অন্তরের নিষ্ঠুরতা

wikishia থেকে

অন্তরের নিষ্ঠুরতা ও পাষাণ্ড মানসিকতা হচ্ছে চারিত্রগত নেতিবাচক স্বভাবের অন্তর্গত। অনেক মুফাসসিরগণের দৃষ্টিতে পবিত্র কুরআনে এ বৈশিষ্ট্যকে আবু জেহেল ও ইহুদি সম্প্রদায়ের কিছু গোত্রের প্রতি আরোপ করা হয়েছে। অনেকের দৃষ্টিতে অন্তরের নিষ্ঠুরতার কিছু স্তর রয়েছে। আল্লাহ ও নবী-রাসূলদের (আ.) বিরুদ্ধোচরণ, আল্লাহকে স্মরণ না করা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, অবৈধ সম্পদ অর্জন, গুনাহে লিপ্ত থাকা প্রভৃতি হচ্ছে অন্তরের নিষ্ঠুরতার প্রতিফল। পক্ষান্তরে সর্বদা আল্লাহকে স্মরণে রাখা, ইবাদত-বন্দেগেী, কুরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর ওলী-আওলিয়াদের প্রতি ভক্তিপোষণ, মৃত্যুকে স্মরণ এবং তওবার মাধ্যমে অন্তরের নিষ্ঠুরতা ও পাষাণ্ড মানসিকতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

সংজ্ঞা

অন্তরের নিষ্ঠুরতা বলতে মন-অন্তর থেকে দয়া, স্নেহ-মমতা ও মহানুভবতা শুন্য হওয়াকে বুঝায়। [১] ফার্সী ভাষায় এ অবস্থাকে পাষাণ্ডতা বলে আখ্যায়িত করা হয়। ইসলামি পরিভাষাতে যে অন্তরে হেদায়েতের আলো প্রবেশ করে না কিংবা হেদায়েত গ্রহণ থেকে বিরত থাকে; সে অন্তরকে «قاسی القلب» ‘কাসীউল কালব’ তথা নিষ্ঠুর অন্তর বলা হয়। [২] অনুরূপভাবে যে অন্তর কোন লোমহর্ষক ও নৃশংস দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে অথবা কোন মর্মান্তিক ঘটনা শ্রবণ করে মর্মাহত কিংবা প্রবাহিত হয় না; সে অন্তরকে পাষান হৃদয় বলা হয়। {প্রাগুক্ত} বিশিষ্ট মুফাসসির তাবারসি (রহ.) বলেছেন যে, অন্তরের নিষ্ঠুরতা বলতে অন্তরের মৃত্যুকে বুঝায়। [৩] হযরত ঈসা (আ.) অন্তরের নিষ্ঠুরতাকে মানুষের সবচেয়ে মারাত্মক রোগ আখ্যায়িত করেছেন। [৪] অনূরূপভাবে শহীদ আয়াতুল্লাহ মূর্ত্তাজা মোতাহহারি বলেছেন যে, অন্তরের নিষ্ঠুরতার চেয়ে বড় কোন শাস্তি আর নেই। [৫]আল মুহাযযেবাতুল বাইজাই’ নামক খ্যাতনামা নীতিশাস্ত্র কিতাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির পাশাপাশি অন্তরের নিষ্ঠুরতা বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। একইভাবে উসূলে কাফী গ্রন্থে ‘বাবুল কাসাউল কালব’ তথা অন্তরের নিষ্ঠুরতা অধ্যায় নামক একটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। [৬]

