উজুব (আত্মমুগ্ধতা)

wikishia থেকে

উজুব (আরবি: عُجب) নৈতিক স্খলনগুলোর অন্যতম;  নিজের সৎকর্মগুলোকে আল্লাহর তৌফিক না ভেবে সত্তাগত পূর্ণতা মনে করে সেগুলো সম্পর্কে সন্তুষ্ট হওয়া ও আনন্দ প্রকাশ করা এবং নিজেকে বড় করে দেখাকে বোঝায়। নৈতিকতা শাস্ত্রে উজুবের কারণ হিসেবে ক্ষমতা, সৌন্দর্য্য, বংশ পরিচয়, সন্তানের সংখ্যাধিক্য ইত্যাদি বিষয়ের নাম উল্লেখিত হয়েছে। এর পরিণতি হিসেবে মানুষের আমল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অহংকার ও বুদ্ধিবৃত্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে।

উলামায়ে আখলাকের দৃষ্টিতে উজুব মূর্খতা থেকে উৎস লাভ করে। তাদের মতে জ্ঞান ও অবগতির মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। একইভাবে তাদের ভাষ্য হলো, নৈতিকতা বিষয়ক এ স্খলনকে এর উৎস ও মূল থেকে চিকিৎসা করতে হবে।

সংজ্ঞা

উজুব (আত্মমুগ্ধতা ও খোদপসন্দি) হলো, কৃত সৎকর্মে আনন্দিত হওয়া এবং সবকিছু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে –এ বিষয়টি ভুলে গিয়ে ঐ কর্মকে নিজের পক্ষ থেকে ভেবে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরোয়া না করা।[১][নোট ১] অবশ্য মোল্লা আহমাদ নারাকির মতে, ‘উজুব’ হলো নিজেকে বড় ও কোন পূর্ণতার অধিকারী জ্ঞান করা।[২]

তাকাব্বুর ও ইদলালের সাথে উজুবের পার্থক্য

উজুব, তাকাব্বুর (تکبر) তথা অহংকার ও দাম্ভিকতার কাছাকাছি অর্থের অধিকারী। পার্থক্য হলো, উজুবের উদ্রেকের সময় মানুষ নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করে না, কিন্তু তাকাব্বুরের ক্ষেত্রে সে নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং উঁচু স্থানে আসীন বলে জ্ঞান করে।[৩]

ইদলাল (إدلال) ও উজুবের মাঝে পার্থক্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, উজুব হলো কোন কাজকে বড় করে দেখা এবং কোন আমল ও ইবাদত সম্পাদনের পর উক্ত আমলের মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রতি অনুগ্রহ করেছে বলে জ্ঞান করে। কিন্তু ইদলাল হলো, উল্লিখিত বিষয়াদি ছাড়াও মানুষ নিজেকে এমন অধিকার প্রাপ্ত হওয়ার যোগ্য বলে জ্ঞান করে যার কারণে কোন কিছু থেকে ভয়-ভীতি অবশিষ্ট থাকে না।[৪]

কারণসমূহ

উলামায়ে আখলাক উজুবের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণ ও উদ্রেককারীর নাম উল্লেখ করেছেন। ফাইয কাশানি তার আল-মুহাজ্জাতুল বাইদা গ্রন্থে লিখেছেন: সৌন্দর্য্য, শক্তি-সামর্থ, চাতুরতা ও বুদ্ধিবৃত্তি, বংশ পরিচয়, রাজা-বাদশাহ বা ক্ষমতাধর ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ততা, সন্তানের আধিক্য, সম্পদ ও চিন্তা ইত্যাদিকে উজুবের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন।[৫] তাদের দৃষ্টিতে সূরা হাশরের ২নং এবং সূরা কাহাফের ১০৪নং আয়াতকে উজুবের সাথে সম্পৃক্ত।[৭] ((وَ یوْمَ حُنَین اذْ اعْجَبَتْکمْ کثْرتُکمْ)) আর হুনাইনের দিন, তোমাদের সংখ্যার আধিক্য তোমাদেরকে গর্বে মাতোয়ারা করে দিয়েছিল।’[৬] নারাকী’র ভাষায়, উজুব ও ইবাদত পরস্পর বিরোধী দু’টি বিষয়; কেননা ইবাদত হলো মহান আল্লাহর সামনে হীনতা ও নীচুতা প্রদর্শন, আর উজুবের অবস্থান ঠিক এর বিপরীতে।[৮]

পরিণতি

উজুবের প্রভাব ও পরিণতি সম্পর্কে হাদীসমূহে বিভিন্ন বিষয় উল্লেখিত হয়েছে, সেগুলোর কতক নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

