মাকামে মাহমুদ
মাকামে মাহমুদ (مقام مَحمود): হচ্ছে সর্বোত্তম ও সর্বোচ্চ প্রশংসিত স্থান; এটি রাসূলুল্লাহর (সা.) অন্যতম উপাধি। আল্লাহ তায়ালা তাহাজ্জুদ ও রাত্রকালীন ইবাদত বন্দেগীর কারণে রাসূলকে (সা.) এমন উপাধি দান করেন। বিশিষ্ট মুফাসসিরগণ সূরা বনি ইসরাঈলের ৭৯ নং আয়াতের তাফসীরে মাকামে মাহমুদের ব্যাখ্যায় এ অবস্থানকে রাসূলের (সা.) মাকামে শাফায়াতের সাথে তুলনা করেছেন।
কুরআনের ভাষায়,
আর রাতের একাংশে তাহাজ্জুদ—নামায আদায় কর, এটা (এ সুন্নাত) তোমার জন্য অতিরিক্ত (ইবাদাতস্বরূপ); অনতিবিলম্বে তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রশংসিত স্থানে পৌঁছে দেবেন। [১]
মুফাসসিরগণ উক্ত আয়াতে বর্ণিত মাকামে মাহমুদের ব্যাখ্যায় এ অবস্থানকে সৃষ্টিজগতের উপর রাসূলুল্লাহর (সা.) বিশেষ কতৃত্ব এবং মহান আল্লাহর সাথে তাঁর অবিচ্ছেদ্য নিবিড় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। অবশ্য এ দু’টি অবস্থাই মাকামে শাফায়াত তথা আল্লাহর নিকট শাফায়াতকারীর মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যতা রাখে। জিয়ারাতে আশুরাতে ইমাম হুসাইনকে (আ.) মাকামে মাহমুদের অধিকারী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
রাসূলের (সা.) সর্বোচ্চ প্রশংসিত স্থান
ইসলামি পণ্ডিত ও শীর্ষ মুফাসসিরগণ মাকামে মাহমুদ বলতে রাসূলের (সা.) সর্বোচ্চ প্রশংসিত স্থানকে বুঝিয়েছেন; যা মহান আল্লাহ তাঁকে তাহাজ্জুদের নামায [২] ও রাত্রকালীন ইবাদত-বন্দেগীর কারণে দান করেছেন। [৩]
মাকামে মাহমুদ সম্পর্কে ইসলামি পণ্ডিত ও শীর্ষ মুফাসসিরগণের মধ্যে কিছু দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান; যেগুলোর প্রত্যেকটিতে মাকামে মাহমুদকে মাকামে শাফায়াতের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যেমন:
- মাকামে শাফায়াত- অনেক শিয়া [৪] এবং সুন্নী [৫] মুফাসসিরগণ হাদীস ও রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে মাকামে মাহমুদকে মাকামে শাফায়াতের সাথে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন- সূরা বনি ইসরাঈলের ৭৯ নং আয়াতে মাকামে মাহমুদকে মাকামে শাফায়াতের সাথে তুলনা করা হয়েছে; অর্থাৎ যে মাকাম থেকে রাসূল (সা.) স্বীয় উম্মতের জন্য আল্লাহর নিকট শাফায়াত প্রার্থনা করবেন। [৬] অনুরূপভাবে ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আ.) ও ইমাম জাফর সাদীক (আ.) থেকে এ আয়াতের তাফসীরে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তাতে মাকামে মাহমুদকে মাকামে শাফায়াত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। [৭] কিছু কিছু মুফাসসিরগণ মাকামে মাহমুদকে মাকামে শাফায়াত হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। [৮] সাইয়েদ মুহাম্মাদ হুসাইন তেহরানি উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা রাসূলকে (সা.) শাফায়াতের অধিকার দিয়েছেন তা মূলত মাকামে মাহমুদের অবস্থান থেকে উৎসারিত।
- সৃষ্টিজগতের উপর প্রভাবশীল- কোন কোন মুফাসসিরগণের দৃষ্টিতে মাকামে মাহমুদ হচ্ছে এমনই এক সুউচ্চ অবস্থান; যে অবস্থানে অসীন হওয়ার ফলে সমগ্র সৃষ্টিজগতের উপর প্রভাবশীল হওয়া যায় এবং এ অবস্থানে সে যা কিছুই চাইবে –হোক তা কোন বান্দার জন্য শাফায়াত- আল্লাহ তা তাকে দান করবেন। [৯]
