সূরা ইনসান
সূরা ইনসান (আরবি: سورة الإنسان), সূরা হাল আতা' (سورة هل أتی) বা সূরা দাহর (سورة الدهر); পবিত্র কুরআনের ৭৬তম সূরা। পবিত্র কুরআনের ২৯তম পারায় স্থান পাওয়া এ সূরাটি মাদানী। মানুষের সৃষ্টি ও মানুষের হেদায়েত, সৎকর্মশীলদের গুণাবলি, মহান আল্লাহ্ প্রদত্ত নিয়ামতরাজি, কুরআনের গুরুত্ব এবং মহান আল্লাহর এরাদা সম্পর্কে এতে আলোচনা করা হয়েছে।
শিয়া ও কিছু কিছু সুন্নি মুফাসসিরের মতে, সূরার ৮নং আয়াতটি -ইতআমের আয়াত নামে যেটির প্রসিদ্ধি রয়েছে- হযরত আলী (আ.), ফাতেমা যাহরা (সা. আ.), ইমাম হাসান (আ.), ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাদের খাদেম ফিজ্জার শানে অবতীর্ণ হয়েছে। নিজেরা ক্ষুধার্ত থেকে তাঁরা পরপর তিনদিন রোজা রাখার মানত পূর্ণ করেছিলেন এবং নিজেদের ইফতার তাঁরা মিসকিন, এতিম ও কয়েদীকে দান করেছিলেন।
‘আখেরাতে মহানবির (স.) সহচর্য লাভ’ এই সূরা তেলাওয়াতের পুরস্কারসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
পরিচিতি
নামকরণ
এই সূরা ‘ইনসান’, ‘হাল আতা’ ও ‘দাহর’ নামে প্রসিদ্ধ।[১] আর ৩ নামকরণের কারণ হল, ৩টি শব্দই সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে।[২] এ সূরাকে ‘আবরার’ও (সৎকর্মশীলগণ) বলা হয়েছে; কেননা সূরার ৫নং আয়াতে শব্দটি এসেছে এবং অর্ধেকের বেশী আয়াতে আবরারের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে।[৩]
অবতীর্ণ হওয়ার স্থান ও ক্রমধারা
অবতীর্ণ হওয়ার ক্রমধারায় সূরা ইনসান মহানবির (স.) উপর অবতীর্ণ হওয়া ৯৬তম সূরা। বর্তমান মুসহাফে এটি ৭৬তম সূরা হিসেবে স্থান পেয়েছে[৪] এবং এর অবস্থান ২৯তম পারায়।[৫]
সূরাটি মাক্কি নাকি মাদানি এ বিষয়ে এখতেলাফ রয়েছে। বিশিষ্ট শিয়া মুফাসসির নাসের মাকারেম শিরাজি’র মতানুযায়ী, এ বিষয়ে শিয়া মুফাসসিরদের মতৈক্য রয়েছে যে, সম্পূর্ণ সূরা অথবা আবরারের গুণাবলি ও তাঁদের সৎকর্মসমূহ সম্পর্কে অবতীর্ণ আয়াতগুলো মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে।[৬] হিজরি ৭ম শতাব্দির বিশিষ্ট সুন্নি মুফাসিসর কুরতুবিরও মত হলো, ‘আহলে সুন্নতের আলেমগণ সূরাটিকে মাদানি বলে জানেন’।[৭] এতদসত্ত্বেও সুন্নি মুফাসসিরদের একটি দল সূরাটিকে মাক্কি[৮] এবং কেউ কেউ সূরার প্রথম আয়াতগুলো মাক্কি এবং ৮ম আয়াত থেকে শেষ অবধি আয়াতগুলোকে মাদানি বলে জ্ঞান করেছেন।[৯]
আয়াতের সংখ্যা ও অন্যান্য বৈশিষ্ট
সূরা ইনসান ৩১ আয়াত বিশিষ্ট একটি সূরা, এতে ২৪৩টি শব্দ এবং ১০৮৯ অক্ষর রয়েছে। কলেবরের দিক থেকে মুফাসসালাত (ছোট আয়াত বিশিষ্ট) সূরাগুলোর অন্যতম এবং তুলনামূলকভাবে ছোট সূরা।[১০] হযরত আব্বাসের যারীহের (মাজারের চতুর্পাশের বেষ্টনী) উপর খোদাই করে যে সকল সূরা লেখা আছে এ সূরাটি সেগুলোর অন্যতম।[১১]
