বিষয়বস্তুতে চলুন

যাবীহুল্লাহ

wikishia থেকে
হযরত ইসমাঈলকে কুরবানির কাল্পনিক চিত্র

যাবীহুল্লাহ (আরবি: ذَبیح‌ُ الله); হচ্ছে হযরত ইব্রাহিমের সন্তান ইসমাঈলের উপাধি; যাকে কুরবানী করতে হযরত ইব্রাহিমকে আল্লাহপাক নির্দেশ দেন। পবিত্র কুরআনে জবাইয়ের ঘটনার বর্ণনা থাকলেও কুরবানীকৃত ব্যক্তির নামের উল্লেখ নেই। শিয়ারা ‘যাবীহুল্লাহ’কে ইসমাঈলের উপাধি এবং ইহুদীরা ইসহাকের উপাধি হিসেবে জ্ঞান করেন। যাবীহ তথা জবাই হওয়া ব্যক্তি ইসমাঈল নাকি ইসহাক সে ব্যাপারে আহলে সুন্নতের মধ্যেও মতপার্থক্য রয়েছে।

জবাইয়ের ঘটনা

যাবীহুল্লাহ’র অর্থ হচ্ছে আল্লাহর জন্য কুরবানীকৃত বা জবাইকৃত। যাবীহুল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সন্তানদের মধ্য হতে একটি সন্তানের উপাধি, যাকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানীর জন্য হযরত ইব্রাহিম (আ.) মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হন।[]

কুরআনের বর্ণনানুয়ায়ী ইব্রাহিম স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি তাঁর সন্তানকে জবাই করছেন, অত:পর তিনি এই বিষয়টি নিয়ে তাঁর পুত্রের সাথে আলোচনা করলে তাঁর সন্তান তাঁকে মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আমল করতে বলেন। যখন আল্লাহর ইচ্ছার কাছে তারা দুজনই আত্নসমর্পণ করেন এবং হযরত ইব্রাহিম তার পুত্রকে জবাই করার জন্য জবাইয়ের স্থানে শোয়ান তখন গায়েবী আওয়াজ আসল যে, ‘হে ইব্রাহিম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছ, প্রকৃতপক্ষে, আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি (আমরা তাদের আমল তথা কর্মের পরিবর্তে পবিত্র ও বিশুদ্ধ নিয়্যতকে গ্রহণ করি) নিঃসন্দেহে, এই পরীক্ষা ছিল সুস্পষ্ট এবং আমরা তার সন্তানকে একটি মহান কুরবানীর মোকাবেলায় (জবাই হওয়া থেকে) মুক্তি দিয়েছি।’[]

রেওয়ায়েত অনুসারে, জিব্রাইল আমিন আল্লাহর ইচ্ছায় ছুরি'র প্রভাব রাখার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এবং হযরত ইব্রাহিমের মাধ্যমে তাঁর পুত্রের পরিবর্তে একটি বেহেশতি ভেড়া জবাই হয়।[] ঐ জবাইয়ের ঘটনা স্মরণ করে ঈদুল আযহার দিন কুরবানীর প্রথা পালন করা হয়।[]

যাবীহ কার উপাধি?

কুরআন জবাইয়ের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। কিন্তু জবাইকৃত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেনি। যাবীহুল্লাহ হযরত ইব্রাহিমের কোন্ সন্তানের উপাধি, এ ব্যাপারে দুটি মত রয়েছে; কেউ কেউ তা হযরত ইসমাঈলের উপাধি এবং কেউ কেউ হযরত ইসহাকের উপাধি হিসেবে মনে করেন।

ইসমাঈল

শিয়া মুফাস্সিরগণ সূরা সাফ্ফাতের ১০১-১১৩ নং আয়াতের দিকে লক্ষ্য রেখে বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহপাক ইসহাকের জন্মের সুসংবাদ ইসমাঈলের জন্মের সুসংবাদ ও জবাইয়ের ঘটনার পর ইব্রাহিমকে দিয়েছেন।[] আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজীর মতে, যারা হযরত ইসহাককে যাবীহ মনে করেন তারা কুরআনে হযরত ইব্রাহিমকে দেওয়া দুটি সুসংবাদকে ইসহাকের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করেন; তারা প্রথম সুসংবাদকে জন্মের সাথে এবং দ্বিতীয় সুসংবাদকে তাঁর নবুওয়াতের সাথে সংশ্লিষ্টতা দেন। তিনি মনে করেন, উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, দুটি সুসংবাদ দুই সন্তানের সাথে সম্পর্কিত।[] একইভাবে আল্লামা তাবাতাবায়ী মনে করেন যে, এই আয়াতের ভাবধারা হযরত ইসমাঈলের যাবীহ হওয়ার বিষয়টিকে প্রমাণ করে।[]

