প্রশান্ত আত্মা বিষয়ক আয়াত
নাফসে মুতমায়িন্নাহ (আরবি: آية النفس المطمئنة); বা প্রশান্ত আত্মা বিষয়ক আয়াত বলতে সূরা ফাজরের শেষের ৪টি আয়াতকে বুঝান হয়। এ আয়াতগুলোতে প্রশান্ত আত্মার বৈশিষ্ট্য এবং এমন আত্মার অধিকারী ব্যক্তিকে বেহেশতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। মুসলিম উলামা ও মনীষীগণের দৃষ্টিতে প্রশান্ত আত্মার অধিকারী ব্যক্তি ঈমান, আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এমন ব্যক্তির গুনাহের প্রতি কোন আসক্তি থাকে না। কুরআনের আয়াতে এমন ব্যক্তি হচ্ছে রাজিয়া ও মারজিয়ার বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। রাজিয়া হচ্ছে আল্লাহর রাজি বা সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ যা কিছু তার জন্য নির্ধারণ করেছেন তাতেই সে পরিতুষ্ট থাকে। আর মারজিয়া হচ্ছে আল্লাহ যার প্রতি সন্তুষ্ট। এমন দু’টি বৈশিষ্ট্যের লোকেরাই প্রশান্ত আত্মার অধিকারী। বিভিন্ন হাদীস ও রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.), ইমাম হুসাইন (আ.) এবং ধর্মপ্রাণ শিয়া মুসলমানরা এমন প্রশান্ত আত্মার অধিকারী।
আয়াত ও বঙ্গানুবাদ
পবিত্র কুরআনের সূরা ফাজরের ২৭ থেকে ৩০ নং আয়াত হচ্ছে প্রশান্ত আত্মা বিষয়ক আয়াত।
অর্থ- (২৭) হে প্রশান্ত আত্মা!, (২৮) তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এস সন্তুষ্টচিত্তে ও সন্তোষভাজন হয়ে, (২৯) আমার বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত হও, (৩০) এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।
প্রশান্ত আত্মার সংজ্ঞা
প্রশান্ত আত্মা মূলত আত্মার এমন অবস্থাকে বুঝায়, যখন মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রদ ও স্বস্তিকর অবস্থায় উন্নীত হয়। এমন অবস্থায় সে কখনও গুনাহের প্রতি অগ্রসর হয় না।[১] বিজ্ঞ আলেমগণ মানুষের নাফস বা আত্মার অবস্থাকে তিনভাগে বিভক্ত করেছে; তম্মধ্যে সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে নাফসে আম্মারেহ তথা কুপ্রবৃত্তিমূলক নাফস বা আত্মা, এ অবস্থাতে মানুষ সব সময় নেতিবাচক দিকে প্রতি প্ররোচিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে হচ্ছে নাফসে লাওয়ামেহ তথা আত্মার এমন অবস্থাতে মানুষ যখন কোন গুনাহে লিপ্ত হয় তখন আত্মশোচনায় ভোগে। আর সর্বোচ্চ পর্যায় হচ্ছে নাফসে মুতমায়িন্নাহ তথা প্রশান্ত আত্মা; যে অবস্থাতে মানুষ একমাত্র আল্লাহর প্রতি আসক্ত এবং সব ধরনের গুনাহ হতে বিরত থাকে। {মেসবাহ ইয়াযদি, আইনে পারওয়াজ, পৃ. ২৬,}
তাফসীর
মুফাসসিরগণের দৃষ্টিতে সূরা ফাজরের ২৭ নং আয়াতে উল্লিখিত প্রশান্ত আত্মা হচ্ছে এমনই অন্তর যা আল্লাহর প্রতি ঈমানে পরিপূর্ণ, ভাবগাম্ভীর্যতায় সিক্ত এবং তার ঈমানে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই। {তাবারসি, মাযমাউল বায়ান, খণ্ড ১০, পৃ. ৭৪২ এবং আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নেমুনেহ, খণ্ড ২৬, পৃ. ৪৭৫-৪৭৭} আল্লামা তাবাতাবায়ি বলেন: প্রশান্ত আত্মা হচ্ছে এমনই অন্তর যা মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আস্থাপোষণের মাধ্যমে চুড়ান্ত শান্তিদায়ক অবস্থায় উন্নীত হয়েছে। এমন আত্মার অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট থাকে এবং জীবনের কোন ঘাত-প্রতিঘাত