বিষয়বস্তু
তাফসীরে নেমুনেহ’তে সূরা ইনসানের বিষয়বস্তু ৫টি বিষয় কেন্দ্রীক বলে উল্লেখ করা হয়েছে:
প্রথম: মানুষ সৃষ্টি, শুক্রাণু থেকে মানুষের সৃষ্টি, মানুষের হেদায়েত এবং চিন্তা করার ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতা;
দ্বিতীয়: নেকবান্দা ও আবরারের পুরস্কার (যা আহলে বাইত (আ.) সম্পর্কে);
তৃতীয়: নেককার বান্দাদের বৈশিষ্ট্য যা তাদেরকে ঐশী পুরষ্কার প্রাপ্ত হওয়ার যোগ্য করে তোলে;
চতুর্থ: পবিত্র কুরআনের গুরুত্ব, এর বিধান জারি করার উপায় ও পদ্ধতি এবং আত্মশুদ্ধির পথের চড়াই-উতরাই;
পঞ্চম: আল্লাহর কর্তৃত্ব, ইরাদা ও চাওয়া।[১২]
তাফসীর সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি
নেককারদের বৈশিষ্টাবলি
সূরা ইনসানের ৭-১১নং আয়াত অবধি নেককার (আবরার) বান্দাদের ৫টি গুণ উল্লেখিত হয়েছে:
১. কৃত মানত পূর্ণ করে।
২. সেদিনকে ভয় করে, যেদিনের অনিষ্ট হবে সুদূরপ্রসারী।
৩. নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য এতিম, মিসকিন ও কয়েদীকে দান করে।
৪. আর এ কাজকে তারা শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্ট কল্পে করে থাকে এর থেকে কারও প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা তারা কামনা করে না।
৫. তারা ভীতিপ্রদ ও ভয়ানক দিনে (কিয়ামত) নিজেদের প্রতিপালককে ভয় করে।[১৩]
‘হুরুল আইন’-এর প্রতি ইশারা না করা
আহলে সুন্নতের বিশিষ্ট মুফাসসির আলুসী’র মতে, সূরাটি মহানবি (স.)-এর আল ও বংশধরদের সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে এবং হযরত ফাতেমাও (সা. আ.) তাঁদের অন্তর্ভুক্ত, তাঁর সম্মানে বেহেশতি সুন্দরী (হুরুল আইন)-এর কথা উল্লেখ হয় নি।[১৪] আল্লামা তাবাতাবায়ীও এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন যে, সূরা ইনসানে বেহেশতের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামতগুলোর অন্যতম ‘হুরুল আইন’-এর কথা উল্লেখ হয় নি। অতএব, এখানে বলা যেতে পারে, যে সকল নেককার বান্দা সম্পর্কে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তাদের মাঝে নারীদেরও উপস্থিতি রয়েছে।[১৫]
প্রসিদ্ধ আয়াতসমূহ
ইতআমের আয়াত
وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে।[ইনসান : ৮।]
সূরা ইনসানের ৮নং আয়াত (এর পূর্বের ও পরের আয়াতকে সাথে নিয়ে) ইতআমের আয়াত নামে খ্যাত।[১৬] আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজি’র ভাষ্যানুযায়ী, শিয়া আলেমদের মাঝে এ বিষয়ে ঐক্যমত্য রয়েছে যে, আলোচ্য আয়াতটিসহ এ সূরার অপর বেশ কয়েকটি আয়াত (সূরার ১৮টি আয়াত বা পূর্ণ সূরা), ইমাম আলী (আ.), ফাতেমা যাহরা (সা. আ.), ইমাম হাসান ও হুসাইন (আলাইহিমাস সালাম) এবং ফিজ্জার ৩ দিন রোজা রাখা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে।[১৭] বর্ণিত হয়েছে যে, ঐ মহান ব্যক্তিবর্গ নিজেরা ক্ষুধার্ত থেকে মিসকিন, এতিম ও কয়েদীর হাতে নিজেদের ইফতারী তুলে দিয়েছিলেন।[১৮] এই শানে নুযুলকে সত্যায়নকারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রেওয়ায়েতও রয়েছে।[১৯] আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজি, আহলে বাইতের (আ.) শান ও ফজিলতে বর্ণিত ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়েতের প্রতি ইঙ্গিত করে আহলে সুন্নতের ৩৪ জন রাবি থেকে -যাদের নাম আল্লামা আমিনী প্রণীত আল-গাদীর[২০] গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে- রেওয়ায়েত করেছেন এবং একে সুন্নিদের মাঝে মশহুর ও মুতাওয়াতির বলে উল্লেখ করেছেন।[২১]
শরাবে তহুরের আয়াত
وَسَقَاهُمْ رَبُّهُمْ شَرَابًا طَهُورًا আর তাদের প্রভু তাদের পান করাবেন এক পবিত্র পানীয় (শরাবে তহুর)।[ইনসান : ২১]
আল্লামা তাবাতায়ী স্বীয় তাফসীরে আল-মীযানে এখানে শরাবে তহুর তথা পবিত্র পানীয় বলতে ঐ পানীয় অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন, যা সকল প্রকার দূষণ ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত যেমন- গাফিলাত (উদাসীনতা), বঞ্চিত হওয়া, মহান আল্লাহ্ থেকে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া। তারা এই বিশেষ পানীয় পান করার পর যেহেতু আবরার ও তাদের প্রতিপালকের মাঝে আর কোন হিজাব (পর্দা) থাকবে না এবং তারা মহান প্রতিপালকের প্রশংসিত হওয়ার বিষয়টি সরাসরি অনুধাবন করতে পারবে। আল্লামা তাবাতাবায়ীর মতে, মহান আল্লাহ্ এ আয়াতে সকল প্রকার মধ্যস্থতাকে দূরে নিক্ষেপ করে বেহেশতিদের পিপাসা নিবারণের বিষয়টিকে সরাসরি নিজের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, আর এটাই হবে বেহেশতিদের জন্য ধার্যকৃত সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ নিয়ামত।[২২]
আয়াতুল আহকাম
সূরার ৭নং আয়াতটি আয়াতুল আহকাম হিসেবে গণনা করা হয়েছে।[২৩] আলোচ্য আয়াতে -যাতে মানত পূর্ণ করাকে নেককার বান্দাদের বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম[২৪] বলে উল্লেখ করা হয়েছে- শুধু মানত করার বিষয়টি যে জায়েয তা নয় বরং তা পূরণ করা ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি আমাদের হস্তগত হয়।[২৫]
ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য
