সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ তিজানী

wikishia থেকে

সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ তিজানি সামাভি (জন্ম: ১৯৩৬ ইং); বিশিষ্ট সুন্নি আলেম, যিনি আহলে সুন্নাত থেকে শিয়া মাযহাবের অনুসারী হয়েছেন। তিজানি প্রথমে মালেকি মাযহাবের অনুসারী ছিলেন, কিন্তু সৌদি সফরের পর তিনি ওয়াহাবি চিন্তাধারায় প্রভাবিত হন এবং এ চিন্তাধারার প্রচার ও তাবলিগ শুরু করেন। কিন্তু নাজাফ সফর এবং সেখানকার শিয়া আলেমদের সাথে সাক্ষাত, মতবিনিময় ও আলোচনার পর তিনি শিয়া মাযহাব অনুসরণ করা শুরু করেন।

সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ তিজানি সামাভি

শিয়া মাযহাবের অনুসরণ শুরুর পর তিনি এ মাযহাবের সমর্থনে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন; ‘অবশেষে সত্যের সন্ধান পেলাম’ (ثُمَّ اهْتَدَیتُ) সেগুলোর অন্যতম। এ গ্রন্থে তিনি তার শিয়া হওয়া এবং শিয়া আলেমদের সাথে তার সাক্ষাতের ঘটনা তুলে ধরেছেন। শিয়া মাযহাব গ্রহণের পর তিজানি সামাভি ওয়াহাবিদের বিভিন্ন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন। তাদের কেউ কেউ তিজানির লেখা গ্রন্থগুলোকে বানোয়াট এবং তাকে মুরতাদ বলে আখ্যায়িত করে।

তিজানি’র ভাষ্যমতে শারাফুদ্দীন রচিত ‘আল-মুরাজিআত’ ও ‘আন-নাস ওয়াল ইজতিহাদ’ গ্রন্থ দু’টি এবং শিয়া মারজায়ে তাক্বলিদ সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ বাকের সদর তার শিয়া হওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

জন্ম ও শিক্ষা

মুহাম্মাদ তিজানি সামাভি ১৯৩৬ সালে তিউনিশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় ‘ক্বাফসাহ’ শহরে জন্মগ্রহণ করেন।[১] তার ভাষায়, তাঁর পূর্বপুরুষরা ইরাকের সামাভা শহরের বাসিন্দা ছিলেন এবং আব্বাসীয় খেলাফতকালে তারা উত্তর আফ্রিকায় হিজরত করেন।[২]

তিনি ২ অথবা ৩ বছর তিউনিশিয়ার ‘জামেয়া যাইতুনিয়া’তে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। অতঃপর তিউনিশিয়া স্বাধীন হওয়ার পর জামেয়া যাইতুনিয়াহ বন্ধ হয়ে গেলে তিনি ফ্রাঙ্কো-আরাবিক (ফ্রেঞ্চ-আরবি) স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের পড়াশুনা শেষে তিনি ঐ স্কুলেই সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দান করেন এবং প্রায় ১৭ বছর তিনি সেখানে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন।[৩]

উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিজানি ফ্রান্সে যান এবং সেখানে তিনি ‘সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়’ ও প্যারিস ইনস্টিটিউট অব হায়ার এড্যুকেশনে দীর্ঘ ৮ বছরেরও অধিক সময় অধ্যয়ন করেন। অতঃপর তিনি ‘দর্শন ও হিউম্যান সায়েন্স’, অতঃপর ‘ইতিহাস এবং ইসলামি মাযহাব’ বিষয়ে ঐ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তার পিএইচডি’র থিসিসের বিষয়বস্তু ছিল ‘ইসলামিক থটস ইন নাহজুল বালাগাহ’। তিনি ফরাসি ভাষায় নাহজুল বালাগাহ অনুবাদ করেন। ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি এক বছর সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ৩ বছর প্যারিসের বালযাক (Balzac) ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেন।[৪]

