মসজিদ-এ সাখরাহ
মসজিদ-এ সাখরাহ; কুব্বাত আস-সাখরাহ (قبّة الصخرة) বা সাখরাহ মুকাদ্দাসাহ; বাইতুল মোকাদ্দাস শহরে অবস্থিত মসজিদুল আকসা’য় মুরিয়া টিলার উপর নির্মিত। মসজিদটি এবং এর গম্বুজ একটি বড় শিলার উপর নির্মিত হয়েছে। ইহুদি, মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের নিকট মসজিদটি বিশেষ সম্মানের অধিকারী। মুসলমানদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে হযরত মুহাম্মাদ (স.) মি’রাজের রাতে এই পাথরের উপর থেকে আসমানে উর্ধ্বগমন করেন। ইহুদিদের বিশ্বাস হলো, ভূপৃষ্ঠকে ঐ পাথর থেকে বিস্তৃতি দান করা হয়েছে, হযরত আদমের শরীর মোবারক ঐ শিলার ধূলিকণা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং হযরত ইব্রাহিম (আ.) এ স্থানেই নিজ সন্তানকে কুরবানী প্রদানের জন্য নির্দেশিত হয়েছিলেন।
প্রসিদ্ধ সোনালী কুব্বাহ বা গম্বুজ, যেটিকে কেউ কেউ মসজিদুল আকসা বলে মনে করে থাকেন, উল্লেখিত সাখরাহ তথা শিলার উপর নির্মিত হয়েছে এবং এটাই ‘মসজিদ-এ সাখরাহ’। মসজিদ-এ সাখরাহ হিজরী প্রথম শতাব্দিতে আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের শাসনামলে নির্মিত হয় এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে এর সংস্কার করা হয়।
গুরুত্ব
দামেস্কে অবস্থিত ‘উমাইয়া মসজিদ’, কায়রোতে অবস্থিত আমরে আস মসজিদ এবং তিউনিশিয়ায় অবস্থিত ‘কাইরুয়ান জামে মসজিদ’সহ কোব্বাত আস-সাখরা মসজিদটি হিজরী প্রথম শতাব্দিতে নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর অন্যতম।[১] ইহুদি, মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের নিকট মসজিদটি বিশেষ সম্মানের অধিকারী।[২]
যে পাহাড়ের উপর মসজিদ-এ সাখরাহ নির্মিত হয়েছে, তা দ্বিতীয় হিজরী পর্যন্ত মুসলমানদের কেবলা ছিল।[৩]
মুসলমানদের আকিদা অনুযায়ী, হযরত মুহাম্মাদ (স.) মি’রাজের রাতে এই শিলার (Rock) উপর থেকেই আসমানে উর্ধ্বগমন করেন।[৪] ইহুদিদের বিশ্বাস এই শিলা থেকেই পৃথিবী সম্প্রসারিত হয়েছে, হযরত আদম (আ.)-এর অবয়ব মোবারক এর ধূলিকণা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ সন্তানকে এ স্থানে কুরবানী প্রদানের জন্য নির্দেশিত হয়েছিলেন এবং তিনি কুরবানীর উদ্দেশ্যে তাকে এখানেই নিয়ে এসেছিলেন।[৫]
ভৌগলিক অবস্থান এবং বৈশিষ্ট্য
মসজিদে সাখরা বা কুব্বাত আত-সাখরাহ, মসজিদুল আকসার উঠোনে বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত মুরিয়া টিলার উপর নির্মিত হয়েছে।[৬] কোব্বাত আত-সাখরা একটি সোনালী গম্বুজের অধিকারী এবং গম্বুজটি ৮ কোণ বিশিষ্ট একটি স্থাপনার উপর নির্মিত হয়েছে, যার দরজা ৪ চারদিকে খোলে।[৭]
