স্বেচ্ছামৃত্যু
স্বেচ্ছামৃত্যু (আরবি: القتل الرحيم) বলতে বোঝায় আত্মহত্যা বা কোনো ব্যক্তিকে সহানুভূতির বশবর্তী হয়ে হত্যা করা, যা সেই ব্যক্তি কোনো অনিরাময়যোগ্য ও দূর্বিষহ যন্ত্রণাদায়ক রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে করা হয়। স্বেচ্ছামৃত্যু সাধারণত প্রাণঘাতী পদার্থ দিয়ে বা জরুরী ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বর্জন করার মাধ্যমে ঘটানো হয়। প্রথম পন্থাকে সক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যু এবং দ্বিতীয় পদ্ধতিকে পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যু বলে অভিহিত করা হয়; তবে কখনও কখনও এমন কিছু ঔষধসামগ্রী রোগীর নিকট দেওয়া হয় যা সে নিজেই ব্যবহার করার মাধ্যমে তার নিজের জীবনের অবসান ঘটায়। এই কাজটিকে বলা হয় পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যু। এই বিষয়টিকে আধুনিককালের অন্যতম ফিকহী সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হয়।
ফকীহগণ, প্রত্যক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুকে হারাম জ্ঞান করেন এবং বলেন, যদি এটি রোগীর অনুমতি ছাড়া সম্পাদিত হয়, তবে রোগীর অভিভাবকের কিসাস (অনুরূপ প্রতিশোধ) বা দিয়া’র (রক্তমূল্য) অধিকার থাকবে। তবে, এই কাজ করার ক্ষেত্রে রোগী অনুমতি দিয়ে থাকলে তখন এ বিষয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে: কেউ কেউ বলেন, রোগীর অভিভাবকের কিসাস বা দিয়া পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং কেউ কেউ বলেন, অধিকার নেই। নিষ্ক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যু সম্পর্কেও ফতওয়াগত মতপার্থক্য রয়েছে: কেউ কেউ নিষিদ্ধ বা হারাম হওয়ার ফতওয়া দেন আবার কেউ কেউ বলেন, অসুস্থ ব্যক্তির রোগ যদি অনিরাময়যোগ্য হয় এবং সে যদি ক্রমাগত যন্ত্রণায় ভুগতে থাকে, তবে তার চিকিৎসা অব্যাহত রাখা ওয়াজীব তথা বাধ্যতামূলক নয়।
পরিভাষা পরিচিতি ও গুরুত্ব
“ইউথানেশিয়া’’ বা “স্বেচ্ছামৃত্যু” হচ্ছে কোন অনিরাময়যোগ্য ও দুর্বিষহ যন্ত্রণাদায়ক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হত্যা করা।[১] এই কাজ করুণার বশবর্তী হয়ে ও যন্ত্রণাহীন একটি পন্থায়,[২] প্রাণঘাতী পদার্থ ব্যবহার করে বা প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য সেবা-যত্ন বর্জন করার মাধ্যমে সংঘটিত হয়।[৩] স্বেচ্ছামৃত্যু তিনটি উপায়ে সম্পাদিত হয়, যথা: সক্রিয়, নিষ্ক্রিয় এবং পরোক্ষ। ঔষধের মাধ্যমে যদি রোগীর মৃত্যু ঘটানো হয়, তবে তাকে সক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যু বলা হয়।[৪] যদি শুধুমাত্র অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে মৃত্যু ঘটানো হয়, তবে তাকে নিষ্ক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যু বলা হয়।[৫] আর পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যুর ক্ষেত্রে, রোগীকে এমন ঔষধসামগ্রী সরবরাহ করা হয়, যাতে রোগী নিজেই সেগুলো ব্যবহার করার মাধ্যমে তার জীবনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়।[৬]
শিয়াদের পুরাতন ফিকহী সূত্রে (শেইখ তুসির সময়ে এবং তার পূর্বে), নিজের মৃত্যুর ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করা ব্যক্তির হত্যা হারাম হওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে; তবে স্বেচ্ছামৃত্যুর হুকুম-আহকাম সম্পর্কে কোন আলোচনা হয় নি।[৭] এই কারণে, এই বিষয়টিকে “মাসায়েলে মুসতাহদাসা” (ইসলামি ফিকহে যে বিষয়ে করণীয় কর্তব্যের উল্লেখ নেই) ফিকহের অন্যতম আধুনিক সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হয়।[৮] স্বেচ্ছামৃত্যু সম্পর্কে ফিকাহগত আলোচনা ব্রেইন ডেড তথা মস্তিষ্কের মৃত্যুর বাইরের বিষয়; এরই ধারাবাহিকতায়, একজন ফকীহ বা মুজতাহিদ ব্রেইন ডেড বা কোমায় পড়ে থাকা রোগীর (যার চিকিৎসার কোনো আশা নেই) থেকে যন্ত্রটিকে আলাদা করা জায়েয বা বৈধ মনে করতে পারেন; কিন্তু ঐ একই ফকীহ নিষ্ক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যুকে, অর্থাৎ সহানুভূতির বশবর্তী হয়ে চিকিৎসা বর্জন করা, হারাম জ্ঞান করেন।
