গোঁড়ামি

wikishia থেকে

গোঁড়ামি হচ্ছে চারিত্রগত নেতিবাচক স্বভাব; এর অর্থ হচ্ছে কোন ব্যক্তি ও গোষ্ঠির প্রতি অন্ধ সমর্থন কিংবা পক্ষপাতিত্ব করা। গোঁড়ামিকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে; যথা: ইতিবাচক ও নেতিবাচক। অবশ্য সাধারণত এ শব্দটি নেতিবাচক ও নিন্দনীয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ শব্দটির নিকটতম ইতিবাচক অর্থ যদি আমরা খুজি তাহলে তা হবে আত্মসম্মানবোধ। গোঁড়ামি মানসিকতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে নানাবিধ নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয় যেমন: আত্ম অহমিকা, অহংবোধ, অজ্ঞতা, সংকীর্ণতা, অবিবেচনা প্রভৃতি। ইসলামের দৃষ্টিতে কুফর, অবাধ্যতা, অন্তরের নিষ্ঠুরতা, হিংসা, সত্য ও ন্যায়কে গ্রহণ না করা, হিংস্রতা এবং জাহান্নামে প্রবেশ প্রভৃতি হচ্ছে গোঁড়ামি মানসিকতার প্রভাব ও পরিণতি।

সংজ্ঞা

গোঁড়ামি মানসিকতা হচ্ছে চারিত্রিক নেতিবাচক দিক; কোন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠির প্রতি মাত্রাতিরিক্ত অন্ধভক্তি কিংবা বিদ্বেষ হচ্ছে গোঁড়ামি মানসিকতার বহি:প্রকাশ। [১] গোঁড়ামি মানসিকতার সমর্থক শব্দ হচ্ছে চিন্তাধারার সংকীর্ণতা, কঠোরতা, পক্ষপাতিত্ব। [২] গোঁড়ামি মানসিকতা বলতে সাধারণত নেতিবাচক, নিন্দনীয় এবং বাড়াবাড়ি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে; এ ধরনের অবস্থাতে মানুষ অযৌক্তিকভাবে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠি কিংবা আকিদা-বিশ্বাসের প্রতি অন্ধ সমর্থন জ্ঞাপন করে। [৩]

নৈতিকতার দিক থেকে গোঁড়ামি মানসিকতা খুবই অপছন্দনীয় একটি স্বভাব হিসেবে বিবেচিত; যে স্বভাবের মাধ্যমে অন্যান্য চারিত্রিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়। প্রবৃত্তির এ নেতিবাচক দিকটি সহজাতভাবেই নিন্দনীয়; যদি গোঁড়ামি মানোভাব নিয়ে কেউ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয় এমনকি ধর্মীয় কোন বিষয়ের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে; তাহলে এমন সমর্থনের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেকে কিংবা নিজ মতাদর্শকে অথবা নিজ ধর্মকে একগুয়েমিভাবে প্রাধান্য দেয়া। [৪] পবিত্র কুরআনের সূরা ফাতহ এর ২৬ নং আয়াতে জাহেলি যুগে মুসলমানদের প্রতি কাফিরমুশরিকদের আত্মশ্লাঘাজনিত মনোভাব বর্ণনার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু আয়াতে «عصبه» ‘আসাবা’ শব্দমূল ব্যবহৃত হয়ে একটি জনগোষ্ঠির লোকদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি গোঁড়ামি মনোভাব বর্ণনার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। [৫] আবার কুরআনের কোথাও কোথাও নবী-রাসূলদের (আ.) বিরুদ্ধে কাফির-মুশরিকদের পূর্বগামী ও তাদের পূর্বপুরুষদের আকিদা ও ধ্যান-ধারণা নিয়ে গোঁড়ামিপূর্ণ আচরণ এবং কথাবার্তার সম্পর্কে বর্ণনার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি পরিভাষা পরোক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। [৬]

হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহেও ‘গোঁড়ামি’ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি অনেক হাদীসগ্রন্থে ‘বাবুল আসাবিয়্যাহ’ তথা গোঁড়ামি অধ্যায় নামক বিশেষ পরিচ্ছেদ রয়েছে। এ সব পরিচ্ছেদে উল্লেখিত হাদীসসমূহে গোঁড়ামি মানসিকতার উৎপত্তি, কারণ ও প্রভাব সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। [৭] কোন কোন হাদীসে গোঁড়ামিকে অজ্ঞতার সৈনিক ও ইনসাফের শত্রু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। [৮]

প্রকারভেদ

গোঁড়ামি মনোভাবকে দু’ভাগে বিভক্ত করা য়েতে পারে; যথা ইতিবাচক ও নেতিবাচক। যদিও এ শব্দটি সাধারণত অতিরঞ্জিত ও নিন্দনীয় অর্থে ব্যবহৃত এবং এর ইতিবাচক অর্থে ভিন্ন শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। [৯]

