ইমাম মাহদীর (আ.) বিবাহ

ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিবাহ (আরবি: زواج الإمام المهدي (ع)) হযরত মাহদী (আ.ফা.) সম্পর্কে বিতর্কিত বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম। হযরত মাহদী (আ.)-এর বিবাহের বিষয়টি সমর্থনকারীরা উক্ত বিষয়টি প্রমাণের জন্য এমন রেওয়ায়েতকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন, যেখানে তাঁর বংশধরদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তদ্রুপভাবে, তাদের দৃষ্টিতে বিবাহ হচ্ছে মহানবির (স.)-এর অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ সুন্নত (সুন্নত-এ মুয়াক্কাদা); সুতরাং ইমাম মাহদী তার প্রতি আমল করেছেন। ভিন্নমত পোষণকারীরা আবার হযরত মাহদি’র বিবাহকে গায়বাত তথা অন্তর্ধানের দর্শনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ জ্ঞান করেন। কেউ কেউ আবার মনে করেন যদিওবা ইমাম মাহদী’র (আ.ফা.) বিবাহ একটি সম্ভাব্য বিষয় তবে এই বিষয়ে সুনিশ্চিতভাবে মতামত প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ সাদর, মুহাদ্দেস নূরী (মৃত্যু:১৩২০ হি.) এবং আলী আকবর নেহাভান্দি (মৃত্যু: ১৩৬৯ হি.) ইমাম মাহদী’র বিবাহের অন্যতম সমর্থক। এই আলোচনাটি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ সাদর (মৃত্যু: ১৯৯৭-৯৮ সন) কর্তৃক রচিত তারিখুল গায়বাতুল কুবরা গ্রন্থে প্রথম বার বিশ্লেষণমূলকভাবে উত্থাপিত হয়েছে।

আলোচনার ইতিহাস

ইমাম মাহদী (আ.) গায়বাত তথা অন্তর্ধানকালীন সময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন কিনা সে ব্যাপারে শিয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মতপার্থক্য বিদ্যমান। দানেশনামে-এ ইমাম মাহদি (আ.ফা.) গ্রন্থের উল্লেখানুসারে, এই আলোচনাটি বিংশ শতাব্দীতে গুরুতরভাবে উত্থাপিত হয়েছে। আর প্রথম যে গ্রন্থটি বিশ্লেষণমূলকভাবে ইমাম মাহদী’র (আ.ফা.) বিবাহ সংক্রান্ত আলোচনা করেছে, সেটি হচ্ছে সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ সাদর (মৃত্যু: ১৯৯৭-৯৮ সন) রচিত তারিখুল গায়বাতুল কুবরা। অবশ্য এর পূর্বে মুহাদ্দেস নূরী রচিত নাজমুস সাকিব এবং আলী আকবার নেহাভান্দি রচিত আল-আবকারিয়্যুল হিসান গ্রন্থগুলোতেও এই বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এবং বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থে “খুলাফা আল-মাহদি ওয়া আউলাদিহি ওয়া মা ইয়াকুনু বা’দুহু আলাইহি ওয়া আলা আবায়িহিস সালাম” নামক একটি অধ্যায় রয়েছে।

মতবাদসমূহ

ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে তিন ধরনের মতবাদ বিদ্যমান রয়েছে:

সহমত পোষণকারীরা

সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ সাদর, মুহাদ্দেস নূরী এবং আলী আকবার নেহাভান্দি ইমাম মাহদী’র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার বিষয়টিকে মেনে নিয়েছেন। একইভাবে, দানেশনামে-এ ইমাম মাহদী গ্রন্থে আল্লামা মাজলিসীও এমন বিশ্বাস পোষণ করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দলটির দলিলসমূহ নিম্নরূপ:

• বিবাহ হচ্ছে মহানবি (স.)-এর সুন্নত এবং ইমাম মাহদী (আ.) হচ্ছেন সুন্নত পালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি, সুতরাং গায়বাতের সময় তিনি এই সুন্নতের প্রতি আমল করেছেন।
• হাদীস ও যিয়ারত ইমাম মাহদী’র (আ.ফা.) সন্তান থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে। দানেশনামে-এ ইমাম মাহদি গ্রন্থে এ সম্পর্কে চৌদ্দটি রেওয়ায়েত সংকলিত হয়েছে।যেমন ঐগুলো ‘হাদীস-এ ওয়াসিয়াত’ হিসেবে প্রসিদ্ধ; উক্ত হাদীস অনুসারে, ইমামে যামানার (আ.ফা.) পর তার বংশধারা থেকে ‘বারো মাহদি’ (ইমাম মাহদী’র পর ১২ জন শাসক) হুকুমত করবেন। অবশ্য আল্লামা মাজলিসীর ভাষ্য অনুযায়ী, এই রেওয়ায়েত মশহুরের (প্রসিদ্ধ) বিপরীত, অনুরূপভাবে, বারো মাহদী’র উদ্দেশ্য হতে পারে মহানবি (স.) এবং হযরত মাহদি ব্যতীত শিয়াদের বাকী ইমামগণ (আ.)। দলিল হিসেবে এই দলটির উদ্ধৃত রেওয়ায়েতসমূহের একটি হচ্ছে ইমাম সাদিক (আ.) হতে বর্ণিত; যেখানে ইমাম মাহদী (আ.) তাঁর পরিবার ও সন্তান-সন্ততি সহকারে মসজিদে সাহলা-তে অবতীর্ণ হবেন বলে ইশারা করা হয়েছে। ইমাম মাহদী’র বিবাহের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণকারীদের অভিমত হচ্ছে, যদি এই হাদীসগুলোকে মেনেও নেওয়া হয়, তবুও ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর স্ত্রী ও সন্তান সংক্রান্ত বিষয়টি তাঁর আবির্ভাব বা আত্মপ্রকাশের পরের সাথে সম্পর্কিত।
• খাযরা দ্বীপে ইমামে যামানার (আ.ফা.) পরিবারের জীবন যাপন সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন। অবশ্য কিছু কিছু শিয়া পণ্ডিত খাযরা দ্বীপকে মিথ্যা ও কাল্পনিক জ্ঞান করেন।

ভিন্নমত পোষণকারী

ইমাম মাহদী’র বিবাহ সম্পন্নের বিরোধীতারীদের দলিলসমূহ নিম্নরূপ:

• অন্তর্ধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া: এরা ইমাম মাহদি’র অন্তর্ধানের দর্শন হিসেবে তাঁর পর্দার আড়ালে থাকা এবং মানুষের কাছে অপরিচিত হওয়াকে জ্ঞান করেন। আর এই দর্শনের সাথে বিবাহ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, কারণ বিবাহ পরিচিত হওয়ার কারণ হয়।
• যে সব রেওয়ায়েত থেকে বুঝা যায় যে ইমামে যামানার (আ.ফা.) কোন সন্তান নেই।
• ইমাম মাহদী (আ.)-এর প্রতিনিধি ও ওয়াকিলগণের ইঙ্গিত না থাকা: যদি ইমাম মাহদী (আ.) বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন তবে তাঁর প্রতিনিধি ও ওয়াকিলগণ গায়বাতে সোগরা তথা স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময় বিবাহ, স্ত্রী ও সন্তানদের ব্যাপারে ইঙ্গিত দিতেন।

নীরবতা

দানেশনামেয়ে ইমাম মাহদী (আ.ফা.) গ্রন্থে যেমনভাবে এসেছে যে, ইমাম মাহদী’র বিবাহের পক্ষে সহমত পোষণকারী ও ভিন্নমত পোষণকারীদের দলিলগুলো পারস্পরিকভাবে সাংঘর্ষিক; এ কারণে ঐগুলোর মাধ্যমে একটা ঐতিহাসিক বিষয়কে স্পষ্ট করা সম্ভব নয়। ইসলামী ইতিহাসের গবেষক সাইয়্যেদ জাফর মুর্তাযা আমেলি (মৃত্যু: ১৪৪১ হি.) মনে করেন, ইমাম মাহদী’র সন্তান থাকার বিষয়টি সন্দেহজনক এবং এ বিষয়ে সুনিশ্চিত মতামত প্রদান করা যাবে না।এছাড়াও বিশিষ্ট মারজা-এ তাক্বলীদ আয়াতুল্লাহ সাফি গুলপাইগানির (মৃত্যু: ২০২২ সন) ভাষ্যানুসারে, হতে পারে হযরত মাহদী’র বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে, তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার মতো কোন গ্রহণযোগ্য হাদীস পাওয়া যায় নি।