উসমান হত্যাকাণ্ড
উসমান হত্যাকাণ্ড (আরবি: حادثة مقتل عثمان) ৩৫ হিজরিতে মুসলমানদের তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফানের বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহ ও তাকে হত্যার ঘটনাকে নির্দেশ করে। আমর ইবনে আস সাহমী-কে মিশরের গভর্নর পদ থেকে অপসারণ ও তার স্থলে আবদুল্লাহ ইবনে আবি সারহ-কে নিয়োগের প্রতিক্রিয়ায় মিশরের অধিবাসীদের পক্ষ থেকে এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। অবশ্য উসমানের শাসন পদ্ধতি- যেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদসমূহ তার উমাইয়া আত্মীয়-স্বজনদেরকে নিয়োগ দেন এবং বাইতুল মাল থেকে তাদেরকে বিপুল পরিমান অর্থ প্রদান করেন- জনগণের, এমনকি রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যেও অসন্তোষ ও প্রতিবাদের সৃষ্টি করেছিল।
মিশরীয় প্রতিবাদকারীরা তাদের প্রতিবাদ জানাতে মদিনায় গমন করেন এবং ইমাম আলী (আ.)-এর মধ্যস্ততা ও সংশোধনের বিষয়ে উসমানের অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে তারা মিশরে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু ফেরার পথে তারা মিশরের গভর্নরের প্রতি উসমানের লেখা একটি চিঠি আবিষ্কার করেন, যাতে তাদেরকে হত্যা ও কারারুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এমতাবস্থায় তারা পুনরায় মদিনায় ফিরে এসে খিলাফত থেকে উসমানের পদত্যাগের দাবি জানান, কিন্তু উসমান তাদের এ দাবি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে তারা উসমানের বাসভবন ঘেরাও করেন এবং চল্লিশ দিন অবরোধের পর তিনি নিহত হন; তাকে মুসলিম কবরস্থানে দাফন করতেও বাধা প্রদান করা হয়।
মিশরীয় প্রতিবাদকারীরা তাদের অভিযোগ নিয়ে মদিনায় গমন করেন এবং ইমাম আলী (আ.)-এর মধ্যস্ততা ও সংশোধনের বিষয়ে উসমানের অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে তারা মিশরে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু ফেরার পথে তারা মিশরের গভর্নরের প্রতি উসমানের লেখা একটি চিঠি আবিষ্কার করেন, যাতে তাদের হত্যা ও কারারুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এমতাবস্থায়, তারা পুনরায় মদিনায় ফিরে এসে খিলাফত থেকে উসমানের পদত্যাগের দাবি জানান, কিন্তু উসমান তাদের এ দাবি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে তারা উসমানের বাসভবন ঘেরাও করেন এবং চল্লিশ দিন অবরোধের পর তিনি নিহত হন; তাকে মুসলিম কবরস্থানে দাফন করতেও বাধা প্রদান করা হয়।
এই ঘটনাপ্রবাহে, যদিও ইমাম আলী (আ.) উসমানকে ভুল ও ত্রুটির অধিকারী বলে মনে করতেন, তবুও তিনি তাকে হত্যা করার ব্যাপারে একমত ছিলেন না। এজন্য তিনি ইমাম হাসান (আ.) ও আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের-এর মতো ব্যক্তিদের উসমানের গৃহ রক্ষার নির্দেশ প্রদান করেন।
