হাদীসে এ’তেলা

wikishia থেকে

হাদীসে এ’তেলা (আরবি: حدیث اعتلا) সকল ধর্মের উপর ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মুসলমানদের উপর কাফেরদের কর্তৃত্ব নাকচ করা প্রসঙ্গে মহানবি (স.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস। সাইয়্যেদ হাসান বোজনুর্দি’র (১৩৯৫ ফার্সী সন) মত স্কলাররা হাদীসে এ’তেলা’র সনদগত দুর্বলতাকে ‘হাদীসটির প্রসিদ্ধি’ এবং ‘মহানবি (স.) থেকে বর্ণিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া’র মাধ্যমে দূর করা সম্ভব বলে জ্ঞান করে এ হাদিসটিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

হাদীস গবেষকদের একটি দল, হাদিসে এ’তেলার সাথে মুসলমানের উপর কাফেরের আধিপত্যকে নাকচ করার বিষয়টির সাথে সম্পৃক্ততাকে প্রত্যাখ্যান করে এ বিশ্বাস পোষণ করেছেন যে, হাদীসটি বিশেষভাবে অন্য সকল ধর্মের উপর ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে। তবে ‘ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন আহকাম ও আইনের সমষ্টি নিয়ে গঠিত’ -এ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে যখনই ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হবে, এর অর্থ হল মহান আল্লাহ্ আহকাম ও বিধি-বিধানগুলো এমনভাবে তাশরী’ করেছেন যে, সেগুলোর কোনটির ক্ষেত্রেই মুসলমানদের উপর কাফেরদের কোন প্রকার কর্তৃত্ব নেই। হাদিসটির সমর্থনে নাফিয়ে সাবিলের আয়াতটিকে (সূরা নিসা’র ১৪১নং আয়াতের শেষাংশ) প্রমাণ হিসেবে আনা হয়েছে।

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও অবস্থান

হাদীসে এ’তেলা মহানবি (স.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস। শিয়াদের প্রসিদ্ধ ৪ হাদিস গ্রন্থ কুতুবে আরাবায়া’র অন্যতম ‘মান লা ইয়াহদুরুল ফাকীহ’[১] এবং আহলে সুন্নতের সুনানে দারু কুতনী’তে[২] বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটি শেইখ মুফিদসাইয়্যেদ মুর্তাযা’র মত মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।[৩] মুর্তাযা মুতাহহারির (১৩৫৮ ফার্সি সন) ভাষায়, হাদিসটি মহানবি (স.) থেকে বর্ণিত মুতাশাবাহ হাদিসগুলোর একটি; উলামাদের একেক দল বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে হাদিসটির অর্থ করেছেন।[৪]

শেইখ সাদূকের বর্ণনায় হাদীসে এ’তেলা: (اَلأِسلامُ يَعْلُو وَ لا يُعلي عَليْهِ وَ الْكُفّارُ بِمَنْزِلَةِ الْمَوْتي لا يَحْجُبونَ وَ لا يَرِثُونَ) ‘ইসলাম ধর্ম সর্বদা (অন্য ধর্মের তুলনায়) শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন এবং এর উপরে কোন কিছুরই শ্রেষ্ঠত্ব নেই; আর কাফেররা মৃতদের ন্যায় না তারা ইরসের পথে বাধা হতে পারে আর না ইরস গ্রহণ করতে পারে।[৫]

কায়েদায়ে নাফিয়ে সাবিল’ প্রমাণে ফকীহগণ দলীল হিসেবে হাদিসটিকে উপস্থাপন করে থাকেন।[৬] মুসাভি বোজনুর্দির ভাষায় এ হাদিসে মুসলমানের উপর কাফেরের কর্তৃত্বশীল হওয়ার বিষয়টি নাকচ হওয়া ছাড়াও অপর সকল ধর্মের উপর ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টিও প্রমাণিত হয়।[৭]

