চিরহারাম বিবাহসমূহ

wikishia থেকে
নিবন্ধটি ফিকাহ সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়ের সংজ্ঞা ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিয়ে এবং ধর্মীয় আমলের মানদণ্ড নয়, আমলের লক্ষ্যে অন্য সূত্রের শরণাপন্ন হোন।

চিরহারাম বিবাহসমূহ; (আরবি :الحرمة المؤبدة) কোন নারী ও পুরুষের পরস্পরের সাথে বিবাহ চিরস্থায়ীভাবে হারাম হওয়া প্রসঙ্গে। শিয়া ফিকাহ’তে বিবাহিত নারীর সাথে ব্যভিচার, লিআন, ইহরামইদ্দত অবস্থায় বিয়ের আকদ পড়া, কোন নারীর পুত্র, পিতা বা ভাইয়ের সাথে লাওয়াতে লিপ্ত হওয়া এবং কোন নারীকে ৯ বার তালাক প্রদান করা হলে ঐ নারী ও পুরুষের পরস্পরের সাথে বিবাহ চিরস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যাওয়ার কারণ হয়।

হারামে আবাদি তথা চিরস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যাওয়া শীর্ষক বিষয়টি ফিকাহ শাস্ত্রের নিকাহ, তালাক, হজ্জ, লিআন ইত্যাদি অধ্যায়ে আলোচিত হয়ে থাকে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দেওয়ানি আইনের ১০৫০ থেকে ১০৫৯নং ধারা চিরস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যাওয়া বিবাহ প্রসঙ্গে প্রণীত হয়েছে।

পরিভাষা পরিচিতি

চিরহারাম বিবাহসমূহ (হারামে আবাদি); ক্ষণস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যাওয়ার বিপরীতে।[১] অর্থাৎ কোন নারী ও পুরুষের প্রথম অবস্থায় পরস্পরের সাথে বিবাহ হালাল হলেও পরবর্তীতে বিশেষ কারণে তাদরে মাঝে বিবাহ চিরস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যায়। হারামে আবাদি দু’টি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য;

  • মাহরামগণের সাথে (বংশগত, স্তন্যপান ও বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে) বিবাহ চিরস্থায়ীভাবে হারাম।[২]
  • মাহরাম নয় এমন কারো সাথে চিরস্থায়ীভাবে বিবাহ হারাম হয়ে যাওয়া; যাদের সাথে সাধারণ অবস্থায় বিবাহ জায়েয হওয়া সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কিছু কারণে বিবাহ চিরস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যায়।[৩]
  • বিষয়টি ফিকাহ শাস্ত্রের নিকাহ, তালাক, হজ্জ ও লিআন অধ্যায়ে আলোচিত হয়।[৪]

যে সকল কারণে হারাম হয়

ইসলামি ফিকাহ’তে এমন কিছু কারণ উল্লিখিত হয়েছে যেগুলোর কারণে নারী ও পুরুষের পরস্পরের সাথে বিবাহ চিরস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যায়-