ইতিবাচক: মানুষ যখন ইনসাফ ও ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে কোন কিছুর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে; আর এ অবস্থাকে আত্মমর্যাদাবোধ বলা হয়। [১০] আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) এ ধরনের গোঁড়া সমর্থন যা ইতিবাচক ক্ষেত্রসমূহে প্রয়োগ করা হয় যেমন: প্রতিবেশির অধিকার রক্ষা, প্রতিশ্রুতি পালন, ন্যায়ের আনুগত্য, দাম্ভিকতা পরিহার, দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন এবং অত্যাচার থেকে আত্মসংবরণ খুবই কাঙ্ক্ষিত। [১১] প্রখ্যাত মনীষী আল্লামা তাবাতাবায়ী পরিবার, আত্ম মর্যাদা, জন্মভূমি প্রভৃতির প্রতি গোঁড়া সমর্থনের মনোভাব মানুষের সত্তার সাথে মিশে আছে। আর ইসলাম ধর্ম হচ্ছে মানুষের সত্তার ধর্ম, তাই ইসলাম এ ধরনের ইতিবাচক মনোভাবকে কখনও প্রত্যাখ্যান করে না; বরং সেটাকে সঠিক পন্থায় প্রয়োগের দিকনির্দেশনা দান করে। [১২] নেতিবাচক: ন্যায় ও ইনসাফ ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ একগুয়েমি ও আত্মশ্লাঘাজনিত মনোভাবের বশবর্তী হয়ে স্বীয় পরিবার, বংশ, গোষ্ঠি ও চিন্তাধারার প্রতি মোহচ্ছন্ন ও অন্ধবিশ্বাস স্থাপন এবং এর ফলে চরম গোঁড়ামিপূর্ণ আচরণ হচ্ছে নেতিবাচক গোঁড়ামি। [১৩] ৪র্থ ইমাম যাইনুল আবেদীন (আ.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এমন নেতিবাচক গোঁড়ামি তখনই সম্পন্ন হয় যখন কেউ স্বীয় গোত্র বা গোষ্ঠির সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে অপর গোত্রের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তির তুলনায় ভাল মনে করে। আর এমন গোঁড়ামিপূর্ণ মানসিকতার কারণে অধমকে উত্তমের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়।[১৪]

উৎস ও কারণ

গোঁড়ামি মানসিকতা মানুষের মধ্যে গড়ে উঠা কিছু নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যাবলির কারণে সৃষ্টি হয়; পবিত্র কুরআন ও হাদীসে সেগুলোর প্রতি ইশারা করা হয়েছে। আত্মপ্রীতি-দাম্ভিকতা, ধন-সম্পদের আধিক্য, অজ্ঞতা, অন্ধবিশ্বাস এবং অন্যদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে ন্যায় ও ইনসাফকে উপেক্ষার কারণে মানুষের মধ্যে গোঁড়ামি মানসিকতার সৃষ্টি হয়। এখন আমরা এ উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর প্রতি ইশারা করব-

১- আত্মপ্রীতি ও দাম্ভিকতা- সূরা সাফফাতের ৩৫ ও ৩৬ নং আয়াতের বর্ণনানুসারে রাসূল (সা.) যখন মক্কার কাফির ও মুশরিকদের প্রতি তওহীদের আহ্বান জানান তখন তারা দাম্ভিকতার সাথে তা প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজেদের পূর্বপুরুষদের আকিদার উপর বহাল থাকার ঘোষণা দেয়। আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) এক হাদীসে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আদমকে (আ.) সিজদা করতে শয়তান কর্তৃক অস্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং এজন্য বেহেশত হতে বিতাড়নের কারণ ছিল শয়তান গোঁড়ামি মনোভাবের বশবর্তী হয়ে নিজেকে হযরত আদমের (আ.) চেয়ে উত্তম মনে করেছিল। [১৫]

২- ধন-সম্পদের আধিক্য- ধন-সম্পদের আধিক্যেরে কারণে অনেক সময় মানুষের মধ্যে অহংবোধ ও গোঁড়ামি মানসিকতার সৃষ্টি হয়। ইতিহাসও সাক্ষী দেয় যে, অতীতকাল থেকেই যারা সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান ছিল, তাদের অধিকাংশই নবী-রাসূলদের (আ.) বিরোধিতা করেছে। [১৬]

৩- অজ্ঞতা- সূরা বাকারা’র ১১৩ নং আয়াতের তাফসীরে অধিকাংশ মুফাসসিরগণ মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা-মূর্খতাকে গোঁড়ামি ও একগুয়েমি মনোভাবের প্রধান কারণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কেননা মূর্খ ব্যক্তিরা সব সময় নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ থাকে এবং তাদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে কোন কিছু গ্রহণ করতে সম্মত হয় না; যদিও তা ভ্রান্ত ও কুসংস্কারপূর্ণ হোক না কেন। [১৭] সূরা ফাতহের ২৬নং আয়াতেও গোঁড়ামি মানসিকতার মধ্যে মূর্খতার প্রভাবের প্রতি ইশারা করা হয়েছে।