শৈশবে তিজানি পবিত্র কুরআনের অর্ধেক হিফয করতে সক্ষম হন, এ কারণে পবিত্র রমজান মাসে তিনি ইমাম হিসেবে তারাবি’র নামাযে অংশগ্রহণ করতেন।[৫] তার ভাষ্যমতে, ‘তিজানি’ নামটি ‘তিজানি’ তরিকত থেকে গৃহীত যা তিউনিশিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া, লিবিয়া, সুদান, মিসর ও অন্যান্য দেশে প্রচলিত ছিল। তাদের বিশ্বাস, সকল মাশায়েখআল্লাহর ওয়ালিগণ নিজেদের ইলম পরস্পর থেকে গ্রহণ করেছেন, শুধুমাত্র আহমাদ তিজানি ব্যতীত; তিনি তার জ্ঞান সরাসরি মহানবি (স.) থেকে গ্রহণ করেছেন।[৬]

শিয়া মাযহাব গ্রহণ

তিজানি ছিলেন মালেকি মাযহাবের অনুসারী।[৭] তিনি ১৯৬৪ সালে মক্কায় মুসলিম আরবদের বিষয়ে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন এবং এ সফরে তিনি ওয়াহাবি চিন্তাধারার দিকে ঝুঁকে পড়েন, অতঃপর ওয়াহাবি চিন্তাধারার প্রচার শুরু করেন।[৮]

সাইয়্যেদ মুহম্মাদ বাকের এর সাথে তিজানি

তিজানি তার বৈরুত সফরে বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ‘মুনঈম’-এর সাথে পরিচিত হন এবং তার সাথে আলাপে শিয়াদেরকে কুফরিশিরকি আকিদার অধিকারী বলে আখ্যায়িত করেন; কিন্তু মুনঈম শিয়া মাযহাব সম্পর্কে অধিক পরিচিতির জন্য তাকে ইরাকে আমন্ত্রণ জানান।[৯] মুনঈমের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তিজানি ইরাক সফরে আসেন এবং সেখানে ইমাম আলী (আ.)-এর মাযার, কাযেমাইনে দুই ইমামের মাযার এবং বাগদাদে শেইখ আব্দুল কাদির জিলানি’র মাযার যিয়ারত করেন। এ সময় তিনি বেশ কয়েকজন শিয়া আলেমের সাথে সাক্ষাত ও মতবিনিময় করেন।[৯] শিয়া মারজা আয়াতুল্লাহ খুয়ী ও সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ বাকের সদরের সাথে সাক্ষাত ও কথোপকথনে শিয়া মাযহাব সম্পর্কে তার কিছু কিছু ভুল আকিদা সংশোধিত হয়।

তিনি শিয়া আলেমদের থেকে প্রভাবিত হওয়ার বিষয়ে বিশেষ করে সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ বাকের সদর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ‘সুম্মাহ তাদাইতু’ (অবশেষে সত্যের সন্ধান পেলাম) গ্রন্থে শিয়া আলেমদের সাথে তার সাক্ষাতের ঘটনা এবং তাদের নিকট করা বিভিন্ন প্রশ্ন ও সেগুলোর উত্তর, বিশেষ করে আয়াতুল্লাহ সদরের উত্তরগুলোকে উল্লেখ করেছেন।[১০]

শিয়া আলেমদের সাথে সাক্ষাতের পর তিনি সত্য পথের অন্বেষণে গভীর গবেষণা শুরু করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন: ‘আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, যে সকল সহিহ হাদিস শিয়া ও সুন্নি উভয়ের নিকট গ্রহণযোগ্য সেগুলোকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করবো এবং যেগুলো শুধু একটি ফির্কা’র নিকট গ্রহণযোগ্য সেগুলোকে উপেক্ষা করবো’।[১৩] তিজানি শিয়া আকিদা সম্পর্কে গবেষণা শুরু করলেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী যে গ্রন্থ দু’টি তাকে প্রভাবিত করেছিল তা হলো সাইয়্যেদ আব্দুল হুসাইন শারাফুদ্দীন রচিত ‘আল-মুরাজিয়াত’ ও ‘আন-নাস ওয়াল-ইজতিহাদ’। [১১]

রচিত গ্রন্থসমূহ

শিয়া মাযহাব গ্রহণের পর তিনি শিয়া মাযহাবের সত্যতা প্রমাণ এবং আহলে সুন্নতের রদ্দে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রহণ রচনা করেছেন; সেগুলোর মধ্যে সুম্মাহ তাদাইতু (অবশেষ সত্যের সন্ধান পেলাম), লাআকুনু মাআস সাদিকীন (সত্য বাদীদের সাথী হয়ে যাও), ফাসআলু আহলায যিকর (আহলে যিকরকে জিজ্ঞেস করো), আশ-শিয়া হুম আহলুস সুন্নাহ (শিয়ারাই প্রকৃত আহলে সুন্নাত), ই’রিফিল হাক্ব (সত্যকে চেনো), ফা-সীরু ফিল আরদি ফানযুরু (পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো), ইত্তাকুল্লাহ (তাক্বওয়াবান হও) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।[১২]