তার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না। এমন ব্যক্তি আল্লাহর বন্দেগীতে মশগুল ও সিরাতুল মুস্তাকিমের উপর অটল থাকে। {আল্লামা তাবাতাবায়ি, তাফসীরে আল মীযান, খণ্ড ২০, পৃ. ২৮৫} তাফসীরে মাযমাউল বায়ান গ্রন্থে প্রশান্ত আত্মা বলতে আল্লাহর প্রতি ঈমানে সিক্ত হয়ে গাম্ভীর্যতায় পরিপূর্ণ আত্মাকে বুঝান হয়েছে এবং এমন আত্মা ঈমান ও ইয়াকীনের চুড়াতে উন্নীত হয়। এমন আত্মার অধিকারী ব্যক্তি কিয়ামত ও পরকালের প্রতি পূর্ণ ঈমানপোষণ করে। {তাবারসি, মাযমাউল বায়ান, খণ্ড ১০, পৃ. ৭৪২} আল্লামা তাবারসি মাযমাউল বায়ান গ্রন্থে উক্ত আয়াতে উল্লিখিত রাজিয়া ও মারজিয়া শব্দকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন: প্রশান্ত আত্মার অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর প্রতিদানে সন্তুষ্ট এবং আল্লাহও এমন বান্দার আমলে সন্তুষ্ট। {তাবারসি, মাযমাউল বায়ান, খণ্ড ১০, পৃ. ৭৪২} আল্লামা তাবাতাবায়ি বলেছেন: নাফসে মুতমায়িন্নাহ’কে এ কারণে রাজিয়া ও মারজিয়া বলা হয় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত তাকদিরের প্রতি পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট থাকে। এ কারণে এমন আত্মার অধিকারী ব্যক্তি কখনও কোন প্রতিকুলতায় তিক্ত হয় না এবং গুনাহে লিপ্ত হয় না। এমন ব্যক্তিকে মারজিয়া তথা আল্লাহর সন্তুষ্টির পাত্র বলা হয়। আল্লাহ কেবল তখনই কোন বান্দার প্রতি অসন্তুষ্ট হন, যখন সে আল্লাহর আনুগত্য থেকে দূরে সরে যায়। {আল্লামা তাবাতাবায়ি, তাফসীরে আল মীযান, খণ্ড ২০, পৃ. ২৮৫}
তাফসীরে নেমুনেহ’র বর্ণনা অনুযায়ী রাজিয়া পরিভাষা এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে যে, এমন আত্মার অধিকারী ব্যক্তিরা আল্লাহর যাবতীয় প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবসম্মত মনে করে এবং সেগুলোর প্রতি তারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি তাদের চুড়ান্ত আনুগত্য ও আত্মসমর্পন বিদ্যমান। আর মারজিয়া পরিভাষার ব্যাখ্যা হচ্ছে আল্লাহও তাদের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। {আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনেহ, খণ্ড ২৬, পৃ. ২৭৭}
অনেকের মতে «اِرْجِعی اِلیٰ رَبِّک» ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এস’- এ আহ্বানটি আল্লাহর পক্ষ থেকে কিয়ামতের দিন মু’মিনদের প্রতি করা হবে। আবার কারও কারও মতে মু’মিনদের মৃত্যুর সময় এ আহ্বান জানান হবে। {তাবারসি, মাযমাউল বায়ান, খণ্ড ১০, পৃ. ৭৪২} আল্লামা তাবাতাবায়ি দ্বিতীয় মতকে সমর্থন দিয়েছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেনঃ فَادْخُلِي فِي عِبَادِي ‘আমার বান্দাদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হও’ এ আয়াতটি প্রমাণ বহন করে যে, প্রশান্ত আত্মার ব্যক্তিরা বন্দেগীর চুড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এ পর্যায়ে মানুষ কেবলমাত্র যা কিছু আল্লাহ পছন্দ করেন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। {আল্লামা তাবাতাবায়ি, তাফসীরে আল মীযান, খণ্ড ২০, পৃ. ২৮৫-২৮৬} আর সর্বশেষ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, وَادْخُلِي جَنَّتِي ‘আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’ এ আয়াতে বান্দার প্রতি বিশেষ সম্মান জ্ঞাপন করা হয়েছে। কেননা পবিত্র কুরআনে এ একটি মাত্র আয়াতে এভাবে বান্দাকে জান্নাতে প্রবেশের আহ্বান জানান হয়েছে। {আল্লামা তাবাতাবায়ি, তাফসীরে আল মীযান, খণ্ড ২০, পৃ. ২৮৬}
