বিষয়বস্তুতে চলুন

সাইফ বা যুদ্ধের আয়াত

wikishia থেকে
সাইফ বা যুদ্ধের আয়াত
আয়াতের নামসাইফ বা যুদ্ধের আয়াত
সূরার নামসূরা তাওবা
আয়াত নম্বর
পারা নম্বর১০
অবতীর্ণের স্থানমদিনা
বিষয়আকাইদ
প্রসঙ্গমুশরিকদের সাথে আচরণ
সংশ্লিষ্ট আয়াতসূরা হজ্জ:৫ নং আয়াত•সূরা তাওবা:২৯ নং আয়াত•সূরা বাকারাহ :১৯০, ১৯১ ও ১৯৩নং আয়াত


সাইফ বা যুদ্ধের আয়াত (আরবি: آية السّيف أو آية القِتال); মুসলমানদেরকে চার মাস পর মুশরিকদের হত্যা বা বন্দী এবং অবরোধ করার নির্দেশ দেয়, যদি না তারা ইসলাম গ্রহণ করে। শিয়া ও সুন্নি মুফাসসিরদের মতে, এই আয়াতে মুশরিক দ্বারা মহানবী (সা.)-এর সময়ের চুক্তি ভঙ্গকারী মুশরিকরা উদ্দেশ্য; তবে উগ্রপন্থী সালাফি জিহাদি গোষ্ঠীগুলি প্রাথমিক জিহাদের জন্য এই আয়াতটি দলিল হিসেবে গ্রহণ করে।

কেউ কেউ সাইফের আয়াতটিকে শান্তিচুক্তি, জিজিয়া এবং মুক্তিপণ সম্পর্কিত কিছু আয়াতের রহিতকরণ বলে মনে করেছেন; অন্যদিকে, কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে এই আয়াতটি কোনও আয়াতকে রহিত করে না; বরং এটি পরবর্তী আয়াতের উপর ভিত্তি করে যেখানে মহান আল্লাহ মহানবীকে আদেশ দিয়েছেন "যদি কোন মুশরিক আল্লাহর বাণী শোনার জন্য তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাহলে তাকে অনুমতি দাও এবং তারপর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও," বিশেষ স্থান পেয়েছে।

সূরা তাওবার ২৯ নম্বর আয়াত এবং সূরা হজ্জের ৩৯ নম্বর আয়াতকেও তরবারি ও যুদ্ধের আয়াত বলা হয়েছে।

আয়াত পরিচিতি

তরবারি বা যুদ্ধের আয়াতটি সূরা তাওবার পঞ্চম আয়াত। এই আয়াত অনুসারে, হিজরির নবম বছরে, মুসলমানদেরকে চার মাস অবকাশের পর মুশরিকদের সাথে কঠোর আচরণ করার, যেমন হত্যা, বন্দী এবং অবরোধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।[1]

فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ


অর্থ: অতএব যখন হারাম মাসসমূহ অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা করো এবং তাদেরকে বন্দি করো, অবরোধ করো এবং তাদের সন্ধানে ওঁৎ পেতে বসে থাকো। যদি তারা তওবা করে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয়, তাহলে তাদের পথ খুলে দাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।



সূরা তাওবা: ৫।


এই আয়াত অনুসারে, যদি মুশরিকরা নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার আগেই ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নামাজ এবং যাকাত, পালন করে, তাহলে তারা নিরাপদ থাকবে এবং কোনও বৈষম্য ছাড়াই অন্যান্য মুসলমানদের মতো সকল সুবিধা ভোগ করবে।[2] আয়াতে নামাজ আদায় এবং যাকাত প্রদানকে তওবা এবং ঈমানের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।[3] মাকারেম শিরাজির মতে, আয়াতের বাহ্যিক দিক থেকে স্পষ্ট যে "রাস্তা বন্ধ করা, অবরোধ করা, বন্দী করা এবং হত্যা করা" এই চারটি বিষয়ের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়া ঐচ্ছিক নয়; বরং সময়, স্থান-কাল ও পরিস্থিতির শর্তানুযায়ী এই বিষয়গুলির মধ্যে একটি বাস্তবায়ন করতে হবে।[4]

অবকাশের এ চার মাস কোন সময়ের অন্তর্ভুক্ত, সে সম্পর্কে মুফাস্সিরদের ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। কেউ কেউ এই মাসগুলোকে নিষিদ্ধ মাসসমুহের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেছেন।[5] বিপরীতে, বেশিরভাগ মুফাস্সির ৯ম হিজরীর ৯ই জিলহজ্জ থেকে ১০ম হিজরীর ১০ই রবিউস্ সানি পর্যন্ত চার মাসকে অবকাশের মাস বলে মনে করেছেন।[6]

কতিপয় ফকীহ সাইফের আয়াতকে উদ্ধৃত করে নামায ত্যাগকারীকে মুরতাদ বলে মনে করেছেন এবং তার হত্যাকে ওয়াজিব বলে মনে করেছেন; কারণ এই আয়াতে নামায হল মুশরিককে হত্যা করা থেকে বিরত রাখার বেশ কয়েকটি শর্তের মধ্যে একটি।[7] কিছু মুফাসসির সূরা তাওবার ২৯ নম্বর আয়াত [8] [নোট ১] এবং সূরা হজ্জের ৩৯ নম্বর আয়াত [নোট ২] কে সাইফ এবং যুদ্ধের আয়াত হিসেবে বিবেচনা করেছেন।[9]

