বিষয়বস্তুতে চলুন

হেরয্ বা তাবিজ

wikishia থেকে
হেরযে ইমাম জাওয়াদ (আ.)

হেরয্ বা তাবিজ (আরবি: حِرْز یا تَعْویذ); হলো, শত্রুর অনিষ্টতা থেকে সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত কুরআনের বিশেষ আয়াত, যিকর এবং দোয়া। শিয়া হাদিস সূত্রে দোয়া সংবলিত তাবিজগুলি সম্পর্কে বর্ণিত প্রভাবের কারণে বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। আয়াতুল কুরসি এবং আয়াতুল ওয়া ইনয়াকাদু (وَإِن یکادُ الَّذِینَ کفَرُ‌وا لَیزْلِقُونَک بِأَبْصَارِ‌هِمْ لَمَّا سَمِعُوا الذِّکرَ‌ وَیقُولُونَ إِنَّهُ لَمَجْنُونٌ وَمَا هُوَ إِلَّا ذِکرٌ‌ لِّلْعَالَمِینَ) হলো তাবিজের জন্য ব্যবহৃত আয়াতগুলোর অন্যতম। ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর তাবিজ এবং ইয়েমেনী তাবিজ দোয়া সংবলিত প্রসিদ্ধ তাবিজগুলির মধ্যে অন্যতম। উসুলে-কাফি এবং মুহাজুদ্-দাওয়াআত গ্রন্থে চৌদ্দ মাসুম থেকে উদ্‌ধৃত দোয়াগুলো একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে সংগ্রহ করা হয়েছে।

ইসলাম ছাড়াও অন্যান্য ধর্ম ও জাতির মধ্যে তাবিজ এবং এর প্রভাবের প্রতি বিশ্বাস বিদ্যমান। ইসলাম ধর্মে, কুসংস্কারপূর্ণ তাবিজ প্রত্যাখ্যান করে আয়াত এবং দোয়া কেন্দ্রিক তাবিজের বিধান করা হয়েছে। কিছু ফিকাহবিদের মতে, অজানা জিনিস দিয়ে তৈরি তাবিজ ব্যবহার করা জায়েজ নয়।

হেরয্ বা তাবিজের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ

হেরয্ বা তাবিজ হলো, কুরআনের আয়াত, বিভিন্ন যিকর্ এবং দোয়া যা শত্রু ও জন্তু-জানোয়ারের অনিষ্টা বা বদনজর থেকে সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়।[] কিছু ক্ষেত্রে, এসব দোয়া কোন কিছুতে লিখে ব্যক্তির সাথে (বাহুতে বা গলায়) রাখা হয় অথবা কোনও জায়গায় (যেমন বাড়ির দরজায়) ঝুলিয়ে রাখা হয়।[] কিছু হেরয্ দোয়া বা যিকির সংবলিত নয় এবং লোহা, হরিণের চামড়া বা নির্দিষ্ট গাছের পাতার মতো জিনিস দিয়ে তৈরি।[] কথিত আছে যে, তাবিজ ব্যবহারের মূল কারণ ছিল বদনজর প্রতিরোধ করা।[]

কতিপয় ইসলামি গবেষকের মতে, হেরয্ এবং তাবিজের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই এবং এই দুটি শব্দের প্রতিটিই পরস্পর জায়গায় ব্যবহৃত হয়।[] কিছু হাদিস গ্রন্থে হেরয্ এবং তাবিজ একই অধ্যায়ে এবং একই সারিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অন্য একদল গবেষকের মতে, হেরয্ এবং তাবিজের মধ্যে পার্থক্য খুব স্পষ্ট না হলেও, এদুটিকে একই জিনিস বিবেচনা করা যায় না।[] তারা আরও বলেছেন যে, সময়ের ব্যবধানে হেরয্ এর অর্থের পরিবর্তন হয়েছে এবং কিছু সময়ে এটি তাবিজের সমার্থক হয়ে উঠেছে এবং অন্য সময়ে এটি যাদু অর্থের কাছাকাছিও হয়েছিল।[] "তামিমা"[] "হাইকাল" এবং "হামায়িল" হল তাবিজের সাথে সম্পর্কিত শব্দ যা এর মতো কাজ করে।

