শোক পালন
- নিবন্ধটি ‘শোক পালন’ সম্পর্কে, ইমাম হুসাইনের (আ.) জন্য শোক পালন সম্পর্কে জানতে মহররম মাসে শোক পালন নিবন্ধটি পড়ুন।
শোক পালন; এমন একটি অনুষ্ঠান যা কারো মৃত্যুতে পালিত হয়। শোক পালনের ইতিহাস দীর্ঘ কালের এবং প্রাচীনকাল থেকেই এটি আত্মীয়স্বজন বা ধর্মীয় বোযোর্গ ব্যক্তিদের স্মরণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রের সাক্ষ্যানুযায়ী, ইসলাম ধর্মে আযাদারি তথা শোক পালনের ইতিহাস স্বয়ং মহানবির (স.) সাথে সম্পৃক্ত। ঐ সময় থেকে আজ পর্যন্ত ইসলামি দেশসমূহে বিভিন্ন পন্থায় শোক পালিত হয়ে আসছে; যেমন, ইসালে সওয়াবের (আমাদের দেশে যেটা কুলখানি নামে প্রসিদ্ধ) অনুষ্ঠান, মৃত্যু ব্যক্তির তৃতীয় দিনের ও চল্লিশার অনুষ্ঠান।
শিয়া ফকীহগণের দৃষ্টিতে মৃত ব্যক্তির জন্য শোক অনুষ্ঠানের আয়োজন ও ক্রন্দন করা জায়েয। তবে আহলে সুন্নতের ফকীহদের দৃষ্টিতে আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুতে নীরবে ক্রন্দন করা যায় এবং তাদের কেউ কেউ উচ্চস্বরে ক্রন্দন ও বিলাপ করাকে জায়েয মনে করেন না।
শিয়াদের বেশীরভাগ আযাদারী ও শোকানুষ্ঠান মাযহাব কেন্দ্রীক; অর্থাৎ ধর্মের কোন সম্মানিত ব্যক্তির স্মরণে যে শোক পালন করা হয়; যেমন, মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (স.), ইমামগণ (আলাইহিমুস সালাম) বিশেষভাবে ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদাতের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানাদি। আহলে সুন্নতের কিছু কিছু আলেম এই ধরনের শোক পালনকে বিদআত ও হারাম জ্ঞান করেন; অথচ আহলে সুন্নতের আলেমদের একটি দল প্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি শিয়াদের আযাদারির অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করে আসছেন।
মৃত ব্যক্তিদের স্মরণে শোক পাালন
শোক পালনের অনুষ্ঠান বলতে ঐ অনুষ্ঠানকে বোঝায় যা কারো মৃত্যুর শোকে পালিত হয়।[১]
কোন প্রিয় ব্যক্তি বা ধর্মীয় কোন বোযোর্গ ব্যক্তির মৃত্যুর শোক পালিত অনুষ্ঠানকেই শোকানুষ্ঠান বা আযাদারি বলা হয়।[২]
শোক পালনের ইতিহাস
বিভিন্ন সংস্কৃতিতে শোক পালন প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। কথিত আছে যে এটি প্রাক-জরথুষ্ট্রীয় ইরানেও জনপ্রিয় ছিল এবং এর কিছু নমুনা শাহনামা’তেও উল্লেখিত হয়েছে।[৩] বাইবেলে মৃতদের জন্য বনি ইসরাইলের শোক পালনের কথাও উল্লেখ আছে।[৪]
ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে ইসলাম ধর্মে শোকের ইতিহাস মহানবির (স.) সময়ের। যেমন: হিজরী ৮ম শতাব্দীর বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর লিখেছেন যে, ওহুদের যুদ্ধের পর মদিনার নারীরা তাদের মৃতদের জন্য শোক প্রকাশ করছিল। এ দৃশ্য দেখে আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন হামযা’র (রা.) জন্য ক্রন্দনের কেউ কি নেই। এরপর নারীরা হযরত হামযাহ বিন আব্দুল মুত্তালিবের জন্য শোক প্রকাশ ও কান্নাকাটি করেন।[৫]
বিভিন্ন সংস্কৃতিতে শোক পালন
বিভিন্ন সংস্কৃতিতে মৃতব্যক্তির জন্য শোক ভিন্ন ভিন্ন রূপে পালিত হয়; যেমন, ইরানে কুলখানি (খতমে কুরআন), মৃত্যুর তৃতীয়, ও সপ্তম দিনের মজলিশ এবং ৪০ দিনের মজলিশের আয়োজিত হয়।[৬] তাজিকিস্তানের মত আরো কিছু দেশে ২০তম দিন, চল্লিশা ও বাৎসরিক শোক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়।[৭] ভারতের মুসলমানরা তৃতীয় দিনে মৃত ব্যক্তিকে স্মরণ করে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।[৮] একইভাবে মিসর, আযারবাইজান ও ইরাকে নিজ্স্ব ও বিশেষ পদ্ধতিতে শোক পালিত হয়।[৯]
