মিথ্যা কসম

wikishia থেকে

মিথ্যা কসম; অতীতে কোন কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়া বা না হওয়া প্রসঙ্গে মিথ্যা তাগিদ প্রদান বা মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করা। মিথ্যা কসম কবিরা গুনাহ’র অন্তর্ভুক্ত হলেও এর কোন কাফ্ফারা নেই। পবিত্র কুরআনে মিথ্যা কসমকারী হিসেবে যাদের নাম উল্লেখিত হয়েছে তাদের মাঝে শয়তান, মুনাফিকগণমুশরিকগণ অন্যতম। মুসলমানের জীবন ও সম্পদ রক্ষার্থে মিথ্যা কসম খাওয়ার বৈধতা রয়েছে।

পরিভাষা পরিচিতি

قَسَم (আরবি) বা শপথ হল, দিব্যি, কিরে অর্থে এবং এমন বাক্যকে বোঝায়, যার মাধ্যমে কোন সংবাদ বা কথার সত্য হওয়া এবং তাতে কোন প্রকার ভুল না থাকা প্রসঙ্গে তাগিদ করা হয়।[১] মিথ্যা হল অসত্য ও বাস্তবতা বিরোধী কথা যা কবিরা গুনাহ’র অন্তর্ভুক্ত।[২] পরিভাষাটি বিশেষভাবে ৩টি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়;

  • কোন বিষয়ের প্রতি তাগিদ করা ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা,
  • কোন কাজ করার জন্য কাউকে কসম (দোহাই) দেওয়া,
  • অঙ্গীকার বা চুক্তির ক্ষেত্রে কসম খাওয়া,[৩]

তবে ‘মিথ্যা কসম’ শুধু প্রথমটির ক্ষেত্রে তথা ‘কোন বিষয়ের প্রতি তাগিদ প্রদান ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ক্ষেত্রে কসম খাওয়ার’ বেলায় প্রযোজ্য।[৪] কোন বিষয়ের প্রতি তাগিদ দিতে কসম খাওয়া অর্থ হল; কোন কাজ সঠিকভাবে সম্পাদিত হওয়া বা না হওয়ার ক্ষেত্রে তাগিদ প্রদান করা। কসমের এই প্রকারটি বহুলপ্রচলিত এবং মানুষ নিজের কথাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে এ ধরনের কসমের আশ্রয় নিয়ে থাকে। যেমন: ‘খোদার কসম গতকাল আমি বাড়ী ছিলাম না’, বা ‘খোদার কসম গতকাল আমি বাড়ি ছিলাম’ ইত্যাদি। অতএব, মিথ্যা কসম হল, এমন কোন কিছুর সঠিক বা সত্য হওয়ার উপর জোর দেওয়া যা আদৌ সত্য নয় ও অবাস্তব এবং যা ডাহা মিথ্যা। যেমন কোন ব্যক্তি যদি বিশেষ কোন স্থানে অনুপস্থিত থেকে কসম খায় যে, সে সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, এ ধরনের কসম কবিরা গুনাহ’র অন্তর্ভুক্ত, তবে এর কোন কাফফারা নেই।[৩] আদালতেও এ ধরনের কসম খাওয়া হয়। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সিভিল কোডের ধারা ২২১ এর ভিত্তিতে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকারীর জন্য ১ থেকে সর্বোচ্চ ৩ বছরের শাস্তি রয়েছে।[৪]

