বিষয়বস্তুতে চলুন

জালুত

wikishia থেকে

জালুত ছিলেন এমন এক রাজা যিনি বনি ইসরাইলের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত নবী দাউদ (আ.)-এর হাতে নিহত হন। পবিত্র কুরআন তালুত ও জালুতের বাহিনীর যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তার নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে এই গল্পটি আরও বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। মুসলমানদের তাফসীর ও ঐতিহাসিক গ্রন্থ সমূহে তালুত ও জালুতের যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা উঠে এসেছে। তন্মধ্যে দাউদ (আ.)-এর জালুতের উপর বিজয়কে ঈমানদারদের বিজয়ের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

অবস্থান

তাবারী’র ন্যায় ইতিহাসবেত্তাদের মতে, জালুত ছিলেন আমালেকার এক রাজা, যিনি বনি ইসরাইল জাতির উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। [১] আমালেকা ছিল একটি প্রাচীন মূর্তিপূজারী জাতি, নূহ (আ.)-এর বংশধর এবং হিজাজের উত্তরে বসবাসকারী আরব, যারা খ্রিস্টপূর্ব ১৭০৩ থেকে ২২১৩ সালের মধ্যে মিশরের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। [২] জালুতের নাম কুরআনে তিনবার, সূরা বাকারার ২৪৯-২৫১ নং আয়াতে এসেছে। [৩] তাফসীরে কুম্মীতে ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, বনি ইসরাইল মূসা (আ.)-এর পর পাপাচারে লিপ্ত হয়। তারা আল্লাহর দ্বীন পরিবর্তন করে দেয় এবং তাদের প্রতিপালকের নির্দেশ অমান্য করে। তারপর, আল্লাহ্ তাদের উপর জালুত নামক এক জালিম বাদশাহকে তাদের উপর চাপিয়ে দেন, যে তাদেরকে অপদস্থ করে। তাদের পুরুষদেরকে হত্যা করে, তাদের নারীদেরকে বন্দী করে, তাদেরকে তাদের শহর ও বাড়িঘর থেকে বের করে দেয় এবং তাদের সম্পদ দখল করে নেয়। [৪]

কুরআনে তালুত ও জালুতের যুদ্ধের বর্ণনা

মূল নিবন্ধ: তালুত ও জালুতের জালুত তালুতের বাহিনী ও জালুতের যুদ্ধের ঘটনাটি কুরআনে সংক্ষেপে এবং বিস্তারিত উল্লেখ ছাড়া এভাবে বর্ণিত হয়েছে: বনি ইসরাইলের তখনকার নবী (যার নাম সামুয়েল বলে জানা যায়) [৫] আল্লাহর নির্দেশে ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তালুতকে রাজা হিসেবে মনোনীত করেন। [৬] বনি ইসরাইল এই নির্বাচন নিয়ে তাদের নবীর কাছে কিছু আপত্তি করার পর, পরিশেষে তাকে রাজা হিসেবে মেনে নেয় এবং তার নেতৃত্বে জালুত ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য রওনা হয়। [৭] যুদ্ধের পথে, একটি নদী অতিক্রমের পর যা ছিল আল্লাহর পরীক্ষার মাধ্যম, তালুতের বেশিরভাগ সৈন্য জালুত ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অক্ষমতা প্রকাশ করে। [৮] যখন তালুতের অনুগত সৈন্যরা জালুত ও তার বাহিনীর মুখোমুখি হয়, তখন তারা আল্লাহর কাছে ধৈর্য ও বিজয় কামনা করে। [৯] তারা আল্লাহর ইচ্ছায় তার উপর বিজয়ী হয় এবং দাউদ জালুতকে হত্যা করে। [১০]

ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনায় জালুত

ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা অনুযায়ী, যখন বনি ইসরাইল ও ফিলিস্তিনীরা (জালুতের বাহিনী) পরস্পরের মুখোমুখি হয়, তখন জিলয়াত (ইবরী ভাষায় জালুত) [১১] ফিলিস্তিনীদের ভিড়ের মধ্য থেকে এগিয়ে আসে এবং যুদ্ধের জন্য চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে। এই কাজ সে চল্লিশ দিন ধরে করতে থাকে। [১২] শাউল (তালুত) ইসরাইলী বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে জিলয়াতের হত্যাকারীকে প্রচুর সম্পদ দেবেন এবং তার মেয়ের সাথে তার বিয়ে দেবেন। তালুতের সৈন্য শিবিরে সবেমাত্র পৌঁছানো তরুন দাউদ, সেনাপতিকে রাজি করানোর পর তার সাথে একক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।[১৩] জালুত যখন দেখল দাউদ তরবারি ছাড়াই এবং কেবল লাঠি ও পাথর নিয়ে তার সাথে লড়াই করতে এসেছে, তখন সে তাকে অপমান ও হুমকী প্রদান করল। পক্ষান্তরে, দাউদও তাকে হুমকী প্রদান করল এবং একটি গুলতি দিয়ে জালুতের কপালে একটি পাথর নিক্ষেপ করে, তাকে পরাস্ত করে। অতঃপর সে তার মৃতদেহের উপর এসে তার নিজের তরবারি দিয়ে তার দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে। এই বিজয় ফিলিস্তিনীদের সম্পূর্ণ পরাজয় এবং তাদের পলায়নের পথে পরিচালিত করে।[১৪] বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে জালুতের অলৌকিক শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে; এর মধ্যে রয়েছে যে, তার উচ্চতা ছিল তিন মিটার এবং বনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সে খুব ভারী অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত ছিল।[১৫]