মৃত ব্যক্তির জন্য ক্রন্দনের ধর্মীয় বিধান
শিয়া ফকীহগণের দৃষ্টিতে, মৃত ব্যক্তির জন্য ক্রন্দন করা জায়েয।[১০] জাওয়াহের গ্রন্থের প্রণেতা মুহাম্মাদ হাসান নাজাফি (মৃত্যু ১২৬৬ হি.) লিখেছেন, মৃত ব্যক্তির জন্য ক্রন্দন জায়েয হওয়া প্রসঙ্গে বহুসংখ্যক হাদীস বিদ্যমান; যেমন, ঐ সকল রেওয়ায়েত যেগুলোতে মহানবির (স.) চাচা হযরত হামযাহ এবং তাঁর সন্তান ইব্রাহিমের জন্য তাঁর (স.) ক্রন্দনের ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। একইভাবে মহানবির (স.) শোকে হযরত ফাতেমা যাহরার (সা. আ.) ক্রন্দনের ঘটনা।[১১] মাসুম ইমামগণ (আ.) ব্যতীত অপর কারও জন্য মাথা ও মুখে আঘাত করে উচ্চস্বরে বিলাপ করে ক্রন্দন করা জায়েয না হলেও আবা আব্দিল্লাহ ইমাম হুসাইনের (আ.) -কারো কারো মতে আহলে বাইতের (আ.)- উপর বয়ে যাওয়া মুসিবত স্মরণ করে শোক পালন করা জায়েয, বরং কোন কোন ফকীহ’র দৃষ্টিতে মাসুম ইমামগণের (আ.) জন্য শোক পালন করা ইবাদত হিসেবে পরিগণিত।[১২]
ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন:
হে আল্লাহ!... রোদে পোড়া মুখগুলো, যে গালগুলো আমার পিতামহ আবা আবদিল্লাহ (হুসাইন)-এর কবরের মাটিতে ঘষা হয় এবং এই আমাদের দুঃখে ব্যথিত হয়ে যে চোখগুলো থেকে অশ্রু ঝরে, আমাদের বিপর্যয়ে যে হৃদয়গুলো বিচলিত ও ব্যথিত হয় এবং যে ক্রন্দন ও বিলাপগুলো (আমাদের বিপদে) করা হয় সেগুলোকে আপনি আপনার রহমতের শামিল করে নিন।[১৩]
আহলে সুন্নতের দৃষ্টিভঙ্গী
বিশিষ্ট মিশরীয় ফকীহ আব্দুর রাহমান জাযিরীর মতে, সুন্নি ফিকাহ অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করে কোন কিছু পাঠ করা বা বলা (Lament) জায়েয নয়; তবে নীরবে ক্রন্দন করার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। শব্দ করে ক্রন্দনের বিষয়ে আহলে সুন্নতের মাযহাবসমূহের মাঝে এখতেলাফ রয়েছে; মালেকি ও হানাফিরা এটাকে হারাম মনে করেন; কিন্তু শাফেয়ী ও হাম্বালিদের দৃষ্টিতে তা জায়েয।[১৪]
মাযহাবি আযাদারি
কিছু কিছু শোক পালন মাযহাব কেন্দ্রীক বিষয়কে কেন্দ্র করে। এই ধরনের শোক শিয়ারা বিশেষ গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকে এবং তারা মহানবি (সা.), হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.) এবং ইমামগণসহ (আ.) অপর ধর্মীয় নেতাদের শোকে ও স্মরণে শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে, বিশেষ করে মহররম মাসে ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদাতের স্মরণে।[১৫]
শিয়াদের মাযহাব কেন্দ্রীক শোক পালনগুলো, মুসিবত বর্ণনা[১৬] মর্সিয়া পাঠ, ক্রন্দন, নওহা পাঠ ও মাতম[১৭] ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।[১৮]
শিয়া আলেমগণ আযাদারীর পক্ষে এবং এর জায়েয হওয়া প্রসঙ্গে বহুসংখ্যক রিসালাহ ও কিতাব রচনা ও সংকলন করেছেন। সাইয়্যেদ মুহসিন আমিন রচিত ‘ইকনাউল লায়েম আলা ইকামাতিল মাআতেম’ গ্রন্থটি সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।[১৯]
