আবদুল্লাহ ইবনে সাবা
আবদুল্লাহ ইবনে সাবা (আরবি: عبد الله بن سبأ); হিজরী তৃতীয় এবং চতুর্থ দশকের প্রাথমিক ইসলামের ইতিহাসে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, যার সম্পর্কে ঐতিহাসিক এবং রিজালশাস্ত্রীয় সূত্রগুলি পরস্পরবিরোধী তথ্য দিয়েছে।
ইবনে সাবা নামটি সর্বপ্রথম সুন্নি ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে জারির তাবারি উল্লেখ করেন। শিয়া সূত্রে তার নাম প্রথম উল্লেখ করা হয়েছে রিজালে কাশশি গ্রন্থে। এই সূত্র অনুসারে, সে একজন ইহুদি ছিল এবং তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফানের রাজত্বকালে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
সুন্নি ঐতিহাসিকরা তাকে খলিফা উসমানের বিরুদ্ধে মুসলিম বিদ্রোহের প্ররোচক এবং শিয়া ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করেন; তবে, শিয়া ঐতিহাসিকরা বলেন যে, একজন নবমুসলিমের পক্ষে মুসলিম সম্প্রদায়কে এতটা প্রভাবিত করা সম্ভব নয় যে তারা খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। কিছু শিয়া আলেম আবদুল্লাহ ইবনে সাবাকে গালিয়ান বা অতিরঞ্জিতকারীগণের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন, আবার অন্যরা বিশ্বাস করেন যে, তার অস্তিত্ব কাল্পনিক, বাহ্যিকভাবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই।
ইবনে সাবা সম্পর্কে একক গ্রন্থ রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বিস্তারিত ও প্রসিদ্ধ হল প্রখ্যাত শিয়া গবেষক সাইয়্যিদ মুর্তজা আসকারী (১২৯৩-১৩৮৬ ফার্সি সন) রচিত "আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ও আরেকটি মিথ্যাচার" বইটি।
ব্যক্তিত্ব পরিচিতি
সুন্নি ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে জারির তাবারির মতে, আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ছিল সানা'র একজন ইহুদি, যে তৃতীয় খলিফার সময় ইসলাম গ্রহণ করেছিল।[1] তাঁর মতে, আবদুল্লাহ ইবনে সাবা উসমান ইবনে আফফানকে খেলাফতের দখলদার মনে করতো এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতো।[2] তবে, শিয়া ইতিহাসবিদ রসুল জাফরিয়ান বিশ্বাস করেন যে, মুসলিম সমাজকে এতটা দুর্বল মনে করা যাবে না যে, মুসলিম খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণ ছিল একজন সদ্য ধর্মান্তরিত ইহুদি।[3]
আবদুল্লাহ ইবনে সাবা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত
ইসলামী উৎসগুলিতে আবদুল্লাহ ইবনে সাবার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। সুন্নি উৎসগুলিতে, তাকে শিয়াদের প্রতিষ্ঠাতা এবং তৃতীয় খলিফা উসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্ররোচনাকারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অনেক শিয়া আলেম তাকে গালিয়ান বা অতিরঞ্জিতকারীগণের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন। সমসাময়িক কিছু শিয়া গবেষক তার কোনও বাহ্যিক অস্তিত্ব ছিল বলে বিশ্বাস করেন না।