পবিত্র কুরআনে ৬টি আয়াতে ‘কাসাউল কালব’ বা অন্তরের নিষ্ঠুরতা এবং এ শব্দমূলের সমার্থক পরিভাষার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। [৭] সূরা জুমার ২২ নং আয়াতে শারহে সাদর তথা অন্তর বা বুকের প্রশস্ততার বিপরীত শব্দ হিসেবে ‘কাসাউল কালব’ বা অন্তরের নিষ্ঠুরতা ব্যবহৃত হয়েছে। আবুল ফুতুহ রাজী এ আয়াতে বর্ণিত فَوَيْلٌ لِلْقَاسِيَةِ ‘অর্থাৎ ধিক্কার হোক, নিষ্ঠুর অন্তরের প্রতি’ বাক্যটি আবু জেহেলকে উদ্দেশ্য করে নাযিল হয়েছে। [৮] অপরদিকে সূরা বাকারার ৭৪ নং আয়াতে বর্ণিত ‘নিষ্ঠুর অন্তর’ শব্দটি ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতি প্রয়োগ করা হয়েছে। কেননা তারা রাসূলের (সা.) উপর্যপুরি মোজেযা দেখার পরও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে নি; এ কারণে তাদের অন্তরের নিষ্ঠুরতাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য শাস্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।[৯] আবার কারও কারও দৃষ্টিতে অন্তরের নিষ্ঠুরতা হচ্ছে শেষ জামানার আলামত। [১০]

অনুরূপভাবে হযরত ইমমা হুসাইনের (আ.) কন্যা হযরত ফাতেম সোগরা আশুরার ঘটনার পর কুফাবাসীর সম্মুখে বাগ্মী বক্তৃতাকালে কুফার লোকদেরকে নিষ্ঠুর অন্তরের অধিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। [১১]

স্তরভেদ ও প্রভাব

বিশিষ্ট মনীষী হযরত আয়াতুল্লাহ জাওয়াদি আমুলী বলেন: অন্তরের নিষ্ঠুরতার স্তরের সূচনা হয় মাকরুহ কাজের মধ্য দিয়ে এবং পর্যায়ক্রমে তা সগিরাহ ও কবিরাহ গুনাহের স্তর অতিক্রম করে আল্লাহর প্রতি শিরককাফির হওয়ার পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছায়। তিনি আরও বলেন: পবিত্র কুরআনের আয়াতের প্রতি মনোযোগের মাত্রা থেকে অন্তরের নিষ্ঠুরতার স্তর ও পরিমাণ বুঝা সম্ভব। [১২]

এছাড়া পবিত্র কুরআন ও হাদীসে আল্লাহর দরবারে মুনাযাতে অনিহা, গুনাহে লিপ্ত হওয়া, আল্লাহর আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান, অন্তরে আল্লাহর ওলীদের প্রতি ভক্তি না থাকা, বালা-মুসিবাতে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা না করা এবং মানুষদের দূরে সরে যাওয়া প্রভৃতিকে অন্তরের নিষ্ঠুরতার প্রভাব হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। [১৩]

কারণসমূহ

আল কুরআনে নবী-রাসূলগণের (আ.) সাথে বনি ইসরাঈলের বিরোধিতা ও শত্রুতার কারণ হিসেবে তাদের অন্তরের নিষ্ঠুরতাকে দায়ী করা হয়েছে। [১৪] বাইবেল শরিফে স্বীয় অনুসারীদের প্রতি ইবলিসের মোকাবেলায় খোদায়ী অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষের উপর শয়তানের কর্তৃত্বের কারণে অন্তরের নিষ্ঠুরতার সৃষ্টি হয়। [১৫] ইমাম মুহাম্মাদ বাকের (আ.) অন্তরের নিষ্ঠুরতার কারণ হিসেবে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল হওয়াকে অভিহিত করেছেন। [১৬] এছাড়া ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে থাকা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, গুনাহে লিপ্ত হওয়া, অতিরিক্ত চাহিদা, সম্পদের আধিক্য, অবৈধ সম্পদ অর্জন, হারাম ভক্ষণ, দুনিয়ার প্রতি মোহচ্ছন্নতা, আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে সরে যাওয়া, রক্তপান এবং কাসাই এর কাজ করা প্রভৃতি অন্তরের নিষ্ঠুরতা তৈরি করে। { [১৭]

