মুরতাদ-এ ফিতরি
মুরতাদ-এ ফিতরি (আরবি: المرتد الفطري) হচ্ছে এমন ব্যক্তি যার পিতা বা মাতা অথবা তারা উভয়ই মুসলমান এবং সে বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হওয়ার পর ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করে। মুরতাদ-এ ফিতরির শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড, তবে ব্যক্তিটি নারী হলে তওবা না করা পর্যন্ত বা মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড।
শীয়া ফকীহগণের বেশিরভাগের ফতোয়ার ভিত্তিতে মুরতাদ-এ ফিতরি পুরুষ হলে তার তওবা গ্রহণযোগ্য নয়। এমতাবস্থায়, হিজরী পনের শতকের বিশিষ্ট শীয়া মারজায়ে তাক্বলীদ আয়াতুল্লাহ খুয়ী মনে করেন, তওবার কারণে তার মৃত্যুদণ্ডের হুকুম, বিবাহ বাতিল ও উত্তরাধিকারদের মধ্যে তার সম্পদ বণ্টন রহিত হয় না। তবে তার মুসলমান হওয়া এবং গুনাহ মাপের কারণ হয়।
পরিভাষা পরিচিতি
মুরতাদ-এ ফিতরি হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যার পিতা বা মাতা অথবা তারা উভয়ই মুসলমান অথচ সে বালেগ তথা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করে।[১] প্রসিদ্ধ মতের ভিত্তিতে তার পিতা-মাতার মুসলমান হওয়ার মানদণ্ড হচ্ছে নিষিক্ত হওয়ার সময়[২] যদিওবা জাওয়াহেরের প্রণেতা “রেসায়েলে জাযায়েরি” গ্রন্থ হতে আজব একটি দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ করেছেন যে, তার পিতা বা মাতা অথবা উভয়ই তার জন্মের সময় মুসলমান থাকবেন।[৩]
মুরতাদে ফিতরির মুকাবিলায় মুরতাদ-এ মিল্লি বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যার পিতা-মাতার কেউই নিষিক্ত হওয়ার সময় মুসলিম থাকে না এবং ঐ ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর মুসলমান হয় এবং অতঃপর কাফের হয়।[৪]
শাস্তি
শীয়া মশহুর ফকীহগণের দৃষ্টিতে মুরতাদে ফিতরি যদি পুরুষ হয় তবে তার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।[৫] অনুরূপভাবে, ফকীহগণের দৃষ্টিতে মুরতাদে ফিতরির সম্পদসমূহ তার উত্তরাধিকারিদের মধ্যে বণ্টন করা হয় এবং তার বিবাহ বাতিল হয়ে যায়।[৬] আর তিনি মুসলমানের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন না।[৭]
নারী যদি মুরতাদ-এ ফিতরি হয়, তবে শীয়া ফকীহদের মতানুসারে তাকে হত্যা করা হবে না;[৮] অবশ্য কারাদণ্ড দেওয়া হবে তওবা না করা বা মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত।[৯]এছাড়াও বিবাহ বাতিল হয়ে যাবে।[১০]
কিছু সংখ্যক ফকীহ মনে করেন, যদি কোন নারীর মুরতাদে ফিতরি হওয়ার বিষয়টি চারবার পুণরাবৃত্তি হয় তবে উক্ত নারীর মৃত্যুদণ্ড হবে,[১১] তবে আয়াতুল্লাহ খুয়ীর মত হচ্ছে নারীর ক্ষেত্রে মুরতাদে ফিতরির বিষয়টি পুণরাবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যুদণ্ড হবে না।[১২]
তওবা
আয়াতুল্লাহ খুয়ী’র ভাষ্যানুসারে, মশহুর ফকীহগণ মনে করেন মুরতাদ-এ ফিতরির তওবা গ্রহণযোগ্য নয়।[১৩] কিন্তু চতুর্থ শতকের বিশিষ্ট শিয়া ফকীহ ইবনে জুনায়েদ এসকাফি’র দৃষ্টিতে, মুরতাদ-এ ফিতরি যদি তওবা করে তবে তার মৃত্যুদণ্ডের হুকুম রহিত হয়ে যায় এবং তার সম্পত্তিসমূহ ফিরিয়ে দিতে হবে এবং নতুন করে আকদ পড়া ব্যতিরেকে তার স্ত্রীর প্রতি রুজু তথা ফিরতে পারবেন।[১৪] তবে আয়াতুল্লাহ খুয়ী মনে করেন, যদি কোন মুরতাদ-এ ফিতরি তওবা করেন তবে তিনি মুসলমান হিসেবে বিবেচিত হবেন, যদিওবা মৃত্যুদণ্ডাদেশ, বিবাহ বাতিল ও সম্পদ বণ্টনের আদেশ রহিত হয়ে যাবে না।[১৫] তবে তওবা করার কারণে আযাব, আগুনে নিক্ষেপ, অপবিত্র হওয়া, স্ত্রী হিসেবে মুসলিম নারী নির্বাচনের অনুমতি না থাকা এবং মুসলমানের উত্তরাধিকারি না হওয়ার বিষয়টি রহিত হবে।[১৬]