কিছু কিছু রেওয়ায়েতেও ইসমাঈলকে যাবীহুল্লাহ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন, মহানবি (স.) একটি রেওয়ায়েতে নিজেকে 'ইবনে যাবিহাইন' বলে উল্লেখ করেছেন।[] এছাড়াও ইমাম আলীর (আ.) দোয়া হিসেবে পরিচিত ‘দোয়ায়ে মাশলুল’[] এবং ইমাম সাদিক (আ.)[১০]ইমাম রেযা (আ.)[১১] হতে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতে হযরত ইসমাঈলকে যাবীহ হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে। যিয়ারতে ‘গুফাইলাহ’-তে (১৫ই রজবে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিশেষ দোয়া) ইমাম হোসাইন (আ.)-কে যাবীহুল্লাহ ইসমাঈলের ওয়ারিস (উত্তরাধিকারী) হিসেবে এভাবে সালাম দেওয়া হয়েছে, “আস্সালামু আলাইকা ইয়া ওয়ারিসা ইসমাঈলা যাবীহিল্লাহ”

السَّلامُ عَلَیک یا وارِثَ إسماعیلَ ذَبیحِ اللّه

কোন কোন লেখক হযরত হাজেরার হিজরত ও ইসমাঈলের জন্মের ঘটনাকে কুরবানীর ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে জ্ঞান করেন এবং ইসমাঈলের জবাইকে ঐগুলোর পরিপূরক হিসেবে জ্ঞান করেন।[১২] শেইখ সাদূক রেওয়ায়েতের পার্থক্যের দিকে ইঙ্গিত করে ইসমাঈলকে যাবীহ জ্ঞান করেন এবং বলেন, ইসহাক জবাইয়ের ঘটনার পর জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই তিনি আফসোস করতেন, তিনি যদি সেই ব্যক্তি হতেন, যাকে জবাই করার জন্য তার পিতা নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন! তবে, তিনিও ইসমাঈলের ন্যায় আল্লাহর নির্দেশের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন এবং সৃষ্টিকর্তার নির্দেশের বরাবরে ধৈর্যধারণ করেছিলেন এবং সওয়াবের ক্ষেত্রে হযরত ইসমাঈলের স্তরে পৌঁছেছিলেন।[১৩]

আহলে সুন্নতের কিছু মুফাস্সির কতকগুলো হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে, যাবীহকে ইসমাঈল জ্ঞান করেন। এই মতের স্বপক্ষে আবু হুরায়রা, আমের বিন ওয়াসলাহ, আব্দুল্লাহ বিন উমর, ইবনে আব্বাস, সাঈদ বিন মুসায়েব, ইউসুফ বিন মেহরান, রাবী’ বিন আনাসের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।[১৪] এছাড়াও ফাখরে রাযী এবং ইবনে আশুরও যাবীহকে ইসমাঈল বলে অভিমত দিয়েছেন।[১৫]

ইসহাক

আহলে সুন্নতের কিছু মুফাস্সির আবার যাবীহু্ল্লাহকে ইসমাঈলের উপাধি জ্ঞান করেন। এই মতের পক্ষে উমর বিন খাত্তাব, সাঈদ বিন যুবাইর, কা’বুল আহবার, কাতাদাহ, যুহরী, তাবারী এবং মালিক বিন আনাস প্রমুখ ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।[১৬] আয়াতু্ল্লাহ মাকারেম শিরাজী ইসহাককে যাবীহুল্লাহ হিসেবে পরিচয় করানো রেওয়ায়েতকে ইসরাইলীয় প্রভাবে প্রভাবিত বলে মনে করেন এবং এই রেওয়ায়েত ইহুদীদের দ্বারা তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন। [১৭]

একইভাবে, তাওরাতে ইসহাককে যাবীহুল্লাহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে যাবীহকে ইব্রাহিমের একমাত্র পুত্র হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়েছে।

ইবনে যাবীহাইন

কিছু রেওয়ায়েতে, আব্দুল মুত্তালিবের মানতের( আব্দুল মুত্তালিব তাঁর নিজের একটি সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী করবেন) কাহিনীর উপর ভিত্তি করে, আব্দুল্লাহ ইবনে মুত্তালিবকে যাবীহ এবং মহানবি (স.)-কে ইবনে যাবীহাইন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র

