আহলে সুন্নাতের সম্মানজনক নিদর্শনসমূহের অবমাননা হারাম হওয়ার ফতওয়া

wikishia থেকে

আহলে সুন্নাতের সম্মানজনক নিদর্শনসমূহের অবমাননা হারাম হওয়ার ফতওয়াটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী দিয়েছেন। তিনি এতে আহলে সুন্নাতের কাছে সম্মানিত বলে গণ্য যেকোনো ব্যক্তি ও নিদর্শনের প্রতি অবমাননাকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন। ইয়াসির হাবিব নামের কুয়েতী একজন শিয়া আলেম মহানবির (আ.) স্ত্রী আয়েশার প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য করলে সৌদির একদল শিয়া আলেম আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর কাছে এ বিষয়ে নির্দেশ জানতে চাইলে তিনি এ ফতওয়া দেন।

আহলে সুন্নাতের সম্মানজনক নিদর্শনসমূহের অবমাননা হারাম হওয়ার ফতওয়াটি আরবি সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। অনেক শিয়াসুন্নি ব্যক্তিত্ব এ ফতওয়াটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের পক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে মূল্যায়ন করেছেন।

প্রেক্ষাপট

আহলে সুন্নাতের সম্মানজনক নিদর্শনসমূহের অবমাননা হারাম ঘোষণার ফতওয়াটি কুয়েতী শিয়া আলেম ইয়াসির হাবিব কর্তৃক আল্লাহর রাসূলের (সা.) স্ত্রী আয়েশার প্রতি অশালীন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেয়া হয়েছে। ইয়াসির হাবিব বেশ কয়েকবার আয়েশাউমর বিন খাত্তাবের বিষয়ে- যারা আহলে সুন্নাতের কাছে বিশেষ সম্মানীয় বলে বিবেচিত- অবমাননাকর কথা বলেছে। সে ১৩৮৯ ফার্সি সালে লণ্ডনে মহানবির (সা.) স্ত্রী আয়েশার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন করে। এ অনুষ্ঠানে সে আয়েশার প্রতি অশোভন মন্তব্য করে। এ অনুষ্ঠানটি ইয়াসির হাবিবের নিজস্ব স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ফাদাক থেকে প্রচরিত হয়। সে দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাবের মৃত্যুবার্ষিকীতেও অনুরূপ উৎসবের আয়োজন করে এবং তা ঐ টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়।

ইয়াসির হাবিবের এরূপ অবমাননাকর মন্তব্যে আহলে সুন্নাতের অনুসারিরা ক্ষিপ্ত হয় ও এর প্রতিবাদ জানায়। তার এ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য কাজে মুসলিম বিশ্বে বিশেষত সুন্নি দেশগুলোতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর ফলে সৌদি আরব ও কুয়েতের শিয়াদের প্রচুর সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। ইয়াসির হাবিবের এ কথার প্রতিক্রিয়ায় সৌদি মুফতি আবদুল আযিয আলে শেইখ মন্তব্য করে যে, ইয়াসির হাবিবের এ কর্ম শিয়াদের অভ্যন্তরীণ প্রকৃত রূপকে প্রকাশ করে দিয়েছে এবং এটা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নিয়ামত; কারণ এর ফলে মুসলিম ও আরব বিশ্বে শিয়া মাযহাবের প্রচার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এ ঘটনাগুলো ঘটার পর সৌদি আরবের শিয়া আলেমরা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও অন্যতম শিয়া মার্জায়ে তাকলিদ আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর নিকট এ বিষয়ে ফতওয়া জানতে চায়। তারা এক্ষেত্রে তাঁর কাছে আয়েশার প্রতি অবমাননা ও তার সম্পর্কে অশালীন ও অপমানজনক মন্তব্য করার বিষয়ে শিয়া ফিকহী দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করার আহ্বান জানান।

ফতওয়ার পাঠ্যাংশ (টেক্সট)

আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী মহানবির (সা.) স্ত্রী আয়েশার অবমাননার বিষয়ে সৌদি আরবের ইহছা অঞ্চলের শিয়া আলেমদের প্রশ্নের জবাবে ১৩৮৯ ফার্সি সালের মেহের মাসের ৮ তারিখে দেয়া ফতওয়ায় বলেন, ‘আহলে সুন্নাতের ভাইদের কাছে সম্মানীয় সকল প্রকার নিদর্শনের অসম্মান যেমন মহানবির (সা.) স্ত্রী আয়েশার প্রতি অবমাননা করা হারাম। সকল নবির স্ত্রীদের অবমাননা বিশেষত সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মাদের (সা.) স্ত্রীদের অবমাননাও এ নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।’(দৈনিক রেসালাত, ১১ মেহর ১৩৮৯ফার্সি সাল, পৃ. ৩)

এ ফতওয়ার প্রতি সাড়া ও প্রতিক্রিয়া

আহলে সুন্নাতের সম্মানজনক নিদর্শনসমূহের অবমাননা হারাম ঘোষণার ফতওয়াটি আরব বিশ্বে ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও মিডিয়াতে ব্যাপক সাড়া ফেলে। উদাহরণস্বরূপ: কুয়েতের দৈনিক ‘আল আম্ব ‘ ও ‘আর রাইউল আম’ পত্রিকা ও ‘আল মুহিত’ ওয়েবসাইট, লেবাননের দৈনিক ‘আস সাফির’ ও ‘আল ইনতিকাদ’ পত্রিকা, সৌদি আরবের দৈনিক ‘আল ওয়াতান’ ও ‘আল উকায’ পত্রিকা, লণ্ডন থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘আলহায়াত’ পত্রিকা ও মিশরের দৈনিক ‘আশ শুরুক’ পত্রিকা সহ আরো অন্যান্য রেডিও, টেলিভিশন ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং আরব বিশ্বের বেশ কিছু স্যাটিলাইট চ্যানেল এ ফতওয়াটি উল্লেখ ও এর ওপর আলোচনা-পর্যালোচনা করে।

‘আল জাযিরা’ টিভি চ্যানেল ‘মা ওয়ারায়াল খাবার’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে কয়েকজন পর্যালোচক ও বিশেষজ্ঞের উপস্থিতিতে মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন মাযহাবের অনুসারিদের পারস্পরিক নৈকট্য স্থাপন ও ঐক্যের পথে এ ফতওয়ার গুরুত্ব ও ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়।

আরব দেশগুলোর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই এ ফতওয়ার গুরুত্ব ও ইতিবাচক ভূমিকার কথা বলেছেন। আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ‘আহমাদ আত তাইয়্যেব’ এক বাণীতে মন্তব্য করেন: ‘এ ফতওয়াটি খুবই সময়োচিত হয়েছে। এটা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পথ রোধ করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। নিঃসন্দেহে এ ফতওয়া মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির তীব্র আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষার পরিচয় বহন করে। লেবাননের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের অনেকেই এ ফতওয়ার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে একে ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎকারী বলে অভিহিত করেছেন। লেবাননের হিযবুল্লাহর মহাসচিব হাসান নাসরুল্লাহ এ ফতওয়াকে ঐ সকল ব্যক্তির প্রচেষ্টাকে ব্যর্থকারী বলেছেন যারা চায় মুসলিম উম্মাহর ঐক্যতে ফাটল ধরিয়ে ফায়দা লুটতে। লণ্ডনের ইসলমিক সেন্টারে অনুষ্ঠিত ‘ইসলামী মাযহাবগুলোকে নৈকট্যে আনয়ন’ শীর্ষক চতুর্থ কনফারেন্সের চূড়ান্ত বিবৃতিতে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর ফতওয়ার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পার্লামেন্টের আহলে সুন্নাত সদস্যদের একাংশ তাদের বিবৃতিতে এ ফতওয়াকে আহলে সুন্নাতের জন্য গর্ব ও প্রশান্তির কারণ বলে বিবেচনা করেছেন। ইরানের গুলিস্তান প্রদেশের আহলে সুন্নাতের আলেমরা স্বতন্ত্র এক বিবৃতিতে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর ফতওয়াকে তাঁর উন্নত চিন্তা ও কর্মেরই প্রতিফলন বলে অভিহিত করেছেন যা কখনই শত্রুদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ দেয়না।

তথ্যসূত্র


গ্রন্থপঞ্জি