মিকদাদ ইবনে আমর

wikishia থেকে

মিকদাদ ইবনে আমর; ওরফে মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ (মৃত্যু ৩৩ হি.), পয়গম্বর (স.)-এর বিশিষ্ট সাহাবিগণের একজন এবং ইমাম আলীর (আ.) প্রথম শিয়াদের অন্যতম। মিকদাদ নবুয়ত ঘোষণার সূচনালগ্নে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং প্রথম দিকে যে ক’জন নিজেদের মুসলমান হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করেছিলেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ইসলামের সূচনার দিককার সকল যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। ইমাম আলীর (আ.) প্রথম শিয়া হিসেবে সালামান ফার্সি, আম্মার ইবনে ইয়াসিরআবুযার গিফারির পাশপাশি মিকদাদের নামও উল্লেখিত হয়েছে; যারা স্বয়ং আল্লাহ রাসূলের (স.) জীবদ্দশাতেই এই নামে পরিচিত ছিলেন।

মহানবির (স.) ওফাতের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ইমাম আলীর (আ.) প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে আবু বকরের হাতে বাইয়াত করা থেকে বিরত থাকেন মিকদাদ এবং মুষ্টমেয় যে ক’জন হযরত ফাতেমা যাহরার (সা. আ.) জানাযায় অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মাঝে তিনিও ছিলেন। উসমানের খেলাফতের ঘোর বিরোধীদের তালিকায় তার নামও উল্লেখিত হয়েছে। আহলে বাইত (আ.) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতে তার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়েছে এবং যারা ইমাম মাহদির (আ.) আবির্ভাবের সময় রাজআত করবেন তাদের মধ্যে তিনিও থাকবেন বলে উল্লেখিত হয়েছে। মহানবি (স.) থেকে বেশ কয়েকটি রেওয়ায়েত তার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

জীবনী

জন্ম ও বংশ পরিচয়

মিকদাদ ইবনে আমর ইবনে সা’লাবাহ্ ওরফে মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ; তার জন্ম তারিখের বিষয়ে কোন তথ্য না থাকলেও ঐতিহাসিকগণ তার ইন্তেকালের বছর ৩৩ হিজরী এবং তিনি ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন।[১] সম্ভবত তিনি নবুয়ত ঘোষণার ২৪ বছর আগে (হিজরতের ৩৭ বছর আগে) জন্মগ্রহণ করেন। ঐতিহাসিকরা তার পূর্ব পুরুষের শাজারা নামায় তার ২০তম পুরুষের নাম পর্যন্ত গণনা করেছেন।[২]

বর্ণিত হয়েছে যে, হাজরামাউত এলাকায় মিকদাদ ও ‘আবি শিমর ইবনে হিজর’ নামক এক ব্যক্তির সাথে মিকদাদের ঝগড়া হয়। এতে ঐ ব্যক্তি আহত হলে মিকদাদ মক্কায় যেয়ে আসওয়াদ ইবনে আব্দ ইবনে ইয়াগুস যুহরি’র সাথে চুক্তিবদ্ধ হন এবং আসওয়াদ তাকে পালকপুত্র বানিয়ে নেন। এ কারণে তাকে কখনো মিকদাদ বিন আসওয়াদ আবার কখনো মিকদাদ যুহরিও বলা হয়েছে। কিন্তু ((ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ)) ‘তাদেরকে তাদের পিতার নাম ধরে ডাকো’[৩] আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর ‘মিকদাদ ইবনে আমর’ নামে তাকে ডাকা হয়।[৪]

কুনিয়াত ও উপাধিসমূহ

মিকদাদের জন্য বাহরায়ী অথবা বাহরাভি[৫], কিন্দী ও হাজরামি উপাধি এবং আবু মা’বাদ, আবু সাঈদ ও আবুল আসওয়াদ ইত্যাদি কুনিয়াত (উপনাম) উল্লেখিত হয়েছে।[৬]

পরিবার

  • স্ত্রী: মিকদাদের স্ত্রী ছিলেন মহানবির (স.) চাচাতো বোন দুবাআহ (যুবাইর ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা)।[৭] উচ্চবংশীয় ও বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মহানবি (স.) দুবাআহ’কে মিকদাদের সাথে বিবাহ দেন এবং বলেন: ‘আমি আমার চাচাতো দুবাআহ’কে মিকদাদের সাথে এই উদ্দেশ্য বিবাহ দিয়েছি যাতে মানুষ বিবাহের বিষয়টিকে সহজভাবে গ্রহণ করে এবং কোন মু’মিনের হাতে নিজের মেয়েকে তুলে দেওয়ার সময় তার বংশ পরিচয়ের বিষয়টি দৃষ্টিতে না রাখে।’[৮]
  • সন্তান-সন্তুনি: আব্দুল্লাহ ও কারিমা নামের দু’টি সন্তান ছিল মিকদাদের। উষ্ট্রের (জামাল) যুদ্ধে আব্দুল্লাহ আয়েশার পক্ষে হযরত আলীর (আ.) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিহত হয়। যুদ্ধের পর যখন ইমাম আলীর (আ.) দৃষ্টি তার উপর পড়ে তখন তিনি আব্দুল্লাহর উদ্দেশ্যে বলেন: ‘কতই না মন্দ ভাগ্নে ছিলে তুমি’।[৯] কেউ কেউ আব্দুল্লাহর স্থলে মিকদাদের পুত্রের নাম ‘মা’বাদ’ বলে উল্লেখ করেছেন।[১০]

মৃত্যু ও দাফনের স্থান

মিকদাদ ৩৩ হিজরীতে ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি ‘জার্ফে’ (মদিনা থেকে সিরিয়ার পথে এক ফারসাখ দূরে) বসবাস করতেন। মুসলমানরা তার জানাযা মদিনায় আনেন এবং উসমান ইবনে আফফান তার জানাযার নামাজ পড়ান, অতঃপর তাকে বাকী কবরস্থানে দাফন করা হয়।[১১] তুরস্কের ‘ভ্যান’ শহরে মিকদাদের নামে একটি কবর কবর রয়েছে, কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে ওটা ফাযেল মিকদাদ অথবা আরব কোন সম্মানিত ব্যক্তির কবর।[১২] একটি বর্ণনার ভিত্তিতে মিকদাদ ছিলেন সম্পদশালী, তার সম্পত্তি থেকে ৩৬ হাজার দিরহাম ইমাম হাসানহুসাইনকে (আলাইহিমাস সালাম) প্রদানের জন্য তিনি ওসিয়ত করে যান।[১৩]

মহানবির (স.) জীবদ্দশায়

ইসলাম গ্রহণ

মিকদাদ নবুয়ত ঘোষণার সূচনালগ্নেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মুশরিক কুরায়েশদের নির্যাতন সহ্য করেন। প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন বলে ঐতিহাসিকরা মত দিলেও তিনি কিভাবে মুসলমান হয়েছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় নি। ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত যে, সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণাকারী ছিলেন ৭ জন; মিকদাদ তাদেরই একজন।[১৪]

হিজরত

মিকদাদ দু’বার হিজরত করেছিলেন; প্রথমবার আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুসলমানদের তৃতীয় দলটির সাথে, আর দ্বিতীয়বার মদিনায়। যদিও তার মদিনায় হিজরতের সময় স্পষ্ট নয়; কিন্তু বিভিন্ন ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, হিজরতের প্রথম বছরে শাওয়াল মাসে সারিয়া আবু উবাইদাহ’তে তিনি মুসলমানদের সাথে যোগ দেন এবং তাদের সাথে মদিনায় হিজরত করেন।[১৫]

আল্লাহর নবি (স.) বলেছেন: মহান আল্লাহ্ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন ৪ জনকে ভালোবাসতে এবং তিনি আমাকে এ সংবাদও দিয়েছেন যে, তিনিও তাদেরকে ভালোবাসেন; (তারা হলো) আলী, মিকদাদ, আবুযার ও সালমান।[ইবনে হাজার আসকালানি, আল-ইসাবাহ, ১৯৯৫ খ্রি./১৪১৫ হি., খ. ৬, পৃ. ১৬১।

বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ

মহানবির (স.) জীবদ্দশায় মিকদাদ সবকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তিনি ছিলেন মহানবির (স.) বীরযোদ্ধাদের একজন।[১৬]

বদরের যুদ্ধে তিনি ছিলেন অশ্বারোহী যোদ্ধা। তার ঘোড়াকে ‘সাবহা’ বলা হত অর্থাৎ ভাসমান; হয়তবা মিকদাদের বীরত্বগাথা যুদ্ধের কারণে তার ঘোড়াকে ‘সাবহা’ তথা ভাসমান বলা হত।[১৭]

ওহুদের যুদ্ধেও মিকদাদের ভূমিকা ছিল নজরকাড়া; ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনার ভিত্তিতে ওহুদের যুদ্ধের শেষের দিকে আলী (আ.), তালহা, যুবাইর, আবু দাজানা, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও মিকদাদ ব্যতীত সকলে মহানবিকে (স.) ছেড়ে পালিয়ে যায়।[১৮] এ যুদ্ধে মিকদাদ তীরান্দাজ বাহিনীতে ছিলেন বলে কেউ কেউ জানিয়েছেন।[১৯] আবার কেউ কেউ যুবাইরের নেতৃত্বাধীন অশ্বরোহী বাহিনীতে ছিলেন বলে মত দিয়েছেন।[২০]

মহানবির (স.) জীবদ্দশায় সালমান, আম্মারআবুযারের পাশে মিকদাদ ছিলেন সর্বপ্রথম শিয়া যাদেরকে এ নামে সবাই চিনতো।[২১]

ইমাম আলীর স্থলাভিষিক্তির প্রতি সমর্থন

মহানবির (স.) ওফাতের পর এবং আবু বকর মহানবির খলিফা ও স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর মুসলমানদের মধ্য থেকে অল্পসংখ্যকই আলীর (আ.) প্রতি বিশ্বস্ত থেকে আবু বকরের হাতে বাইয়াত করা থেকে বিরত থাকেন। মিকদাদ সাকিফাহ’তে উপস্থিত ছিলেন না এবং আমিরুল মু’মিনীন (আ.) ও অপর কয়েকজন সাহাবীর সাথে মহানবির (স.) গোসল ও কাফন এবং তাঁর (স.) জানাযার নামাজ ও দাফনকার্যে ব্যস্ত ছিলেন।[২২] বিভিন্ন রেওয়ায়েতের সাক্ষ্যানুযায়ী মুষ্টিমেয় যে ক’জন হযরত ফাতেমা যাহরা’র (সা. আ.) জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি ছিলেন তাদেরই একজন।[২৩] কিছু কিছু সূত্রে তাকে ‘শুরতাতুল খামীস’-এর সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[২৪](শুরতাতুল খামিস হলো সর্বদা সশস্ত্র অবস্থায় প্রস্তুত থাকা একটি দল যারা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজে হজরত আলীকে (আ.) সাহায্য করতো এবং তাঁর সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতো।) [অবশ্য শোরতাতুল খামিস হযরত আলীর (আ.) হুকুমতে গঠিত হয়ে থাকলে ঐ দলে মিকদাদের থাকার সম্ভাবনা নেই, কেননা মিকদাদ ৩৩ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, অথচ হযরত আলীর (আ.) হুকুমতের শুরু ৩৫ হিজরীতে, এ জন্য মিকদাদকে শোরতাতুল খামিসের সদস্য ধরে নেয়া সম্ভব নয়।]

বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিকদাদ আলীর (আ.) খেলাফত ও জা-নশীনির বিষয়টি আবু বকর ও তার সাথীদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতেন এবং বিষয়টি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপও গ্রহণ করতেন। আলীর (আ.) সমর্থনে মিকদাদের কয়েকটি পদক্ষেপের প্রতি এখানে ইঙ্গিত করা হল:

  1. জনগণ আবু বকরের হাতে বাইয়াত করলেও মুহাজিরআনসারদের একটি দল তার হাতে বাইয়াত করা থেকে বিরত থেকে আলী ইবনে আবি তালিবের পাশে এসে দাঁড়ান, মিকদাদ ছিলেন তাদেরই একজন।[২৫]
  2. যখন ৪০ জন ব্যক্তি ইমাম আলীর (আ.) কাছে এসে বললো: ‘আমরা আপনার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতে এবং আপনার পক্ষ নেয়ার জন্য প্রস্তুত’। ইমাম (আ.) তাদেরকে বললেন: ‘যদি তোমরা নিজেদের কথার উপর অটল থাকো তাহলে আগামীকাল মাথামুণ্ডন করে আমার কাছে এসো। পরবর্তী দিন শুধু সালমান, মিকদাদ ও আবুযার মাথা মুণ্ডন করে ইমামের নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন।[২৬]
  3. দ্বিতীয় খলিফার পর নতুন খলিফা নির্বাচনে ৬ জনের শুরার ঘটনায় যখন আব্দুর রহমান ইবনে আওফ আলীকে (আ.) বললো: ‘যদি তুমি আল্লাহর কিতাব ও নবির (স.) সুন্নত এবং আবু বকরের পদ্ধতি অনুসরণ করো তবেই তোমার হাতে বাইয়াত করবো’, তখন আলী (আ.) প্রথম দু’টি শর্তকে (আল্লাহর কিতাব ও নবির সুন্নত অনুযায়ী আমল করা) মেনে নেন। এ সময় মেকদাদ অভিযোগ করে আব্দুর রহমানের দিকে তাকিয়ে বলেন: ‘আল্লাহর কসম! আলী হলো সেই ব্যক্তি যে সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে বিচার করে, তাকে তোমরা ত্যাগ করলে’। এরপর তিনি বলেন: কোন ব্যক্তি বা বংশকে আমি দেখিনি যে, নিজেদের নবির পর এমন মজলুম ও অসহায় হয়ে গেছে, যেভাবে আহলে বাইত জুলুমের শিকার হয়েছে।’[২৭]

উসমানের খেলাফতের বিরোধিতা করেছিলেন মিকদাদ এবং মদিনার মসজিদে প্রদত্ত এক ভাষণে এ বিরোধিতার কথা তিনি ঘোষণা দেন তিনি।[২৮]

ইয়াকুবি বর্ণনা করেছে যে, উসমানের হাতে যেদিন বাইয়াতের ঘটনা ঘটেছিল সেদিন রাতেই ইশার নামাজের জন্য উসমান বের হলে তার আগে আগে একজন বাতি নিয়ে হাটতে থাকে। এ সময় মিকদাদের সাথে তার দেখা হয়ে গেলে তিনি বলেন: এটা কেমন বিদআত?[২৯] ইয়াকুবির ভাষ্যমতে মিকদাদ ছিলেন ঐ দলের অন্তর্ভুক্ত যারা ছিলেন উসমানের সমালোচনাকারী ও আলী ইবনে আবি তালিবের প্রতি সমর্থন ব্যক্তকারী।[৩০]

আহলে বাইতের (আ.) রেওয়ায়েতে মিকদাদ

মিকদাদ সম্পর্কে মাসুমগণ (আ.) হতে বিভিন্ন রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে; যেগুলোর বেশীরভাগই তার ফজিলত, বৈশিষ্ট্য এবং ঈমান সম্পর্কে। নমুনা স্বরূপ ঐ রেওয়ায়েতের কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল:

