মৃত্যু যন্ত্রণা
মৃত্যু যন্ত্রণা (আরবি: سکرة الموت); হল মৃত্যুর সময় মুমূর্ষু ব্যক্তি যে কষ্ট বা যন্ত্রণা ভোগ করে। পবিত্র কুরআনের সূরা ক্বাফের ১৯নং আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসের ভিত্তিতে সাকরাতুল মাওত অত্যন্ত কষ্টকর ও ভয়াবহ এবং সকলের জন্য অবধারিত।
হাদীসে এসেছে, কোন কোন মু’মিনও মৃত্যুকষ্টে ভোগে, এর মাধ্যমে তার গুনাহগুলোকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। মহানবি (স.) ও মাসুম ইমামগণ (আ.) থেকে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসের ভিত্তিতে কিছু কিছু কাজ করলে মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ হয়ে যায়; যেমন- রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক, পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ, দ্বীনি ভাইকে সাহায্য করা, সূরা ইয়াসিন ও সাফফাত তেলাওয়াত করা, ইমাম আলীকে (আ.) ভালোবাসা এবং ইমাম হুসাইনের (আ.) মাজার বারবার যিয়ারত করা ইত্যাদি।
পরিভাষা পরিচিতি
মৃত্যুর সময় মুমূর্ষু ব্যক্তি যে কঠিন অবস্থা অতিবাহিত করে তা, মাতাল বা ঘোরে থাকা ব্যক্তির আবস্থার কাছাকাছি। আর ঐ অবস্থাকে সাকরাতুল মাওত (মৃত্যু যন্ত্রণা) বলা হয়। এ সময় মানুষ পরিচিত কোন কিছু বা কোন ব্যক্তিকে চেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।[১] (سکرات) শব্দটি (سکرة) শব্দের বহুবচন মাতালামি, কষ্ট ও উদ্ভ্রান্ত অর্থে।[২] আর (موت) অর্থ হচ্ছে মৃত্যু।[৩]
কুরআন ও হাদীসে সাকরাতুল মাওত
পবিত্র কুরআনের সূরা ক্বাফে’র ১৯নং আয়াতে (سَکرَةُالمَوت) শব্দটি এসেছে-
অর্থ: ‘আর মৃত্যুকালীন মূর্ছা (যন্ত্রণা) সত্যিই আসবে, এ তো তাই যা থেকে তুমি টাল-বাহানা করতে (পলায়ন করতে চাইতে)।’
বিভিন্ন হাদীসেও (سَکرَةُالمَوت) [৪] ও (سَکَرَاتُ المَوت)[৫] দু’টোই এসেছে। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বিহারুল আনওয়ারের একটি অংশে সাকরাতুল মাওত সংশ্লিষ্ট মোট ৫২টি হাদীস উল্লিখিত হয়েছে।[৬] শেইখ তুসী রচিত তাহযীবুল আহকাম গ্রন্থে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে একটি দোয়া বর্ণিত হয়েছে, ঐ দোয়ার একাংশে এসেছে যে, ‘হে আল্লাহ্ সাকরাতুল মাওতের সময় আমাকে সাহায্য করো।’[৭]
সাকরাতুল মাওত কেমন হবে
শেইখ সাদুক ইমাম আলী (আ.) থেকে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তার ভিত্তিতে, মানুষের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় হলো ৩টি; যখন সে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়; যখন কবর থেকে উত্তোলিত হয় এবং যখন মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়।[৮] পায়ামে কুরআন তাফসীর গ্রন্থে সূরা ক্বাফে’র ১৯নং আয়াতে আগত (سَکرَةُ المَوت) শব্দটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে; ভয়ানক কষ্ট ও ভীতির সাথে মৃত্যুর আগমন ঘটে।[৯] গ্রন্থটিতে আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন রেওয়ায়েতের বর্ণনা অনুযায়ী; ‘এমনকি নবিগণ (আ.) এবং আল্লাহর ওলিগণও সাকরাতুল মওতের কষ্ট থেকে নিরাপদ নন’।[১০]
মু’মিন ও কাফেরের মৃত্যু যন্ত্রণা
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতে এসেছে যে, মু’মিনের জন্য সাকরাতুল মাওত হবে অত্যন্ত সহজ। তবে কিছু কিছু মু’মিনের জন্য কঠোরও হতে পারে, আর সেটা তার কৃত গুনাহগুলোকে ক্ষমা করার জন্য হবে। এর বিপরীতে কাফেরের মৃত্যু হবে অত্যন্ত কঠিন; তবে কিছু কিছু কাফেরের মৃত্যু আবার সহজও হতে পারে; তা হবে এই দুনিয়াতে যে ভাল কাজ তারা করেছে সেগুলোর বিনিময় হিসেবে, আর আখেরাতে তারা আযাব ভোগ করবে।[১১]
