হারেসা বিন নোমান

হারেসা বিন নোমান (আরবি:حارثة بن النعمان) (মৃত্যু: ৫০ হিজরী) মহানবি (স.) এবং ইমাম আলী (আ.)-এর একজন সাহাবী। তিনি বদর, ওহুদ, হুনায়েন এবং ইমাম আলী (আ.)-এর হুকুমতের সময় সংঘটিত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হারেসা নিজের ঘরগুলোকে মহানবি (স.)-কে হাদিয়া দেন, যেন নবী করিম (স.) তারঁ স্ত্রীদের নিয়ে সেখানে বসবাস করতে পারেন। এছাড়াও তিনি ইমাম আলী (আ.) ও ফাতেমা (সা. আ)-এর বসবাসের জন্য একটি ঘর রাসুলুল্লাহ (স.)-কে হাদিয়া হিসেবে প্রদান করেন। তিনি জিব্রাইল (আ.)-কে দাহিয়ে কালবী’র রূপে দেখতে পান এবং তাকে সালাম করেন। হাসীদের সূত্রগুলোতে হারেসা মারফত রাসুল (স.) হতে হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

অবস্থান ও তাৎপর্য

হারেসা বিন নোমান ছিলেন রাসুলুল্লাহ (স.) এবং ইমাম আলীর (আ.) সাহাবী। তিনি মহানবির (স.) সাথে বদর,ওহুদ, হুনায়েন ও অন্যান্য যুদ্ধগুলোতে অংশগ্রহণ করেন। শেইখ তুসীর ভাষ্য মতে, তিনি ইমাম আলী (আ.)-এর হুকুমতের সময়কার যুদ্ধগুলোতে ইমামের পাশেই উপস্থিত ছিলেন। হারেসা হল এমন এক সাহাবী; যে কিনা হুনায়েনের যুদ্ধে মুশরিকদের আকস্মিক হামলার মুখে কিছু সংখ্যক মুসলমান পালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও রাসুল (স.)-এর পাশেই অবস্থান করেন এবং প্রতিরোধ করেন।

হাদীস বর্ণনায় তার অবস্থান

হারেসা ছিলেন হাদীস বর্ণনাকারীদের একজন। কথিত আছে, হাদীস, রেজাল ও ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহ যেমন: মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বাল, কিতাবুল মাগাযি, আল-মু’তালিফ ওয়াল মুখতালিফ গ্রন্থে তার বর্ণনাগুলো এসেছে। আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস, আব্দুল্লাহ বিন আমের বিন রাবিয়া’হ এবং সা’লাবাহ বিন আবি মালেক তার বরাত দিয়ে রাসুল (স.) হতে রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন।

জিব্রাইলকে দেখা

সাহাবীদেরকে নিয়ে রচিত সূত্রসমূহে হারিসাকে শ্রেষ্ঠ সাহাবীদের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শেইখ তুসী’র মতে, তিনি দুই বার হযরত জিব্রাইল আমিনকে দাহিয়ে কালবী'র রূপে দেখতে পেয়েছেন এবং সালাম করেছেন। একইভাবে, ইবনে আব্দুল বার আল-ইস্তিআ’ব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মায়ের প্রতি সম্মান ও মায়ের সেবা করার কারণেই হারেস এমন মহৎ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন।

মহানবি (স.)-কে ঘর হাদীয়া

হারেসাকে সর্বপ্রথম ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যিনি মদীনাতে মহানবিকে (স.) হাদীয়া হিসেবে ঘর দান করেছিলেন। হিজরী তৃতীয় শতকের ইতিহাসবিদ ইবনে সা’দের মতে, হারেসার ঘরগুলো ছিল হযরত রাসুল (স.) এর ঘরগুলোর সন্নিকটে। রাসুলুল্লাহ (স.) যখনই নতুন বিবাহ করতেন তখন হারিসা তার থাকার ঘরটি রাসুল (স.)-কে দিয়ে পরের ঘরে চলে যেতেন, এভাবে পর্যায়ক্রমে তিনি নিজের সমস্ত ঘর হাদীয়া হিসেবে নবী করিম (স.)-কে দান করেন, যাতে তিনি (স.) স্ত্রীদের নিয়ে বসবাস করতে পারেন। যেমন, এগুলোর মধ্যে প্রথম ঘরটি ছিল মারিয়ার, তাছাড়াও তারমধ্যে আরও ঘর ছিল যা নবী (স.) সাফিয়াকে দেন এবং হযরত আয়েশা ও আনসার নারীরা তাকে দেখতে ঐ ঘরে যেতেন। নবী করিম (স.) ও মুহাজেরিনদেরকে ঘর দান করায় রাসুলুল্লাহ (স.) হারেসার জন্য দোয়া করেন।