হাদিসে এ’তেলাকে এমন কিছু আহকাম ও আইনের বর্ণনাকারী হিসেবে জ্ঞান করে থাকেন[৮] যে, এর মাধ্যমে চুক্তি, মালিকানা, কর্তৃত্ব, বিবাহ ইত্যাদিসহ সকল বিষয়ে মুসলমানের উপর কাফেরের কর্তৃত্বশীল হওয়ার বিষয়টি নাকচ করা হয়েছে।[৯]রেওয়ায়েতটিতে একটি প্রমাণসূচক এবং একটি প্রত্যাখ্যানসূচক বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে; দু’টি বাক্যই মুসলমানের উপর কাফেরের কর্তৃত্বশীল হওয়ার বিষয়কে নাকচ করে।[১০]

  1. প্রমাণসূচক বাক্যটিতে (জুমলায়ে ইসবাতি) (یعلو و لایعلی علیه) ইসলাম ধর্মের জন্য স্থিরকৃত বিধি-বিধান ও আইন-কানুন সংশ্লিষ্ট এবং সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।[১১]
  2. প্রত্যাখ্যানসূচক বাক্যের (জুমলায়ে সালবি) (لا يَحْجُبونَ وَ لا يَرِثُونَ) মাধ্যমে বিধি-বিধান ও আইন-কানুনের যে কোন অবস্থাতেই মুসলমানদের উপর কাফেরদের কর্তৃত্বশীল হওয়ার বিষয়টি নাকচ হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।[১২]

সনদের নির্ভরযোগ্যতা ও প্রয়োগ

বলা হয়েছে, সনদে কিছু অস্পষ্টতা থাকার কারণে কেউ কেউ হাদিসে এ’তেলাকে সনগতভাবে যঈফ ও দুর্বল জ্ঞান করেছেন।[১৩] অবশ্য এর বিপরীতে রেওয়ায়েতটির নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ ও এর সনদগত দুর্বলতা দূর করতে ‘হাদীসটির প্রসিদ্ধি’ এবং ‘মহানবি (স.) থেকে বর্ণিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া’কে প্রমাণ হিসেবে এনেছেন অনেকে।[১৪]

এছাড়া, শেইখ সাদূক মারফত শিয়াদের কুতুবে আরবায়া’র অন্যতম গ্রন্থ ‘মান লা ইয়াহদুরুহুল ফাকীহ’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন [১৫] এবং আব্দুল আ’লা সাবযেভারি তাফসিরে মাওয়াহিবুর রাহমান গ্রন্থে নাফিয়ে সাবিলের আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদিসটি উল্লেখ করে একে নির্ভরযোগ্য জ্ঞান করেছেন।[১৬]

হাদিসে এ’তেলাকে কেউ কেউ আবার তাওহিদী ধর্মগুলোর মাঝে ইসলাম ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে পরিচয়কারী হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন: মুসলমানের উপর কাফেরের কর্তৃত্বশীল হওয়ার বিষয়টি নাকচ হওয়ার সাথে রেওয়ায়েতটির কোন সম্পর্ক নেই।[১৭] এর জবাবে বলা হয়েছে, ইসলাম ধর্ম কিছু বিধান ও আইনের সমষ্টি; তাই যখন বলা হবে ‘সকল ধর্মের উপর এর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে’ -এর অর্থ হল আহকাম ও বিধানগুলো- মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এমনভাবে তাশরি’ করা হয়েছে যে, এর কোন ক্ষেত্রেই মুসলমানের উপর কাফের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব রাখতে পারবে না।[১৮]

হাদিসের ব্যবহার

মুর্তাযা মুতাহহারি’র ভাষায়, হাদিসে এ’তেলার ফিকাহ শাস্ত্র, কালাম শাস্ত্র ও সমাজিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্যতা রয়েছে যেমন:

  • ফিকাহ শাস্ত্রে: মুসলমানের উপর অমুসলমানকে প্রধান্য দেবে এমন কোন আইন, বিধান ও আহকাম বিদ্যমান নেই।
  • কালাম শাস্ত্রে: দলীল ও যুক্তি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ইসলামের যুক্তি অপর যেকোন যুক্তির উপর ভারী ও অগ্রগামী হবে।
  • সামাজিক ক্ষেত্রে: মানব জাতির চাহিদার সাথে ইসলাম ধর্মের আইন ও বিধান অপর সকল আইনের চেয়ে অধিক সামঞ্জস্যশীল।[১৯]

নাফি সাবিলের আয়াতের সাথে সম্পর্ক

নাফিয়ে সাবিল সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদিসে এ’তেলা উভয়েই কাফেরের কর্তৃত্বশীল হওয়ার বিষয়টি নাকচ করে।[২০] এ দু’য়ের মাঝে একটি যৌক্তিক সম্পর্কও রয়েছে।[২১]রেওয়ায়েতটিতে মুসলমানের উপর কাফেরের কর্তৃত্বশীল হওয়ার বিষয়টি নাকচ করা হয়েছে এবং আয়াতে মু’মিনের উপর কাফেরের কর্তৃত্বশীল হওয়ার বিষয়টি নাকচ করা হয়েছে। আর পবিত্র কুরআনের ভাষ্যানুযায়ী মু’মিন মুসলমানের চেয়ে খাস (অর্থাৎ মুসলিমের তুলনায় মু’মিনের গণ্ডি ছোট)।[২২] একইভাবে নাফিয়ে সাবিল সংশ্লিষ্ট আয়াতটিও রেওয়াতের তুলনায় খাস (রেওয়ায়েতের তুলনায় আয়াতের গণ্ডি ছোট)।[২৩]

তথ্যসূত্র

  1. শেইখ সাদুক, মান লা ইয়াহদুরুহুল ফাকীহ, ১৪১৩ হি., খণ্ড ৪, পৃ. ৩৩৪।
  2. দারাকুতনী, সুনান আল-দারাকুতনী, ১৪২৪ হি., খণ্ড ৪, পৃ. ৩৭০।
  3. মুসাভি বোজনুর্দি, কাওয়ায়েদে ফিকহী, ১৩৭৯ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫২-৩৫৩।
  4. মুতাহহারি, হামাছে হুসাইনি, ১৩৭৯ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৩২৬।
  5. শেইখ সাদুক, মান লা ইয়াহদুরুহুল ফাকীহ, ১৪১৩ হি., খণ্ড ৪, পৃ. ৩৩৪।
  6. মুসাভি বোজনুর্দি, কাওয়ায়েদে ফিকহী, ১৩৭৯ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৩৪৯-৩৫৮।
  7. মুসাভি বোজনুর্দি, কাওয়ায়েদে ফিকহী, ১৩৭৯ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৩৪৯-৩৫৮।
  8. ফাযেল লাঙ্কারানি, আল-কাওয়াইদুল ফিকহীয়্যাহ, ১৩৮৩ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ২৩৮।
  9. ফাযেল লাঙ্কারানি, আল-কাওয়াইদুল ফিকহীয়্যাহ, ১৩৮৩ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ২৩৮।
  10. মুসাভি বোজনুর্দি, আল-কাওয়াইদুল ফিকহীয়্যাহ, ১৩৭৭ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ১৯০।
  11. মুসাভি বোজনুর্দি, আল-কাওয়াইদুল ফিকহীয়্যাহ, ১৩৭৭ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ১৯০।
  12. মুসাভি বোজনুর্দি, আল-কাওয়াইদুল ফিকহীয়্যাহ, ১৩৭৭ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ১৯০।
  13. মুসাভি বোজনুর্দি, কাওয়ায়েদে ফিকহী, ১৩৭৯ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫২-৩৫৩।
  14. মুসাভি বোজনুর্দি, কাওয়ায়েদে ফিকহী, ১৩৭৯ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫২-৩৫৩।
  15. মুসাভি বোজনুর্দি, কাওয়ায়েদে ফিকহী, ১৩৭৯ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫২-৩৫৩।
  16. মুসাভি সাবযেভারি, মাওয়াহিবুর রাহমান, ১৪০৯ হি., খণ্ড ১০, পৃ. ৪৩।
  17. মুসাভি বোজনুর্দি, কাওয়ায়েদে ফিকহী, ১৩৭৯ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫৫।
  18. মুসাভি বোজনুর্দি, কাওয়ায়েদে ফিকহী, ১৩৭৯ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫৫।
  19. মুতাহহারি, হামাছে হুসাইনি, ১৩৭৯ ফার্সি সন, খণ্ড ১, পৃ. ৩২৬।
  20. হাজী আলী, "তাআম্মোলী বার আয়ে নাফিয়ে সাবিল বা তাকিদ বার মাফহুমে ওয়াঝেয়ে সাবিল", পৃ. ১৫১।
  21. হাজী আলী, "তাআম্মোলী বার আয়ে নাফিয়ে সাবিল বা তাকিদ বার মাফহুমে ওয়াঝেয়ে সাবিল", পৃ. ১৫১।
  22. সূরা হুজরাত, আয়াত ১৪।
  23. হাজী আলী, "তাআম্মোলী বার আয়ে নাফিয়ে সাবিল বা তাকিদ বার মাফহুমে ওয়াঝেয়ে সাবিল", পৃ. ১৫১।