মসজিদে সাখরা’র দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত মরমর পাথরের একটি পিলারের উপর ‘কাদামে মুহাম্মাদ’ নামে একটি মাকাম (স্থান) রয়েছে; বলা হয়েছে যে, শাবে মি’রাজে মহানবি (স.)-এর পদচিহ্ন ওটা।[৮] এছাড়া কুব্বাত আস-সাখরার সন্নিকটে ‘কোব্বাত আন-নাবি’ নামে প্রসিদ্ধ একটি মাকাম রয়েছে, কুদসের বাসিন্দাদের বিশ্বাস হযরত খিযির (আ.) ঐ স্থানে নামায আদায় করেছেন।[৯] সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যের দিক থেকে কোব্বাত আস-সাখরাহ ইসলামি স্থাপনাগুলোর মাঝে অন্যতম সমৃদ্ধ স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত।[১০]
ইতিহাস ও উৎপত্তি
মসজিদ-এ সাখরা’র নির্মাণকাজ ৬৬ হিজরীতে উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের শাসনামলে বাইতুল মুকাদ্দাসে (জেরুজালেমে) অবস্থিত মুরিয়া নামক টিলার উপর শুরু হয় এবং ৭২ হিজরীতে সমাপ্ত হয়।[১১] আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর মক্কায় খেলাফত ঘোষণার পর হাজীদেরকে যখন তার নিকট বাইয়াত গ্রহণে বাধ্য করছিল তখন আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান হজ্জের সফর থেকে জনগণকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, আর এর ধারাবাহিকতায় সে কোব্বাত আস-সাখরার তাওয়াফ ও যিয়ারতকে হজ্জের সফরের স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা করে।[১২]
২১৬ হিজরীতে আব্বাসি খলিফা আব্বাসি খলিফা মা’মুনের সময়কালে কোব্বাত আস-সাখরাহ সংস্কার করা হয়। সংস্কার কাজ শেষে মসজিদের নাম খচিত ফলকে আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের নামের পরিবর্তে মা’মুনের নাম লিখে দেওয়া হলেও নির্মাণের বছর তথা ৭২ হিজরী লেখাটি পরিবর্তন করা হয়নি।[১৩]
৪০৭ হিজরীতে কুদসে ভয়াবহ ভূমিকম্প হলে কোব্বাত আস-সাখরা ভেঙ্গে যায় এবং ৪১২ হিজরীতে ফাতেমি খলিফা আয-যাহেরে’র যুগে মসজিদে সাখরা পূণরায় সংস্কার করা হয়। ৪৬০ হিজরীতে ভূমিকম্পের ঘটনায় আবারও মসজিদটি ভেঙ্গে পড়ে এবং ৪৬৭ হিজরীতে আব্বাসীয় খলিফা আল-কায়েম বি-আমরিল্লাহ’র খেলাফতকালে পূণরায় তা সংস্কার করা হয়।[১৪]
নামকরণ
মসজিদে সাখরা নামকরণের কারণ হচ্ছে মসজিদটি বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত মুরিয়া টিলার উপরে বিদ্যমান একটি সাখরার (শিলা/বৃহৎ পাথর খণ্ড) উপর নির্মিত। এই কারণে একে কোব্বাত আস-সাখরাও বলা হয়।[১৫] আরাবিতে কোব্বাত শব্দের অর্থ হলো গম্বুজ।[১৬]
অনেকে কোব্বাত আস-সাখরাকে মসজিদুল আকসা বলে মনে করে, অথচ কোব্বাত আস-সাখরার গম্বুজটি সোনালী রংয়ের; কিন্তু মসজিদুল আকসার গম্বুজটি আবছা কালো রং বিশিষ্ট।[১৭]
তথ্যসূত্র
- ↑ সাআদাতি, "নাকশে আমাকেন ওয়া আসার দার তামাদ্দোনে ইসলামি", পৃ. ১৫০।