যেভাবে মৃত্যু যন্ত্রণা লাঘব করা যায়
কিছু কিছু হাদীসে সাকরাতুল মাওতকে সহজ করার বেশ কিছু উপায় উল্লেখিত হয়েছে; যেমন- বিশিষ্ট শিয়া মুহাদ্দিস কুলাইনি ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে যে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন; ‘যে তার দ্বীনি ভাইকে কাপড় পরিধান করাবে (কাপড় দান করবে) মহান আল্লাহ তাকে বেহেশতি পোশাক পরিধান করাবেন এবং সাকরাতুল মাওতকে তার জন্য সহজ করবেন।[১২]
এছাড়া, যে সকল কাজ মৃত্যু যন্ত্রণায় হ্রাস ঘটায় সেগুলোর মধ্যে;
রক্তসম্পর্কীয়দের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা, পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণ, রমযান মাসের রোজা, সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত, রজব মাসের রোজা, ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি মহব্বত, ইমাম হুসাইনের (আ.) যিয়ারতে বারবার যাওয়া[১৯] ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মুহাম্মাদ মাহদি নারাকী তার জামেউস সায়াদাহ গ্রন্থে একটি রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে বলেছেন: কারো মা তার উপর অসন্তুষ্ট থাকলে তার সাকরাত ও কবরের আযাব অধিকতর কঠিন হবে।
মুমূর্ষু ব্যক্তির সাকরাতকে করার উপায়
বিশিষ্ট শিয়া ফকীহ মুহাম্মাদ হাসান নাজাফী (জাওয়াহের গ্রন্থের প্রণেতা) বলেন, বিভিন্ন রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, মুস্তাহাব হলো মুমূর্ষু ব্যক্তিকে তার নামাজের স্থানে স্থানান্তরীত করা। এ কাজ তার মৃত্যু যন্ত্রণাকে সহজ করে দেয়।[১৩]
মহানবি (সা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যে, মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত তার মৃত্যুকে সহজ করে দেয়। ইমাম মূসা কাযিম (আ.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসের ভিত্তিতে মুহাক্কিক কারাকী, মুমূর্ষু ব্যক্তির জন্য সূরা সাফফাত তেলাওয়াত করাকে মুস্তাহাব জেনেছেন।[১৪] ঐ হাদিসের ভিত্তিতে, যদি মুমূর্ষু ব্যক্তির শিয়রে সূরা সাফফাত তেলাওয়াত করা হয়, মহান আল্লাহ তার মৃত্যু সহজ করে দেন।[১৫]
তথ্যসূত্র
- ↑ তাবাতাবায়ী, আল-মিযান, হিঃ১৪১৭, খণ্ড-১৮, পৃষ্ঠা নং-৩৪৮।
- ↑ দেহখোদা, লুগাতনামা দেহখোদা।
- ↑ দেহখোদা, লুগাতনামা দেহখোদা।
- ↑ শেইখ তূসী, মিসবাহুল মুতাহাজ্জেদ ওয়া সিলাহুল মুতাআব্বেদ, ১৪১১ হিঃ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-৪৪৩।
- ↑ শেইখ তূসী, তাহযিবুল আহকাম, ১৪০৭ হিঃ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা নং-৯৩।
- ↑ মাজলেসী, বিহারুল আনওয়ার, ১৪০৩ হিঃ, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা নং-১৪৫-১৭৩।
- ↑ শেইখ তূসী, তাহযিবুল আহকাম, ১৪০৭ হিঃ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা নং-৯৩।
- ↑ শেইখ সাদুক, আল-খিসাল, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ) খণ্ড-১, পৃষ্ঠা নং-১১৯।
- ↑ মাকারেম শিরাজী ও অন্যান্য, পায়ামে কুরআন,১৩৭৭ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা নং-৪৩১।
