মেসওয়াক করা
মেসওয়াক করা; অত্যন্ত তাকিদপূর্ণ মুস্তাহাবগুলির মধ্যে একটি এবং ওযু] ও নামাজের আদবগুলির মধ্যে একটি, এবং হাদিসে এটি নবীদের (আ.) সুন্নাত হিসাবে পরিচিত। এটি মহানবী (সাঃ) এর উপর ওয়াজিব ছিল এবং মেসওয়াক করে নামাজ পড়া মেসওয়াক করা ছাড়া নামাজের চেয়ে অনেক উত্তম বলে বিবেচিত হয়। এর অনেক প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন- মুখ পরিষ্কার থাকে, ঝকঝকে সাদা দাঁত, মাড়ি শক্তিশালী হয়, কফ দূর করে এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে।
মেসওয়াক করার জন্য মুস্তাহাব সময়গুলির মধ্যে রয়েছে ফজর, ওযু ও নামাজের আগে এবং ঘুমানোর আগে এবং পরে। মেসওয়াক করার পাশাপাশি গড়গড়া করা এর আদবের অংশ হিসাবে বিবেচিত হয় এবং এজন্য আরাক গাছ ব্যবহার করার তাকিদ দেওয়া হয়েছে।
ফকীহগণ নামাজ, রোজা এবং হজ্জের অধ্যায়গুলিতে মেসওয়াক করার হুকুম নিয়ে আলোচনা করেছেন; যার মধ্যে রয়েছে ওযু ও নামাজের আদব, রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ এবং ইহরাম বাঁধার আগে মুস্তাহাব ও ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়গুলির অধ্যায়ে।
অব্স্থান ও গুরুত্ব
মেসওয়াক করাকে ওযু ও নামাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব [1] এবং আদব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। [2] মাসুমিনদের হাদিসসমূহে এই অভ্যাসকে সুন্নাত হিসেবে বিবেচনা করা হয় [3] এবং নবীদের আখলাকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য [4] এবং ইমাম আলী [আ.] -এর প্রতি রাসূলের [সা.] সুপারিশগুলির মধ্যে একটি। [5] বলা হয় যে, মেসওয়াক করা আল্লাহর রাসূলে [সা.] -এর উপর ওয়াজিব ছিল এবং এটি মহানবীর [সা.] বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হিসাবে গণ্য করা হয়। [6]
হাদিস অনুসারে, মেসওয়াক করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল হয়, [7] নেক আমল দ্বিগুণ করে, [8] এবং ফেরেশতারা আনন্দিত হয়।[9] এক হাদিস অনুসারে, ইসলামে এর গুরুত্ব এত বেশি যে আল্লাহর রাসূল (সা.) শুধুমাত্র মুসলমানদের কষ্টের কথা বিবেচনা করে প্রতিটি নামাযের এটিকে ওয়াজিব করেননি।[10] হাদিসে, মেসওয়াক করে নামাজ পড়াকে ৭০ রাকাত [11] অথবা চল্লিশ দিন মেসওয়াক না করে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম বলে বিবেচনা করা হয়েছে। নবী (সা.) থেকে বর্ণিত আছে যে,জিব্রাইল (আ.) এত বেশি মেসওয়াক করার তাকিদ দিয়েছিলেন যে, আমি ভেবেছিলাম শীঘ্রই এটি ওয়াজিব হয়ে যাবে। [13]
মেসওয়াক এর উপকারিতা
হাদিসসমূহে মেসওয়াক করার অনেক উপকারিতা উল্লেখ করা হয়েছে, এমনকি বলা হয়েছে যে, শুধুমাত্র একটি হাদিসেই এর বারোটি উপকারিতা বর্ণনা করা হয়েছে।[15] এর মধ্যে রয়েছে যে, মেসওয়াক করলে মুখ পরিষ্কার হয়, দাঁত সাদা হয়, দাঁতের ক্ষয় দূর হয়, মাড়ি শক্তিশালী হয়, কফ দূর হয়, ক্ষুধা বৃদ্ধি এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।[16] এছাড়াও, হাদিস অনুসারে, মেসওয়াক করলে মুখের গন্ধ দূর হয়, [17] চুল ঘন হয়, [18] চোখের পানি পড়া দূর হয়, [19] চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি পায়, [20] ব্যক্তিকে বাগ্মী করে তোলে, [21] এবং হৃদয় থেকে ওয়াসওয়াসা বা শয়তানি প্রলোভন দূর করে। [22]