৪- অন্ধবিশ্বাস- কখনও কখনও মানুষ স্বীয় পিতামাতা, পূর্বপুরুষ, ধর্মগুরু, গোত্রপতি, শিক্ষকের প্রতি এতই অন্ধবিশ্বাস গড়ে তুলে যে, তাদের কথা-বার্তার বাইরে কোন কিছুকে গ্রহণ করতে মোটেও রাজি নয়। কুরআনের অনেক আয়াতে এ ধরনের মন-মানসিকতাকে গোঁড়ামি মনোভাব সৃষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

৫- ভক্তি কিংবা শত্রুতার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি- পবিত্র কুরআনে মু’মিনদের প্রতি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইনসাফ ও ভারসাম্যতা বজায় রাখার আদেশ করা হয়েছে। [১৮] এ থেকে বুঝা যায় যে, কারও প্রতি ভক্তিপোষণ কিংবা শত্রুতাপোষণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি মূলত: গোঁড়ামি মনোভাবের কারণে উদ্ভব ঘটে।

প্রভাব ও পরিণতি

মানুষের মধ্যে যখন গোঁড়ামি মনোভাব এবং একগুয়েমি মানসিকতার সৃষ্টি হয়, তখন এহেন মানসিকতার প্রভাবে তার মধ্যে নানাবিধ অনৈতিক ও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যাবলি সৃষ্টি হবে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কুফর ও সীমালংঘন, গুনাহ, বিভেদ, অন্তরের নিষ্ঠুরতা, হিংসা, ন্যায় ও ইনসাফের পথ থেকে বিচ্যুতি, সত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি, ঈমানচ্যুতি, জাহেলি প্রথায় প্রত্যাবর্তন, আত্মকেন্দ্রীকতা, বিদ্বেষপরায়ণ, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ প্রভৃতি।

  1. আনওয়ারি, ফারহাঙ্গে বুজুর্গ সুখান, গোঁড়ামি শব্দমূল
  2. মুঈন, ফারহাঙ্গে ফারসী, গোঁড়ামি শব্দমূল
  3. ইবনে মানজুর, লিসানুল আরাব, গোঁড়ামি শব্দমূল
  4. ইমাম খোমেনী (রহ.), শারহে চেহেল হাদীস, প্রকাশকাল ২০০০ খ্রি. পৃ. ১৪৫-১৪৬
  5. সূরা ইউসুফ, আয়াত নং ৭ ও ১৪ এবং সূরা নুর, আয়াত নং ১১
  6. সূরা বাকারা, আয়াত নং ১৭, সূরা মায়েদা, আয়াত নং ১০৪, সূরা আরাফ, আয়াত নং ২৭, ৭০, সূরা ইউনুস, আয়াত নং ৭৮, সূরা শা’আরা, আয়াত নং ৭৪, সূরা লোকমান, আয়াত নং ২১
  7. কুলাইনি, উসুলে কাফী, প্রকাশকাল ১৪০৭ হিজরী, খণ্ড ২, পৃ. ৩৭০; মাযলিসী, বিহারুল আনওয়ার, প্রকাশকাল ১৪০৩ হিজরী, খণ্ড ৭০, পৃ. ২৮১
  8. কুলাইনি, উসূলে কাফী, প্রকাশকাল ১৪০৭ হিজরী, খণ্ড ১, পৃ. ২১
  9. নারাকী, জামেউস সায়াদাত, খণ্ড ১, পৃ. ৪০২; ইমাম খোমেনী (রহ.), শারহে চেহেল হাদীস, প্রকাশকাল ২০০০ খ্রি. পৃ. ১৪৫
  10. তাবাতাবায়ী, আল মিযান, প্রকাশকাল ১৩৯০ হিজরী, খণ্ড ৪, পৃ. ৪২০
  11. নাহযুল বালাগা, খুতবা নং ১৯২, পৃ. ২৯৫
  12. তাবাতাবায়ী, আল মিযান, প্রকাশকাল ১৩৯০ হিজরী, খণ্ড ৪, পৃ. ৪২০
  13. নারাকী, জামেউস সায়াদাত, খণ্ড ১, পৃ. ৪০২; লিসানুল আরাব, গোঁড়ামি শব্দমূল
  14. কুলাইনি, আল কাফী, প্রকাশকাল ১৪০৭, খণ্ড ২, পৃ. ৩০৮
  15. নাহযুল বালাগা, খুতবা নং ১৯২, পৃ. ২৯৫
  16. প্রাগুক্ত
  17. তাবারসী, মাযমাউল বায়ান, খণ্ড ১, পৃ. ৩৫৯; মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনা, খণ্ড ১, পৃ. ৪০৭
  18. দ্র: সূরা নিসা, আয়াত নং ১৩৫; সূরা মায়েদা, আয়াত নং ৮