উসমানের হত্যাকাণ্ড মুসলমানদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধের সূচনা করে; বিশেষত বনু হাশিম ও বনু উমাইয়ার মধ্যকার পুরনো দ্বন্দ্ব পুনরায় প্রজ্বলিত হয় এবং আয়েশা, তালহা ও যুবায়ের উসমানের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের অজুহাতে জঙ্গে জামাল (উটের যুদ্ধ) সংঘটিত করেন। এই ঘটনাকে ইসলামী বিশ্বে ফিতনা বা গৃহবিবাদের সূচনাকাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া, উসমান হত্যাকাণ্ডকে ‘উসমানিয়া’ তথা উসমানপন্থী গোষ্ঠীর উদ্ভবের সূচনাও বলা হয়ে থাকে।
ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্ব ও স্থান
উসমান হত্যাকাণ্ড মহানবী (সা.)-পরবর্তী সময়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম। কিছু কিছু গবেষকের মতে, তার হত্যাকাণ্ডের পর ইসলামী ইতিহাস এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে।[১] তাছাড়া উসমানের হত্যাকাণ্ড নানাবিধ পরিণতি বয়ে আনে এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। আহলে সুন্নতের ইতিহাসবিদ ইবনে হাজার আল-আসকালানী (মৃত্যু: ৮৫২ হি.) উসমানের হত্যাকাণ্ডকে ইসলামী বিশ্বে ফিতনা বা গৃহবিবাদের সূচনা বলে চিহ্নিত করেছেন।[২] উসমানের হত্যাকাণ্ডকে উসমানিয়া ফিরকা গঠনের সূচনা[৩] এবং রাজনৈতিক, সামরিক ও জ্ঞানগত—এই তিন অঙ্গনে শিয়াদের সাথে তাদের সংঘাতের সূত্রপাত হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।[৪]
ঘটনার বিবরণ
সূত্র অনুযায়ী, আমর ইবনে আস-কে মিশরের গভর্নর পদ থেকে অপসারণ ও তার স্থলে আবদুল্লাহ ইবনে আবি সারহ-কে নিয়োগের পর, প্রায় ছয়শত মিশরবাসী প্রতিবাদ জানাতে মদিনায় গমন করেন। এটিই ছিল উসমানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সূচনা ছিল।[৫] অন্যদের মতে, বাইতুল মাল থেকে খলিফা কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটায়।[৬] প্রতিবাদকারীরা মদিনার দিকে রওনা হওয়ার পর চিঠির মাধ্যমে অন্যদেরও মদিনায় উপস্থিত হওয়ার আহ্বান জানান।[৭]
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- ইবনে আসির, আলী ইবনে মুহাম্মাদ, আসাদুল গাবা ফি মা'রিফাতিস সাহাবা, বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৪০৯ হি.।
- ইবনে আসির, আলী ইবনে মুহাম্মাদ, আল-কামিল ফিত তারিখ, বৈরুত, দার সাদির, ১৩৮৫ হি.।
- ইবনে আ'সাম কুফি, আহমাদ ইবনে আ'সাম, আল-ফুতুহ, তাহকিক: আলী শিরি, বৈরুত, দারুল আদওয়া, ১৪১১ হি.।
- ইবনুত তাকতাকি, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, আল-ফাখরি, তাহকিক: আবদুল কাদের মুহাম্মাদ মায়ো, বৈরুত, দারুল কালামিল আরাবি, ১ম সংস্করণ, ১৪১৮ হি.।
- ইবনুল ইবরি, তারিখ মুখতাসারুদ দুয়াল, বৈরুত, দারুশ শার্ক, ১৯৯২ খ্রি.।