সুন্নি ঐতিহাসিক তাবারি এবং তার অনুসারীরা আব্দুল্লাহ ইবনে সাবাকে প্রাথমিক ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর প্রধান অপরাধী বলে মনে করে, যেমন- খলিফা উসমানের হত্যাকাণ্ড এবং শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতাও।[4]
শিয়া আলেম ও গবেষকরা আব্দুল্লাহ ইবনে সাবাকে একজন মুনাফিক বলে মনে করেন, যে ইমাম আলী (আ.)-এর মর্যাদাকে অতিরঞ্জিত করেছিল এবং তাঁকে মহান আল্লাহর মর্যাদায় উন্নীত করেছিল এবং এই কারণেই সে শিয়া ইমামদের দ্বারা অভিশপ্ত হয়েছিল।[5]
কিছু সমসাময়িক শিয়া আলেম, যেমন- আল্লামা তাবাতাবাঈ, আল্লামা আসকারী এবং ডক্টর তাহা হুসাইন, বিশ্বাস করেন যে আবদুল্লাহ ইবনে সাবা নামে কোনো ব্যক্তির বাহ্যিক অস্তিত্ব ছিল না এবং তার চরিত্রটি সাইফ ইবনে উমরের মতো ব্যক্তিদের দ্বারা কাল্পনিকভাবে তৈরি হয়েছিল।[6]
আরব গবেষক আলী আল-ওয়ারদী, ‘আবদুল্লাহ ইবনে সাবা একজন কাল্পনিক ব্যক্তি ছিল’ এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে, তাবারি এবং অন্যান্য ইতিহাসে তার জন্য উল্লিখিত বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্যই নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এবং ইমাম আলী (আঃ) -এর সাহাবী আম্মার ইবনে ইয়াসিরের মধ্যে উপস্থিত ছিল। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আম্মার ইয়াসিরকে সাবাইয়ানদের নেতা, এমনকি তাকে আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।[7] আম্মার ইয়াসির এবং কাল্পনিক চরিত্র আবদুল্লাহ ইবনে সাবার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে; যেমন- উভয়েই ইবনে সাওদা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। এছাড়াও, ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি প্রবল আগ্রহ, তাঁর প্রতি আনুগত্যের জন্য লোকদের আমন্ত্রণ জানানো এবং জামালের যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকায় উভয়ের সাদৃশ্য রয়েছে।
ঐতিহাসিক সূত্রের মূল্যায়ন
যেসব সূত্রে আবদুল্লাহ ইবনে সাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রথম সুন্নি সূত্রে তারিখে তাবারি এবং শিয়া সূত্রে রিজালে কাশ্শী-তে এসেছে। সর্বপ্রথম উৎস হল তারিখে তাবারি (২২৪-৩১০ হিজরি)। তাবারি সাইফ ইবনে উমর নামে একজন ব্যক্তির মাধ্যমে আবদুল্লাহ ইবনে সাবার কাহিনী বর্ণনা করে । ইবনে আসির (মৃত্যু: ৬৩০ হিজরি) [9] এবং ইবনে আসাকির (মৃত্যু: ৫৭১ হিজরি) [10] এর মতো অন্যান্য ঐতিহাসিকরাও সাইফের উদ্ধৃতি দিয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে সাবার অস্তিত্ব প্রমাণে তাবারির প্রধান বর্ণনাকারী, অর্থাৎ সাইফ ইবনে উমর, অনেক সুন্নি আলেমের কাছে দুর্বল এবং অবিশ্বাস্য বলে বিবেচিত, যেমন- ইয়াহিয়া ইবনে মু’ইন (মৃত্যু: ২৩৩ হিজরি), নাসাঈ (মৃত্যু: ৩০৩ হিজরি), [১১] আবু দাউদ (মৃত্যু: ২৭৫ হিজরি), [১২] ইবনে হাম্মাদ আকিলি (মৃত্যু: ৩২২ হিজরি), [১৩] ইবনে আবি হাতেম (মৃত্যু: ৩২৭ হিজরি), [১৪] এবং ইবনে হিব্বান (মৃত্যু: ৩৫৪ হিজরি)।[15] নিজ নিজ গ্রন্থে তাকে হাদিস বর্ণনায় যাঈফ বা দুর্বল, হাদিস জালকারী এবং অবিশ্বস্ত বলে উল্লেখ করেছেন।