- আল্লাহর নিকট চুড়ান্ত নৈকট্যপ্রাপ্ত- তাফসীরে নমুনা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মাকামে মাহমুদ এমনই এক অবস্থার নাম; যেখানে আল্লাহর সাথে রাসূলের (সা.) চুড়ান্ত নৈকট্য সৃষ্টি হয়। যার ফলে তিনি আল্লাহর দরবারে শাফায়াতের অধিকার প্রাপ্ত হন। [১০]
ইমামগণের জন্য মাকামে মাহমুদ
কোন কোন জিয়ারত নামাতে আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) [১১] ইমাম হুসাইন (আ.) [১২] এবং ইমাম রেযাকে (আ.) [১৩] মাকামে মাহমুদের অধিকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন: জিয়ারাতে আশুরাতে উল্লেখ করা হয়েছে- আমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি… তিনি যেন আমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে আপনার (হে ইমাম হুসাইন!) সান্নিধ্য লাভের সুযোগ দেন… আর তার নিকট প্রার্থনা করি তিনি আপনাকে যে মাকামে মাহমুদের অধিকারী করেছেন; আমাদেরকেও যেন উক্ত মাকামের সান্নিধ্য করে। [১৪]
খ্যাতনামা শিয়া মনীষী ও মুফাসসির আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাজী বনি ইসরাঈলের ৭৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেছেন যে, যদিও এ আয়াতে রাসূলকে (সা.) উদ্দেশ্য করে মাকামে মাহমুদে উন্নীত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তদুপরি ওলী-আওলিয়া এবং মু’মিনগণ তাহাজ্জুদের নামায ও রাত্রকালীন ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ সান্নিধ্য লাভ করতে পারেন; যার মাধ্যমে তারা আংশিক শাফায়াতের অধিকারী হতে পারেন। [১৫]
তথ্যসূত্র
- ↑ সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত নং ৭৯।
- ↑ তাবারসি, মাযমাউল বায়ান, খণ্ড ৬, পৃ. ৬৭০।
- ↑ শেখ তুসী, আত তিবইয়ান, খণ্ড ৬, পৃ. ৫১০; তাবারসি, মাযমাউল বায়ান, খণ্ড ৬, পৃ. ৬৭১; ফাইজে কাসানি, তাফসীরে সাফী, খণ্ড ৩, পৃ. ৫৬৯; মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনা, খণ্ড ১২, পৃ. ২৩২ এবং তাবাতাবায়ি, তাফসীরে আল মীযান, খণ্ড ১, পৃ. ১৭৮।
- ↑ শেখ তুসী, আত তিবইয়ান, খণ্ড ৬, পৃ. ৫১২; তাবারসি, মাযমাউল বায়ান, খণ্ড ৬, পৃ. ৬৭১; ফাইজে কাসানি, তাফসীরে সাফী, খণ্ড ৩, পৃ. ২১১-২১২; মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনা, খণ্ড ১২, পৃ. ২৩২ এবং তাবাতাবায়ি, তাফসীরে আল মীযান, খণ্ড ১, পৃ. ১৭৮; জাওয়াদ আমুলী, তাফসীরে তাসনীম, খণ্ড ৪, পৃ. ২৮৫ এবং তাফসীরুল কুরআন, পৃ. ২৮৬।
- ↑ ফাখরে রাজি, মাফাতিহুল গাইব, খণ্ড ২১, পৃ. ৩৮৭।
- ↑ ইবনে হাম্বাল, মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল, খণ্ড ২, পৃ.৩১৪।
- ↑ আইয়াশি, কিতাবুল তাফসীর, খণ্ড ২, পৃ. ৩১৪।
- ↑ তাবাতাবায়ি, তাফসীরে আল মীযান, খণ্ড ১, পৃ. ১৭৮; মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনা, খণ্ড ১২, পৃ. ২৩২; জাওয়াদ আমুলী, তাফসীরে তাসনীম, খণ্ড ৪, পৃ. ২৮৫
- ↑ তাবারসি, মাযমাউল বায়ান, খণ্ড ৬, পৃ. ৬৭১; ইবনে আরাবী, ফুতুহাতে মাক্কী, খণ্ড ৪, পৃ. ৫৭ এবং তাফসীরে নুরুস সাকালাঈন, খণ্ড ৩, পৃ. ২০৬।