বিভিন্ন রেওয়ায়েতে সূরা ইনসান তেলাওয়াতের ফজিলত বর্ণনায়, বেহেশত, বেহেশতি হুর[২৬] এবং মহানবির (স.) সহচর্য লাভের বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে।[২৭] একইভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম রেজা (আ.) রোববার ও বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজে প্রথম রাকাতে সূরা হামদের পর সূরা ইনসান এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা হামদের পর সূরা গাশিয়াহ তেলাওয়াত করতেন। আর তিনি এও বলতেন, যে কেউ এ কাজ করবে মহান আল্লাহ এ দু’দিনে তাকে সকল প্রকার বিপদ থেকে নিরাপদ রাখবেন।[২৮]
এ সূরা তেলাওয়াতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, যদি কেউ এ সূরা তেলাওয়াত অব্যাহত রাখে তবে তার রুহ (আত্মা) যদি দূর্বল হয় তাহলে তা শক্তিশালী হবে[২৯], স্নায়ু শক্তিশালী করণ এবং উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্তির জন্য এ সূরার তেলাওয়াত কার্যকর।[৩০]
মূল সূরা ও অনুবাদ
هَلْ أَتَیٰ عَلَی الْإِنسَانِ حِینٌ مِّنَ الدَّهْرِ لَمْ یكُن شَیئًا مَّذْكُورًا ﴿۱﴾ إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِن نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَّبْتَلِیهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِیعًا بَصِیرًا﴿۲﴾ إِنَّا هَدَینَاهُ السَّبِیلَ إِمَّا شَاكِرًاوَإِمَّا كَفُورًا﴿۳﴾ إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِینَ سَلَاسِلَ وَأَغْلَالًا وَ سَعِیرًا﴿۴﴾ إِنَّ الْأَبْرَارَ یشْرَبُونَ مِن كَأْسٍ كَانَ مِزَاجُهَا كَافُورًا﴿۵﴾ عَینًا یشْرَبُ بِهَا عِبَادُ اللَّـهِ یفَجِّرُونَهَا تَفْجِیرًا﴿۶﴾ یوفُونَ بِالنَّذْرِ وَ یخَافُونَ یوْمًا كَانَ شَرُّهُ مُسْتَطِیرًا﴿۷﴾ وَ یطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَیٰ حُبِّهِ مِسْكِینًا وَ یتِیمًا وَأَسِیرًا﴿۸﴾ إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّـهِ لانُرِیدُ مِنكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا﴿۹﴾ إِنَّا نَخَافُ مِن رَّبِّنَا یوْمًا عَبُوسًا قَمْطَرِیرًا﴿۱۰﴾ فَوَقَاهُمُ اللَّـهُ شَرَّ ذَٰلِكَ الْیوْمِ وَ لَقَّاهُمْ نَضْرَةً وَ سُرُورًا﴿۱۱﴾ وَ جَزَاهُم بِمَا صَبَرُوا جَنَّةً وَ حَرِیرًا﴿۱۲﴾ مُّتَّكِئِینَ فِیهَا عَلَی الْأَرَائِكِ ۖ لایرَوْنَ فِیهَا شَمْسًا وَ لَا زَمْهَرِیرًا﴿۱۳﴾ وَ دَانِیةً عَلَیهِمْ ظِلَالُهَا وَ ذُلِّلَتْ قُطُوفُهَا تَذْلِیلًا ﴿۱۴﴾ وَ یطَافُ عَلَیهِم بِآنِیةٍ مِّن فِضَّةٍ وَأَكْوَابٍ كَانَتْ قَوَارِیرَا﴿۱۵﴾ قَوَارِیرَ مِن فِضَّةٍ قَدَّرُوهَا تَقْدِیرًا﴿۱۶﴾ وَ یسْقَوْنَ فِیهَا كَأْسًا كَانَ مِزَاجُهَا زَنجَبِیلًا ﴿۱۷﴾ عَینًا فِیهَا تُسَمَّیٰ سَلْسَبِیلًا ﴿۱۸﴾ وَ یطُوفُ عَلَیهِمْ وِلْدَانٌ مُّخَلَّدُونَ إِذَا رَأَیتَهُمْ حَسِبْتَهُمْ لُؤْلُؤًا مَّنثُورًا﴿۱۹﴾ وَإِذَا رَأَیتَ ثَمَّ رَأَیتَ نَعِیمًا وَ مُلْكًا كَبِیرًا﴿۲۰﴾ عَالِیهُمْ ثِیابُ سُندُسٍ خُضْرٌ وَ إِسْتَبْرَ قٌ ۖ وَ حُلُّوا أَسَاوِرَ مِن فِضَّةٍ وَ سَقَاهُمْ رَبُّهُمْ شَرَابًا طَهُورًا﴿۲۱﴾ إِنَّ هَـٰذَا كَانَ لَكُمْ جَزَاءً وَ كَانَ سَعْیكُم مَّشْكُورً ا ﴿۲۲﴾ إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا عَلَیكَ الْقُرْآنَ تَنزِیلًا ﴿۲۳﴾ فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تُطِعْ مِنْهُمْ آثِمًا أَوْ كَفُورًا ﴿۲۴﴾ وَاذْكُرِ اسْمَ رَبِّكَ بُكْرَةً وَأَصِیلًا ﴿۲۵﴾ وَ مِنَ اللَّـیلِ فَاسْجُدْ لَهُ وَسَبِّحْهُ لَیلًا طَوِیلًا ﴿۲۶﴾ إِنَّ هَـٰؤُلَاءِ یحِبُّونَ الْعَاجِلَةَ وَ یذَرُونَ وَرَاءَهُمْ یوْمًا ثَقِیلًا ﴿۲۷﴾ نَّحْنُ خَلَقْنَاهُمْ وَ شَدَدْنَا أَسْرَهُمْ ۖ وَ إِذَا شِئْنَا بَدَّلْنَا أَمْثَالَهُمْ تَبْدِیلًا ﴿۲۸﴾ إِنَّ هَـٰذِهِ تَذْكِرَةٌ ۖ فَمَن شَاءَ اتَّخَذَ إِلَیٰ رَ بِّهِ سَبِیلًا ﴿۲۹﴾ وَ مَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن یشَاءَ اللَّـهُ ۚ إِنَّ اللَّـهَ كَانَ عَلِیمًا حَكِیمًا ﴿۳۰﴾ یدْخِلُ مَن یشَاءُ فِی رَحْمَتِهِ ۚ وَ الظَّالِمِینَ أَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا أَلِیمًا ﴿۳۱﴾
মহাকালের মধ্য হতে মানুষের উপর কি এমন একটা সময় অতিবাহিত হয়নি যখন সে উল্লেখ করার যোগ্য কোন বস্তুই ছিল না? (১) আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সংমিশ্রিত শুক্রবিন্দু থেকে তাকে পরীক্ষা করার জন্য, এজন্য তাকে করেছি শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী। (২) আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে। (৩) আমি (অকৃতজ্ঞ) কাফিরদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি শেকল, বেড়ি আর জ্বলন্ত আগুন। (৪) (অপরদিকে) নেককার লোকেরা এমন পানপাত্র থেকে পান করবে যাতে কর্পুরের সংমিশ্রণ থাকবে। (৫) আল্লাহর বান্দারা একটি ঝর্ণা থেকে পান করবে। তারা এই ঝর্ণাকে (তাদের) ইচ্ছেমত প্রবাহিত করবে। (৬) যারা মানত পূরণ করে আর সেই দিনকে ভয় করে যার অনিষ্ট হবে সুদূরপ্রসারী। (৭)
তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। (৮) তারা বলেঃ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। (৯) আমরা কেবল ভয় করি আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে এক ভীতিপ্রদ ভয়ানক দিনের। (১০) অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে সেদিনের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন এবং তাদেরকে দিবেন সজীবতা ও আনন্দ। (১১) এবং তাদের সবরের প্রতিদানে