তিনি তার ‘সুম্মাহ তাদাইতু’ গ্রন্থে যা বাংলায় ‘অবশেষ সত্যের সন্ধান পেলাম’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে, তার আহলে সুন্নত থেকে শিয়া মাযহাব গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঐ গ্রন্থে তিনি নিজের সংক্ষিপ্ত জীবনী বর্ণনার পাশাপাশি তার ইরাক সফর এবং শিয়া আলেমদের সাথে তার সাক্ষাত ও তাদের সাথে আলাপগুলো তুলে ধরেছেন। এতে তিনি আহলে সুন্নাত কর্তৃক বর্ণিত বিভিন্ন হাদিসের কথা উল্লেখ পূর্বক শিয়া মাযহাবের সত্যতা প্রমাণ করেছেন। গ্রন্থটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।

তিজানি সামাভি’র ৬টি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত রূপ হুসাইন গাফফারি কর্তৃক সংকলিত ও প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিক্রিয়া

এক সাক্ষাতকারে তিজানি বলেন, শিয়া মাযহাব গ্রহণের পর তিনি ওয়াহাবি ও সৌদিদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন। তার ভাষায়, ওয়াহাবিদের একটি দল প্রথমে তিজানি নামের কোন ব্যক্তির শিয়া হওয়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করে, অতঃপর তারা দাবি করে যে, ‘সুম্মাহ তাদাইতু’ গ্রন্থটি ইসরাইলিদের লেখা, আবার তাদের কেউ কেউ বলেন, সে না শিয়া না সুন্নি বরং সে মুরতাদ[১৩]

তথ্যসূত্র

  1. জিন্দেগিনামা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ তিজানি, ওয়েবগাহে মারকাযে জাহানিয়ে মুসতাবসিরিন
  2. মাশরুহে মুসাহেবেয়ে ফার্স বা আল্লামা তিজানি সামাভি, ওয়েবগাহে খাবারগুজারিয়ে ফার্স।
  3. মাশরুহে মুসাহেবেয়ে ফার্স বা আল্লামা তিজানি সামাভি, ওয়েবগাহে খাবারগুজারিয়ে ফার্স।
  4. মাশরুহে মুসাহেবেয়ে ফার্স বা আল্লামা তিজানি সামাভি, ওয়েবগাহে খাবারগুজারিয়ে ফার্স।
  5. তিজানি, সুম্মাহ তাদাইতু, মানশুরাতু মাদিনাতুল ইলম, পৃ: ১১-১২।
  6. তিজানি, সুম্মাহ তাদাইতু, মানশুরাতু মাদিনাতুল ইলম, পৃ:১২-১৩।
  7. তিজানি, সুম্মাহ তাদাইতু, মানশুরাতু মাদিনাতুল ইলম, পৃ: ২৮-২৯।
  8. তিজানি, সুম্মাহ তাদাইতু, মানশুরাতু মাদিনাতুল ইলম, পৃ: ১৬-১৭।
  9. তিজানি, সুম্মাহ তাদাইতু, মানশুরাতু মাদিনাতুল ইলম, পৃ: ৪৫-৪৬।
  10. তিজানি, সুম্মাহ তাদাইতু, মানশুরাতু মাদিনাতুল ইলম, পৃ: ৫৩-৬০।
  11. তিজানি, সুম্মাহ তাদাইতু, মানশুরাতু মাদিনাতুল ইলম, পৃ: ৭৫।
  12. মাজমুয়ে কিতাবহায়ে ডক্টর তিজানি সামাভি, ওয়েবগাহে তিবয়ান।
  13. মাশরুহে মুসাহেবেয়ে ফার্স বা আল্লামা তিজানি সামাভি, ওয়েবগাহে খাবারগুজারিয়ে ফার্স।

গ্রন্থপঞ্জি

  • তিজানি সামাভি, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ, সুম্মাহ তাদাইতু, মানশুরাতু মাদিনাতুল ইলম- আয়াতুল্লাহিল উযমা খুয়ী, ...।