তাফসীর ও ঐতিহাসিক সূত্রের বর্ণনা

তাফসীর ও ঐতিহাসিক সূত্রসমূহে জালুত সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে: হিজরী দ্বিতীয় শতকের মুফাসসির কুম্মী [১৬] তাকে কিবতী (মিশরের আদিবাসী) [১৭] এবং ইবনে খালদুন (ইতিহাসবেত্তা) [১৮] তাকে ফিলিস্তিনের কনআনীয়ানের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেছেন। অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন যে, সে সম্ভবত ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ছিল না, বরং ফিলিস্তিনি বাহিনীর একজন সৈনিক হিসেবে ছিল। [১৯] তাবারী জালুতকে আমালেকার একজন বাদশাহ, একজন যোদ্ধা ও শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। [২০] ইয়াকুবীও তার উচ্চতা পাঁচ হাত (প্রতি হাত প্রায় আধা মিটার) লিখেছেন। [২১] জালুত ও বনি ইসরাইলের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা, বিশেষ করে দাউদ (আলাইহিস সালাম) এর সাথে তার যুদ্ধ বিস্তারিতভাবে ইসলামী সূত্র সমূহে বর্ণিত হয়েছে।[২২] সাধারণত এই বর্ণনাগুলোতে এই ঘটনা সম্পর্কে ইহুদি বর্ণনার দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করা হয় [২৩] যা মাঝে মাঝে কিছু পার্থক্য সহ মুসলমানদের তাফসীর ও ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহে প্রবেশ করেছে। [২৪] যুদ্ধের স্থান ও জালুতের নিহত হওয়া সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে; মাসউদী [২৫] জালুতের নিহত হওয়ার স্থান জর্ডানের বাইসান এবং ইবনে আসাকির দামেস্কের নিকটবর্তী উম্মু হাকিম প্রাসাদ বলে মনে করেন। [২৬] দাব্বাগও এই ঘটনার স্থান বেথলেহেমের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি গ্রাম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। [২৭] ফিলিস্তিনের 'আইন জালুত' অঞ্চলের নামকরণকেও দাউদ ও জালুতের যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়েছে। [২৮]

দাউদের বিজয়, ঈমানদারদের বিজয়ের প্রতীক

কোন কোন তাফসীরে, সূরা বাকারার ২৪৯ নং আয়াতের উপর নির্ভর করে, জালুতের উপর দাউদের অলৌকিক বিজয়ের মাধ্যমে এই বিষয়টিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, যুদ্ধ ও সংঘর্ষে বিজয় ঈমানদারদের এবং আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করেন, বাহ্যিকভাবে যতই তাদের জনবল ও সরঞ্জাম কম থাকুক না কেন ; [২৯] যেমনভাবে কিছু লোক বদর যুদ্ধে পয়গম্বর (স.)-এর সাহাবীদেরক তালুতের সেনাবাহিনীর সংখ্যার সমতূল্য জ্ঞান করেন এবং এই যুদ্ধকে তালুত ও জালুতের বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। [৩০] মহানবীর সাহাবী জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আল-আনসারীও খন্দকের যুদ্ধে ইমাম আলী (আ.)-এর হাতে আমর ইবনে আবু দাউদের নিহত হওয়াকে জালুত ও দাউদের ঘটনার সাথে তুলনা করেছেন। [৩১]

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

  • কিতাবে মুকাদ্দাস (আহাদে আতিক ওয়া আহাদে জাদিদ), লন্ডন, ১৯২৫ খ্রি.।
  • মারকাযে ফারহাঙ্গ ওয়া মাআরেফে কুরআন, আ’লাম কুরআন আয দায়েরাতুল মাআরেফ কুরআন কারিম, কোম, বুস্তান কিতাব, প্রথম অধ্যায়, ১৩৮৫ ফার্সি সন।
  • মাসউদি, আবুল হাসান আলী ইবনি আল-হুসাইন, মুরুজুয যাহাব ওয়া মাআদিনুল জাওহার, তাহকিক: দাগের, আসাদ, কোম, দারুল হিজরাত, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪০৯ হিজরি।
  • মুফিদ, মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ, আল-ইরশাদ ফি মা’রিফাতি হুজাজ আল্লাহ আলাল ইবাদ, তাহকিক ও তাসহিহ: মুআসসিসাতু আলিল বাইত (আ.), কোম, কংগ্রেয়ে শেখ মুফিদ, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৩ হিজরি।
  • মেইবদি, আহমদ বিন মুহাম্মদ, তাফসীর খাজা আবদুল্লাহ আনসারী, তেহরান, আমির কবির, পঞ্চম সংস্করণ, ১৩৭১ ফার্সি সন।
  • ওয়ায়েয যাদেহ খোরাসানি, মুহাম্মদ, আল-মু’জান ফি ফিকহি লুগাতিল কুরআন, মাশহাদ, আস্তান কুদস রাজাভি, বুনিয়াদ পেঝুহেশহায়ে ইসলামী, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৮৮ ফার্সি সন।
  • ইয়াকুবি, আহমদ বিন আবি ইয়াকুব, তারিখে ইয়াকুবি, দারু সাদের, বৈরুত, প্রথম সংস্করণ, তারিখ অজ্ঞাত।