- ↑ মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনা, খণ্ড ১২, পৃ. ২৩১-২৩২।
- ↑ শেখ তুসী, তাহজিবুল আহকাম, খণ্ড ৬, পৃ. ৩০।
- ↑ মাজলিসী, বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ১০১, পৃ. ২৯২।
- ↑ সাদুক, মানলা ইয়াহযারহুল ফাকীহ, খণ্ড ২, পৃ. ৬০৫।
- ↑ মাজলিসী, বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ১০১, পৃ. ২৯২।
- ↑ মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনা, খণ্ড ১২, পৃ. ২৩২।
গ্রন্থপঞ্জি
- ইবনে হাম্বল, আহমাদ, মুসনাদ, বৈরুত, দারু সাদের, (প্রকাশের তারিখ অজ্ঞাত)।
- ইবনে আরাবি, মুহিউদ্দিন, ফুতুহাতে মাক্কিয়্যাহ, কোম, মুয়াস্সাসাতু আলিল বাইত লি ইহয়ায়িত্ তুরাস, (প্রকাশের তারিখ অজ্ঞাত)।
- বাহরানি, সাইয়্যেদ হাশেম, আল-বুরহানু ফি তাফসিরিল কুরআন, তেহরান, বুনয়াদে বেসাত, ১৪১৬ হিঃ।
- জাওয়াদী আমুলী, আব্দুল্লাহ, তাফসিরে তাসনিম, কোম, মারকাজে নাশরে ইসরা, ১৩৭৮ (সৌরবর্ষ)।
- শাব্বার, সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ, তাফসিরুল কুরআনিল কারিম, বৈরুত, দারুল বালাগাতি লিত্ তাবাআতি ওয়ান্ নাশরে, ১৪১২ হিঃ।
- শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে বাবুয়েহ, মান লা ইয়াহযুরুহুল ফাকিহ, তাহকিক আলী; আকবার গাফ্ফারী, কোম, দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামী, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৪১৩ হিঃ।
- তাবাতাবায়ী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন, তাফসিরুল মিজান, কোম, দাফতারে ইন্তেশারাতে ইসলামী, ১৩৭৭ (সৌরবর্ষ)।
- তাবারসি, ফাযল ইবনে হাসান, তাফসিরু জাওয়ামিউল জামেঅ্, তেহরান, ইন্তেশারাতে দানেশগাহে তেহরান ও মুদিরিয়াতে হাওযায়ে ইলমিয়্যাহ কোম, ১৩৭৭ (সৌরবর্ষ)।
- তাবারসি, ফাযল ইবনে হাসান, মাজমাউল বায়ান ফি তাফসিরিল কুরআন, তেহরান, ইন্তেশারাতে নাসের খুসরু, ১৩৭২ (সৌরবর্ষ)।
- শেইখ তূসী, মুহাম্মাদ ইবনে হাসান, তাহযিবুল আহকাম, তাহকিক; হাসান মুসাভী খোরাসান, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, চতুর্থ প্রকাশ, ১৪০৭ হিঃ।
- শেইখ তূসী, মুহাম্মাদ ইবনে হাসান, আত্-তিবয়ান ফি তাফসিরিল কুরআন, বৈরুত, দারু ইহয়ায়িত্ তুরাসিল আরাবি, (প্রকাশের তারিখ অজ্ঞাত)।
- আইয়াশী, মুহাম্মাদ ইবনে মাসউদ, কিতাবুত্ তাফসির, তেহরান, চাপখানে ইলমিয়্যাহ, ১৩৮০ হিঃ।
- ফাখরে রাযী, মুহাম্মাদ ইবনে উমার, মাফাতিহুল গাইব, বৈরুত, দারু ইহয়ায়িত্ তুরাসিল আরাবি, ১৪২০ হিঃ।
- ফেইযে কাশানী, মোল্লা মুহসেন, তাফসিরুস্ সাফী, তেহরান, ইন্তেশারাতুস সাদর্, ১৪১৫ হিঃ।
- কুরতুবী, মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল-আনসারী, ইয়াউমুল ফাযায়িল আকবার, তহকিক; মুহাম্মাদ ইবরাহিম সালিম, মিশর, আত্-তাবাউ ওয়ান্ নাশরু মাকতাবাতিল কুরআন, (প্রকাশের তারিখ অজ্ঞাত)।
- মাজলেসী, মুহাম্মাদ বাকের, বিহারুল আনওয়ার, বৈরুত, দারু ইহয়ায়িত্ তুরাসিল আরাবি, ১৪০৩ হিঃ।
- মাকারেম সিরাজী, নাসের, তাফসিরে নেমুনেহ, কোম, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, ১৩৭০ (সৌরবর্ষ)।