চুক্তি ভঙ্গকারী মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ

এই আয়াতের মুশরিক দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে মহানবী (সাঃ) এর যুগে চুক্তি ভঙ্গকারী মুশরিকগণ, যারা মহানবী (সাঃ) এবং মুসলমানদের সাথে একটি চুক্তি করেছিল, কিন্তু তা ভঙ্গ করেছিল।[10] কেউ কেউ বলেছেন যে, মুশরিকরা দ্বারা উদ্দেশ্য ষড়যন্ত্রকারী মুশরিকগণ এবং কাফিরে হারবি (যার জান ও মাল হালাল)।[11]

বলা হয় যে, সুন্নি মুফাস্সির রশিদ রেজা (মৃত্যু ১৯৩৫) এই আয়াত এবং যুদ্ধ সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াতের তাফসিরে মুশরিক বলতে মক্কার মুশরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন এবং যুদ্ধের আয়াতগুলিতে আল্লাহ তাদের বারবার চুক্তি ভঙ্গের উপর জোর দিয়েছেন।[12] অপর একজন মুফাস্সির মুহাম্মদ এজ্জাত দারুজা (মৃত্যু: ১৯৮৪) বিশ্বাস করেন যে সূরা আত-তাওবার প্রথম আয়াতের বিধানের বিষয়বস্তু হল সেইসব মুশরিক যারা তাদের চুক্তি ভঙ্গ করেছিল এবং মহানবী যখন তাবুকের যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করেছিল।[13] তাঁর মতে, ‘এই আয়াতগুলি সকল মুশরিকদের জন্য সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য’ এই দাবিটি আয়াতগুলির প্রেক্ষাপট এবং বিষয়বস্তু দ্বারা সমর্থিত নয়।[14]

কিছু ইসলামি গবেষক বলেছেন যে, উগ্রপন্থী সালাফি জিহাদি গোষ্ঠীগুলি প্রাথমিক জিহাদের দালিল হিসেবে সূরা তাওবার ৫ নম্বর আয়াতকে উদ্ধৃত করেছে।[15]

তারা এই আয়াতটিকে শান্তিচুক্তি ও ক্ষমার সকল আয়াতকে রহিতকারী বলে মনে করে এবং এই আয়াতে মুশরিক বলতে কাফিরে হারবি (যার জান ও মাল হালাল) ও কাফিরে গাইরে হারবি (যার জান ও মাল হালাল নয়) সকল কাফেরকে মনে করে। [16] পক্ষান্তরে, একদল মুফাসসির এধরণের ভুল ব্যাখ্যা এবং ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার ধারণাকে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার কারণ বলে মনে করে যা মুসলিম বিশ্বাসের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। [17]

নাসেখ বা মানসুখ হওয়া প্রসঙ্গ

কিছু মুফাস্সিরের মতে, সাইফের আয়াতটি ১২৪টি আয়াতকে রহিতকারী যেগুলোতে মুশরিকদের বিরুদ্ধে ক্ষমা, শান্তিচুক্তি এবং মুক্তিপণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।[18] অপর কিছু মুফাসসির এই আয়াতটিকে ক্ষমা এবং শান্তিচুক্তির আয়াতগুলির দ্বারা রহিত হয়েছে বলে মনে করেছেন।[19] কতিপয়ের মতে, সাইফের আয়াত এবং সূরা মুহাম্মদের ৪ নম্বর আয়াত (যা মুশরিকদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে) একে অপরকে রহিত করে না এবং উভয় আয়াতই মুহকাম বা স্পষ্ট হুকুম বহন করে; কারণ মহানবী মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং ক্ষমা ও মুক্তিপণ গ্রহণের নির্দেশও দিয়েছিলেন। [20]

কিছু মুফাসসির, এই আয়াতটিকে পরবর্তী আয়াতের (সূরা তাওবা-৬) সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করেছেন। [21] পরবর্তী আয়াতে, আল্লাহ মহানবীকে আদেশ দিচ্ছেন: ‘যদি মুশরিকদের কেউ আল্লাহর বাণী শোনার জন্য তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাহলে তাকে অনুমতি দাও এবং তারপর তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাও।’ [নোট] সুন্নি মুফাসসির রশিদ রেজা (মৃত্যু ১৯৩৫) বিশ্বাস করেন যে, এই আয়াতটি সাইফের আয়াতকে অন্যান্য আয়াত থেকে আলাদা করেছে। এর কারণ হল এমন অনেক মুশরিক ছিল যারা আল্লাহর বাণী শোনেনি এবং তাদের কাছে দাওয়াত সম্পূর্ণরূপে পৌঁছায়নি। এই কারণে, আল্লাহ তাদের জন্য সত্যের পথ উন্মুক্ত রেখেছেন এবং সাইফের আয়াতের হুকুমকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন।[23]

কেউ কেউ বলেছেন যে, সাইফের আয়াত রহিতকারী হওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়; কারণ সূরা তাওবার ২৯ নং আয়াত যা সাইফের আয়াতের পরে এসেছে, মুসলিম দেশে আহলে কিতাবদের অবস্থানকে জিজিয়া প্রদানের দ্বারা অনুমোদন করেছে। [24]

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি