হজ্জের রুকনসমূহ
নিবন্ধটিতে ফিকাহ সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়ের সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়েছে, এটি আমলের মানদণ্ড নয়। এ বিষয়ক মাসআলা ও আহকাম জানার জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রন্থের শরণাপন্ন হোন।
হজ্জের রুকনসমূহ (আরবিঃ أركان الحج); হল হজ্জের ওয়াজিব (অবশ্য পালনীয়) কর্মসমূহ; যেগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করলে হজ্জ বাতিল হয়ে যায়। শিয়া ফকীহগণের দৃষ্টিতে এহরাম, তাওয়াফ, আরাফাতে অবস্থান, মাশআরুল হারামে অবস্থান (মুযদালাফায়), সাফা ও মারওয়ার মাঝে সায়ী করা হজ্জের রুকনগুলোর অন্যতম। কিছু কিছু ফকীহ’র মতে নিয়্যাত, তালবিয়্যাহ ও হজ্জের কার্যাদি পর্যায়ক্রমে আঞ্জাম দেওয়াও হজ্জের রুকনগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
বলা হয়েছে যে, জেনেশুনে অথবা শরয়ী হুকুম না জানার কারণে ওয়াজিব রুকন পরিত্যাগ করলে হজ্জ বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু হজ্জের রুকন নয় এমন কিছু পরিত্যাগ করলে -তা যদি ইচ্ছাকৃতভাবেও হয়ে থাকে- হজ্জ বাতিল হয় না এবং ঐ আমলটি পূনরায় আঞ্জামের জন্য নায়েব বা প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
হজ্জের আরকান
হজ্জের আরকান (রুকুনসমূহ) বলতে হজ্জের ঐ সকল ওয়াজিব ও মূল কাজকে বলা হয় যেগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করলে হজ্জ বাতিল হওয়ার কারণ হয়।[১] ফিকহী পরিভাষায় কোন ইবাদতের রুকন হল ঐ আমলের অবশ্য পালনীয় অংশ যা জেনেশুনে বা অজানায় পরিত্যাগ করলে নামাজের মত ইবাদত বাতিল হওয়ার কারণ হয়।[২]
আহলে বাইত (আ.)-এর মাযহাবের অনুসারী (শিয়া) ফকীহগণের দৃষ্টিতে ইহরাম, তাওয়াফ, আরাফাতে অবস্থান, মাশআরুল হারামে অবস্থান (মুযদালাফায়) এবং সাফা ও মারওয়ার মাঝে সায়ী হজ্জের রুকন হিসেবে গণ্য।[৩] তবে নিয়্যাত, তালবিয়া এবং তারতীব (পর্যায়ক্রমে হজ্জের কার্যাদি আঞ্জাম দেওয়া) রুকনের অন্তর্ভুক্ত কি না এ প্রসঙ্গে মতানৈক্য রয়েছে। শিয়া ফকীহদের মাঝে মুহাম্মাদ বিন জামালদ্দীন মাক্কি আমেলী (শহীদে আওয়াল),[৪] সাইমারী, কাশেফুল গিতা ও মুহাক্কিক কারাকির[৫] তে এ আমলগুলো রুকনের অন্তর্ভক্ত।
সুন্নি মাযহাবের ফকীহগণের মাঝেও হজ্জের রুকনের বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে। শাফেয়ী মাযহাবের ফকীহদের দৃষ্টিতে হজ্জের রুকন ৬টি, মালেকি মাযহাবের ফকীহগণ এবং হাম্বালি মাযহাবের অনেক ফকীহর মতে ৪টি এবং মশহুর হানাফী ফকীহদের দৃষ্টিতে ২টি।[৬] শাফেয়ীরা অপর রুকনের পাশাপাশি হালক্ব (মাথামুন্ডন) ও তাক্বছীরও (চুল ছাটা) রুকনের অন্তর্ভুক্ত বলে জানে। মালেকী মাযহাবের ফকীহরা মুযদালাফায় অবস্থানের রুকন হওয়ার বিষয়টি গ্রহণ করেননি। হাম্বালি মাযহাবের ফকীহগণ সাফা ও মারওয়ার মাঝে সায়ী করাটা রুকনের অন্তর্ভুক্ত কিনা এ প্রসঙ্গে দ্বিধাগ্রস্ত। এছাড়া হানাফী মাযহাবের ফকীহগণ ইহরাম, মুযদালাফায় অবস্থান এবং সাফা ও মারওয়ার মাঝে সায়ী করাকে রুকন বলে মনে করেন না।[৭]
হজ্জের আহকাম
- হজ্জের রুকনসমূহ এবং হজ্জের রুকন নয় এমন ওয়াজিব কর্মসমূহের মধ্যে পার্থক্য হল জেনেশুনে কোন রুকন পরিত্যাগ করলে হজ্জ বাতিল হয়ে যায়। যদি কেউ জেনেশুনে -অজানায় নয়- হজ্জের রুকনগুলোর কোনটি পরিত্যাগ করে তবে তার হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে;[৮] কিন্তু যদি কেউ হজ্জের রুকন নয় এমন (যেমন, মাথা মুন্ডানো, চুল ও নখ ছাটা, জামারাতে পাথর নিক্ষেপ করা ও কুরবানী) কোন কাজ ইচ্ছাকৃতভাবেও ত্যাগ করে তবুও তার হজ্জ বাতিল হবে না।[৯] কোন কোন ফকীহের মতে, শরয়ী বিধান না জানার কারণে অনিচ্ছায় রুকন পরিত্যাগ করা, জেনেশুনে রুকন পরিত্যাগ করার মতই হজ্জকে বাতিল করে দেয়।[১০]
- আরাফাত ও মুযদালাফায় অবস্থান পরিত্যাগ করা চায় তা ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, হজ্জ বাতিল হওয়ার কারণ হয়।[১১]
- শিয়া ফকীহগণের মতে হজ্জের রুকনের কোন একটি ভুলে গেলে শুধুমাত্র ঐ অবস্থায় নায়েব বা প্রতিনিধি নির্ধারণ করে ঐ কাজ আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব যখন পুনরায় মক্কায় প্রত্যাবর্তন অসম্ভব ও কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে।[১৯] কিন্তু যদি রুকন নয় এমন কোন কাজ আঞ্জাম দিতে ভুলে যায় (ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়) সেক্ষেত্রে যেকোন অবস্থায় ঐ কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য নায়েব বা প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে।[১২]
- মশহুর ইমামি ফকীহগণের দৃষ্টিতে নতুনভাবে আহলে বাইত (আ.)-এর মাযহাবের আহকাম-মাসায়েল অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনকারীর জন্য পূর্ববর্তী মাযহাবের ফতওয়া অনুযায়ী সঠিক পন্থায় আঞ্জাম দেওয়া হজ্জ পূনরায় আঞ্জাম দেওয়া জরুরী নয়। তবে শর্ত হল, রুকনগুলোকে যেন সে সঠিকভাবে আঞ্জাম দিয়ে থাকে। কিন্তু রুকন নির্ধারণের ক্ষেত্রে মানদণ্ড তার পূর্ববর্তী মাযহাবের বিধান হবে নাকি আহলে বাইত (আ.)-এর মাযহাবের আহকাম এ বিষয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। [১৩]
তথ্যসূত্র
- ↑ নাজাফী, জাওয়াহিরুল কালাম, ১৪০৪ হি, খঃ১৮, পৃঃ১৩৬ ও গুলপায়গানী, কিতাবুল হাজ্জ, ১৪০৩ হি, খঃ১, পৃঃ১৭।
- ↑ মিশকিনী, মুস্তাতালাহাতুল ফিক্হ, ১৪২৮ হি, পৃঃ২৭৪-২৭৫।
- ↑ নাজাফী, জাওয়াহিরুল কালাম, ১৪০৪ হি, খঃ১৮, পৃঃ১৩৬।