মিথ্যা কসমের শাস্তি

কারো কারো মতে মিথ্যা কসম খাওয়ার ক্ষেত্রে দু’টি শাস্তি রয়েছে। প্রথমটি হল মিথ্যা বলার জন্য -যা কবিরা গুনাহ- এবং দ্বিতীয়টি হল পবিত্র কোন নাম নিয়ে -যেমন মহান আল্লাহ- মিথ্যা ও অবাস্তব কোন বিষয়ে কসম খাওয়া। অতএব, মিথ্যা কসমের গুনাহের শাস্তি হল দু’টি কবিরা গুনাহ’র শাস্তির সমপরিমাণে। [৫] ইমাম আলীকে (আ.) করা হযরত মহানবির (সা.) ওসিয়তে উল্লেখিত হয়েছে, মহান আল্লাহর নামে যে মিথ্যা কসম খায় তার প্রতি তিনি দয়া দেখাবেন না।[৬] অপর এক রেওয়ায়েতে মিথ্যা কসম খাওয়াকে আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করার অর্থে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন রেওয়ায়েতে মিথ্যা কসম অভাব-অনটন, দরিদ্রতা, বন্ধ্যাত্ব, সম্পর্কচ্ছেদ এবং শহর জনমানব শূণ্য হয়ে যাওয়ার কারণ বলে উল্লেখিত হয়েছে।[৭]

পবিত্র কুরআনেও মিথ্যা কসমের বিভিন্ন শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে:

‘মহান আল্লাহ কর্তৃক যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করা হবে।’[৮]

কেয়ামতের দিন মানুষ লাঞ্ছিত হবে।’ [৯]

‘মানুষের ধ্বংসের কারণ হবে।[১০]

আখেরাতের বহু নিয়ামত হতে বঞ্চিত হবে।’[১১]

‘মিথ্যা কসম খাওয়া ব্যক্তির সাথে মহান আল্লাহ কথা বলবেন না।’[১২]

কুরআনে যাদের মিথ্যা কসম খাওয়ার কথা এসেছে

পবিত্র কুরআনে মিথ্যা কসমকারী হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ হয়েছে তাদের মাঝে শয়তান, মুনাফিকমুশরিকরা অন্যতম।

শয়তান

সূরা আ’রাফের ২১ ও ২২নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, শয়তান মিথ্যা কসম খেয়ে হযরত আদমহযরত হাওয়াকে (আলাইহিমাস সালাম) বিভ্রান্ত করেছিল। সে হযরত আদম ও হযরত হাওয়াকে কুমন্ত্রণা দেয়, যেন তারা নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খায়। সে নিজেকে তাঁদের শুভাকাঙ্খী প্রমাণ করতে মিথ্যা কসম খেয়েছিল।[১৩] মিথ্যা কসম খাওয়ার কারণে হযরত আদম ও হযরত হাওয়ার মনে তার প্রতি ভাল ধারণা জন্মায়। অতঃপর ঐ নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ার কারণে তাঁদেরকে বেহেশত থেকে বের করে দেওয়া হয়।[১৪] কিছু কিছু রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে হযরত আদমকে (আ.) বিভ্রান্ত করার জন্য শয়তান যে মিথ্যা কসম খেয়েছিল ওটাই হল প্রথম মিথ্যা কসম।[১৫]

মুনাফিকগণ

মুনাফিকরা সবসময় লোক দেখানোর জন্য ঈমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে নিজেদের অন্তরে বিদ্যমান কুফরকে গোপন করত।[১৬] তারা নিজেদের কথা ও কাজকে সত্য প্রমাণের লক্ষ্যে মিথ্যা বলত। পবিত্র কুরআনে তাদের মিথ্যা কসম খাওয়ার বেশ কিছু নমুনা উল্লেখিত হয়েছে।[১৭] সূরা তাওবাহ’র ৫৬নং আয়াতের ভিত্তিতে, মু’মিনদের সাথে সাক্ষাতে মুনাফিকরা দাবী করত ‘তারাও মু’মিন’ এবং নিজেদের দাবী প্রমাণের লক্ষ্যে তারা মিথ্যা কসম খেত।[১৮] মুসলমানদের সন্তুষ্টি অর্জনে মিথ্যা বলত।[১৯] আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যা কসম খেত।[২০] জিহাদে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে মিথ্যা কসমের আশ্রয় নিত।[২১]