- ইবনে জাওজি, আবদুর রহমান ইবনে আলী, আল-মুনতাজাম, মুহাক্কি: মুহাম্মাদ আবদুল কাদের আতা, মুস্তাফা আবদুল কাদের আতা, বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, ১ম সংস্করণ, ১৪১২ হি.।
- ইবনে হাজার আসকালানি, আহমাদ ইবনে আলী, আল-ইসাবা ফি তামইজিস সাহাবা, তাহকিক: আদিল আহমাদ আবদুল মাওজুদ, আলী মুহাম্মাদ মুয়াউয়াদ, বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, ১৪১৫ হি.।
- ইবনে খালদুন, আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ, তারিখ ইবনে খালদুন, তাহকিক খলীল শাহাদা, বৈরুত, দারুল ফিকর, ২য় সংস্করণ, ১৪০৮ হি.।
- ইবনে সা'দ, মুহাম্মাদ ইবনে সা'দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, তাহকিক: মুহাম্মাদ আবদুল কাদের আতা, বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, ১ম সংস্করণ, ১৪১০ হি.।
- ইবনে আবদিল বার, ইউসুফ ইবনে আবদুল্লাহ, আল-ইসতিয়াব ফি মা'রিফাতিল আস-হাব, তাহকিক: আলী মুহাম্মাদ আল-বাজাউই, বৈরুত, দারুল জাইল, ১ম সংস্করণ, ১৪১২ হি.।
- ইবনে কুতাইবা দিনওয়ারি, আবদুল্লাহ ইবনে মুসলিম, আল-ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, তাহকিক: আলী শিরি, বৈরুত, দারুল আদওয়া, ১ম সংস্করণ, ১৪১০ হি.।
- ইবনে কাসির দিমাশ্কি, ইসমাইল ইবনে উমর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৪০৭ হি.।
- ইবনে মিসকাওয়াইহ, আবু আলী, তাজারিবুল উমাম, তাহকিক: আবুল কাসিম ইমামি, তেহরান, সুরুশ, ২য় সংস্করণ, ১৩৭৯ ফার্সি সন।
- আশ-শেখ, আবদুল মুন'ইম, "আসবাবুল ফিতনাহ ফি 'আহদি উসমান", মাজাল্লাহ আল-আজহার, সংখ্যা ২২, মুহাররাম ১৩৭০ হি.।
- আল-গিবান, মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ, ফিতনাতু মাকতালি উসমান বিন আফফান, মদিনা, আল-জামি'আতুল ইসলামিয়া, ১৪১৯ হি.।
- বখতিয়ারি, শাহলা, "সখতারে সিয়াসিয়ে হুকুমতে উসমান", মাজাল্লেয়ে কেইহান আন্দিশে, সংখ্যা ৭৭, উর্দি বিহেশত ১৩৭৭ ফার্সি সন।
- বালাজুরি, আহমাদ ইবনে ইয়াহইয়া, আনসাবুল আশরাফ, তাহকিক: সুহাইল যাকার, রিয়াদ যিরিকলি, বৈরুত, দারুল ফিকর, ১ম সংস্করণ, ১৪১৭ হি.।
- সাকাফি, ইবরাহিম ইবনে মুহাম্মাদ, আল-গারাত, তাসহিহ: জালালুদ্দিন মুহাদ্দিস, তেহরান, আঞ্জুমানে অসারে মিল্লি, ১ম সংস্করণ, ১৩৯৫ হি.।
- জাফরিয়ান, রাসূল, তারিখুল খুলাফা, কুম, দালিলে মা, ১৩৮০ ফার্সি সন।
- জাফরি, হুসাইন মুহাম্মাদ, তাশাইয়ু' দার মাসিরে তারিখ, তরজমা: সৈয়দ মুহাম্মাদ তাকি আয়াতুল্লাহি, তেহরান, দাফতারে নাশরে ফারহাঙ্গে ইসলামি, ১৩৮০ ফার্সি সন।
- হুসাইন, তাহা, "আলী ওয়া ফিতনেয়ে বুযুর্গে কাতলে উসমান", তরজমা: রেজা রাদি, মাজাল্লেয়ে গুলিস্তানে কুরআন, সংখ্যা ১০, উর্দি বেহেশত ১৩৭৯ ফার্সি সন।