তাদেরকে দিবেন জান্নাত ও রেশমী পোশাক। (১২) তারা সেখানে সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে রৌদ্র ও শৈত্য অনুভব করবে না। (১৩) জান্নাতের বৃক্ষরাজির ছায়া তাদের উপর থাকবে, আর ফলের গুচ্ছ একেবারে তাদের নাগালের মধ্যে রাখা হবে। (১৪) তাদের সামনে ঘুরে ঘুরে রুপার পাত্র পরিবেশন করা হবে আর সাদা পাথরের পানপাত্র। (১৫) সেই সাদা পাথরও হবে রুপার তৈরী। তারা এগুলোকে যথাযথ পরিমাণে ভর্তি করবে। (১৬) তাদেরকে পান করানোর জন্য এমন পাত্র পরিবেশন করা হবে যাতে আদার মিশ্রণ থাকবে। (১৭) সেখানে আছে একটা ঝর্ণা, যার নাম সালসাবীল। (১৮) ঘুরে ঘুরে তাদের সেবাদান কার্যে নিয়োজিত থাকবে চিরকিশোরগণ। তুমি যখন তাদেরকে দেখবে, তুমি মনে করবে, তারা যেন ছড়ানো মুক্তা। (১৯) তুমি যখন দেখবে তখন দেখতে পাবে ভোগ বিলাসের নানান সামগ্রী আর এক বিশাল রাজ্য। (২০) তাদের আবরণ হবে চিকন সবুজ রেশম ও মোটা রেশম, আর তাদেরকে অলংকারে সজ্জিত করা হবে রুপার কঙ্কণ দ্বারা, আর তাদের রব্ব তাদেরকে পান করাবেন পবিত্র পরিচ্ছন্ন পানীয়। (২১) ‘এটাই তোমাদের প্রতিদান, তোমাদের চেষ্টা-সাধনা সাদরে গৃহীত হয়েছে।’ (২২) (হে নবী!) আমি তোমার কাছে কুরআন অবতীর্ণ করেছি ক্রমে ক্রমে (অল্প অল্প করে)। (২৩) কাজেই তুমি ধৈর্য ধ’রে, তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষা কর আর তাদের মধ্যেকার পাপাচারী অথবা কাফিরের আনুগত্য কর না। (২৪) আর সকাল-সন্ধ্যায় তোমার রব্ব এর নাম স্মরণ কর। (২৫) আর রাতের কিছু অংশে তাঁর জন্য সেজদায় অবনত হও আর রাতের দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর মহিমা বর্ণনা কর। (২৬) এ লোকেরা তো পার্থিব জীবনকে ভালবাসে আর তাদের আড়ালে যে (কিয়ামাতের) কঠিন দিন (আসছে) তাকে উপেক্ষা করে। (২৭) আমিই তাদেরকে সৃষ্টি করেছি আর তাদের গঠন মজবুত করেছি। আমি যখন চাইব তখন তাদের স্থলে তাদের মত অন্য লোক আনব। (২৮) এটা এক উপদেশ, কাজেই যার ইচ্ছে সে (এ উপদেশ মান্য ক’রে) তার প্রতিপালকের পথ ধরুক। (২৯) তোমরা ইচ্ছে কর না আল্লাহর ইচ্ছে ব্যতীত। (অর্থাৎ আল্লাহ কোন কিছু কার্যকর করতে চাইলে তোমাদের মাঝে ইচ্ছে ও শক্তি সঞ্চার করতঃ তোমাদের মাধ্যমে তা কার্যকর করেন)। আল্লাহ সর্বজ্ঞাতা মহাবিজ্ঞানী। (৩০) তিনি যাকে ইচ্ছে তাঁর রাহমাতে দাখিল করেন। আর যালিমরা- তাদের জন্য তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন বড়ই পীড়াদায়ক শাস্তি। (৩১)
তথ্যসূত্র
- ↑ মাকারেম শিরাজি, তাফসিরে নেমুনে, ১৩৭১ সৌরবর্ষ, খ. ২৫, পৃ. ৩২৭।
- ↑ মাকারেম শিরাজি, তাফসিরে নেমুনে, ১৩৭১ সৌরবর্ষ, খ. ২৫, পৃ. ৩২৭।
- ↑ খোররাম শাহি, দানেশনামে কোরান ওয়া কোরান পেজোহি, ১৩৭৭ সৌর বর্ষ, খ. ২, পৃ. ১২৬০।