- ↑ শহীদে আউয়াল, আদ্-দুরুশ শারইয়্যাতু ফি ফিকহিল ইমামিয়্যাহ, ১৪১৭ হি, খঃ১, পৃঃ৩২৮-৩২৯।
- ↑ মুহাক্কেক কারকী, জামেউল মাকাসেদ ফি শারহিল কাওয়ায়েদ, ১৪১৪ হি, খ১, পৃঃ৩৬।
- ↑ সামারকান্দী, তুহফাতুল ফোকাহা, ১৪০৫ হি, খঃ১, পৃ;৩৮১।
- ↑ সামারকান্দী, তুহফাতুল ফোকাহা, ১৪০৫ হি, খঃ১, পৃ;৩৮১।
- ↑ শহীদে আউয়াল, আদ্-দুরুশ শারইয়্যাতু ফি ফিকহিল ইমামিয়্যাহ, ১৪১৭ হি, খঃ১, পৃঃ৩২৮।
- ↑ নাজাফী, জাওয়াহিরুল কালাম, ১৪০৪ হি, খঃ১৮, পৃঃ১৩৬ ও গুলপায়গানী, কিতাবুল হাজ্জ, ১৪০৩ হি, খঃ১, পৃঃ১৭।
- ↑ মুহাক্কেক কারকী, জামেউল মাকাসেদ ফি শারহিল কাওয়ায়েদ, ১৪১১ হি, খ৩, পৃঃ২০১।
- ↑ শহীদে সানি, মাসালিকুল আফহাম, ১৪১৩ হি, খঃ২, পৃঃ২৭৫।
- ↑ ইবনে ফাহদ হিল্লি, আল-মুহযযাবুল বারি, ১৪০৭, খঃ২, পৃঃ২০৬ হি।
- ↑ নাজাফী, জাওয়াহিরুল কালাম, ১৪০৪ হি, খঃ১৭, পৃঃ৩০৪।
গ্রন্থপঞ্জি
- ইবনে ইদ্রিস, মুহাম্মাদ বিন আহমাদ, আস্-সারাইরুল হাভি লিত্ তাহরিরিল ফাতাভি, কোম, ইন্তেশারাতে ইসলামি, ১৪১০ হি।
- ইবনে হামযা তুসী, মুহাম্মাদ বিন আলী, আল-ওয়াসিলাতু ইলা নাইলিল ফাদিলাহ, কোম, ইন্তেশারাতে কিতাবখানেয়ে মারাশী নাজাফী, ১৪০৮ হি।
- ইবনে ফাহদ হিল্লি, আহমাদ বিন মুহাম্মাদ, আল-মুহযযাবুল বারি, কোম, ইন্তেশারাতে ইসলামি, ১৪০৭ হি।
- ইবনে কুদামা, আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ, আল-মুগনি, কায়রো, মাকতাবাতুল কায়রো, ১৩৮৮ হি।
- কারামী, মারয়া বিন ইউসুফ, দালিলুত তালিবি লিনাইলিল মাতালিব, রিয়াদ, দারু তায়্যিবাতি লিন নাশরি ওয়াত্ তাউযি, ১৪২৫ হি।
- বাহরানী, ইউসুফ বিন আহমাদ, আল-হাদায়িকুন্ নাযিরাহ; আলী আখুন্দী, নাশরে ইসলামি, ১৩৬৩ (সৌরবর্ষ)।
- হিল্লি, ইয়াহিয়া বিন সাঈদ, আল্-জামিয়ু লিল শারায়েঅ, মুয়াসসাসাতু সাইয়্যিদুশ শুহাদ আল-ইলমিয়্যাহ, ১৪০৫ হি।
- সামারক্বান্দী, আলাউদ্দিন মুহাম্মাদ, তুহফাতুল ফুকাহা, বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪০৫ হি।
- শহীদে আউয়াল, মুহাম্মাদ বিন মাক্কী, আদ্-দুরুশ শারইয়্যাতু ফি ফিকহিল ইমামিয়্যাহ, কোম, ইন্তেশারাতে ইসলামি, ১৪১৭ হি।
- শহীদে সানি, যাইনুদ্দিন বিন আলী, মাসালিকুল আফহাম, কোম, মুয়াসসাসাতুল মায়ারিফিল ইলমিয়্যাহ, ১৪১৩ হি।
- গুলপায়গানী, মুহাম্মাদ রেযা, কিতাবুল হাজ্জ, কোম, দারুল কুরআনুল কারিম, ১৪০৩ হি।
- মুহাক্কেক কারকী, আলী বিন হোসাইন, জামেউল মাকাসেদ ফি শারহিল কাওয়ায়েদ, কোম, আলুল বাইত, ১৪১৪ হি।
- মিশকিনী, মির্জা আলী, মুস্তাতালাহাতুল ফিক্হ, কোম, আল-হাদী, ১৪২৮ হি।
- মুসাভী আমেলি, মুহাম্মাদ বিন আলী, মাদারিকুল আহকাম, কোম, মুয়াসসাসাতু আলিল বাইত, ১৪১০ হি।
- নাজাফী, মুহাম্মাদ হাসান, জাওয়াহিরুল কালাম, বৈরুত, দারু ইহয়ায়িত্ তুরাসিল আরাবি, ১৪০৪ হি।