ইমাম খোমেনীর (রহ.) দৃষ্টিতে মানুষ এমনই সত্তার অধিকারী যে সব সময় পূর্ণতা, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও পরিপূর্ণ জ্ঞান কামনা করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সমগ্র সৃষ্টিজগতে একমাত্র আল্লাহর সত্তাই পরিপূর্ণ এবং একক ক্ষমতার অধিকারী। তাই খোদামুখী কোন বান্দা যখন পূর্ণতা, ক্ষমতা ও জ্ঞানের অন্বেষণ করে; তখন সে অনন্ত, অসীম ও একক ক্ষমতার অধিকারী পরাক্রমশালী আল্লাহর পবিত্র সত্তার প্রতি শরণাপন্ন হয়। নিজের সীমাবদ্ধ অস্তিত্বকে প্রাণবন্ত করতে সীমাহীন অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ততা গড়ে তুলে। ফলে মানুষ আল্লাহর উপাসনা ও স্মরণের মাধ্যমে অস্তিত্বগত পূর্ণতা লাভের পাশাপাশি আত্মিক প্রশান্তি ও স্বস্তি অনুভব করে।
প্রশান্ত আত্মার বর্ণনাগত তাফসীর
তাফসীরে রেওয়াঈ বা বর্ণনাগত তাফসীর এবং অনেক হাদীসগ্রন্থে নাফসে মুতমায়িন্নাহ তথা প্রশান্ত আত্মা বিষয়ক আয়াতের অনেক উপমা ও উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। যেমন: তাফসীরে ফুরাতে কুফী {ফুরাতে কুফী, তাফসীরে ফুরাতে কুফী, পৃ. ৫৫৫} এবং তাফসীরে শাওয়াহেদুত তানযীল {হাসকানী, তাফসীরে শাওয়াহেদুত তানযীল, খণ্ড ২, পৃ. ৪২৯} কিতাবে ইমাম জাফর সাদীক (আ.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এ আয়াতের উপমা হিসেবে আমিরুল মু’মিনিন আলীকে (আ.) পরিচয় করান হয়েছে। আবার তাফসীরে কুম্মী কিতাবে ইমাম জাফর সাদীক (আ.) থেকে বর্ণিত হাদীসের আলোকে প্রশান্ত আত্মার উপমা হিসেবে ইমাম হুসাইনের (আ.) নামোল্লেখ করা হয়েছে। {কুম্মী, তাফসীরে কুম্মী, খণ্ড ২, পৃ. ৪২২} বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সূরা ফাজর হচ্ছে সূরা ইমাম হুসাইন (আ.)। কেননা ইমাম হুসাইন (আ.) হলেন প্রশান্ত আত্মার বাস্তব নমুনা। এ হাদীসে ইমাম হুসাইনের (আ.) অনুসারীদেরকে রাজিয়া ও মারজিয়ার বৈশিষ্ট্যধারী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কেননা কিয়ামত দিবসে তারা মহান আল্লাহর প্রদত্ত প্রতিদানে সন্তুষ্ট হবে এবং আল্লাহও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। {আল্লামা মাযলিসী, বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ২৪, পৃ. ৯৩} আল কাফী হাদীস গ্রন্থে শেইখ কুলাইনী এক রেওয়ায়েতে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম জাফর সাদীক (আ.) নাফসে মুতমায়িন্নাহ’র আয়াতসমূহকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেনঃ হে নাফস বা আত্মা, মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি বিশ্বাসপোষণকারী! তোমার প্রতিপালকের দিকে প্রত্যাবর্তন কর। যেহেতু আহলে বাইতের (আ.) বেলায়েতের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশকারী, সেহেতু আল্লাহর প্রদত্ত প্রতিদানেও সন্তুষ্টি অর্জন করবে। সুতরাং আমার বিশেষ বান্দাগণ অর্থাৎ মুহাম্মাদ ও তাঁর আহলে বাইতের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হও এবং বেহেশতে প্রবেশ কর। {শেইখ কুলাইনী, আল কাফী, খণ্ড ৩, পৃ. ১২৭-১২৮}
- ↑ মেসবাহ ইয়াযদি, আইনে পারওয়াজ, পৃ. ২৭