আসহাবুল আইকাহ
আসহাবে আইকাহ এমন একটি গোত্র যাদেরকে কুরআনে, ওজনে কম দেওয়া এবং মূর্তিপূজার জন্য তিরস্কার করা হয়েছে। তাফসীর এবং হাদীসের উৎস অনুযায়ী, আসহাবে আইকাহ বা আইকাহ গোত্রের লোকেরা শুয়াইব নবী’র এর পক্ষ থেকে গুনাহ থেকে দূরে থাকা এবং বিশেষ করে ওজনে কম দেওয়ার আহ্বান জানানো হলে তারা তা গ্রহণ না করে উল্টো তাঁর লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করে। পরিশেষে, তারা আল্লাহর শাস্তির মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে যায়। আসহাবে আইকাহ হিজাজ থেকে শামের বানিজ্যিক রুটের একটি অঞ্চলে বসবাস করত। কুরআনে "আসহাব আইকাহ" নামটি চারবার উল্লেখিত হয়েছে।
পরিচিতি ও অবস্থান
আসহাবে আইকাহ এমন একটি গোত্র ছিল, যারা হিজাজ থেকে শামের বানিজ্যিক পথের আইকাহ নামক অঞ্চলে বসবাস করত।[১]বিখ্যাত জনবসতি আইকাহ’র অবস্থান ছিল মদিনার নিকটে।[২] আসহাবুল আইকাহ «اصحاب الایکه» কুরআনে চারবার এসেছে: সূরা হিজর ৭৮ নং আয়াত, সূরা শুআরা ১৭৬ নং আয়াত, সূরা সোয়াদ ১৩ নং আয়াত, এবং সূরা কাফ এর ১৪ নং আয়াতে।[৩] মুফাস্সিরগণের ভাষ্যমতে, বহুবিধ পাপাচারের কারণে এই জাতিকে তিরস্কার করা হয়েছে। এছাড়াও তারা তাদের নবী শুয়াইব (আ.)-এর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে।[৪] তারা তাদের নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার পর আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হয় এবং ধ্বংস হয়ে যায়।[৫]
আসহাবে আইকাহ ও আহলে মাদায়েন
আসহাবে আইকাহ এবং মাদায়েন গোত্র কি একই সম্প্রদায় ছিল, যাদেরকে কুরআনে দুটি ভিন্ন নামে উল্লেখ করা হয়েছে, নাকি একই নবীর সাথে সংশ্লিষ্ট এবং অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন দুটি ভিন্ন সম্প্রদায় ছিল, এ ব্যাপারে তাফসীরকারকগণের মধ্যে মতপার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে।[৬] কোন কোন গবেষক অধিকাংশ তাফসীরকারকগণের উদ্ধৃতি দিয়ে, হযরত শুয়াইবকে (আ.) প্রথমে আহলে মাদায়েনের নবী হিসেবে জ্ঞান করেন, যিনি তাদের ধ্বংসের পর আসহাব আইকাহ’র হেদায়েতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।[৭]
তাদের দলিল হচ্ছে মহানবী (স.)-এর একটি রেওয়ায়েত,[৮] কুরআনের মুফাসসির কাতাদাহ ইবনে দিয়ামা’র একটি বক্তব্য[৯] এবং কুরআনে আসহাবে আইকাহ এবং মাদায়েন সম্প্রদায়ের শাস্তি সম্পর্কিত বর্ণনার ভিন্নতা: কুরআনে আসহাবে আইকাহ’র আযাবের ক্ষেত্রে «عَذابُ یَوْمِ الظُّلَّةِ» "মেঘলা দিনের আযাব" এবং আহলে মাদায়েনের আযাবের ক্ষেত্রে «رَجْفه» "তীব্র কম্পন" এবং «صَیحه» "ভয়ানক শব্দ" হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[১০] অধিকন্তু, কুরআনের সূরা আ’রাফের ৮৫ নং আয়াতে হযরত শুয়াইব "আহলে মাদায়েনের ভাই" বলে অভিহিত করা হয়েছে; কিন্তু "আসহাব আইকাহ’র ভাই" বলে আখ্যায়িত করা হয় নি।[১১]
বৈশিষ্ট্যসমূহ
আসহাব আইকাহ’র বৈশিষ্ট্য হিসেবে ওজনে কম দেওয়া এবং মূর্তিপূজার উল্লেখ করা হয়েছে:
ব্যবসায় ওজনে কম দেওয়া
গবেষণা অনুসারে, আসহাব আইকাহ’র সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি ছিল ওজনে কম দেওয়া। বিভিন্ন উৎসের ভিত্তিতে, তারা ব্যবসার ক্ষেত্রে ওজন এবং পরিমাপে কম দেওয়া, পরিমাপক যন্ত্র ও বাটখারায় জালিয়াতি এবং এমনকি পণ্যসমূহের রঙ ও প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটানোর[১৪] মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা ও অপকর্মে লিপ্ত হতো।[১৫]। কুতুবুদ্দিন রাওন্দি তাঁর "কাসাসুল আম্বিয়া" গ্রন্থে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত শুয়াইব (আ.) নিজ হাতে দাঁড়িপাল্লা তথা পরিমাপক সারঞ্জাম তৈরি করেন, যেন মানুষ সঠিকভাবে পরিমাপ করতে এবং অন্যের অধিকার বজায় রেখে ব্যবসা করতে পারেন। এমতাবস্থায় মানুষ প্রথম প্রথম সঠিক ও ন্যায় সঙ্গতভাবে ওজন করত, কিন্তু আবার ধীরে ধীরে তারা ওজনে কম দেওয়ায় লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং মাপের ক্ষেত্রে অন্যের অধিকারকে উপেক্ষা করতে থাকে।