  • সৎকর্মসমূহ ধ্বংস হয়ে যায়; আল্লাহর নবি (স.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, উজুব ও আত্মমুগ্ধতা মানুষের ৭০ বছরের আমল ধ্বংস করে দেয়।[৯] ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে একজন পাপী ও একজন নামাজি একত্রে মসজিদে প্রবেশ করলো। তারা মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় নামাজি পাপী হয়ে এবং পাপী নামাজি হয়ে মসজিদ থেকে বের হলো। কারণ নামাজি লোকটি মসজিদে উজুবের শিকার হয়ে নিজের ইবাদত নিয়ে আত্মমুগ্ধতায় ভুগলো, কিন্তু পাপী লোকটি তওবার প্রতি মনোযোগী হল এবং ইস্তিগফার করতে লাগলো।[১০]
  • তাকাব্বুর: তাকাব্বুর ও অহংকারের ভূমিকা ও প্রাথমিক রূপ হিসেবে উজুবের নাম উল্লেখিত হয়েছে: [১১]
  • গুনাহসমূহকে ভুলে যায় অথবা সেগুলোকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করে।
  • নিজের আমল ও ইবাদতকে বড় মনে করে এবং কোন সৎকাজ করলে মনে করে সে এ কাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রতি অনুগ্রহ করেছে।[১২]

বিভিন্ন রেওয়ায়েতে বুদ্ধিবৃত্তি[১৩] ও জ্ঞান[১৪] ক্ষতিগ্রস্থ ও নষ্ট হয়ে যাওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া[১৫] ও নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়া[১৬] ইত্যাদিকে উজুবের পরিণতি বলে উল্লেখ করে একে জ্ঞানের প্রবৃদ্ধি[১৭] ও পূর্ণতায় পৌঁছানোর[১৮] পথে অন্তরায় বলে উল্লিখিত হয়েছে।

নাহজুল বালাগা’তে বর্ণিত এক রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, যে সকল গুনাহ মানুষের মাঝে অসন্তুষ্টির জন্ম দেয় এবং তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে তা ঐ সৎকাজ অপেক্ষা শ্রেয় যা মানুষকে উজুবে পতিত করে।[১৯]

প্রতিকার

ফাইয কাশানির মতে, উজুব হলো এমনই এক ব্যাধি যা মূর্খতা থেকে উৎস লাভ করে, আর যেহেতু তিনি যে কোন (আত্মিক) ব্যাধিকে তার বিপরীত কিছু দিয়ে নিরাময় করা সম্ভব বলে জ্ঞান করেন, তাই উজুবকে কোন বিষয় সম্পর্কে অবগতি ও পরিচিতি অর্জনের মাধ্যমে নিরাময় করা সম্ভব বলে জেনেছেন।[২০] ফাইয কাশানীসহ অপর উলামায়ে আখলাকের মতে, উজুবের মূলোৎপাটনের জন্য এর উৎস ও শেঁকড়ের দিকে মনোযোগী হতে হবে; যদি উজুব সৌন্দর্য্য, ক্ষমতা ও সন্তানের সংখ্যাধিক্য ইত্যাদির ন্যায় মহান আল্লাহ প্রদত্ত কোন নিয়ামতের কারণে হয়ে থাকে তাহলে মানুষের উচিত এ বিষয়টি দৃষ্টিতে রাখা যে, যে আল্লাহ্ তাকে এ নিয়ামত প্রদান করেছেন তিনি চোখের পলকে তা নিয়েও নিতে পারেন। এছাড়া ইতিহাসের ঐ সকল ব্যক্তিদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে যারা বিভিন্ন নিয়ামতের অপব্যবহার করার কারণে সেগুলোকে তাদের থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর যদি উজুবের উৎস ক্ষমতা হয়ে থাকে তাহলে এর প্রতিকারের জন্য মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও মহত্ব সম্পর্কে ভাবা; এছাড়া মানুষ সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে চিন্তা করা যে, তাকে কি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর যদি কারো মাঝে উজুবের উৎপত্তি তার চিন্তা ও বুদ্ধির কারণে হয়ে থাকে তবে তার প্রতিকার হল, সে সর্বদা নিজের মতকে তিরস্কার করবে। তবে যদি তার মতের পক্ষে কুরআন ও হাদিস ভিত্তিক নিশ্চিত কোন যুক্তি ও দলীল থেকে থাকে এবং সে নিজের মতকে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের নিকট উত্থাপন করে সেক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন।[২১]

ইমাম সাদিক (আ.) কর্তৃক জাবের ইবনে ইয়াযিদ জু’ফির উদ্দেশ্যে করা এক ওসিয়তের ভিত্তিতে, নফসকে চেনার (নিজেকে চেনা) মাধ্যমে উজুবের পথ রোধ করা সম্ভব। ((وسُدَّ سبيلَ العُجب بمعرفة النفس))[২২]


[নোট: যদি কেউ নিজের কৃতকর্মে সন্তুষ্ট হয়, কিন্তু সেই কর্মকে সে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত বলে গন্য করে এবং তা হরণ হওয়ার ভীতিও তার মাঝে থাকে তবে তা উজুব (আত্মমুগ্ধতা) নয়। (আল-মুহাজ্জাতুল বাইদা, মুআসসিসাতুন নাশরিল ইসলামি, খণ্ড ৬, পৃ. ২৭৬।)]