গ্রন্থপঞ্জি

  • হাজী আলী, ফারিবা, https://quran.isca.ac.ir/fa/Article/Detail/10126 "তাআম্মোলী বার আয়ে নাফিয়ে সাবিল বা তাকিদ বার মাফহুমে ওয়াঝেয়ে সাবিল।"
  • দারাকুতনী, আলী বিন উমর, সুনান আল-দারাকুতনী, বৈরুত, মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪২৪ হি.।
  • সাবযওয়ারি, আব্দুল আ’লা, মাওয়াহিবুর রাহমান ফি তাফসিরিল কুরআন, বৈরুত, মুআসসেসেয়ে আহলে বাইত (আ.), ১৪০৯ হি.।
  • শেইখ সাদূক, মুহাম্মাদ বিন আলী, মান লা ইয়াহদুরুহুল ফাকীহ, কোম, ইন্তেশারাতে ইসলামি ওয়াবাস্তে বে জামেয়ে মুদারেরসিন হাওযে ইলমিয়া কোম, ১৪১৩ হি.।
  • তাবাতাবায়ী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হুসাইন, আল-মিযান ফি তাফসিরিল কুরআন, বৈরুত, মুআসসাসাতুল আ’লামি লিল মাতবুআত, ১৩৯০ হি.।
  • ফাযেল লাঙ্কারানি, মুহাম্মাদ জাওয়াদ, আল-কাওয়াইদুল ফিকহীয়্যাহ, কোম, মারকাযে ফিকহী আইম্মে আতহার আলাইহিমুস সালাম, ১৩৮৩ ফার্সি

সন।

  • মারকাযে ফারহাঙ্গ ওয়া মাআরেফে কুরআন, দায়েরাতুল মাআরেফে কুরআনে কারিম, কোম, বুস্তানে কিতাব, ১৩৮২ ফার্সি সন।
  • মুতাহহারি, মুর্তাযা, হামাছে হুসাইনি, তেহরান, সাদরা, ১৩৭৯ ফার্সি সন।
  • মুসাভি বোজনুর্দি, হাসান, আল-কাওয়াইদুল ফিকহীয়্যাহ, কোম, নাশরুল হাদি, ১৩৭৭ ফার্সি সন।
  • মুসাভি বোজনুর্দি, মুহাম্মাদ, কাওয়ায়েদে ফিকহী, তেহরান, মুআসসেসেয়ে তানযিম ওয়া নাশরে আসারে ইমাম খোমেনী, ১৩৭৯ ফার্সি সন।