সূরা ফীল

wikishia থেকে

সূরা ফীল (আরবি: سورة الفيل); পবিত্র কুরআনের ১০৫তম সূরা এবং মক্কায় অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্যতম। পবিত্র এ গ্রন্থের ৩০তম পারায় স্থান পাওয়া এ সূরায় হস্তিবাহিনীর ঘটনা বর্ণনা হওয়ার কারণে এ সূরা নাম ফীল (হস্তি) নামকরণ করা হয়েছে।

পবিত্র কা’বা গৃহ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নিজেদের ভূখণ্ড থেকে রওয়ানা হওয়া হস্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ আবাবিল পাখি প্রেরণ করেন। আবাবিল পাখির দল হস্তিবাহিনীর উপর ছোট ছোট পাথর নিক্ষেপ করে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়।

কিছু কিছু মারজা’র মত হল, যদি কেউ প্রতিদিনের নামাজে সূরা ফাতিহার পর সূরা ফীল তেলাওয়াত করে তবে এহতেয়াত (সতর্কতা) হল এর সাথে সূরা কুরাইশও তেলাওয়াত করা। কেননা এ দু’টি সূরা মূলতঃ এক সূরার হুকুমে।

ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত, ওয়াজিব নামাজসমূহে এ সূরা তেলাওয়াত করলে, কেয়ামতের দিন সমস্ত সৃষ্টিকূল সাক্ষ্য দেবে যে, সে নামাজিদের অন্তর্ভুক্ত। অতএব, মহান আল্লাহ্ তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন এবং তাকে বেহেশতে প্রবেশ করানোর নির্দেশ দেবেন।

পরিচিতি

নামকরণ

হস্তিবাহিনীর ঘটনা বর্ণনার কারণে সূরাটি ফীল নামে নামকরণ করা হয়েছে। কখনো আবার এ সূরাকে ‘আলাম তারা’ও বলা হয়; কেননা এ বাক্যের মাধ্যমেই সূরা আরম্ভ হয়েছে।[১]

বিন্যাস ও অবতীর্ণ হওয়ার স্থান

সূরা ফীল মক্কায় অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্যতম এবং নুযুলের ধারা অনুযায়ী মহানবি (স.)-এর উপর অবতীর্ণ হওয়া ১৯তম সূরা। বর্তমান মুসহাফের (কুরআন) বিন্যাস অনুযায়ী এ সূরার অবস্থান ১০৫ তে[২] এবং ৩০তম পারায়।

আয়াতের সংখ্যা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য

সূরা ফীলে ৫টি আয়াত, ৩২টি শব্দ এবং ৯৭টি অক্ষর রয়েছে। এ সূরা পবিত্র কুরআনের ছোট সূরাগুলোর অন্যতম এবং কুরআনের ((مُفَصَّلات)) মুফাসসালাত (যে সকল সূরা ছোট ছোট আয়াত দ্বারা সমন্বিত) সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া ঐ সকল সূরার একটি যেগুলোর সকল আয়াত একত্রে মহানবি (স.)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে।[৩]

বিষয়বস্তু

এতে মহান আল্লাহ পবিত্র কা’বা গৃহ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে নিজেদের ভূখণ্ড থেকে রওয়ানা হওয়া হস্তিবাহিনীর ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। মহান আল্লাহ আবাবিল পাখি প্রেরণের মাধ্যম তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। আবাবিল পাখি তাদের উপর ছোট ছোট পাথর বর্ষণ করে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়। ঐ ছোট পাথরের আঘাতে হস্তিবাহিনী ভক্ষিত তৃণ-ভুষির মত হয়ে গিয়েছিল।[৪]