কেউ কেউ ইবনে সাবা সম্পর্কে রিজালে কাশ্শীর বর্ণনাকেও অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন। ঐতিহাসিক সাইয়্যেদ মুর্তজা আসকারী এর দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন:
- এই বর্ণনাগুলি শিয়াদের বিশুদ্ধ চারটি গ্রন্থে বিদ্যমান নেই এবং এটি শিয়া আলেমদের এই বর্ণনাগুলির প্রতি অবিশ্বাসের লক্ষণ।
- নাজাশি, মুহাদ্দিস নূরী এবং মুহাম্মদ তাকি শুশতারির মতো পণ্ডিতরা কাশ্শী এবং তার গ্রন্থে ত্রুটি এবং দুর্বল বর্ণনা রয়েছে বলে মনে করেন।[16]
স্বতন্ত্র রচনাবলি
আবদুল্লাহ ইবনে সাবার বিষয়বস্তু অনেক গ্রন্থে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। তাহা হুসাইনের (১৮৮৯-১৯৭৩) ‘ফিতনা আল-কুবরা’ এবং আলী আল-ওয়ারদীর (জন্ম: ১৯১৩) ‘ওয়াজ আল-সুলতান’-এর মতো বইগুলিতে আবদুল্লাহ ইবনে সাবার উপর আলোচনা-পর্যালোচনা ও পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়েছে। এই বিষয়ে আরোও কিছু স্বতন্ত্র বইয়ের মধ্যে রয়েছে:
- "আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ও আরেকটি মিথ্যাচার" সাইয়্যেদ মুর্তুজা আসকারির লেখা এ বইটি ১৩৭৫ হিজরিতে প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটি বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি, উর্দু এবং তুর্কি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
- آراء وأصداء حول عبد الله بن سبأ وروایات سیف في الصحف السعودیة: এই বইটিতে সৌদি আরবের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের "আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ও আরেকটি মিথ্যাচার" বইটির উপর করা সমালোচনা এবং সাইয়্যেদ মুর্তজা আসকারীর প্রতিউত্তর সংগ্রহ করা হয়েছে।
- عبد الله بن سبأ بمعنى آخر: আসাদ হায়দার,
- عبد الله بن سبأ بين الواقع والخيال: সাইয়্যেদ হাদী খুসরু শাহী,
- عبد الله بن سبأ حقيقةٌ أم خرافة: আলী আল মুহসিন।
তথ্যসূত্র
গ্রন্থপঞ্জি
- ইবনে আবি হাতেম, আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মাদ, আল-জারহ ওয়া তাঅ্লিল, হায়দার আবাদ, মাজলিসু দায়েরাতিল মায়ারিফিল ইসলামিয়্যাহ, ১৩৭১ হি.,
- ইবনে আসির, আলী বিন মুহাম্মাদ, আল-কামিলু ফিত্ তারিখ, বৈরুত, দারু সাদের, ১৩৮৫ হি.,
- ইবনে হিব্বান, মুহাম্মাদ, আল-মাজরুহিনু মিনাল মুহাদ্দিসিনা ওয়াদ দুয়াফাই ওয়াল মাতরুকিন; তাহকিক-মুহাম্মাদ ইবরাহিম যায়েদ, হালাব, দারুল ওয়াঈ, ১৩৯৬ হি.,
- ইবনে হাম্মাদ আল আকিলি, মুহাম্মাদ বিন উমার, আদ্-দুয়াফাউল কাবির; তাহকিক-আব্দুল মু’তি আমিন, বৈরুত, দারুল মাকতাবাতিল ইলমিয়্যাহ, ১৪০৪ হি.,
- ইবনে হাজার আসকালানি, আহমাদ বিন আলী, তাহযিবুত্ তাহযিব, ভারত, মাতবায়াতু দায়েরাতিল মায়ারিফিন্ নিযামিয়্যাহ, ১৩২৬ হি.,
- ইবনে আসাকের, আলী বিন হাসান, তারিখ মাদিনাতি দামেশ্ক; তাহকিক-আলী শিরি, বৈরুত, দারুল ফিকর...
- জাফারিয়ান, রসুল, তারিখে খোলাফা আযা রেহলাতে পয়গম্বর থা যেওয়ালে উমাবিয়ান (১১-১৩২ হি.), কোম, দালিলেমা, ১৩৯৪ (ফার্সি সন),