মেসওয়াক করার আদব
হাদিসসমূহে, ফজরের সময় রাত্রিকালীন ইবাদতের পূর্বে [23] এবং ওযু ও নামাজের আগে মেসওয়াক করা সুন্নাতের অংশ হিসেবে বিবেচিত।[24] মির্জা জাওয়াদ মালেকি তাবরিজির মতে, প্রতিটি ওযু ও নামাজের সময়, রাতে ঘুমানোর সময়, ভোরে ঘুম থেকে ওঠার সময় এবং ফজর নামাজের আগে মেসওয়াক করা মুস্তাহাব। [25] তাবরিজির মতে, মেসওয়াক করার সময় বিশেষ দোয়া পড়া মুস্তাহাব। [26] এই দোয়াটি কুতুবুদ্দীন রাওয়ান্দির কিতাবুদ্ দাওয়াআতে উল্লেখ করা হয়েছে। [27]
মেসওয়াক করার আদবের মধ্যে একটি হচ্ছে, মুখে পানি নয়ে গড়গড়া করা।[28] এছাড়াও, হাদিসে দাঁত লম্ব আকারে (উপর-নীচ) মেসওয়াক করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।[29] হাদিস অনুসারে, আল্লাহর রাসূল (সা.) এবং অন্যন্য নবীগণের মেসওয়াক যয়তুন গাছের ডাল দিয়ে তৈরি ছিল।[30] বলা হয় যে, আরাক নামক গাছের কান্ড দ্বারা মেসওয়াক করা মুস্তাহাব। [31] এই মেসওয়াক ডালিম গাছের অনুরূপ গাছের শিকড়, কান্ড এবং শাখা থেকে তৈরি করা হয়।[32] এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম সালভাদোরা পার্সিকা (Salvadora Persica), যা ইরান, সৌদি আরব, আফ্রিকা, ইরাক, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা সহ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে জন্মে।[33]
মেসওয়াক করার ফিকাহগত আহকাম
ফিকাহশাস্ত্রের নামাজ, নামাজের আদব,[34], রোজা,[35] এবং হজ্জের অধ্যায়ে মেসওয়াক করার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। [36]
রোজার আলোচনায়, ফকীহগণ পানাহারকে রোজা ভঙ্গকারী বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হিসেবে আলোচনা করার সময় ফতওয়া জারি করেছেন যে, যদি কোন রোজাদার তার মুখ থেকে মেসওয়াক বের করে পুনরায় মুখে রাখে এবং এতে লেগে থাকা লালা বা পানি গিলে ফেলে, তাহলে তার রোজা ভঙ্গ হবে, যদি না মেসওয়াকের সে পানি মুখের লালার সাথে এমনভাবে মিশে যায় যে তা মুখের বাইরের পানি হিসেবে বিবেচিত না হয়। এটাও বলা হয়েছে যে, ভেজা মেসওয়াক বা টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজা রোজাদারের জন্য মাকরূহ। [38]
হাদিস অনুসারে বলা হয় যে, [39] হজ্জ ও ওমরায় ইহরাম বাঁধার আগে মেসওয়াক করা একটি সুপারিশকৃত মুস্তাহাব আমল হিসেবে বিবেচিত; [40] কিন্তু যেহেতু ইহরাম অবস্থায় শরীর থেকে রক্তপাত হারাম কাজগুলির মধ্যে একটি, তাই ইহরামে থাকা ব্যক্তি যদি জানেন যে তিনি মেসওয়াক বা দাঁত ব্রাশ করলে তার মাড়ি থেকে রক্ত বের হবে, তাহলে তার জন্য মেসওয়াক বা দাঁত ব্রাশ করা হারাম। [41] অবশ্য, শীর্ষস্থানীয় মার্জায়ে তাকলিদ সাইয়্যিদ আলী সিস্তানির মতে, ইহরাম অবস্থায় মেসওয়াক করাতে কোন সমস্যা নেই, এমনকি যদি কেউ জানে যে মেসওয়াক করলে দাঁত থেকে রক্ত বের হবে। [42]
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- ইমাম খোমিনী ও অন্যান্য মার্জাগণ, রেসালেয়ে তাউযিহুল মাসায়েলে মারাজেঅ্, কোম, দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামি ওয়াবাস্তে বে জামেয়ে মুদাররেসিনে হাউজা ইলমিয়্যায়ে কোম...