- হুসাইন, তাহা, আল-ফিতনাতুল কুবরা, কায়রো, হিন্দাওয়ি, ২০১২ খ্রি.।
- খলিফা ইবনে খিয়াত, তারিখ খলিফা ইবনে খিয়াত, তাহকিক: ফাওয়াজ, বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, ১৪১৫ হি.।
- দিনওয়ারি, আহমাদ ইবনে দাউদ, আল-আখবারুত তিওয়াল, কুম, মানশুরাতে রাদি, ১৩৬৮ ফার্সি সন।
- যাহাবি, মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ, তারিখুল ইসলাম, তাহকিক: উমর আবদুস সালাম তাদমুরি, বৈরুত, দারুল কিতাবিল আরাবি, ২য় সংস্করণ, ১৪০৯ হি.।
- সরূশ মাহাল্লাতি, মুহাম্মাদ, জিহাদ দার ফিকহে মু'আসিরে শিয়া, তেহরান, মিরাসে আহলে কালাম, ১৪০০ ফার্সি সন।
- শেখ তুসি, মুহাম্মাদ ইবনে হাসান, আল-আমালি, কুম, দারুস সাকাফাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১৪ হি.।
- শেইখ মুফিদ, মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ, আল-ইখতিসাস, কুম, কংগ্রেয়ে শেখ মুফিদ, ১ম সংস্করণ, ১৪১৩ হি.।
- তাবারি, মুহাম্মাদ ইবনে জারির, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, তাহকিক: মুহাম্মাদ আবুল ফাদল ইবরাহিম, বৈরুত, দারুত তুরাস, ২য় সংস্করণ, ১৩৮৭ হি.।
- আবদুল মাকসুদ, আবদুল ফাত্তাহ, ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব, বৈরুত, মাকতাবাতুল আরফান, তারিখ অজ্ঞাত।
- গারিব, মামুন, খিলাফাতু উসমান বিন আফফান, কায়রো, মারকাযুল কিতাব লিন নাশর, তারিখ অজ্ঞাত।
- কাউসারী, আহমাদ, "বাররাসি রিশেহায়ে তারিখে নাসিবি গারি", দার মাজাল্লেয়ে সিরাজ মুনির, সংখ্যা ১৬, যেমেস্তান ১৩৯৩ ফার্সি সন।
- মাজলিসী, মুহাম্মাদ বাকির, বিহারুল আনোয়ার, বৈরুত, দারু ইহইয়ায়িত তুরাসিল আরাবি, ২য় সংস্করণ, ১৪০৩ হি.।
- মুরুজি তাবাসি, মুহাম্মাদ মহসিন, "তাসিরে তাফাক্কুরে উসমানিয়্যাহ বার ইবনে তাইমিয়্যাহ দার তাকাবুল বা রেওয়ায়ানে ফাযায়েলে আহলে বাইত (আ.)", দার ফারহাঙ্গে, সংখ্যা ৪৬, বাহার ১৪০০ ফার্সি সন।
- মাকদিসি, মুতাহহার ইবনে তাহির, আল-বাদউ ওয়াত তারিখ, বুর সাইদ, মাকতাবাতুস সাকাফাতিদ দিনিয়া, তারিখ অজ্ঞাত।
- মাকারেম শিরাজি, নাসির, নাহজুল বালাগাহ বা তারজমে-এ ফারসি রাওয়ান, নাশের: মাদ্রাসাতুল ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.), কুম, ১৩৮৪ ফার্সি সন।
- নাশি' আল-আকবার, আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ, মাসাইলুল ইমামাহ, তাহকিক: ইওজেফ ফান এস, বৈরুত, অজ্ঞাত প্রকাশনা, ১৯৭১ হি.।
- নাসর ইবনে মুজাহিম, ওয়াক'আতু সিফফিন, তাসহিহ: আবদুস সালাম মুহাম্মাদ হারুন, কুম, মাকতাবাতু আয়াতিল্লাহিল মার'আশি আন-নাজাফি, ২য় সংস্করণ, ১৪০৪ হি.।
- নাহজুল বালাগা, তাহকিক: সুবহি সালেহ, কুম, হিজরাত, ১ম সংস্করণ, ১৪১৪ হি.।
- ইয়াকুবি, আহমাদ ইবনে আবি ইয়াকুব, তারিখে ইয়াকুবি, বৈরুত, দার সাদির, ১ম সংস্করণ, তারিখ অজ্ঞাত।