  • লিআন: যদি নারী ও পুরুষের মাঝে লিআন সংঘটিত হয়; তারা পরস্পরের জন্য চিরস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যায়।[৫] লিআন; বিচারকের উপস্থিতিতে স্বামী (লিআনের’ জন্য নির্ধারিত) বিশেষ কসম খেয়ে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করে এবং স্ত্রীও একই কসম খেয়ে স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত অপবাদকে অস্বীকার করে।[৬] লিআন জারী হওয়ার মাধ্যমে স্বামীর উপর থেকে (ব্যভিচারের অপবাদ আরোপের কারণে প্রযোজ্য) কাযাফ ও স্ত্রীর উপর থেকে যিনা ও ব্যভিচারের হদ তুলে নেয়া হয়।[৭]
  • স্ত্রীকে ৯ বার তালাক প্রদান: শিয়া ফিকাহ’র ভিত্তিতে যদি কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে ৩ তালাক (প্রতি তালাকে ৩ দফা = ৯ তালাক) দেয়, তবে তার সাথে বিবাহ করার অধিকার তার আর থাকবে না। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হল মুহাল্লিলের মাধ্যমে (তথা নারী অন্য কোন পুরুষ তার সাথে বিবাহ করবে এবং দ্বিতীয় স্বামী তাকে তালাক প্রদানের করবে)।[৮] যদি কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে ৩ বার তালাক প্রদান করে, তথা ৯ দফায় ৩ তালাক দেয়, তবে ঐ নারী চিরস্থায়ীভাবে তার জন্য হারাম হয়ে যাবে।[৯] বলা বাহুল্য যে, শিয়া ফকীহদের মশহুর মত হল, শুধু মাত্র মুখে ৩ বার তালাক বললেই ৩ তালাক হয়ে যায় না।
  • এফদ্বা: যদি কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বে এফদ্বা (افضاء) করে ঐ নারী তার জন্য চিরস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যাবে। শহীদ সানী, রাওদতুল বাহিয়্যাহ, ১৪১০ হিঃ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা নং-১০৪-১০৫। এফদা হলো প্রস্রাবহায়েজের পথকে এক করে দেওয়া।[১০]
  • ব্যভিচার: শিয়া ফকীহদের মশহুর দৃষ্টিভঙ্গী হলো, যদি কোন পুরুষ বিবাহের পূর্বে কোন নারীর মা বা তার কন্যার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তাহলে ঐ নারী চিরস্থায়ীভাবে তার জন্য হারাম হয়ে যায়।[১১] একইভাবে বিবাহিতা নারীর সাথে এবং তালাকে রিজঈ’র ইদ্দতে পালনরত কোন নারীর সাথে ব্যভচারে লিপ্ত হলে ঐ নারীর সাথে বিবাহ ঐ পুরুষের জন্য চিরস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যায়।[১২]
  • লাওয়াত: যদি কোন পুরুষ বিবাহের পূর্বে কোন নারীর পুত্র বা ভাই বা পিতার সাথে লাওয়াতে (Sodomy) লিপ্ত হয়, তবে ঐ নারী তার জন্য চিরস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যায়।[১৩]
  • ইদ্দতে থাকা অবস্থায় বিবাহ: ইদ্দতকালীন সময় পার করছে এমন নারীর সাথে বিবাহ জায়েয নয়।[১৪] এ কারণে, যদি কেউ, কোন নারী ইদ্দতে রয়েছে এবং ইদ্দতে থাকা নারীর সাথে বিবাহ হারাম এ বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও ঐ নারীর সাথে বিবাহ করে তাহলে ঐ নারী চিরস্থায়ীভাবে ঐ পুরুষের জন্য হারাম হয়ে যাবে, যদি তাদের মধ্যে সহবাস নাও হয়ে থাকে।[১৫] তবে যদি পুরুষ এ বিষয়ে অজ্ঞ থাকে সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র দুখুল করার (পুরুষাঙ্গ যৌনির ভেতর প্রবেশ করানো) শর্তে নারী ঐ পুরুষের জন্য চিরস্থায়ীভাবে হারাম হয়ে যাবে। আর যদি দুখুল সংঘটিত না হয়ে থাকে তবে শুধু আকদ বাতিল বলে গন্য হবে এবং ইদ্দত শেষ হওয়ার পর ঐ নারীর সাথে বিবাহ করতে পারবে।[১৬]
  • ইহরাম অবস্থায় বিবাহ: ইহরাম অবস্থায় কোন নারী বা পুরুষের জন্য বিবাহ করা হারাম[১৭] এবং কেউ এমনটি করলে তা বাতিল। ইহরাম অবস্থায় বিবাহ হারাম হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও বিবাহ করলে -এমনকি সহবাস সংঘটিত না হলেও- চিরস্থায়ীভাবে তার সাথে বিবাহ হারাম হয়ে যাবে।[১৮] তবে মশহুর মত হলো, বিধান সম্পর্কে অনাবগতি শুধুমাত্র আকদকে বাতিল করবে, এমনকি যদি তাদের মাঝে সহবাসের ঘটনা ঘটেও থাকে।[১৯]