- ↑ মারেফাত, আমুজেশে উলুমে কোরান, ১৩৭১ সৌরবর্ষ, খ. ১, পৃ. ১৬৮।
- ↑ খোররাম শাহি, দানেশনামে কোরান ওয়া কোরান পেজোহি, ১৩৭৭ ফার্সি সন, খ. ২, পৃ. ১২৬০।
- ↑ মাকারেম শিরাজি, তাফসিরে নেমুনে, ১৩৭১ সৌরবর্ষ, খ. ২৫, পৃ. ৩২৮।
- ↑ কুরতুবি, আল জামে লি-আহকামিল কুরআন, ১৩৬৪ হি., খ. ১৯, পৃ. ১১৭।
- ↑ সা’লাবি, আল কাশফ ওয়াল বায়ান, ১৪২২ হি., খ. ১০, পৃ. ৯২; ফাখরে রাযি, আত তাফসিরুল কাবির, ১৪২০ হি., খ. ৩০, পৃ. ৭৩৯।
- ↑ তাবরানি, আত তাফসিরুল কাবির ; তাফসিরুল কোরআনিল আযিম, ২০০৮ খ্রি., খ. ৬, পৃ. ৩৯৮।
- ↑ খোররাম শাহি, দানেশনামে কোরান ওয়া কোরান পেজোহি, ১৩৭৭ সৌরবর্ষ, খ. ২, পৃ. ১২৬০।
- ↑ "ইমশাব কোরসে কামার দার কারবালা তো'নে বে খুরশিদ মি যানাদ" সাইটে খাবারিয়ে ফারদা, তারিখে বযদিদ ২১শে শাহরিভার, ১৩৯৫ সৌরবর্ষ।
- ↑ মাকারেম শিরাজি, তাফসিরে নেমুনে, ১৩৭১ সৌরবর্ষ, খ. ২৫, পৃ. ৩২৭।
- ↑ মাকারেম শিরাজি, তাফসিরে নেমুনে, ১৩৭১ সৌরবর্ষ, খ. ২৫, পৃ. ৩৫১-৩৫৫।
- ↑ আলুসি, তাফসিরে রুহুর মাআনি, খ. ১৫, পৃ. ১৭০-১৭৪।
- ↑ তাবাতাবায়ি, আল-মিজান, ১৩৯০ হি., খ. ২০, পৃ. ১৩১।
- ↑ দ্র: রুহানি নিয়া, ফুরুগে গাদীর, ১৩৮৬ ফার্সি সন, পৃ. ১৪৬; আনসারি, আহলুল বাইত আলাইহিমুস সালাম, মাজমাউল ফিকর, পৃ. ১৭৩। মাজাহেরি, যেন্দেগানিয়ে চাহারদা মাসুম আলাইহিমুস সালাম, ১৩৭৮ সৌরবর্ষ, পৃ. ৫৬; দেইলামি, এরশাদুল কুলুব, তেহরান, খ. ২, পৃ. ১৩৬; বাশভি, জায়গাহে আহলে বাইত দার সূরেয়ে দাহর আয মানজারে ফারিকাইন, পৃ. ৬৮; ইমাম আলি দার পোরসেশ হায়ে কুরআনি, পৃ. ১০৮।
- ↑ মাকারেম শিরাজি, তাফসিরে নেমুনেহ, ১৩৭১ সৌরবর্ষ, খ. ২৫, পৃ. ৩৪৫।
- ↑ যেমাখশারি, আল কাশ্শাফ, ১৪১৫ হি., খ. ৪, পৃ. ৬৭০; ফাখরে রাজি, তাফসিরুল কাবির, ১৪২০ হি., খ. ৩০, পৃ. ৭৪৬; তাবারসি, মাজমাউল বায়ান, ১৩৭২ ফার্সি সন, খ. ১০, পৃ. ৬১২; মাকারেম শিরাজি, তাফসিরে নেমুনে, ১৩৭১ ফার্সি সন, খ. ২৫, পৃ. ৩৪৩।
- ↑ দ্র: তাবারসি, মাজমাউল বায়ান, ১৩৭২ সৌরবর্ষ, খ. ২, পৃ. ৬১১ ও ৬১২।
- ↑ দ্র: আমিনি, আল গাদীর, ১৪১৬ হি., খ. ৩, পৃ. ১৫৫-১৬১।
- ↑ মাকারেম শিরাজি, তাফসিরে নেমুনে, ১৩৭১ সৌরবর্ষ, খ. ২৫, পৃ. ৩৪৫।
- ↑ তাবাতাবায়ি, আল-মিজান, ১৩৯০ হি., খ. ২০, পৃ. ১৩০ ও ১৩১।
- ↑ ইরাওয়ানি, দুরুসুন তামহিদিয়াহ, ১৪২৩ হি., খ. ১, পৃ. ৪৫১।
- ↑ মাকারেম শিরাজি, তাফসিরে নেমুনে, ১৩৭১ সৌরবর্ষ, খ. ২৫, পৃ. ৩৫১।
- ↑ ইরাওয়ানি, দুরুসুন তামহিদিয়াহ, ১৪২৩ হি., খ. ১, পৃ. ৪৫১।
- ↑ তাবারসি, মাজমাউল বায়ান, ১৩৭২ সৌরবর্ষ, খ. ১০, পৃ. ২০৬।
- ↑ শেইখ সাদুক, সাওয়াবুল আমাল ওয়া ইকাবুল আমাল, ১৪০৬ হি., পৃ. ১২১।
- ↑ শেইখ সাদুক, মান লা ইয়াহযারুহুল ফাকিহ, এনতেশারাতে জামেয়ে মুদাররিসিন, খ. ১, পৃ. ৩০৭-৩০৮।