ইসলামে হেরয্ এর গুরুত্ব

দোয়া সংবলিত হেরয্গুলো প্রকৃত অর্থে দোয়ার অংশ, যেগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং প্রভাবের কারণে সর্বদা আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পবিত্র কুরআনে হেরয্ শব্দটির উল্লেখ নেই; কিন্তু শিয়া-সুন্নি উভয়সূত্রে এটি অসংখ্য হাদিসে এসেছে।[] আয়াতুল কুরসি এবং 'ওয়া ইন ইয়াকাদ (آیهٔ وَ اِن یَکاد...) আয়াতগুলি হেরয্ এর জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এগুলো আয়াতুল হেরয্ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।[১০] কুলাইনী (মৃত্যু ৩২৯ হিজরী) তাঁর আল-কাফি[১১] গ্রন্থে এবং সাইয়্যিদ ইবনে তাউস (মৃত্যু ৬৬৪ হিজরী) তার মুহাজ্জুদ্ দাওয়া'ত গ্রন্থে চৌদ্দ মাসুম থেকে বর্ণিত দোয়া সংবলিত হেরয্গুলোকে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে সংগ্রহ করেছেন।[১২]

সাফিনাতুল বাহার গ্রন্থে শেইখ আব্বাস কুম্মির (মৃত্যু ১৩৫৯ হিজরী) বর্ণনা অনুযায়ী, মহানবী (সা.) ইমাম হাসানাইনের জন্য মুয়াভ্ভাযাতাইন (مُعَوِّذَتَیْن) পাঠ করতেন।[১৩] প্রসিদ্ধ হেরয্ বা তাবিজের মধ্যে রয়েছে, হেরযে ইমাম জাওয়াদ (সা.), হেরযে ইয়ামানী, হেরযে আবু দাজানা এবং হেরযে ইয়াসিন[১৪]

ইসলামবিদদের মতে, হেরয্ এর সত্যতা বা অসাড়তার দিকে মনোযোগ না দিলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। অতএব, বলা হয়েছে যে, কেবলমাত্র মাসুম বা নিষ্পাপ ব্যক্তিদের থেকে বর্ণিত হেরয্ ব্যবহার করা এবং যে হেরয্ এর হাদিস ভিত্তিক উৎস নেই তা এড়িয়ে চলা উচিত।[১৫] সাইয়্যেদ আলী লাওয়াসানী রচিত "মাসুমিনদের হেরয্সমূহ" গ্রন্থটি মাসুমিনদের থেকে বর্ণিত হেরয্ বিষয়ের উপর লেখা বইগুলির মধ্যে একটি।[১৬] ৪৮৮ পৃষ্ঠার এই বইটি ১৪০১ (সৌরবর্ষ) সালে ‘দার আল-সিবতাইন’ প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল।[১৭]

সাইয়্যেদ আলী লাওয়াসানী রচিত "মাসুমিনদের হেরয্সমূহ" গ্রন্থ

পটভূমি

হেরয্ ও তাবিজ এবং এর প্রভাবের প্রতি বিশ্বাস ইসলামের অবিসংবাদিত শিক্ষার মধ্যে একটি বলে বিবেচিত হয়; তবে, এটি কেবল ইসলামের জন্য নির্দিষ্ট নয় এবং এই বিশ্বাস অন্যান্য ধর্ম[১৮] এবং জাতিগুলিতেও বিদ্যমান।[১৯] কিছু হাদিসে, অন্যান্য ধর্মেও হেরয্ পড়া বা গলায় ঝুলানো কথা বর্ণিত হয়েছে।[২০] কিছু আলেমের মতে, ইসলাম জাহেলি যুগের তাবিজগুলিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, যা কুসংস্কারে কলঙ্কিত ছিল এবং পরিবর্তে এমন তাবিজ প্রবর্তন করেছিল যাতে প্রায়শই কুরআনের আয়াত এবং তাওহিদ ভিত্তিক দোয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল।[২১]