  1. মিকদাদের প্রতি মহানবির (স.) ভালোবাসা: মহানবি (স.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ্ আমাকে ৪ ব্যক্তিকে ভালোবাসতে বলেছেন, জনৈক ব্যক্তি তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: আলী, সালমান, মিকদাদ ও আবুযার।[৩১]
  2. বেহেশতবাসী মিকদাদ: আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণিত যে, একদা আল্লাহর রাসূল (স.) বললেন: ‘আমার উম্মতের মধ্য হতে ৪ জনের জন্য বেহেশত অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে, হজরত আলী (আ.) ঐ ৪ জন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: আল্লাহর কসম, তুমি তাদের সবার প্রথমে, আর অবশিষ্ট ৩ জন হলো মিকদাদ, সালমান ও আবুযার। একইভাবে ইমাম সাদিক (আ.) ((إِنَّ الَّذِینَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ کانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا)) (‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের অভ্যর্থনার জন্যে আছে জান্নাতুল ফেরদাউস।’)[৩২] -এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন: আয়াতটি আবুযার, মিকদাদ, সালমান ও আম্মার সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।[৩৩]
  3. তাঁর ঈমান: ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘ঈমানের ১০টি পর্যায় রয়েছে, মিকদাদ হলেন ৮ম পর্যায়ে, আবুযার ৯ম পর্যায়ে এবং সালমান ১০ম পর্যায়ে।[৩৪]
  4. মাওয়াদ্দাতের আয়াতের উপর আমল: ইমাম সাদিক (আ.) মাওয়াদ্দাতের আয়াত ((قُل لا أَسئَلُکم عَلَیهِ أَجراً إِلاَّ المَوَدَّةَ فِی القُربی)) (বলুন, আমি আমার দাওয়াতের জন্যে তোমাদের কাছে কেবল (আমার) নিকট আত্নীয়দের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চাই না)[৩৫] সম্পর্কে বলেছেন: ‘আল্লাহর কসম! ৭ জন ব্যতীত এ আয়াতের উপর কেউ আমল করে নি, মিকদাদ তাদেরই একজন।[৩৬]
  5. মিকদাদ আহলে বাইত থেকে: একদা জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারি, আল্লাহর রাসূলকে (স.) সালমান, মিকদাদ ও আবুযার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। অতঃপর তিনি (স.) সবার সম্পর্কে কিছু না কিছু বললেন, মিকদাদ সম্পর্কে বললেন: ‘মিকদাদ আমাদের থেকে। যে তার দুশমন আল্লাহও তার দুশমন, আর যে তার বন্ধু আল্লাহও তার বন্ধু। হে জাবির! যখন কোন দোয়া করতে চাও এবং তা কবুল হওয়ার আশা রাখো, মহান আল্লাহকে তাদের নামের উসিলায় আহবান করো, কেননা এই নামগুলো প্রতিপালকের নিকট সর্বোত্তম (নাম)।[৩৭]
  6. ইমাম আলীর (আ.) প্রতি বিশ্বস্ততা: ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূলের (স.) পর জনগণ তার পথ-পন্থা থেকে প্রত্যাবর্তন করে, ৩ জন ব্যতীত; সালমান, আবুযার ও মিকদাদ।[৩৮] কিছু কিছু রেওয়ায়েতে মিকদাদকে আমিরুল মু’মিনীনের (আ.) সবচেয়ে অনুগত সাথী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।[৩৯]
  7. মিকদাদের রাজআত: কিছু কিছু রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে, মিকদাদ ঐ লোকদের অন্তর্ভুক্ত যারা ইমাম মাহদী’র (আ.) আবির্ভাব ও তাঁর বিপ্লবের সময় প্রত্যাবর্তন করে ইমামের (আ.) সঙ্গী হবেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।[৪০]
  8. মিকদাদের প্রতি ভালবাসা পোষণ: ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর রাসূলের (স.) পর বিচ্যুতির পথে হাটেন নি তাদের প্রতি মহব্বত পোষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। অতঃপর তিনি তাদের কয়েকজনের নাম বলেন; সালমান, আবুযার ও মিকদাদ।[৪১]

হাদীস বর্ণনা

মিকদাদ মহানবি (স.) থেকে বেশ কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং একদল রাভিও তাঁর থেকে হাদীস শুনেছে বা হাদীস বর্ণনা করেছে; যেমন: সুলাইম ইবনে কায়েস, আনাস ইবনে মালিক, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আব্দুর রহমান ইবনে আবি লাইলা, আবু আইয়ুব আনসারি, দুবাআহ বিনতে যুবাইর ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (তাঁর স্ত্রী) এবং তাঁর কন্যা কারিমাহ।[৪২]

স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা

মিকদাদ সম্পর্কে বিভিন্ন স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে, তার কয়েকটির নাম নিম্নে উল্লেখ করা হল: মুহাম্মাদ মুহাম্মাদি ইশতেহারিদী রচিত ‘সিমায়ে মেকদাদ’, গ্রন্থটি ‘পায়ামে ইসলাম প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। মুহাম্মাদ কামরানি আকদাম প্রণীত ‘মিকদাদ’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ‘হাদীসে নাইনাভা’ প্রকাশনী। ‘হযরত মিকদাদের সচিত্র জীবনী’; গ্রন্থটি গল্প আকারে বিভিন্ন ছবির সংযোজনে, ‘মারকাযে অফারিনেশহায়ে আদাবিয়ে তাদভিন’ এবং ‘সুরেয়ে মেহের’ প্রকাশনীর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে। মুহাম্মাদ জাওয়াদ আল-ফাকীহ রচিত ‘আল-মিকদাদ ইবনিল আসওয়াদ আল-কিন্দী আওওয়াল ফার্স ফীল ইসলাম’ গ্রন্থটি লেবাননের ‘মুআসসাসাতুল আ’লামি লিল-মাতবুআত’ প্রকাশনী প্রকাশ করেছে। ৪ খণ্ডে প্রকাশিত ‘সিলসিলাতুল আরকানিল আরবায়া’ গ্রন্থটির ৩য় খণ্ড মিকদাদের জীবনীর উপর রচিত হয়েছে, গ্রন্থটির লেখক মুহাম্মাদ জাওয়াদ ফাকীহ, এটি আরবি ভাষায় লেবানন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ‘মাআস সাহাবাতি ওয়াত তাবিঈন’ শীর্ষক ১০ খণ্ডের গ্রন্থটির ৬ষ্ঠ খণ্ড মিকদাদের জীবনী সম্পর্কে। আরবি ভাষায় ‘কামাল সাইয়্যেদ’ প্রণীত গ্রন্থটি কোমের আনসারিয়ান পাবলিকেশান্স প্রকাশ করেছে।