  1. সূরা: আস-সাফফাত: ১০২।
  2. সূরা: আস-সাফফাত: ১০১-১০৮।
  3. শেইখ কুলাইনি, উসুলে কাফি, ১৪০৭ হি., খ: ৪, পৃ: ২০৮।
  4. সাদিকী তেহরানী, মুহাম্মাদ, আল-ইবলাগু ফি তাফসিরিল কুরআন বিল কুরআন, ১৪১৯ হি., পৃ: ৪৫০ ও কুতুব, ফি যিলালিল কুরআন, ১৪১২ হি., খ: ৫, পৃ: ২৯৯।
  5. মাকারেম শিরাজী, তাফসিরে নেমুনেহ, ১৩১৭ (ফার্সি সন), খ: ১৯, পৃ: ১২৯।
  6. মাকারেম শিরাজী, তাফসিরে নেমুনেহ, ১৩১৭ (ফার্সি সন), খ: ১৯, পৃ: ১২৯।
  7. তাবাতাবায়ী, তাফসিরে আল মিযান, ১৪১৭ হি., খ: ১৭, পৃ: ১৫৫।
  8. শেইখ সাদুক, আল-খিসাল, ১৩৬২ (ফার্সি সন), খ: ১, পৃ: ৫৬-৫৮ ও শেইখ সাদুক, উয়ুনু আখবারুর ‍রেযা, ১৩৭৮ (ফার্সি সন), খ: ১, পৃ: ২১০।
  9. কাফয়ামী, আল-মিসবাহুল কাফয়ামী, ১৪০৫ হি., পৃ: ২৬৩।
  10. কুম্মী, তাফসিরে আল-কুম্মী, ১৪০৪ হি., খ: ২, পৃ: ২২৬।
  11. শেইখ কুলাইনি, উসুলে কাফি, ১৪০৭ হি., খ: ৬, পৃ: ৩১০।
  12. মাকারেম শিরাজী, তাফসিরে নেমুনেহ, ১৩১৭ (ফার্সি সন), খ: ১৯, পৃ: ১২০।
  13. শেইখ সাদুক, আল-খিসাল, ১৩৬২ (ফার্সি সন), খ: ১, পৃ: ৫৭-৫৮।
  14. কুরতুবী, আল-জামিয়ু লিল আহকামিল কুরআন, ১৩৬৪ (ফার্সি সন), খ: ১৬, পৃ: ১০০।
  15. ফখরুদ্দিন রাযি, মাফাতিহুল গাইব, ১৪২০ হি., খ: ২৬, পৃ: ৩৫১।
  16. কুরতুবী, আল-জামিয়ু লিল আহকামিল কুরআন, ১৩৬৪ (ফার্সি সন), খ: ১৬, পৃ: ১০০।
  17. মাকারেম শিরাজী, তাফসিরে নেমুনেহ, ১৩১৭ (ফার্সি সন), খ: ১৯, পৃ: ১১৯-১২০।

গ্রন্থপঞ্জি

  • ইবনে আশুর, মুহাম্মাদ বিন তাহের, আত্-তাহরির ওয়া আত্-তানভির, বৈরুত, ‍মুয়াস্সাসাতু আত্-তারিখ, ১৪২০ হি.।
  • ইবনে হিশাম, আব্দুল মালেক বিন হিশাম, সিরাতুন নাবাভিয়্যাহ, দারুল মারেফা...
  • কুতুব, সাইয়্যেদ, ফি যিলালিল কুরআন, দারু আশ্-শারুক্ব, বৈরুত, কায়রো ১৪১২ হি.।
  • শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ বিন আলী, উয়ুনু আখবারুর ‍রেযা; সম্পাদনায়-মাহদি লাজুরদী, তেহরান, নাশরে জাহান, প্রথম সংস্করণ, ১৩৭৮ (ফার্সি সন)।
  • শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ বিন আলী, আল-খিসাল; সম্পাদনায়- আলী আকবার গাফফারী, কোম, জামেয়ে মুদাররেসিন, ১৩৬২ (ফার্সি সন)।
  • শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ বিন আলী, মান লা ইয়াহযুরুহুল ফাকিহ; সম্পাদনায়- আলী আকবার গাফফারী, কোম, দাফ্তারে ইন্তেশারাতে ইসলামি, ১৪১৩ হি.।
  • সাদিকী তেহরানী, মুহাম্মাদ, আল-ইবলাগু ফি তাফসিরিল কুরআন বিল কুরআন, মুয়াল্লেফ, কোম, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৯ হি.।
  • তাবাতাবায়ী, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন, তাফসিরে আল মিযান, কোম, দাফ্তারে ইন্তেশারাতে ইসলামি, পঞ্চম সংস্করণ, ১৪১৭ হি.।
  • ফখরুদ্দিন রাযি, মুহাম্মাদ বিন উমার, মাফাতিহুল গাইব, দারু ইহয়াইত্ তুরাসিল আরাবি, বৈরুত, তৃতীয় সংস্করণ, ১৪২০ হি.।
  • কুরতুবী, মুহাম্মাদ বিন আহমাদ, আল-জামিয়ু লিল আহকামিল কুরআন, তেহরান, নাসের খসরু, ১৩৬৪ (ফার্সি সন)।
  • কুম্মী, আলী বিন ইবরাহিম, তাফসিরে আল-কুম্মী; সম্পাদনায়-সাইয়্যেদ তাইয়্যেব মুসাভী আল-জাযায়েরী, কোম, দারুল কিতাব, তৃতীয় সংস্করণ, ১৪০৪ হি.।
  • কাফয়ামী, ইবরাহিম বিন আলী, আল-মিসবাহুল কাফয়ামী, কোম, দারুর রাযি, ১৪০৫ হি.।
  • শেইখ কুলাইনি, মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব, উসুলে কাফি; সম্পাদনায়- আলী আকবার গাফফারী ও মুহাম্মাদ আখুন্দী, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, ১৪০৭ হি.।
  • আল্লামা মাজলেসী, মুহাম্মাদ বাকের, বিহারুল আনওয়ার, মুয়াস্সাসাতুল ওয়াফাঅ্, ১৪০৩ হি.।
  • মাকারেম শিরাজী, নাসের, তাফসিরে নেমুনেহ, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, প্রথম সংস্করণ, ১৩১৭ (ফার্সি সন)।