তথ্যসূত্র

  1. মুয়াস্সাসাতু দায়েরাতুল মায়ারেফুল ফেকহুল ইসলামী, ফারহাঙ্গে ফেকহে ফারসি, ১৩৮৭ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা নং-২৯১।
  2. আকবারী, আহকামে রাওয়াবেতে মাহরাম ও নামাহরাম, ১৩৯২ (সৌরবর্ষ), পৃষ্ঠা নং-২৪।
  3. মুজতাহেদী তেহরানী, তিন রিসালাহ; মাহরাম ও নামাহরাম, কোম, ১৩৮১ হিঃ, পৃষ্ঠা নং-১৮-১৯।
  4. মুয়াস্সাসাতু দায়েরাতুল মায়ারেফুল ফেকহুল ইসলামী, ফারহাঙ্গে ফেকহে ফারসি, ১৩৮৭ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-১, পৃষ্ঠা নং-৩৯২।
  5. নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-৩৪, পৃষ্ঠা নং;৩-৪।
  6. শহীদ সানী, রাওদতুল বাহিয়্যাহ, ১৪১০ হিঃ, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা নং-১৮১।
  7. খোমিনী, তাহরিরুল ওয়াসিলাহ, ১৩৩৪ হিঃ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-৩৪২ ও শহীদ সানী, রাওদতুল বাহিয়্যাহ, ১৪১০ হিঃ, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা নং-১৮১।
  8. শেইখ মুফিদ, আল-মুকনিয়াহ, ১৪১৩ হিঃ, পৃষ্ঠা নং-৫০১।
  9. খোমিনী, তাহরিরুল ওয়াসিলাহ, ১৩৭৯ (সৌরবর্ষ), পৃষ্ঠা নং-৭৩১।
  10. নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-২৯, পৃষ্ঠা নং;৪১৯।
  11. শহীদ সানী, মাসালিকুল আফহাম, ১৪১৩ হিঃ, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা নং-২৯৭-২৯৮।
  12. নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-২৯, পৃষ্ঠা নং-৪৪৬।
  13. খুয়ী, মিনহাজুস সালেহিন, ১৪১০ হিঃ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-২৬৫।
  14. খোমিনী, তাহরিরুল ওয়াসিলাহ, ১৩৩৪ হিঃ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-৩০৩।
  15. খোমিনী, তাহরিরুল ওয়াসিলাহ, ১৩৩৪ হিঃ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা নং-৩০৩।
  16. মুয়াস্সাসাতু দায়েরাতুল মায়ারেফুল ফেকহুল ইসলামী, আল্-মাওসুয়াতুল ফেকহিয়্যাহ, ১৪২৯ হিঃ, খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা নং-৪৭৩।
  17. নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-২৯, পৃষ্ঠা নং-৪৫০।
  18. নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-২৯, পৃষ্ঠা নং-৪৫০।
  19. নাজাফী, জাওয়াহেরুল কালাম, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ), খণ্ড-২৯, পৃষ্ঠা নং-৪৫০।

গ্রন্থপঞ্জি

  • আকবারী, মাহমুদ, আহকামে রাওয়াবেতে মাহরাম ও নামাহরাম, কোম, ইন্তেশারাতে ফিতয়ান, ১৩৯২ (সৌরবর্ষ)।
  • হোজ্জাতী আশরাফী, মুর্তাজা, মাজমুয়েয়ে কাওয়ানিনে আসাসী-মাদানী, তেহরান, কিতাবখানেয়ে গাঞ্জে দানেশ, ১৩৭৮ (সৌরবর্ষ)।
  • খোমিনী, সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ, তাহরিরুল ওয়াসিলাহ, তেহরান, মুয়াসসেসেয়ে তানযিম ও নাশরে আসারে ইমাম খোমিনী, ১৩৭৯ (সৌরবর্ষ)।
  • খোমিনী, সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ, তাহরিরুল ওয়াসিলাহ, তেহরান, মুয়াসসেসেয়ে তানযিম ও নাশরে আসারে ইমাম খোমিনী, প্রথম প্রকাশ, ১৩৩৪ হিঃ।
  • খুয়ী, সাইয়্যেদ আবুল কাসেম, মিনহাজুস সালেহিন, কোম, মাদিনাতুল ইলম, ২২তম প্রকাশ, ১৪১০ হিঃ।
  • শহীদ সানী, যাইনুদ্দিন বিন আলী, মাসালিকুল আফহাম, কোম, মুয়াস্সাসাতু আল-মায়ারিফিল ইসলামিয়্যাহ, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৩ হিঃ।
  • শহীদ সানী, যাইনুদ্দিন বিন আলী, রাওদতুল বাহিয়্যাহ, কোম, ইন্তেশারাতে দাওয়ারী, ১৪১০ হিঃ।
  • শেইখ মুফিদ, মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ, আল-মুকনিয়াহ, কোম, শেইখ মুফিদ কন্ফারেন্স, প্রথম প্রকাশ, ১৪১৩ হিঃ।
  • মুয়াস্সাসাতু দায়েরাতুল মায়ারেফুল ফেকহুল ইসলামী, আল্-মাওসুয়াতুল ফেকহিয়্যাহ, কোম, মুয়াস্সাসাতু দায়েরাতুল মায়ারেফুল ফেকহুল ইসলামী, ১৪২৯ হিঃ।
  • মুয়াস্সাসাতু দায়েরাতুল মায়ারেফুল ফেকহুল ইসলামী, ফারহাঙ্গে ফেকহে ফারসি, কোম, মুয়াস্সাসাতু দায়েরাতুল মায়ারেফুল ফেকহুল ইসলামী, ১৩৮৭ (সৌরবর্ষ)।
  • মুজতাহেদী তেহরানী, আহমাদ, মাহরাম ও নামাহরাম, কোম, মুয়াসসেসেয়ে দার রাহে হাক্ব, ১৩৮১ হিঃ।
  • নাজাফী, মুহাম্মাদ হাসান, জাওয়াহেরুল কালাম, বৈরুত, দারু ইহয়ায়িত তুরাসিল আরাবী, ৭ম প্রকাশ, ১৩৬২ (সৌরবর্ষ)।