হযরত আলী (আ.) ও ফাতেমার (সা. আ.) বসবাসের জন্য ঘর হাদীয়া

আহলে সুন্নতের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ (মৃত্যু: ৩২০ হিজরী) আল-তাবাকাতুল কুবরা গ্রন্থে ইমাম বাকের (আ.) হতে বর্ণনা করেন যে, হযরত ফাতেমা (সা.আ)-এর সাথে বিবাহের পর ইমাম আলী (আ.) নবী করিম (স.) এর ঘর থেকে একটু দূরে একটি ঘর প্রস্তুত করেন। রাসুল (স.) তখন বলেন, তিনি চান তাঁর কন্যা যেন তারঁর ঘরের কাছেই বসবাস করে। ফাতেমা (সা. আ) মহানবি (স.)-কে এ ব্যাপারে হারেসার সাথে কথা বলতে অনুরোধ করেন যেন তার ঘরে বসবাস করতে পারেন। রাসুল (স.) বলেন, তিনি হারেসার সাথে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে লজ্জাবোধ করছেন, কারণ সে ইতিমধ্যেই কতকগুলো ঘর মহানবি (স.)-কে দান করেছেন এবং এই কারণেই তাকে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থানান্তরিত হতে হয়েছে। হারেসা এই বিষয়টি অবগত হওয়ার সাথে সাথে তার ঘর নবী (স.)-কে দিয়ে দেন। কিছু কিছু শিয়া সূত্রের বর্ণনার ভিত্তিতে, আলী (আ.) ও ফাতেমা (সা. আ.) বিবাহের পর পয়গম্বর (স.)-কে হারেসার দেওয়া ঘরে বসবাস শুরু করেন। সুন্নি ঐতিহাসিক ইবনে শাব্বাহ(মৃত্যু: ২৬২ হি.) উল্লেখ করেন যে, হারেসার বাড়ির অবস্থান ছিল আবু আইয়ুব আনসারীর বাড়ির নিকটে, যা পরবর্তীতে ইমাম সাদিক (আ.)-এর মালিকানায় আসে এবং ইমাম (আ.) ঐ ঘরে বসবাস করতেন। এই ঘরটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় ১৩৬৫ ফার্সি সনে ধ্বংস হয়।

বংশ ও মৃত্যু

হারেস হলেন নোমান বিন নাফ’ বা নাক্ক’ আনসারী খাযরাজী এবং জা’দাহ বিনতে উবাইদ বিন সা’লাবার সন্তান। তার কুনিয়াত হল আবু আব্দুল্লাহ। তিনি ছিলেন বনি নাজ্জার গোত্রের ও মদীনার অধিবাসী। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে তাকে কোন কোন সূত্রে হারিসাহ বিন নোমান আনসারী বদরী হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। কথিত আছে যে, আবুল রেজাল হিসেবে পরিচিত মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান বিন আব্দুল্লাহ বিন হারেসা হলেন তার বংশধরদের একজন।

আহলে সুন্নতের বিশিষ্ট রেজালবিদ ইবনে হিব্বান একটি রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে উল্লেখ করেন যে, হারেসা বদরের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। তবে, মহানবি (স.)-এর সময়ে অন্যান্য যুদ্ধে হারেসার উপস্থিতির কারণে কেউ কেউ ইবনে হিব্বানের মতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইবনে সা’দের মতে, মুয়াবিয়ার খেলাফতকালে হারেসার মৃত্যু হয়েছে বলে ইতিহাসবিদেরা মনে করেন। অবশ্য যাহাবী (মৃত্যু: ৭৪৮ হি.) মনে করেন, তার মৃত্যু হয়েছে ৫০ হিজরীতে।