[১৬] আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজী কর্তৃক রচিত তাফসীরে নেমুনেহ’তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই গোত্রটি তাদের অনুকূলে থাকা ব্যবসায়িক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে[১৭] মানুষের পণ্য কম মূল্যে ক্রয় করতো এবং নিজেদের পণ্যকে সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রয় করতো;[১৮]অনুরূপভাবে, যখন নিজেদের পণ্য পরিমাপ করতো তখন অত্যন্ত মনযোগসহকারে করতো; অথচ অন্যদের পণ্যগুলোকে একেবারে অমনযোগিতা ও উদাসীনতার সহিত পরিমাপ করতো।[১৯] হিজরী তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীর বিশিষ্ট ঐতিহাসিক তাবারি’র ভাষ্য অনুসারে, তারা তাদের সমৃদ্ধ জীবনের ব্যবস্থা এভাবেই করেছিল।[২০]
মূর্তিপূজা
বিভিন্ন উৎস অনুযায়ী, আসহাবে আইকাহ প্রাকৃতিক এবং পরিবেশগত নেয়ামতসমূহ থেকে উপকৃত ছিল; অথচ তারা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণের পরিবর্তে বিভিন্ন মূর্তিপূজা[২১] এবং সবুজ শ্যামল গাছের পূজায় নিমগ্ন হয়ে পড়েছিল;[২২] এছাড়াও তারা কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করেছিল।[২৩]
হযরত শুয়াইব (আ.)-এর আহ্বান এবং তাদের প্রতিক্রিয়া
ঐতিহাসিক এবং তাফসিরগত উৎস অনুযায়ী, আসহাবে আইকাহর মধ্যে শিরক এবং পাপাচার বৃ্দ্ধি পেতে থাকলে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত শুয়াইব (আ.)-কে তাদের নিকট প্রেরণ করেন[২৪]। হযরত শুয়াইব (আ.) মানুষকে আল্লাহর ইবাদত,[২৫] তাক্বওয়া অর্জন করা, পাপাচার থেকে দূরে থাকা, ইবাদতের ক্ষেত্রে এখলাস এবং আল্লাহর নির্দেশগুলোকে মেনে চলার আহ্বান জানাতেন।[২৬] পক্ষান্তরে, শিরক ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সতর্ক করতেন।[২৭]
একইভাবে, তিনি আইকাহ’র অধিবাসীদেরকে ওজমে কম দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলতেন[২৮] এবং ফিতনা-ফ্যাসাদ,[২৯] হত্যা,[৩০]ধন-সম্পদ লুণ্ঠন ও রাহাজানি থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানাতেন।[৩১] তিনি তাদের সতর্ক করেন যে, যদি তারা তাদের কৃত গুনাহের জন্য তওবা না করে, তাহলে তারা আল্লাহর আযাবে নিপতিত হবে।[৩২]
পক্ষান্তরে, ইবনে আব্বাসের মতে, আসহাবে আইকাহ পথের ধারে বসে হযরত শুয়াইব (আ.)-কে মানুষের শত্রু এবং তাদের ধর্মের বিকৃতিকারক হিসেবে উপস্থাপন করত।[৩৩] তাফসির আল-মুনিরের উদ্ধৃতি অনুযায়ী, তারা হুমকির মাধ্যমে হযরত শুয়াইব (আ.)-এর অবস্থানকে দুর্বল এবং তার আহ্বানকে অকার্যকর করার চেষ্টা করতো।[৩৪]
বিভিন্ন উৎসের তথ্য অনুযায়ী, আসহাবে আইকাহ হযরত শুয়াইব (আ.)-এর উদাত্ত আহ্বানের মোকাবেলায় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে[৩৫] এবং তাঁকে পাগল,[৩৬] মিথ্যাবাদী,[৩৭] জাদুকর[৩৮] এবং নিজেদের মতো সাধারণ একজন মানুষ (যার তাদের উপর কোনো বিশেষত্ব নেই) বলে অভিহিত করে।[৩৯]
ধ্বংস
আসহাবে আইকাহ, হযরত শুয়াইব (আ.)-কে প্রত্যাখ্যান করা[৪০] ছাড়াও তাঁকে বলতো যে, যদি তিনি সত্য বলে থাকেন, তবে আকাশ থেকে যেন তাদের উপর পাথর পড়ে এবং তিনি তাদের যে বিপদের হুমকি দিয়ে থাকেন তা যেন তাদের উপর নেমে আসে। হুজ্জাত তামাম (প্রমাণ সম্পূর্ণ) হওয়ার পর তথা হযরত শুয়াইব (আ.)-এর আহ্বানের পরিপূর্ণতা শেষে, তারা আল্লাহর আযাবের শিকার হয়।[৪২]
তাফসীর এবং হাদীস সূত্র অনুযায়ী, আসহাবে আইকাহ সাত দিন ধরে তীব্র গরমের মুখে পড়ে; এমনভাবে যে তাদের শহর এবং অঞ্চলে কোন ধরনের বাতাস প্রবাহিত হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপর একটি মেঘ দেখা দেয় এবং তারা গরম থেকে বাঁচার জন্য তার ছায়ায় আশ্রয় নেয়; কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, সেই মেঘ থেকে আগুন নেমে আসে এবং সবাইকে পুড়িয়ে দেয়।