- ↑ মাকারেম শিরাজী ও অন্যান্য, পায়ামে কুরআন,১৩৭৭ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা নং-৪৩২।
- ↑ শেইখ সাদুক, উয়ুনু আখবারুর রেযা, ১৩৭৮ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-১, পৃষ্ঠা নং-২৭৪-২৭৫।
- ↑ কুলাইনী, আল-কাফী, ১৪০৭ হিঃ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-২০৪।
- ↑ নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৪০৪ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা নং-১৮।
- ↑ মুহাক্কিক কারাকী, জামেউল মাকাসেদ, ১৪১৪ হিঃ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা নং-৩৫৩।
- ↑ কুলাইনী, আল-কাফী, ১৪০৭ হিঃ, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা নং-১২৬।
গ্রন্থপঞ্জি
- শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, ফাযাইলু আল্-আশহুরী আস্-সালাসাতি, তাহকিক গোলাম রেযা ইরফানিয়ান ইয়াযদী, কোম, প্রথম প্রকাশ, কিতাব ফুরুশিয়ে দাভারী, ১৩৯৬ হিঃ।
- শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, আল্-খিসাল, তাহকিক আলী আকবার গাফ্ফারী, কোম, জামেয়ে মুদাররেসিন, প্রথম প্রকাশ, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ)।
- শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, আমালী, তেহরান, কিতাবচী, ষষ্ঠ প্রকাশ, ১৩৭৬ (সৌরবর্ষ)।
- শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, সাওয়াবুল আমল ওয়া ইক্বাবুল আমল, কোম, দারু শারিফুর রাযি, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৪০৬ হিঃ।
- শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, উয়ুনু আখবারুর রেযা, তাহকিক ও তাছহিহ মাহদী লাজুরদী, তেহরান, নাশরে জাহান, প্রথম প্রকাশ, ১৩৭৮ (সৌরবর্ষ)।
- শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, ফাযায়েলুশ্ শিয়া, তেহরান, আলামী, প্রথম প্রকাশ, (প্রকাশের তারিখ অজ্ঞাত)।
- শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ ইবনে আলী, মান লা ইয়াহদুহুল ফাকিহ, তাহকিক ও তাছহিহ আলী আকবার গাফফারী, কোম, দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামী, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৪১৩ হিঃ।
- শেইখ তূসী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, আল-আমালী, তাহকিক মুয়াস্সাসাতুল বি’সাহ, কোম, দারুস সিক্বাফাহ, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৪ হিঃ।
- শেইখ তূসী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, তাহযিবুল আহকাম, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, চতুর্থ প্রকাশ, ১৪০৭ হিঃ।
- শেইখ তূসী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, মিসবাহুল মুতাহাজ্জেদ ওয়া সিলাহুল মুতাআব্বেদ, বৈরুত, মুয়াস্সাসাতু ফিকহিশ্ শিয়া, প্রথম প্রকাশ, ১৪১১ হিঃ।
- শেইখ কুলাইনী, মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব, আল-কাফী, তাহকিক আলী আকবার গাফফারী ওয়া মুহাম্মাদ আখুন্দী, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, চতুর্থ প্রকাশ, ১৪০৭ হিঃ।
- মাজলেসী, মুহাম্মাদ বাকের, বিহারুল আনওয়ার, বৈরুত, দারু ইহয়ায়িত্ তুরাসিল আরাবী, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৪০৩ হিঃ।
- মাকারেম শিরাজী, নাসের ও অন্যান্য, পায়ামে কুরআন, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, ১৩৭৭ (সৌরবর্ষ)।