শারয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে তাবিজের বৈধতা

কিছু ইসলামবিদ, হেরয্ এবং তাবিজ সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি হাদিস পর্যালোচনা করার পর, কিছু হেরয্ কে সহিহ বলে মনে করেছেন এবং বাকিগুলোকে বাতিল বলে মনে করেছেন।[২২] জা'ফর কাশিফ আল-গিতার মতে, কুরআনের আয়াত, যিকর্ এবং চৌদ্দ মাসুম থেকে বর্ণিত হাদিসের উপর ভিত্তি করে তাবিজ ব্যবহার করা জায়েজ; তবে, অজানা বস্তুর উপর ভিত্তি করে তাবিজ ব্যবহার করা জায়েজ নয়।[২৩]

তথ্যসূত্র

  1. ইবনে সিনা, কুনুযুল মুয়াযযামিন, তাছহিহ-জালালুুদ্দিন হুমায়ী, আঞ্জুমানে আসারে মিল্লি, পৃ: ৭৬।
  2. ইবনে সিনা, কুনুযুল মুয়াযযামিন, তাছহিহ-জালালুুদ্দিন হুমায়ী, আঞ্জুমানে আসারে মিল্লি, পৃ: ৭৬।
  3. ইবনে সিনা, কুনুযুল মুয়াযযামিন, তাছহিহ-জালালুুদ্দিন হুমায়ী, আঞ্জুমানে আসারে মিল্লি, পৃ: ৭৪।
  4. আরাবেস্তানী, তাবিজ, পৃ: ৬৩৫।
  5. তাবাতাবায়ী, হেরয্, পৃ: ১১।
  6. শেইখ কুলাইনী, উসুলে কাফি, তেহরান, ১৪০৭ হি., খ: ২, পৃ: ৫৬৮-৫৭৩ ও মাজলেসী, মিরয়াতুল উকুল, ১৪০৪ হি., খ: ১২, পৃ: ৪৩৬।
  7. খানী, সেইরে তাহাভ্যুলে মাফহুমে হেরয্ দার ফারহাঙ্গে ইসলামি, ১৪৯০ (ফার্সি সন), পৃ: ৭১-৭৮।
  8. ইবনে সিনা, কুনুযুল মুয়াযযামিন; তাছহিহ-জালালুুদ্দিন হুমায়ী, তেহরান, আঞ্জুমানে আসারে মিল্লি, পৃ: ৮২।
  9. তাবাতাবায়ী, হেরয্, পৃ: ১২।
  10. তাবাতাবায়ী, হেরয্, পৃ: ১২।
  11. শেইখ কুলাইনী, উসুলে কাফি, তেহরান, ১৪০৭ হি., খ: ২, পৃ: ৫৬৮-৫৭৩।
  12. সাইয্যেদ ইবনে তাউস, মুহাজু আদ্-দাওয়াত ওয়া মানহাজুল ইবাদাত, ১৪১১ হি., পৃ: ৩-৪৫।
  13. কুম্মী, সাফিনাতুল বিহার, ১৪১৪ হি., খ: ৬, পৃ: ৫৪২।
  14. খানী, সেইরে তাহাভ্যুলে মাফহুমে হেরয্ দার ফারহাঙ্গে ইসলামি, ১৪৯০ (ফার্সি সন), পৃ: ৬৬।
  15. মাসউদী, مقاله حرز از دایرة المعارف قرآن لیدن», পৃ: ১৪২।
  16. লাওয়াসানী, মাসুমিনদের হেরয্সমূহ, ১৪০১ (ফার্সি সন), শেনাসনামা কিতাব।
  17. লাওয়াসানী, মাসুমিনদের হেরয্সমূহ, ১৪০১ (ফার্সি সন), শেনাসনামা কিতাব।
  18. আগা গুলিযাদেহ, বাররাসিয়ে সানাদি ও মাতনিয়ে রেওয়ায়াতে হেরয্ ও তাবজি, ১৩৯০ (ফার্সি সন), পৃ: ১৯।
  19. ইবনে সিনা, কুনুযুল মুয়াযযামিন, তাছহিহ-জালালুুদ্দিন হুমায়ী, আঞ্জুমানে আসারে মিল্লি, পৃ: ৭৭।
  20. শেইখ কুলাইনী, উসুলে কাফি, ১৪০৭ হি., খ: ২, পৃ: ৫৬৯।
  21. ইবনে সিনা, কুনুযুল মুয়াযযামিন, তাছহিহ-জালালুুদ্দিন হুমায়ী, আঞ্জুমানে আসারে মিল্লি, পৃ: ৭৮।
  22. আগা গুলিযাদেহ, বাররাসিয়ে সানাদি ও মাতনিয়ে রেওয়ায়াতে হেরয্ ও তাবজি, ১৩৯০ (ফার্সি সন), পৃ: ২১৫-২১৮।
  23. কাশিফুল গিতা, কাশফুল গিতা, ১৪২২ হি., খ: ৩, পৃ: ৪৬০।

