সৈয়দ মোহাম্মদ নাকী শাহরুখী

wikishia থেকে

আলহাজ্ব আয়াতুল্লাহ সৈয়দ মোহাম্মদ নাকী শাহরুখী (ইরানি ১৩১৩ - ১৩৯৫ ) ছিলেন একজন শিয়া আলেম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ নেতা ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পবিত্র শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আল-উযমা সৈয়দ আলী খামেনেয়ীর (হাফিযাহুল্লাহ) প্রতিনিধি। পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

তিনি আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব পরিষদের সাধারণ সদস্য এবং বাংলাদেশে এই আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি ছিলেন এবং তিনি তাঁর সমগ্র জীবন পবিত্র আহলে বাইত (আ:)'র আদর্শ প্রচার ও প্রসারে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় অঞ্চলে আহলে বাইত (আ:)'র অনুসারীদের খেদমতের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

ইসলামের খেদমতে নিবেদিত এই শিয়া আলেম ইসলামী মাযহাব সমূহের মাঝে সম্প্রীতি আনয়নে ও মুসলমানদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ছিলেন, এমনকি তিনি "ইসলামী মাযহাব সমূহের মাঝে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা বিশ্ব সংস্থার" একজন সদস্য ছিলেন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিয়াদের আধ্যাত্মিক পিতা এবং এই অঞ্চলে ইসলামী ঐক্যের আহ্বানকারী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর এই সকল কর্মকাণ্ড এই অঞ্চলে শিয়াদের ভিত্তি ও মাযহাব আকারে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

জীবনী

আয়াতুল্লাহ শাহরুখী ইরানি ১৩১৩ সালের উরদিবেহেস্ত মাসে, অর্থাৎ ১৯৩৪ সালের মে মাসে ইরানের লোরেস্তান প্রদেশের খোররামাবাদ নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা একজন সম্ভ্রান্ত সৈয়দ এবং স্বনামধন্য শিক্ষক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।

সৈয়দ মোহাম্মদ নাকী তাঁর পিতার কাছ থেকে প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন এবং ইরানি ১৩২৭ সালে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য বোরুজার্দ শহরের হাউযা ইলমিয়্যাতে প্রবেশ করেন। দুই বছর পর, তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পবিত্র কোম শহরের হাউযা ইলমিয়্যাকে বেছে নেন।

আয়াতুল্লাহ শাহরুখী হাউযা ইলমিয়্যার পর্যায়ক্রমিক কোর্স সমূহ যথাক্রমে আয়াতুল্লাহ মারআশি নাজাফি, শহীদ সাদুকি, ইয়াজদি, ফাকুরি, হায়েরি, মুজাহিদী এবং সুলতানি তাবাতাবায়ীর সান্নিধ্যে শিক্ষা লাভ করেন এবং আসফারশেফা নামক বই এবং তাফসিরের কিছু অংশ আল্লামা তাবাতাবায়ীর কাছে অতিবাহিত করেছেন। ফেকাহ ও উসুল শাস্ত্রের উচ্চ পর্যায়ের বিষয়বস্তু সমূহ (দার্সে খারেজ) যথাক্রমে আয়াতুল্লাহ বুরুজার্দী, ইমাম খোমাইনী, মোহাক্কেক দামাদ ও গুলপায়গনীর ক্লাসে অংশগ্রহণ করেন এবং অবশেষে ইরানি ১৩৪০ সালে এবং ২৭ বছর বয়সে আয়াতুল্লাহ আল-উযমা হাজ্বী শেখ মুর্তোজা হায়েরির কাছ থেকে ইজতিহাদের অনুমোদন লাভে সফল হন।

আয়াতুল্লাহ শাহরুখী ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে কোম শহরের হাউযা ইলমিয়্যাতে হাউযা ইলমিয়্যার বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন ও শিক্ষাদানে নিযুক্ত ছিলেন, এমনকি বিদেশী ছাত্রদেরকে তিনি সাহিত্য, নীতিশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন এবং ফেকাহ ও উসুল শাস্ত্রের উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞানসহ বিভিন্ন জ্ঞানের শিক্ষা দিয়েছিলেন। বিভিন্ন বিষয়বস্তুর উপর তাঁর একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে "সালাত আল-জামাআহ", কুরআনের অ-বিকৃতি, ভ্রমণকারীর নামাজ ও উসুল শাস্ত্রের উচ্চ পর্যায়ের পর্যায়ক্রমিক আলোচনার মতো বইগুলি উল্লেখযোগ্য।

সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড

ইরানের শাহেনশাহী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আয়াতুল্লাহ সৈয়দ মোহাম্মদ নাকী শাহরুখী হাউযা ইলমিয়্যার আলেম-ওলামা ও শিক্ষকদের পাশাপাশি নিজেও সক্রিয় ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছেন এবং তাঁর সংগ্রামী জীবনে তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেছিলেন। কারাগারে তিনি আয়াতুল্লাহ দাস্তেগাইব এবং মরহুম ফালসেফি (ইরানের বিশিষ্ট বক্তাদের একজন) এর মতো ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচয় লাভ করেছিলেন। তিনি চাহরমহল, বখতিয়ারী এবং বোরুজানে শাহেনশাহী শাসনের বিরুদ্ধে অভিযানের নেতৃত্ব দেন। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পরও তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত ছিলেন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি

আয়াতুল্লাহ শাহরুখীকে ইরানি ১৩৬৯ সালে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর পক্ষ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত দেশগুলিতে যেমন: বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মায়ানমার এবং শ্রীলঙ্কায় প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তিনি তাঁর মহৎ জীবনের প্রায় পঁচিশ বছর সেই অঞ্চলের শিয়াদের সেবা, প্রকৃত মোহাম্মদী (সাঃ) ইসলামকে পরিচয় করানো এবং মুসলমানদের বিশেষ করে আহলে বাইত (আ:)'র অনুসারীদের বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক স্তরকে উন্নতির কাজে ব্যায় করেন এবং তাঁর ব্যাপক ও অক্লান্ত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি উক্ত অঞ্চলে শিয়া মাযহাবের ভিত্তিকে শক্তিশালী করেন এবং ইসলামী মাযহাব সমূহের মাঝে ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আহলে বাইত (আ.)-এর আদর্শ প্রচার ও প্রসারের জন্য বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য দেশ যেমন: ভারত, পাকিস্তান, পশ্চিমবঙ্গ, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করেন।

ইরানের বাইরে তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম নিম্নরূপ

  • শিয়াদের ধর্মীয় ও জীবিকা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করা এবং তাদের খাঁটি ইসলামী শিক্ষার জ্ঞানের স্তর বৃদ্ধি করা এবং সাংস্কৃতিক সমস্যা সমাধান করা এবং ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ইবাদতের কেন্দ্রগুলিকে শক্তিশালী করা।
  • বাংলাদেশের রাজধানীতে (ঢাকা) বিভিন্ন ভাষার কয়েক হাজার ভলিউম বই নিয়ে একটি বৃহৎ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা এবং শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল সমূহে ধর্মীয় গ্রন্থাগারকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি আহলে বাইত (আ:)'র অনুসারীদের কেন্দ্রে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ফার্মেসি প্রতিষ্ঠা করা।
  • আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারীদের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় দারুল-কুরআন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন এবং বাংলাদেশে ইরানি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা।
  • তাঁর দায়িত্বে থাকা দেশ সমূহের মাদ্রাসা ও হাউযা ইলমিয়্যা সমূহ পরিচালনা, ইরান থেকে পড়াশোনা সমাপ্ত করা ছাত্র, আলেম-ওলামা ও জুমার খতিবদের পর্যবেক্ষণ ও সমন্বয় সম্পর্কিত কাজ সমূহ দেখাশোনা করা।
  • ইসলামী মাযহাব সমূহের মধ্যে ঐক্য, সম্প্রীতি ও সমঝোতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ও আহলে সুন্নাতের মুফতিদের দ্বারা আহলে বাইত (আ:)'র অনুসারীদের তাকফিরি প্রতিরোধে আহলে সুন্নাতের ওলামা এবং সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করা।
  • সন্দেহ ও অভিযোগের জবাব দেওয়া এবং ইসলাম ও আহলে বাইত (আ.)-এর মাযহাবের প্রকৃত রূপ তুলে ধরা।
  • ঝগরা-বিবাদ ও সহিংসতা প্রতিরোধ, অজ্ঞতা দূরীকরণ এবং গোঁড়ামী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই।
  • এসব দেশে শিয়াদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মবিশ্বাসের চেতনাকে শক্তিশালী করা।
  • সংখ্যালঘু থাকা সত্ত্বেও শিয়া মাযহাবকে অন্যতম ইসলামিক মাযহাব হিসাবে চিহ্নিত করা এবং শিয়া মর্যাদার সামঞ্জস্য যোগ্য একটি অবস্থান তৈরি করা এবং শিয়াদেরকে অপমান-অপদস্ত করা থেকে আহলে সুন্নাতের কিছু ইমাম ও জামাতকে বিরত রাখা।

মৃত্যু

অবশেষে আয়াতুল্লাহ শাহরুখী, আহলে বাইত (আ:)'র আদর্শ প্রচার ও প্রসারের পথে নিজের জ্ঞানচর্চাময় ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটিয়ে এবং দীর্ঘ অসুস্থতার সময়কাল সহ্য করার পর, ইরানি ১৩৯৫ সালের ৭ই অযার, অর্থাৎ ২০১৬ সালের ২৭শে নভেম্বর রোজ রবিবার, ৮২ বছর বয়সে, মস্তিষ্কের জটিলতার কারণে কোমের নিকুয়ী হাসপাতালে ইহকালের মায়া ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে পরলোক গমন করেন। আয়াতুল্লাহ শোবাইরি জানজানীর ইমামতিতে জানাজার নামাজ আদায় শেষে মরহুমের মরদেহ ভাবগম্ভীর্যপূর্ণ ভাবে হযরত মাসুমা (সা. আ.) এর মাজারে দাফন করা হয়।

তথ্যসূত্র


গ্রন্থপঞ্জি