আহলে সুন্নতের আলেমদের কেউ কেউ –যেমন হাম্বালি মাযহাবের আলেমরা- আযদারি ও শোক পালনকে বিদআত ও হারাম মনে করেন।[২০] এতদসত্ত্বেও ঐতিহাসিক বিভিন্ন বর্ণনার ভিত্তিতে ইরানে আহলে সুন্নতের একটি দল –বিশেষ করে শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারীরা- এমনকি হানাফি ও শাফেয়ী মাযহাবের আলেমদের কেউ কেউ আযাদারীর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।[২১]
তথ্যসূত্র
- ↑ আনওয়ারি, ফারহাঙ্গে বোযোর্গে সোখান, ১৩৮১ ফার্সি সন, খণ্ড ৫, যেইলে ওয়াঝে "আযাদারী"।
- ↑ বাকী, "আযাদারী"।
- ↑ বাকী, "আযাদারী"।
- ↑ বাহরামি, "তারহীম, মাজলিস", পৃ. ১০৮।
- ↑ ইবনে কাসীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ১৪০৮ হি., খণ্ড ৪, পৃ. ৫৫।
- ↑ ফারহাঙ্গী ওয়া মুনফারিদ, "তারহীম, মাজলিস", পৃ. ১০৩।
- ↑ ফারহাঙ্গী ওয়া মুনফারিদ, "তারহীম, মাজলিস", পৃ. ১০৩, ১০৪।
- ↑ বাহরামি, "তারহীম, মাজলিস", পৃ. ১১০।
- ↑ ফারহাঙ্গী ওয়া মুনফারিদ, "তারহীম, মাজলিস", পৃ. ১০৪, ১০৫।
- ↑ দ্র: তাবাতাবায়ী ইয়াযদি, উরওয়াতুল উসকা, ১৪১৯ হি., খণ্ড ২, পৃ. ১৩০-১৩১; নাজাফি, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৪০৪ হি., খণ্ড ৪, পৃ. ২৬৪-২৬৫।
- ↑ নাজাফি, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৪০৪ হি., খণ্ড ৪, পৃ. ২৬৪-২৬৫।
- ↑ তাবরিযী, সীরাতুন্নেযাহ, খণ্ড ৩, পৃ. ৪৩৪; নাজাফি, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৪০৪ হি., খণ্ড ৪, পৃ. ৩৭১।
- ↑ মাজলিসী, বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ১০১, পৃ. ৮।
- ↑ জাযিরী, আল-ফিকহু আলাল মাযহাবিল আরবাআ, ১৪২৪ হি., খণ্ড ১, পৃ. ৪৮৪।
- ↑ মাযাহেরি, "আযাদারী", পৃ. ৩৪৫।
- ↑ মুহাদ্দেসী, ফারহাঙ্গে আশুরা, ১৩৮০ ফার্সি সন, পৃ. ৪৪১।
- ↑ মুহাদ্দেসী, ফারহাঙ্গে আশুরা, ১৩৮০ ফার্সি সন, পৃ. ২৫৬।
- ↑ মুহাদ্দেসী, ফারহাঙ্গে আশুরা, ১৩৮০ ফার্সি সন, পৃ. ২১৪।
- ↑ মাযাহেরি, "আযাদারী", পৃ. ৩৪৬।
- ↑ মাযাহেরি, "আযাদারী", পৃ. ৩৪৬।
- ↑ মাযাহেরি, "আযাদারী", পৃ. ৩৪৭।
গ্রন্থপঞ্জি
- ইবনে কাসীর, ইসমাঈল ইবনে উমার, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, দারু ইহিয়াইত তুরাসিল আরাবি, প্রথম সংস্করণ, ১৪০৮ হি.।
- আনওয়ারি, হাসান ও অন্যান্যরা, ফারহাঙ্গে বোযোর্গে সোখান, তেহরান, এন্তেশারাতে ইলমি, ৭ম সংস্করণ, ১৩৯০।
- বাকী, ইমাদুদ্দীন, আযাদারী, ‘দায়েরাতুল মাআরেফে বোযোর্গে ইসলামি’ ওয়েব সাইট, প্রকাশের তারিখ ৮ উর্দিবেহেশত ১৩৯৯ ফার্সি সন, ভিজিটের তারিখি ৬ তীর ১৪০১ ফার্সি সন।
- বাহরামি, আসকার, ‘তারহীম, মাজলিস’, দায়েরোতুল মায়ারেফে বোযোর্গে ইসলামি, খণ্ড ১৫, দায়েরাতুল মাআরেফে বোযোর্গে ইসলামি সেন্টার, প্রথম সংস্করণ, ১৩৭৮ ফার্সি সন।
- জাযিরী, আব্দুর রাহমান ইবনে মুহাম্মাদ আওদ্ব, আল-ফিকহু আলাল মাযহাবিল আরবাআ, দারুল কুতুবিল আলামিয়াহ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪২৪ হি.।
- ফারহাঙ্গী, সুসান ও আফসানে মুনফারিদ, দানেশ নামেয়ে জাহানে ইসলাম, তেহরান, দায়েরাতুল মায়ারেফে ইসলামি ফাউন্ডেশন, প্রথম সংস্করণ, ১৩৮২ ফার্সি সন।
- তাবাতাবায়ী, ইয়াযদি, মুহাম্মাদ কাযেম, আল-উরওয়াতুল উসকা, কোম, এন্তেশারাতে ইসলামি ইনস্টিটিউট, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৯ হি.।
- মাযাহেরি, মুহসিন হাসসাম, আযাদারী দার ফারহাঙ্গে শিয়ী, তেহরান, খেইমেহ, প্রথম সংস্করণ, ১৩৯৫ ফার্সি সন।
- নাজাফি, মুহাম্মাদ হাসান, জাওয়াহেরুল কালাম ফি শারহি শারায়েইল ইসলাম, বৈরুত, দারু ইহিয়াইত তুরাসিল আরাবি, ৭ম সংস্করণ, ১৪০৪ হি.।