স্বেচ্ছামৃত্যু’র বৈধতা-অবৈধতা
স্বেচ্ছামৃত্যু হারাম বা হালাল হওয়ার বিষয়ে শিয়া ফকীহগণের দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নরূপ:
সক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যু (সহানুভূতির বশবর্তী হয়ে রোগীকে হত্যা করা): আধুনিক শিয়া ফকীহগণ কর্তৃক প্রদত্ত ফতওয়া অনুসারে, সক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যুকে হত্যা হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এটি হারাম।[১০] ফকীহগণের মতে, স্বেচ্ছামৃত্যু ঘটানোর ক্ষেত্রে রোগীর অনুমতি এবং সম্মতি দায়বদ্ধতার উপর কোনো প্রভাব ফেলে না; অর্থাৎ, এই ধরনের মৃত্যু হারাম।
নিষ্ক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যু (রোগীর চিকিৎসা বর্জন করে মৃত্যু ঘটানো): কিছু কিছু ফকীহ যেমন: লুৎফুল্লাহ সাফি গুলপায়গানী এবং হুসাইন আলী মুনতাযেরী, দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে তীব্র যন্ত্রণায় ভুগা রোগীর চিকিৎসা বর্জন করাকে হারাম জ্ঞান করেন। উক্ত মতের বিপরীতে, মির্যা জাওয়াদ তাবরিযী, সাইয়্যেদ আবুল কাসেম খুয়ী এবং সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী’র ন্যায় ফকীহগণের ফতওয়া হচ্ছে যে, এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসা অব্যাহত রাখা ওয়াজীব নয়।[১৩]
পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যু: শিয়া ফকীহগণের ফতওয়া অনুসারে, পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যু তথা নিজের জীবন অবসানের লক্ষ্যে রোগী কর্তৃক ঔষধ গ্রহণ, আত্মহত্যা হিসেবে পরিগণিত হবে এবং এটি হারাম।[১৪]
স্বেচ্ছামৃত্যুর দায়বদ্ধতা
স্বেচ্ছামৃত্যুর দায়বদ্ধতার বিষয়ে ফকীহগণের ফতওয়া নিম্নরূপ:
সক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যু: যদি কোনো ডাক্তার বা অন্য কোন ব্যক্তি, দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করা রোগীকে তার অনুমতি ছাড়াই ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তবে কাতলে আমদ (ইচ্ছাকৃত হত্যা) হিসেবে গণ্য করা হবে; যদিও এই কাজ করুণা বা সহানুভূতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে করে থাকে না কেন। এই কাজের ফলে হত্যাকৃত ব্যক্তির অভিভাবকের জন্য কিসাস (অনুরূপ প্রতিশোধ) বা দিয়া’র (রক্তমূল্য) অধিকার তৈরি হবে;[১৫] তবে, রোগীর পক্ষ থেকে যদি তার মৃত্যুর ব্যাপারে সম্মতি থাকে বা ঐ কাজে অনুমতি দিয়ে থাকে, তবে ফকীহগণের মধ্যে এ বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে: ১. কিসাস ও দিয়াত’র অধিকার নেই: সাইয়্যেদ আব্দুল আলী সাবযওয়ারী, ইমাম খোমেনী এবং সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ সাদেক রুহানী’র ন্যায় ফকীগণের অভিমত হচ্ছে, যেহেতু হত্যাকৃত ব্যক্তি তার মৃত্যুর ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন, কিসাস ও দিয়া’র অধিকার হারিয়েছেন।[১৬] ২. কিসাস ও দিয়াত’র অধিকার রয়েছে: সাইয়্যেদ আবুল কাসেম খুয়ী, মির্যা জাওয়াদ তাবরিযী এবং জাফর সুবহানী’র ন্যায় ফকীহগণ মনে করেন, হত্যার ব্যাপারে হত্যাকৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে সম্মতি ও অনুমতি থাকা সত্ত্বেও কিসাস ও দিয়া’র অধিকার রহিত হবে না;[১৭] কেননা, মানুষের তার নিজেকে ধ্বংস করার অধিকার নেই।
নিষ্ক্রিয় স্বেচ্ছামৃত্যু: ফকীহগণের ফতওয়া হচ্ছে, কেউ যদি কোন ব্যক্তিকে ধ্বংস হতে দেখেন এবং তাকে রক্ষা করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে রক্ষা না করেন, তবে যদিওবা তিনি গুনাহ’তে লিপ্ত হয়েছেন, কিন্তু তার ঘাড়ে কিসাস ও দিয়া বর্তাবে না।[১৯] এরই উপর ভিত্তি করে, যদি কোনো ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা না করেন এবং তার অবহেলার ফলে রোগী মারা যায়, তবে ডাক্তার পাপ করেছেন বটে; কিন্তু তিনি দায়বদ্ধ নন, আর মৃতের উত্তরাধিকারীর কিসাস বা দিয়াত’র অধিকারও নেই।[২০]