আয়াতুল্লাহ খুয়ীর ভাষ্যানুসারে তওবার অর্থ হচ্ছে কুফরির জন্য অনুশোচনার প্রকাশ। আর অনুশোচনার প্রকাশ, মুরতাদের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের ন্যায় শাস্তিসমূহের বাস্তবায়নকে রহিত করতে সক্ষম নয়।[১৭] তিনি অনুরূপভাবে মনে করেন, তওবা করার পর গুণাহের তাকউয়িনি প্রভাব শেষ হয়ে যায়, কিন্তু এমন কোন দলিল নেই যে তার শারয়ী প্রভাবও তওবার মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যায়।[১৮] আয়াতুল্লাহ খুয়ী এছাড়াও উল্লেখ করেন, মুরতাদের হত্যার হুকুম ও ইসলামের মধ্যে কোন ধরনের বিরোধ নেই; কেননা, লাওয়াত তথা সমকামিতার ন্যায় অন্য আহকাম রয়েছে যেক্ষেত্রে মুসলমানকে হত্যার হুকুম দেওয়া হয় এবং তওবার মাধ্যমেও তার মৃত্যুদণ্ডের হুকুম রহিত হয় না।[১৯]
তথ্যসূত্র
- ↑ নাজাফি, জাওয়াহেরুল কালাম, খণ্ড ৪১, পৃ. ৬০২।
- ↑ শাহীদ সানি, মাসালেকুল আফহাম, ১৪১৩ হি., খণ্ড ১৫, পৃ. ২৩; খুয়ী, আত-তানকীহ, আত-তাহারাহ ৩, ১৪১৩ হি., পৃ. ২২৪।
- ↑ নাজাফি, জাওয়াহেরুল কালাম, খণ্ড ৪১, পৃ. ৬০৫।
- ↑ শাহীদ সানি, আর-রাওযাতুল বাহইয়াহ, ১৪১০ হি., খণ্ড ৮, পৃ. ৩০; খুয়ী, আত-তানকীহ, আত-তাহারাহ ৩, ১৪১৩ হি., পৃ. ২২৪।
- ↑ নাজাফি, জাওয়াহেরুল কালাম, খণ্ড ৪১, পৃ. ৬০৫।
- ↑ নাজাফি, জাওয়াহেরুল কালাম, খণ্ড ৪১, পৃ. ৬০৫।
- ↑ মুসাভি আরদেবিলী, ফিকহুল হুদুদ ওয়াত তা’যিরাত, ১৪২৯ হি., খণ্ড ৪, পৃ. ১০২।
- ↑ খুয়ী, মাবানিউ তাকমিলাতিল মিনহাজ, ১৪২৮ হি., খণ্ড ১, পৃ. ৩৯৯।
- ↑ খুয়ী, মাবানিউ তাকমিলাতিল মিনহাজ, ১৪২৮ হি., খণ্ড ১, পৃ. ৩৯৯।
- ↑ খুয়ী, মাবানিউ তাকমিলাতিল মিনহাজ, ১৪২৮ হি., খণ্ড ১, পৃ. ৩৯৯।
- ↑ দ্র: খুয়ী, মাবানিউ তাকমিলাতিল মিনহাজ, ১৪২৮ হি., খণ্ড ১, পৃ. ৪০১।
- ↑ খুয়ী, মাবানিউ তাকমিলাতিল মিনহাজ, ১৪২৮ হি., খণ্ড ১, পৃ. ৪০১।
- ↑ খুয়ী, আত-তানকীহ, আত-তাহারাহ ৩, ১৪১৩ হি., পৃ. ২২৪।
- ↑ খুয়ী, আত-তানকীহ, আত-তাহারাহ ৩, ১৪১৩ হি., পৃ. ২২৪।
- ↑ খুয়ী, আত-তানকীহ, আত-তাহারাহ ৩, ১৪১৩ হি., পৃ. ২২৪।
- ↑ খুয়ী, আত-তানকীহ, আত-তাহারাহ ৩, ১৪১৩ হি., পৃ. ২২৭।
- ↑ খুয়ী, আত-তানকীহ, আত-তাহারাহ ৩, ১৪১৩ হি., পৃ. ২২৫।
- ↑ খুয়ী, আত-তানকীহ, আত-তাহারাহ ৩, ১৪১৩ হি., পৃ. ২২৬।
- ↑ খুয়ী, আত-তানকীহ, আত-তাহারাহ ৩, ১৪১৩ হি., পৃ. ২২৮।
গ্রন্থপঞ্জি
- খুয়ী, আবুল কাসেম, আত-তানকীহু ফি শারহিল উরওয়াতুল উসকা, তাকরীরে মির্যা আলী গারভি, কোম, দারুল হাদি, ১৪১৩ হি.।
- খুয়ী, আবুল কাসেম, মাবানিউ তাকমিলাতিল মিনহাজ, কোম, মুআসসেসেয়ে আহইয়া আসার আল-ইমাম আল-খুয়ী, ১৪২৮ হি.।
- শহীদ আওয়াল, মুহাম্মাদ ইবনে মাক্কি, আদ-দুরুসুশ শারীয়া’হ ফি ফিকহিল ইমামিয়্যাহ, কোম, জামেয়াতুল মুদাররেসিন, ১৪০৪ হি.।
- শহীদ সানি, যাইনুদ্দিন ইবনে আলী, মাসালেকুল আফহাম ইলা তানকীহ শারায়েউল ইসলাম, কোম, মুআসসাসাতুল মাআরেফ আল-ইসলামিয়্যাহ, ১৪১৩ হি.।
- মুসাভি আরদেবেলী, সাইয়্যেদ আব্দুল কারিম, ফিকহুল হুদুদ ওয়াত তা’যিরাত, কোম, জামেয়াতুল মুফিদ, ১৪২৯ হি.।
- নাজাফি, মুহাম্মাদ হাসান, জাওয়াহেরুল কালাম, তাহকিক: ইব্রাহিম সালতানি, বৈরুত, দারু ইহিয়ায়িত তুরাসিল আরাবি, ১৩৬২ হি.।