মুশরিকগণ

পবিত্র কুরআনে মিথ্যা কসমকারী হিসেবে যাদের কথা উল্লেখ হয়েছে মুশরিকগণ তাদের অন্যতম। সূরা ফাতিরের ৪২নং আয়াতের ভিত্তিতে, মুশরিকগণ কসম খেল ‘যদি তাদের হেদায়েতের জন্য কোন নবি প্রেরণ করা হয় তবে তারা ঈমান আনবে’। অথচ মহানবি (সা.) যখন প্রেরিত হলেন তখন তারা তাদের কুফরীতে আরও কঠোর হল।[২২] এছাড়া কেয়ামতের দিন মুশরিকদের মিথ্যা কসম খাওয়ার কথাও পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে, সেদিন তারা কসম খাবে যে, দুনিয়াতে তারা মুশরিক ছিল না।[২৩]

যেসব ক্ষেত্রে মিথ্যা কসম খাওয়া জায়েয

ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত এক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা কসম খাওয়া গুনাহ নয়, বরং তাতে সওয়াব রয়েছে। ঐ রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, চোর-ডাকাত বা কোন আগ্রাসীর হাত থেকে কোন মুসলমানের জীবন বাঁচাতে, এমনকি কোন মুসলমানের সম্পদ রক্ষার্থে মিথ্যা কসম খেলে তাতে কোন গুনাহ নেই, বরং ঐ কাজের জন্য তাকে সওয়াব প্রদান করা হবে।[২৪]

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

  • কুরআন
  • শেইখ সাদুক, মুহাম্মদ বিন আলী, সাওয়াবুল আমল ও ইকাবুল আমল, কোম, আশ্-শারিফুর রাদ্বা, ১৩৬৪ সৌরবর্ষ।
  • শেইখ সাদুক, মুহাম্মদ বিন আলী, মান লা ইয়াহদুরুল ফাকিহ, কোম, জামেয়ে মুদাররেসিনে হাওযায়ে ইলমিয়্যাহ, ১৪০৪ হিঃ।
  • ইমামী, সাইয়্যেদ হাসান, হুকুকে মাদানী, তেহরান, ইন্তেশারাতে ইসরামিয়্যাহ।
  • বুরুজার্দী, আগা কাসেম তাবাতায়ী, মানাবেয়ে ফেকহে শিয়া, তেহরান, ইন্তেশারাতে ফারহাঙ্গে সাবজ, ১৪২৯ হিঃ।
  • ইমাম খোমিনী, সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ, তাহরিরুল ওয়াসিলাহ, কোম, দারুল ইলম, ১৩৭৯ সৌরবর্ষ।
  • সাদেকী তেহরানী, মুহাম্মদ, আল-ফুরকানু ফি তাফসিরিল কুরআন বিল কুরআন, কোম, ফারহাঙ্গে ইসলামী, ১৩৬৫ সৌরবর্ষ।
  • আল্লামা তাবাতায়ী, সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হোসাইন, আল-মিজান ফি তাফসিরিল কুরআন, কোম, ইসলামী, ১৪১৭ হিঃ।
  • তাবারসী, ফাজল বিন হাসান, মাজমউল বায়ান ফি তাফসিরিল কুরআন, তেহরান, নাসের খসরু, ১৩৭২ সৌরবর্ষ।
  • তাইয়্যেব, সাইয়্যেদ আব্দুল হোসাইন, আতয়াবুল বায়ান ফি তাফসিরিল কুরআন, তেহরান, ইসলাম, ১৩৭৮ সৌরবর্ষ।
  • ফেইযে কাশানী, মোল্লা মুহসেন, তাফসিরু আস-সাফী, তেহরান, সাদর, ১৪১৫ হিঃ।
  • মুতাহারী, মুর্তুজা, আশনায়ী ব কুরআন, কোম, ইন্তেশারাতে সাদরা, ১৩৮৯ সৌরবর্ষ।
  • নূরী, মুহাম্মদ মূসা, ওযেগিহায়ে জারয়ানে নিফাক দার আসরে নাবাবী, নাশরিয়ে মারেফাত, অযার, ১৩৮৫ সৌরবর্ষ।
  • হাশেসী রাফসানযানী, আকবার, ফারহাঙ্গে কুরআন, ইন্তেশারাতে বুস্তানে কিতাব, ১৩৮৬ সৌরবর্ষ।