গ্রন্থপঞ্জি

  • আবি, আবু সাঈদ মানসুর ইবনিল হুসাইন, নাসরুদ দুরর ফীল মুহাদ্বারাত, তাহকীক: খালিদ আব্দুল গানী মাহফুজ, বৈরুত, দারুল কুতুবিল আলামিয়াহ, প্রথম সংস্করণ, ১৪২৪/২০০৪।
  • ইবনে আবিল হাদীদ, ইজ্জুদ্দীন ইবনে হিবাতুল্লাহ, শারহু নাহজিল বালাগাহ, তাহকীক: মুহাম্মাদ আব্দুল কারিম আন-নেমেরি, বৈরুত, দারুল কুতুবিল আলামিয়াহ, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৮/১৯৯৮।
  • ইবনে আসীর, আলী ইবনে মুহাম্মাদ, উসদুল গাবাহ, তাহকীক: মুহাম্মাদ ইব্রাহিম আল-বান্না, দারু ইহিয়ায়িত তুরাসিল আরাবি, ১৯৭০ খ্রি.।
  • ইবনে আসীর, আলী ইবনে মুহাম্মাদ, আল-কামিল ফিত তারিখ, বৈরুত, দারু সাদির।
  • ইবনে হাযম আন্দোলুসী, আলী ইবনে আহমাদ, জামহারাতু আনসাবিল আরাব, তাহকীক: মুহাম্মাদ আব্দুস সালাম হারুন, কায়রো, দারুল মাআরেফ।
  • ইবনে হাজার আসকালানী, আহমাদ ইবনে আলী, আল-ইসাবাতু ফীত তাময়ীযিস সাহাবাহ, তাহকীক: আদেল আহমাদ আব্দুল মাওজুদ ও আলী মুহাম্মাদ মুআওয়ায, বৈরুত, দারুল কুতুবিল আলামিয়াহ, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৫/১৯৯৫।
  • ইবনে সাআদ, মুহাম্মাদ ইবনে সাআদ, তাবাকাতুল কোবরা, তাহকীক: মুহাম্মাদ আব্দুল কাদের আতা, বৈরুত, দারুল কুতুবিল আলামিয়াহ, ১৪১০ হি., প্রথম সংস্করণ।
  • আমিন, সাইয়্যেদ মুহসিন আমিন, আইয়ানুশ শিয়া, তাহকীক ও তাখরীজ: হাসান আল-আমিন, বৈরুত, দারুত তাআরুফ লি-লমাতবুআত, ১৪০৩/১৯৮৩।
  • আমিনী, আব্দুল হুসাইন, আল-গাদীর ফীল কিতাবি ওয়াস সুন্নাতি ওয়াল আদাব, খ. ৯, বৈরুত, দারুল কুতুবিল আরাবিয়াহ, ১৩৯৭/১৯৭৭
  • বালাজুরি, আহমাদ ইবনে ইয়াহিয়া ইবনে জাবির, আনসাবুল আশরাফ, তাহকীক: মুহাম্মাদ হামিদুল্লাহ, মিসর, মুআহহাদুল মাখতুতাত বি-জামিয়াতিদ দুওয়ালিল আরাবিয়াতি বিল-ইশতিরাকি মাআ দারিল মাআরিফ, ১৯৫৯ খ্রি.।
  • খুয়ী, আবুল কাসেম, মু’জামু রিজালিল হাদীস, মারকাযে নাশরে আসারে শিয়েহ, কোম, ১৪১০হি./ ১৩৬৯ ফার্সি সন।
  • যারকুলী, খাইরুদ্দীন, আল-আ’লাম, খ. ৭, বৈরুত, দারুল ইলমি লিল-মালাঈন, ১৯৭০ খ্রি.।
  • শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনিল হুসাইন, আল-খিসাল, ১৪০৩ হি., পৃ. ৪৬১-৪৬৫, তাহকীক: আলী আকবার গাফফারী, কোম, জামেয়ে মুদাররিসীনে হাওযা ইলমিয়া কোম, ১৪০৩ হি./ ১৩৬২ ফার্সি সন।
  • শেইখ সাদুক, উয়ুনু আখবারির রিযা (আ.), তেহরান, জাহান পাবলিকেশন্স, ১৩৭৮ হি.,।
  • তাবারী, মুহাম্মাদ ইবনে জারির, তারিখে তাবারি, বৈরুত।
  • কুম্মি, শেইখ আব্বাস, মুনতাহাল আমাল, কোম, হিজরত প্রকাশনী, ১৪১৩ হি.।
  • কেশশি, ইখতিয়ারু মা’রিফাতির রিজাল, তাহকীক: সাইয়্যেদ মাহদি রেজায়ী, কোম, মুআসসাসাতু আলিল বাইত লি-ইহিয়াইত তুরাস, ১৪০৪ হি.।
  • কুলাইনি, মুহাম্মাদ ইয়াকুব, আল-কাফী, তাসহীহ: আলী আকবার গাফফারী ও মুহাম্মাদ আখুন্দী, তেহরান, দরুল কুতুবিল ইসলামিয়া, চতুর্থ সংস্করণ, ১৪০৭ হি.।
  • মামকানী, আব্দুল্লাহ, তানকীহুল মাকাল ফী ইলমির রিজাল, নাজাফে আশরাফ, মুর্তাযাভিয়াহ প্রকাশনী, ১৩৫২ হি.।
  • মামকানী, আব্দুল্লাহ, কামুসুর রিজাল।
  • মাজলিসী, মুহাম্মাদ বাকির, বিহারুল আনওয়ার, দারু ইহিয়াইত তুরাসিল আরাবি, তৃতীয় সংস্করণ, ১৪০৩ হি.।
  • মাযযি, ইউসুফ ইবনে আব্দির রাহমান, তাহযীবুল কামাল ফী আসমাইর রিজাল, মুহাক্কিক: বাশশার আওয়াদ মা’রুফ, বৈরুত, মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ১৪০০ হি.।
  • মুফিদ, মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ, আল-ইখতিসাস, কোম, জামেয়ে মুদাররেসীন।
  • মুফিদ, মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ, আল-ইরশাদ, ফার্সি অনুবাদ: হাসান মুসাভি মুজাব, কোম, সারওয়ার প্রকাশনী, ১৩৮৮ ফার্সি সন।
  • নৌবাখতি, হাসান ইবনে মুসা, ফিরাকুশ শিয়াহ, বৈরুত, দারুল আদ্বওয়া, ১৪০৪/১৯৮৪।
  • ইয়াকুবি, তারিখে ইয়াকুবি, কোম, শারিফ রাযী, ১৩৭৩ ফার্সি সন।