নিরাময়ের উপায়

নীতিশাস্ত্রের শিক্ষক ও ধর্মগুরুরা অন্তরের নিষ্ঠুরতাকে নিরাময়যোগ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ নিরাময় পদ্ধতি সহজ নয়, বরং কষ্টসাধ্য। আধ্যাত্মিক সাধক মোল্লা আহমাদ নারাকী উল্লেখ করেছেন: যে সমস্ত কার্যাদি ও আমলসমূহ মানুষের মন ও অন্তরে কোমলতা আনে সেগুলো নিয়মিত ও অব্যাহতভাবে সম্পন্ন করলে অন্তরের নিষ্ঠুরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। [১৮] আয়াতুল্লাহ শহীদ দাস্তাগাইব এক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন যে, অন্তরের নিষ্ঠুরতা নিরাময়ের জন্য প্রথম উক্ত নিষ্ঠুরতা সৃষ্টির কারণ চিহ্নিত করতে হবে; অত:পর তারা নিরাময়ে হাদীসসমূহে বর্ণিত পন্থা অবলম্বন করা জরুরী। রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চোখে অশ্রু না আসা অন্তরের নিষ্ঠুরতার অন্যতম আলামত; আর ইয়াতীমের ভরণ-পোষণ এবং তার প্রতি সহানুভূতি অন্তরের নিষ্ঠুরতা হ্রাসের কারণ হয়। [১৯] এছাড়া নিয়মিত আল্লাহর স্মরণ, কুরআন তেলাওয়াত, আল্লহর ওলীগণের প্রতি ভক্তি ও মহব্বতপোষণ, মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং তওবা করার মাধ্যমে অন্তরের নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

তথ্যসূত্র

  1. ইবনে মানজুর, লিসানুল আরাব, প্রকাশকাল ১৪০৮ হিজরী, খণ্ড ৫, পৃ. ১৮১।
  2. মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনা, প্রকাশকাল, ১৯৯৪ খ্রি. খণ্ড ৭, পৃ. ৯১।
  3. তাবারসি, মাজমাউল বায়ান, খণ্ড ৬, পৃ. ২৪৭।
  4. নুরী, মুসতাদরাকুল ওসায়েল, প্রকাশকাল ১৪০৮ হিজরী, খণ্ড ১৬, পৃ. ২১২।
  5. শহীদ মূর্ত্তাজা মুতাহহারি, মাজমুয়ে আসার, খণ্ড ১, পৃ. ১৮৪।
  6. কুলাইনি, উসূলে কাফী, প্রকাশকাল ১৯৯৬ খ্রি. খণ্ড ৫, পৃ. ২৬৯।
  7. সূরা বাকারা, আয়াত নং ৭৪, সূরা আনআম, আয়াত নং ৪৩, সূরা হাদীদ, আয়াত নং ১৬, সূরা মায়েদা, আয়াত নং ১৩, সূরা হাজ্ব. আয়াত নং ৫৩, সূরা জুমার, আয়াত নং ২২।
  8. আবুল ফুতুহ রাজী, তাফসীরে রওজুল জিনান, প্রকাশকাল ১৪০৮ হিজরী, খণ্ড ১৬, পৃ. ৩১৬।
  9. মাকারেম শিরাজী, তাফসীরে নমুনা, প্রকাশকাল, ১৯৯৪ খ্রি. খণ্ড ৪, পৃ. ৩১২।
  10. সাফী গুলপাইগানি, মুনতাখাবুল আসার, প্রকাশকাল ১৯৯৮ খ্রি. পৃ. ৪১৮।
  11. তাবারসি, আল এহতেজায, প্রকাশকাল ১৯৯১ খ্রি. খণ্ড ৩, পৃ. ১৫১
  12. জাওয়াদি আমুলী, তাসনীম, প্রকাশকাল ২০০০ খ্রি. খণ্ড ২, পৃ. ২৩৪।
  13. দেহকান পুর, মাহিয়্যাত, আওয়ামেল ওয়া আসারে কাসাউল কালব, পৃ. ৫৮, ৬৩।
  14. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০।
  15. কিতাবে মুকাদ্দাস, অধ্যায় ১১, আয়াত নং ৬।
  16. ইবনে শো’বেহ হারানী, তোহফুল উকুল, পৃ. ২৯৩।
  17. দেহকান পুর, মাহিয়্যাত, আওয়ামেল ওয়া আসারে কাসাউল কালব, পৃ. ৬২; তাবারসি, আল এহতেজায, প্রকাশকাল ১৯৯১ খ্রি. খণ্ড ৩, পৃ. ৩০৩; শেখ সাদুক, আল খেসাল, প্রকাশকাল, ১৯৯৮ খ্রি. খণ্ড ১, পৃ. ২৬০।
  18. নারাকী, মি’রাজুস সায়াদাহ, খণ্ড ১, পৃ. ৩০৯।
  19. শেখ সাদুক, মানলা ইয়াহ জারহুল ফাকীহ, প্রকাশকাল ১৪০৯ হি. খণ্ড ৬, পৃ. ২৮৭।

গ্রন্থপঞ্জি

  • ইবনে শো’বেহ বাহরানী, হাসান ইবনে আলী, তোহাফুল উকুল, অনুবাদ: কামারেহয়ী, তেহরান, কিতাবচী, ষষ্ঠ সংস্করণ, ১৩৮৬ সৌরবর্ষ।
  • ইবনে মানজুর, মুহাম্মাদ ইবনে মুকাররম, লিসানুল আরাব, বৈরুত, দারুল ‍জিল, প্রথম সংস্করণ, ১৪০৮ হিজরী।
  • আবুল ফুতুহ রাজি, হোসাইন বিন আলী, মাশহাদ, উস্তানে কুদ্স, প্রথম সংস্করণ, ১৪০৮ হিজরী।
  • জাওয়াদ আমুলী, আব্দুল্লাহ, তাফসিরে তাসনিম, কোম, মারকাযে নাশরাসুরা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৭৯ সৌরবর্ষ।
  • শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ বিন আলী, মানলা ইয়াহ জারহুল ফাকীহ, তেহরান, ইন্তেশারাতে সাদুক, প্রথম সংস্করণ, ১৪০৯ হিঃ।
  • শেইখ সাদুক, মুহাম্মাদ বিন আলী, আল খেছাল, অনুবাদ: কামারেহয়ী, তেহরান, কিতাবচী, ১৩৭৭ সৌরবর্ষ।
  • শেইখ তূসী, মুহাম্মাদ বিন হাসান, আমালী, কোম, ইন্তেশারাতে দারুস্ সিকাফাহ, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৪ হিঃ।
  • সাফী গুলপাইগানি, লুৎফুল্লাহ, মুনতাখাবুল আসার, কোম, মুয়াস্সাসাতু সাইয়্যিদাতি মাসুমাহ, ১৩৭৭ সৌরবর্ষ।
  • তাবারসি, ফায্ল বিন হাসান, মাজমাউল বায়ান, অনুবাদ: হাশেম রাসুলী, তেহরান, ফারহানী, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশের তারিখ অজ্ঞাত।
  • তাবারসি, আহমাদ বিন আলী, আল এহতেজায, অনুবাদ: আহমাদ গাফ্ফারী মাজানদারানী, তেহরান, নাশরে মুরতাযাভী, প্রথম সংস্করণ, ১৩৭১ সৌরবর্ষ।
  • কুলাইনি, মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুব, উসূলে কাফী,অনুবাদ কামারেহয়ী, কোম, উসয়েহ, প্রথম সংস্করণ, ১৩৭৫ সৌরবর্ষ।
  • শহীদ মুতাহহারি, মূর্ত্তাজা, মাজমুয়ে আসার, তেহরান, ইন্তেশারাতে সাদরা, প্রকাশের তারিখ অজ্ঞাত।
  • মাকারেম শিরাজী, নাসের, তাফসীরে নমুনা, তেহরান, দারুল কুুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, দশম সংস্করণ, ১৩৭১ সৌরবর্ষ।
  • মাকারেম শিরাজী, নাসের, তাফসীরে নমুনা, তেহরান, দারুল কুুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, দ্বাদশ সংস্করণ, ১৩৭৩ সৌরবর্ষ।
  • নূরী, হোসাইন ইবনে মুহাম্মাদ তাক্বী, মুস্তাদরাকুল ওয়াসালী মুস্তামবিতুল মাসায়লে, কোম, মুয়াস্সেসেয়ে আলুল বাইত (আ.), প্রথম সংস্করণ, ১৪০৮ হিঃ।