- বারক্বী, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন খালেদ, আল-মাহাসেন, কোম, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, ১৩৭১ হি.,
- পায়ান্দেহ, আবুল কাশেম, নাহজুল ফাসাহাহ, তেহরান, দুনিয়ায়ে দানেশ, ১৩৮২ (ফার্সি সন),
- مسواک چیست؛ فواید و روش درست استفاده از آن, আসরে ইরান, ১৪/৬/১৩৯৩ (ফার্সি সন),
- পাজুহেশকাদেহ হজ্জ ও যিয়ারত, মানাসেকে হজ্জ মুহশি, তেহরান, মাশআ’র, ১৩৯৬ (ফার্সি সন),
- হুর আমেলী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, ওয়াসাইলুশ শিয়া, কোম, মুয়াসসেসেয়ে আলিল বাইত (আ.), ১৪০৭ হি.,
- রাওয়ান্দি, কুতুবুদ্দিন, আদ্-দাওয়াআত, কোম, ইন্তেশারাতে মাদরাসেয়ে ইমাম মাহদী (আ.), ১৪০৭ হি.,
- রেই শাহরী, মুহাম্মাদ মুহাম্মাদী, হজ্জ ও উমরা দার কুরআন ও হাদিস, কোম, নাশরে মাশআ’র, ১৪২৭ হি.,
- সুয়ুতী, আব্দুর রহমান বিন আবি বাকর, খাসাইসুল কুবরা, বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ...
- শিরাজী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হুসাইনী, আল-ফিকহ-আন্-নিযাফাহ...
- সাদুক, মুহাম্মাদ বিন আলী বিন বাবুইয়ে, মান লা ইয়াহযুুরুহুল ফাকিহ, কোম, দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামি ওয়াবাস্তে বে জামেয়ে মুদাররেসিনে হাউজা ইলমিয়্যায়ে কোম, ১৪১৩ হি.,
- তাবারসী, হাসান বিন ফাযল, মাকারিমুল আখলাক, কোম, নাশরে শারিফ রাযি, ১৪১২ হি.,
- তুসী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, আমালি, কোম, দারুস সিক্বাফা, ১৪১৪ হি.,
- কারাকী, আলী বিন হুসাইন, জামিউল মাকাসিদ ফি শারহিল কাওয়াইদ, কোম, মুয়াসসেসেয়ে আলিল বাইত (আ.), ১৪১৪ হি.,
- কুলাইনী, মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব, উসুলে কাফি, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪০৭ হি.,
- মাজলেসী আউওয়াল, মুহাম্মাদ তাকী, লাওয়ামিউ সাহেবকারানী, কোম, ইসমাইলিয়ান, ১৪১৪হি.,
- মাজলেসী, মুহাম্মাদ বাকের, বিহারুল আনওয়ার, বৈরুত, দারু ইহয়াইত তুরাসিল আরবি, ১৪০৩ হি.,
- মাহমুদী, মুহাম্মাদ রেযা, মানাসেকে উমরেয়ে মুফরাদা, কোম, নাশরে মাশআ’র, ১৪২৯ হি.,
- মালেকি তাবরেযি, মির্জা জাওয়াদ, আসরারুস সালাত; তরজমা-রেযা রজবযাদেহ, তেহরান, পায়ামে আযাদি, ১৪২০ হি.,
- ইয়াযদী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ কাযেম, আল-উরওয়াতুল উসকা, কোম, দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামি ওয়াবাস্তে বে জামেয়ে মুদাররেসিনে হাউজা ইলমিয়্যায়ে কোম, ১৪১৯ হিজরী।