শানে নুযুল

এ সূরার শানে নুযুল সম্পর্কে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, হজরত আবু তালিব মহানবি (স.)-কে বললেন: তুমি কি সকল মানুষের জন্যই প্রেরিত হয়েছ? নাকি শুধুমাত্র তোমার গোত্রের উদ্দেশ্যে? মহানবি (স.) বললেন: ‘না, সকল মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছি; সাদা-কালো, আরব-আজম সকলেই; আমি সকলকে এমনকি যারা পাহাড়ের চূড়ায় বসবাস করে এবং সমূদ্রের রয়েছে তাদেরকেও এ দ্বীনের প্রতি আমন্ত্রণ জানাবো। আমি ফারস ও রোমের সকলের প্রতি আহবান জানাবো’। মহানবি (স.)-এর এ কথা কুরাইশের কানে পৌঁছুলে তাদের আশ্চর্যের কারণ হল। হজরত আবু তালিবের উদ্দেশ্যে কুরাইশ বললো: তুমি কি তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র কি বলছে তা শোন্ না? খোদার কসম যদি রোম এবং পারস্যের লোকেরা এ কথা শোনে তাহলে তারা আমাদেরকে আমাদের ভূমি থেকে ধরে নিয়ে যাবে এবং কা’বার প্রতিটি পাথরকে আলাদা আলাদা করে ফেলবে। এ সময় মহান আল্লাহ্ তাদের ‘পারস্য ও রোমের লোকেরা কা’বা ধ্বংস করে দেবে’ শীর্ষক মন্তব্যের জবাবে সূরা ফীল অবতীর্ণ করেন।[৫]

নামাজে সূরা ফীলের তেলাওয়াত

কোন কোন মারজা’র মত হল, যদি কেউ প্রত্যহের নামাজে সূরা ফাতিহার পর সূরা ফীল তেলাওয়াত করে তবে এহতেয়াত (সতর্কতা) হল এর সাথে সূরা কুরাইশেরও তেলাওয়াত করা। কেননা এ দু’টি সূরা মূলতঃ এক সূরার হুকুমে।[৬]

সূরার ফজিলত

সূরা ফীল তেলাওয়াত প্রসঙ্গে বিভিন্ন ফজিলত বর্ণিত হয়েছে তম্মধ্যে ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতটি উল্লেখযোগ্য। বর্ণিত হয়েছে যে, ওয়াজিব নামাজসমূহে এ সূরা তেলাওয়াত করলে, কেয়ামতের দিন সমস্ত সৃষ্টিকূল সাক্ষ্য দেবে যে, সে নামাজিদের অন্তর্ভুক্ত। আহবানকারী কেয়ামতের দিন আহবান জানাবে যে, আমার বান্দার বিষয়ে তোমরা সত্য সাক্ষ্য দিয়েছো, তার সম্পর্কে তোমাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করলাম, তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাও। আর সে ঐ সকল লোকদের অন্তর্ভুক্ত মহান আল্লাহ্ যার কাজ পছন্দ করেন।[৭] অপর রেওয়ায়েতে এ সূরার ফজিলতে বর্ণিত হয়েছে যে, এ সূরা তেলাওয়াত করলে শত্রুর অনিষ্ট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়[৮] এবং অপবাদ থেকে ও মাসখ হওয়া (কোনো সত্তা বা প্রাণির নিকৃষ্টতর বা অধিকতর কুৎসিত সত্তা বা প্রাণিতে রূপান্তরিত হওয়া) থেকে নিরাপদ থাকা যায়[৯]

তথ্যসূত্র

  1. দানেশ নামেয়ে কুরআন ওয়া কুরআন পেঝুহেশি, ১৩৭৭ ফার্সি সন, খণ্ড ২, পৃ. ১২৬৮।
  2. মা'রেফাত, আমুযেশে উলুমে কুরআন, ১৩৭১ ফার্সি সন, খণ্ড ২, পৃ. ১৬৬।
  3. দানেশ নামেয়ে কুরআন ওয়া কুরআন পেঝুহেশি, ১৩৭৭ ফার্সি সন, খণ্ড ২, পৃ. ১২৬৮।
  4. তাবাতাবায়ী, আল-মিযান, ১৯৭৪ খ্রি., খণ্ড ২০, পৃ. ৩৬১।
  5. ফাত্তাল নিশাপুরি, রাওদ্বাতুল ওয়া'ইযিন ওয়া বাসিরাতুল মুত্তা'ইযিন, ১৩৭৫ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৫৪-৫৫।
  6. বানি হাশেমি খোমেনী, তৌযিহুল মাসায়েল মারাজেঅ, ১৩৯২ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৬৯৩, আয়াতুল্লাহ খুয়ী, সিস্তানি, সাফি এবং ওয়াহিদ খোরাসানির মতের ভিত্তিতে।
  7. শেইখ সাদুক, সাওয়াবুল আ'মাল ওয়া ইকাবুল আ'মাল, ১৩৮২ ফার্সি সন, পৃ. ১২৬।
  8. হুররে আমেলী, ওয়াসায়েলুশ শিয়া, ১৪১৪ হি., খণ্ড ৬, পৃ. ৫৫।
  9. তাবারসী, মাজমাউল বায়ান, ১৩৭২ ফার্সি সন, খণ্ড ১০, পৃ. ৮২০।

গ্রন্থপঞ্জি

  • কুরআনে কারিম, তরজমা মুহাম্মাদ মাহদি ফুলাদওয়ান্দ, তেহরান, দারুল কুরআনুল কারিম, ১৪১৮ হি./১৩৭৬ ফার্সি সন।
  • বানি হাশেমী খোমেনী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হুসেইন, তৌযিহুল মাসায়েল মারাজেঅ: মোতাবেক বা ফতওয়ায়ে শন্য্দাহ নাফার আয মারাজেয়ে মোআযযামে তাকলীদ, কোম, দাফতারে ইনতেশারাতে ইসলামী, প্রথম সংস্করণ, ১৩৯২ ফার্সি সন।
  • হুররে আমেলী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, ওয়াসায়েলুশ শিয়া, কোম, আলুল বাইত, ১৪১৪ হি.।
  • দানেশ নামেয়ে কুরআন ও কুরআন পেঝুহি, খণ্ড ২, বে কৌশিশে বাহাউদ্দিন খুররামশাহী, তেহরান: দুস্তান, নাহিদ, ১৩৭৭ ফার্সি সন।
  • শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ বিন আলী, সাওয়াবুল আ'মাল ওয়া ইকাবুল আ'মাল, তাহকীক: সাদেক হাসান যাদেহ, তেহরান, ১৩৮২ ফার্সি সন।
  • তাবাতাবায়ী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হুসেইন, আল-মিযান ফি তাফসীরিল কুরআন, বৈরুত, মুআসসেসাতুল আ'লামি লিল মাতবুআত, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৭৪ খ্রি.।
  • তাবারসী, ফাযল বিন হাসান, মাজমাউল বায়ান ফি তাফসীরিল কুরআন, বে তাসহীহ-এ- ফাযলুল্লাহ ইয়াযদি তাবাতাবায়ী ওয়া হাশেম রাসূলী, তেহরান, নাসের খসরু, তৃতীয় সংস্করণ, ১৩৭২ ফার্সি সন।
  • মা'রেফাত, মুহাম্মাদ হাদি, আমুযেশে উলুমে কুরআন, মারকাযে চাপ ওয়া নাশর সাযেমানে তাবলীগাতে ইসলামী, প্রথম সংস্করণ, ১৩৭১ ফার্সি সন।
  • ফাত্তাল নিশাপুরি, মুহাম্মাদ বিন আহমাদ, রাওদ্বাতুল ওয়া'ইযিন ওয়া বাসিরাতুল মুতা'ইযিন, কোম, ইন্তেশারাতে রাযি, প্রথম সংস্করণ, ১৩৭৫ ফার্সি সন।
  • মা'রেফাত, মুহাম্মাদ হাদি, আত-তামহিদ ফি উলুমিল কুরআন, কোম, মুআসসেসাতুল নাশরিল ইসলামি, ১৪১৫ হি.।