- ↑ বীনেশ, নেগাহি নৌ বে জাঙ্গহায়ে সালিবী, ১৩৮৬ ফার্সি সন, পৃ. ২৫।
- ↑ মীর আবুল কাসেমি, বাসতান শেনাসি, ১৩৯২ ফার্সি সন, পৃ. ১১৪।
- ↑ মূসা গৌশে, তারিখে মাজমুয়ে মাসজিদুল আকসা, ১৩৯০ ফার্সি সন, পৃ. ২৩।
- ↑ হামিদী, তারিখে উরশালিম, ১৩৮১ ফার্সি সন, পৃ. ১৭ ও ১৮।
- ↑ মূসা গৌশে, তারিখে মাজমুয়ে মাসজিদুল আকসা, ১৩৯০ ফার্সি সন, পৃ. ২৩।
- ↑ মূসা গৌশে, তারিখে মাজমুয়ে মাসজিদুল আকসা, ১৩৯০ ফার্সি সন, পৃ. ২৩।
- ↑ হামিদী, তারিখে উরশালিম, ১৩৮১ ফার্সি সন, পৃ. ১৭ ও ১৮।
- ↑ নেজাতি, হযতর খিযির (আ.) ওয়া মাকান হায়ে মুন্তাসাব বে ইশান, ১৩৯৫ ফার্সি সন, পৃ. ২৪৪।
- ↑ হামিদী, তারিখে উরশালিম, ১৩৮১ ফার্সি সন, পৃ. ১৭ ও ১৮।
- ↑ মূসা গৌশে, তারিখে মাজমুয়ে মাসজিদুল আকসা, ১৩৯০ ফার্সি সন, পৃ. ২৩।
- ↑ আদ-দামিরী, হায়াতুল হায়াওয়ানুল কোবরা, ১৪২৪ হি., খণ্ড ১, পৃ. ১০০; হুসাইনি তেহরানি, ইমাম শেনাসি, ১৪১৮ হি., খণ্ড ১৮, পৃ. ৩২৩ ও ৩২৫।
- ↑ মূসা গৌশে, তারিখে মাজমুয়ে মাসজিদুল আকসা, ১৩৯০ ফার্সি সন, পৃ. ২৬।
- ↑ মূসা গৌশে, তারিখে মাজমুয়ে মাসজিদুল আকসা, ১৩৯০ ফার্সি সন, পৃ. ২৬।
- ↑ হামিদী, তারিখে উরশালিম, ১৩৮১ ফার্সি সন, পৃ. ১৭ ও ১৮।
- ↑ মুসাভী পানাহ, ইব্রাহিম, হারাম দার ওয়াঝেহ-হা, ১৩৯১ ফার্সি সন, পৃ. ৪৩।
- ↑ মূসা গৌশে, তারিখে মাজমুয়ে মাসজিদুল আকসা, ১৩৯০ ফার্সি সন, পৃ. ৭।
গ্রন্থপঞ্জি
- বীনেশ, আব্দুল হুসাইন, নেগাহি নৌ বে জাঙ্গহায়ে সালিবী, কোম, যামযামে হেদায়াত, ১৩৮৬ ফার্সি সন।
- হামিদী, জাফার, তারিখে উরশালিম, আমির কাবীর, তেহরান, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৩৮১।
- হুসাইনি তেহরানি, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হুসাইন, ইমাম শেনাসি, খণ্ড ১৮, মাশহাদ, এন্তেশারাতে আল্লামেহ তাবাতাবাঈ, ১৪১৮ হি.।
- আদ-দামিরী, কামালূদ্দীন মুহাম্মাদ, হায়াতুল হায়াওয়ানুল কোবরা, বৈরুত, দারুল কুতুবিল আলামিয়াহ, ১৪২৩ হি./২০০৭ ইং।
- সাআদাতি, কাদের, নাকশে আমাকেন ওয়া আসার দার তামাদ্দোনে ইসলামি, উলামায়ে ইসলামের দৃষ্টিতে চরপন্থি ও তাকফিরি মুভমেন্ট শীর্ষক আন্তর্জাতিক কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে রচিত প্রবন্ধ সমাহার, খণ্ড ১, কোম, দারুল এ’লাম লি-মাদরাসাতি আহলিল বাইত, ১৩৯৩ ফার্সি সন।
- মুসাভী পানাহ, ইব্রাহিম, হারাম দার ওয়াঝেহ-হা, মাশহাদ, কুদসে রাজাভি আস্তানা, ১৩৯১ ফার্সি সন।
- মীর আবুল কাসেমি, মুহাম্মাদ তাকী, বাসতান শেনাসিয়ে কুরআন, রাশত, কেতাবে মুবিন, ১৩৯২ ফার্সি সন।
- নেজাতি, মুহাম্মাদ সাঈদ ও মুহাম্মাদ মাহদি ফাকীহ বাহরুল উলুম, হযতর খিযির (আ.) ওয়া মাকান হায়ে মুন্তাসাব বে ইশান, তেহরান, মাশআর, ১৩৯৫ ফার্সি সন।