- ↑ বাহরানি, আল-বোরহান, ১৪১৬ হি., খ. ৫, পৃ. ৫৪৩।
- ↑ বাহরানি, আল-বোরহান, ১৪১৬ হি., খ. ৫, পৃ. ৫৪৩।
গ্রন্থপঞ্জি
- কুরআনে করীম, তরজমা মুহাম্মদ মাহদী ফুলাদওয়ান্দ, তেহরান: দারুল কুরআনুল কারীম, ১৪১৮ হি./ ১৩৭৬ সৌরবর্ষ।
- কুরআনে করীম, তরজমা, তাওযিহাত ও ওয়াজেহ নামেহ বাহাউদ্দিন খোররাম শাহি, তেহরান, জামী, নিলুফার, ১৩৭৬ সৌরবর্ষ।
- ইমাম আলী দার পুরছেশহায়ে কুরআনী, মাজাল্লেয়ে ফারহাঙ্গে কাউসার, শোরেহ ৪৭, এসফান্দ, ১৩৭৯ সৌরবর্ষ।
- ইরওয়ানী, বাকের, দুরুসে তামহিদিয়ে ফি তাফসিরে আয়াতে আহকাম, কোম, দারুল ফেকহ, ১৪২৩ হিঃ।
- আনসারী, মোহাম্মাদ আলী, আহলে বাইত (আঃ) ইমামাতুহুম হায়াতুহুম, কোম, মাজামাউল ফিকরুল ইসালামী, প্রকাশের তারিখ অজ্ঞাত।
- বাহরানী, সাইয়্যেদ হাশেম, আল-বুরহানু ফি তাফসিরিল কুরআন, তাহকিক কিসমুত দিরাসাতুল ইসলামীয়্যাতু কোম, তেহরান, বুনিয়াদে বেসাত, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৬ হিঃ।
- সা’লাবি, আহমাদ বিন মোহাম্মাদ, আল কাশফ ওয়াল বায়ান, বৈরুত, দারু ইহয়ায়িত তুরাসিল আরাবী, প্রথম প্রকাশ, ১৪২২ হিঃ।
- খোররাম শাহি, বাহাউদ্দিন, দানেশনামে কোরান ওয়া কোরান পেজোহি, তেহরান, দুস্তান-নাহিদ, ১৩৭৭ সৌরবর্ষ।
- মাকারেম শিরাজি, নাসের, তাফসিরে নেমুনে, ১৩৭১ সৌরবর্ষ, তেহরান, দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, দশম প্রকাশ, ১৩৭১ সৌরবর্ষ।
- কুরতুবি, মোহাম্মাদ বিন মোহাম্মাদ, আল জামে লি-আহকামিল কুরআন, তেহরান, নাসের খুসরূ, প্রথম প্রকাশ, ১৩৬৪ সৌরবর্ষ।
- মারেফাত, মোহাম্মাদ হাদি, আমুজেশে উলুমে কোরান, মারকাযে চাপ ও নাশরে সজমানে তাবলিগাতে ইসলামী, প্রথম প্রকাশ, ১৩৭১ সৌরবর্ষ।
- শেইখ সাদুক, মোহাম্মাদ বিন আলী, মান লা ইয়াহযারুহুল ফাকিহ, কোম, এনতেশারাতে জামেয়ে মুদাররিসিন, দ্বিতীয় প্রকাশ, প্রকাশের তারিখ অজ্ঞাত।
- শেইখ সাদুক, মোহাম্মাদ বিন আলী, সাওয়াবুল আমাল ওয়া ইকাবুল আমাল, দারুশ্ শারিফুর রাজি, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৪০৬ হি।
- তাবারানী, সোলাইমান বিন আহমাদ, আত তাফসিরুল কাবির ; তাফসিরুল কোরআনিল আযিম, দারুল কিতাবিল সাকাফী, প্রথম প্রকাশ, ২০০৮ ঈসায়ী।
- তাবারসী, ফাযল বিন হাসান, মাজমাউল বায়ান ফি তাফসিরিল কুরআন, তাহকিক মোহাম্মাদ জাওয়াদে বালাগী, তেহরান, ইন্তেশারাতে নাসের খুসরূ, তৃতীয় প্রকাশ, ১৩৭২ সৌরবর্ষ।
- ফাখরে রাজী, মোহাম্মাদ বিন উমার, আত্-তাফসিরুল কাবির, বৈরুত, দারু ইহয়ায়িত তুরাসিল আরাবী, তৃতীয় প্রকাশ, ১৪২০ হিঃ।
- রুহানি নিয়া, আব্দুর রাহিম, ফুরুগে গাদীর, কোমে মাশহুর, ১৩৮৬ সৌরবর্ষ।
- মাজাহেরি, হোসাইন, যেন্দেগানিয়ে চাহারদা মাসুম আলাইহিমুস সালাম, তেহরান, পায়ামে আযাদী, ১৩৭৮ সৌরবর্ষ।