গ্রন্থপঞ্জি

  • আগা গুলিযাদেহ, যাইনাব, বাররাসিয়ে সানাদি ও মাতনিয়ে রেওয়ায়াতে হেরয্ ও তাবজি, মাশহাদ, দানশকাদেহ ইলাহিয়্যাত ও মায়ারেফে ইসলামি, ১৩৯০ (ফার্সি সন)।
  • ইবনে সিনা, হুসাইন বিন আব্দুল্লাহ, কুনুযুল মুয়াযযামিন; তাছহিহ-জালালুুদ্দিন হুমায়ী, তেহরান, আঞ্জুমানে আসারে মিল্লি...
  • ইসবাতি, ইসমাইল, و بررسی حرز منسوب به امام جواد(ع) উলুমে কুরআন ও হাদিস ম্যাগাজিন, সংখ্যা-১০৮, ১৪০১ (ফার্সি সন)।
  • খানী, হামেদ, সেইরে তাহাভ্যুলে মাফহুমে হেরয্ দার ফারহাঙ্গে ইসলামি, পেজুহেশনামা তারিখে তামাদ্দুনে ইসলামি, সংখ্যা-০১, ১৪৯০ (ফার্সি সন)।
  • সাইয্যেদ ইবনে তাউস, মুহাজু আদ্-দাওয়াত ওয়া মানহাজুল ইবাদাত, কোম, দারুয্ যাখায়ের, ১৪১১ হি.।
  • তাবাতাবায়ী, সাইয্যেদ কাযেম, [১] দানশনামা জাহানে ইসলাম (খ: ১৩), তেহরান, বুনিয়াদে দায়েরাতুল মায়ারেফে ইসলামি, ১৩৮৮ (ফার্সি সন)।
  • আরাবেস্তানী, ‍মেহরদাদ, [২] দায়েরাতুল মায়ারেফে ‍বুজুর্গে ইসলামি (খ: ১৫), তেহরান, মার্কাযে দায়েরাতুল মায়ারেফে বুজুর্গে ইসলামি, ১৩৮৭ (ফার্সি সন)।
  • কুম্মী, শেইখ আব্বাস, সাফিনাতুল বিহার, কোম, উসওয়াহ, ১৪১৪ হি.।
  • কাশিফুল গিতা, জাফর বিন খিযর্, কাশফুল গিতা, কোম, বুস্তানে কিতাব, ১৪২২ হি.।
  • শেইখ কুলাইনী, মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব, উসুলে কাফি, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪০৭ হি.।
  • লাওয়াসানী, সাইয্যেদ আলী, মাসুমিনদের হেরয্সমূহ, কোম, দারু আস্-সিবতাইন, ১৪০১ (ফার্সি সন)।
  • মাজলেসী, মুহাম্মাদ বাকের, মিরয়াতুল উকুল, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪০৪ হি.।
  • মাসউদী, মুহাম্মাদ মাহদি, مقاله حرز از دایرة المعارف قرآن لیدن» কুরআন পেজুহিয়ে খাওয়ারশেনাসান ম্যাগাজিন, সংখ্যা-১১, ১৩৯৫ (ফার্সি সন)।