকিদার প্রমাণ বহন করবে।{৪২}

বিশিষ্ট মনীষী সাইয়েদ মুহসেন আমীন মদীনার জান্নাতুল বাকী ও ইসলামি নিদর্শনাবলি ধ্বংসের পর হিজাজ সফর করেন এবং সেখানে গবেষণানির্ভর গ্রন্থ ‘কাশফুল এরতিয়াব’ প্রণয়ন করেন।{৪৩} এ কিতাবে তিনি ওহাবি সম্প্রদায়ের জন্ম ইতিহাস, তাদের আকিদার ধরণ, তাদের বক্র চিন্তাধারার স্বরূপ এবং সেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ ও গঠনমূলক সমালোচনা তুলে ধরেছেন।{৪৪} মুহাম্মাদ জাওয়াদ বালাগি নাজাফী ‘রাদ্দুল ফাতওয়া বেহাদামি কুবুরিল আইম্মা ফীল বাকী’ নামক কিতাবে জান্নাতুল বাকী ও মদীনার ইসলামি নির্দশনাবলি ধ্বংসে ওহাবিদের মনগড়া চিন্তাধারার তীব্র সমালোচনা এবং তাদের এহেন পদক্ষেপের প্রতি কড়া ধিক্কার জ্ঞাপন করেছেন।{৪৫} এছাড়া অনেক মুসলিম খ্যাতনামা কবি তাদের কবিতার প্রতিটি অংশে জান্নাতুল বাকী ধ্বংসের তীব্র প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানিয়েছেন।{৪৭}

মুহাম্মাদ জাওয়াদ বালাগি নাজাফী ওহাবি গোষ্ঠীর ভ্রান্ত আকিদার অকাট্য জবাব তুলে ধরে ‘আর রাদ্দা আলাল ওয়াবিয়্যাহ’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.), ইমাম আলী (আ.), ইমাম জাফর সাদীক (আ.) ও অন্যান্য মাসুম ইমামগণের হাদীসসমূহের উদ্ধৃতি তুলে ধরে, সুন্নতে রাসূল (সা.) এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষাবলির আলোকে ওহাবিদের আকিদা ও চিন্তাধারার অসারতার প্রমাণ তুলে ধরেছেন। তিনি এ কিতাবে উল্লেখ করেছেন: ওহাবিরা যে সব হাদীস ও রেওয়ায়েতকে পুজি করে কবরকে ঘিরে সমাধি নির্মাণকে হারাম বলে প্রচার করে সেখানে বলা হয়েছে ‘কবরের উপর ভবন আকৃতির প্রাচীর নির্মাণ জায়েয নয়’; না কবরকে ঘিরে সমাধি নির্মাণ।{৪৮}

শিয়া মাযহাবের সমকালীন শীর্ষ ফিকাহবিদগণ জান্নাতুল বাকী এবং সেখানে অবস্থিত ইমামগণ ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের মাজার পুনঃনির্মানের উপর জোর গুরুত্বারোপ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- হযরত আয়াতুল্লাহ ফাজেল লানকারানি, হযরত আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাজী, হযরত আয়াতুল্লাহ লুতফুল্লাহ সাফী গুলপাইগানি। তারা প্রত্যেকে জান্নাতুল বাকীস্থ চারজন মাসুম ইমামের (আ.) মাজার পুনঃনির্মাণের সার্বিক চেষ্টো ও প্রচেষ্টাকে ওয়াজিব কিংবা ওয়াজিবে কিফায়ী হিসেবে অভিহিত করেছেন। হযরত আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ আলী হুসাইনি সিস্তানী এক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকে জায়েয বলে গণ্য করেছেন।{৫১} 

গণ ও সরকারি উদ্যোগসমূহ

জান্নাতুল বাকী ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়নভূক্ত মুসলিম দেশগুলোর জনগণ এবং তুরস্ক, আফগানিস্তান, চীনসহ বিভিন্ন দেশের মুসলিম জনগণ সৌদি সরকারের প্রতি পত্র প্রেরণের মাধ্যমে মক্কা ও মদীনার ইসলামি নিদর্শনাবলি সংক্ষরণের জোর দাবি জানায়।{৫২}

ইরানের তৎকালীন সরকার এ ঘটনার প্রতিবাদে এক সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে ১৯২৫ সনের ৫ই সেপ্টেম্বর মোতাবেক ১৬ সফর ১৩৪৪ হিজরী দিনটি দেশব্যাপী জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে। ফলে রাজধানী তেহরানের সর্বত্র শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়।{৫৪} উল্লেখ করা হয়েছে যে, সেদিন তেহরানের দারওয়াজে দৌলাত স্কয়ারে দশ হাজারের বেশি ধর্মপ্রাণ মুসলমান মদীনার জান্নাতুল বাকীতে ধ্বংসযজ্ঞের কারণে সৌদি ওহাবি গোষ্ঠীর প্রতি তীব্র প্রতিবাদ ও ধিক্কার জ্ঞাপন করে।{৫৫}

মদীনার ইসলামি নিদর্শনাবলি ধ্বংসযজ্ঞের ধারাবাহিক প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ইরান সরকার ২ মার্চ ১৯২৬ সালে এক সরকারি ঘোষণায় ইরানের জনগণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সে বছর হজ্ব পালনে সৌদি গমন নিষিদ্ধ করে।{৫৪} এরপর ইরান সরকার ১৯২৬ সনের ২৩ জুন এক বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে মদীনার ধর্মীয় নিদর্শনাবলি ধ্বংস এবং জান্নাতুল বাকীতে অবস্থিত চারজন মাসুম ইমাম (আ.) ও অন্যান্য বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গের কবরের প্রতি অপমাননার কারণে ইরানের ধর্মপ্রাণ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত হেনেছে এবং একই সাথে মুসলিম জাহানের ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাসের প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনের প্রতিবাদ হিসেবে সৌদি আরবের জাতীয় অধিবেশনে যোগদানের আমন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করে।{৫৭} ইরান সরকার এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে সৌদি ওহাবি সমর্থিত সরকারের স্বীকৃতি দান থেকে বিরত থাকে। অবশেষে সৌদি সরকার ১৯২৯ সনে ইরান ও অন্যান্য মুসলিম দেশের সরকার প্রধানদের প্রতি প্রেরিত এক পত্রে হাজিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করণের প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করে।{৫৯} ফলে দীর্ঘ ৪ বছর কুটনৈতিক সম্পর্ক বিছিন্ন থাকার পর ১৯৩০ সনের জুন মাসে ইরান ও সৌদির মধ্যে পুনরায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক চালু হয়{৬০} এবং সে বছর থেকে আবার ইরানি হাজিরা হজ্বে গমণ করে।{৬১}